ফানুস - পর্ব ৩৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          কীভাবে প্রিয় এতটা কাছে এল বা সে নিজেই প্রিয়র কাছে চলে গেল, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না নিকিতা। মাত্র চার-পাঁচ দিনের অনুপস্থিতিও এখন সহ্য হয় না। অথচ কিছুদিন আগেও কত দূরের মানুষ ছিল প্রিয়। আগেও তো অফিসের কাজে এখানে-ওখানে চলে যেত। কই, তখন তো এমন লাগত না। কিন্তু ভালো লো নিকিতা তখনো বাসত। কিন্তু তখন প্রিয়র শরীরের ওপর কোনো অধিকার ছিল না। তাকে ছোঁয়াও নিষেধ ছিল। অথচ এখন পুরো অধিকার আছে তার শরীরের ওপর। যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে সে এখন, প্রিয় বাধা দেয় না। সারা রাত প্রিয়র বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারে। এটাও তার জন্য অনেক বড় কিছু। কারণ, সে প্রিয়কে ভালোবাসে। প্রিয় নাই-বা বাসুক। গত কয়েক মাসের নিয়মিত শারীরিক মিলনের ফলে সে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে প্রিয়কে। চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভালোবাসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে? তাহলে প্রিয়র কেন তার ওপর ভালোবাসা জন্মাচ্ছে না? সে যা করেছে, প্রিয়ও তো তা-ই করেছে। সে এত দুর্বল হয়ে গেলে প্রিয় কেন হচ্ছে না? নাকি প্রিয়ও দুর্বল হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না নিজের বাবার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ে? সব মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে।

পরশু ফোন করেছিল প্রিয়। কাল করে নি, তাতেই নিকিতার মনে হচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে তার নিঃশ্বাস আটকে যাবে। সে মেসেজ দিয়ে রেখেছে। চব্বিশ ঘণ্টা ওয়াইফাই চাল করে রাখছে। বাইরে গেলেও মোবাইল ডেটা অন করে রাখছে। প্রিয়র একটা কলও সে মিস করতে চায় না।

—————

পেট্রা শুদ্ধর সঙ্গে তার সময়মতো কথা বলে। আবার প্রিয় বলে আলাদাভাবে। তারা শুদ্ধকেও জানাতে চায় না যে তারা এখন একসঙ্গে আছে। প্রিয় মালয়েশিয়ায় আসার পর থেকে ফোন ব্যবহার করছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কথা বলছে শুদ্ধর সঙ্গে। কোনো রিস্ক সে নিতে চায় না।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রিয় শুদ্ধকে ফোন করল। শুদ্ধর সঙ্গে কথা বলা শেষ করতেই পেট্রা বলল, তুই নিকিতার সাথে কথা বলছিস না কেন? সে তত দুশ্চিন্তা করবে। তার দুশ্চিন্তা দেখে তোর বাবা যদি কিছু গেস করে, তাহলে কিন্তু বিপদ হবে, প্রিয়।

‘আমি ওকে এত ফোন করি না। তা ছাড়া পরশু তো কথা বললাম। আবার কী?

‘আজকেও বলবি। উল্টাপাল্টা জেদ দেখাবি না! যা করলে সবার ভালো হবে, তা-ই করবি।’

প্রিয় অগত্যা ফোন করল নিকিতাকে। পেট্রা ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেল শুদ্ধর সঙ্গে কথা বলতে, যাতে প্রিয় নিকিতার সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলতে পারে। এদিকে নিকিতা ঘুমিয়ে ছিল। লাফিয়ে উঠে ফোন ধরতেই প্রিয় বলল, ‘বাপরে! ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলে নাকি? কল দেওয়ার

সাথে সাথে ধরলে!

নিকিতা অভিমানের সুরে বলল, এই তোমার সময় হলো আমাকে ফোন করার? এমন কেন তুমি? প্রতিদিন একবার ফোন দিলে কী হয়?

‘যত পাই তত চাই না? আগে যে মোটেও ফোন দিতাম না, তখন খুব ভালো লাগত? শোনো, একদম বউগিরি করবে না। আমি তোমাকে বউ বলে মানি না।’

‘বউ না। একসাথে থাকি, সেই হিসেবেও তো একটু খবরাখবর দেওয়া যায়।

‘না, যায় না। এত বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে আমি চলতে পারব না।

‘আচ্ছা বাবা, সরি। ভুল হয়েছে আমার। একটু ভিডিও কলে আসো না, প্লিজ।

প্রিয় ভিডিও কল করল। তারপর হেসে বলল, ‘আরে বাপরে বাপ, আমার দুঃখে কি তুমি দেবদাসী হয়ে গেলে নাকি? চেহারার এই অবস্থা কেন?

‘ঘুম হয় না আমার। প্রায় সারা রাত জেগে থাকি।’

‘আহা রে!’

‘মজা নিচ্ছ?

‘না। শোনো, তোমার ঘুমের ব্যবস্থা করছি।

‘কীভাবে?

‘কাল ঢাকা আসছি।’

নিকিতা খুশিতে লাফিয়ে উঠল, ‘সত্যি?

‘হ্যাঁ। রাতের ফ্লাইটে ফিরছি। একটা-দুটো নাগাদ বাসায় পৌঁছে যাব।’

—————

পেট্রা প্রিয়র জুতার ফিতা বাঁধছিল। প্রিয় তাকিয়ে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। কিছু মুহূর্ত এত মধুর কেন হয়? ফিতা বাঁধা শেষ করে পেট্রা উঠে দাঁড়াল। তারপর শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল, ‘তোর জুতার ফিতা এখন কে বেঁধে দেয়?

‘আমি নিজেই বাঁধি।

‘বাব্বাহ! আর নখ কেটে দেয় কে?

‘আমি নিজেই। তোর অনুপস্থিতি আমাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে।’

পেট্রা হাসল। তারপর প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ও ধরল। পেট্রা প্রিয়র বুকে মাথা রেখে বলল, ‘থ্যাংক ইউ, প্রিয়।

‘কেন?’

‘এই ম্যাজিক্যাল তিনটি দিনের জন্য।

প্রিয় আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংক ইউ টু।’

এবার পেট্রা সরে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা প্রিয়, সত্যি করে বল তো, শুধু আমি তোকে না বলে চলে এসেছি বলে তুই এত রিস্ক নিয়ে এখানে এলি?

‘না। আসলে কনফেস করতে এসেছি।

‘কিসের জন্য?

‘তোকে ভুল বোঝার জন্য।’

পেট্রা হেসে আবার জড়িয়ে ধরল, ‘তুই এত ভালো কেন, প্রিয়? তুই না বললে আমি কখনো জানতে পারতাম না যে তুই আমাকে ভুল বুঝেছিলি। এ জন্যই তোকে এত ভালোবাসি, প্রিয়।

এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসেছে পেট্রা। যাওয়ার আগমুহূর্তে বলল, ‘বিদায় দিতে খারাপ লাগছে না। বরং একটা ভালোলাগা কাজ করছে।

‘আমারও খারাপ লাগছে না। আনএক্সপেকটেডলি যা পেয়েছি, তা স্বপ্নেও ভাবি নি। এটা আমার জন্য অনেক।

পেট্রা হেসে বলল, আমার জন্য দোয়া করিস প্রিয়, যাতে মা হতে পারি।’

প্রিয় পেট্রাকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, পারবি ইনশা আল্লাহ।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘ফিঙ্গার ক্রসড।

পেট্রার চোখ পানিতে ছলছল করছে। এই দৃশ্য দেখে প্রিয়র চোখও ভিজে উঠল। একটা মানুষ চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে দূরে চলে যায়, অথচ হাত বাড়িয়ে ধরে রাখারও কোনো উপায় নেই।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp