চার-পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে নিহিনের সাথে কথা হয়েছে কিন্তু অস্থিরতা কাটেনি কলরবের। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে, তবু যেন কিছু ঠিক নেই। কলরবের খুব ইচ্ছে হয় নিহিনকে কল করতে, কথা বলতে। তার চেয়ে বেশি ইচ্ছে হয় একবার নিহিনকে দেখতে। কিন্তু দেখলে নিজেকে সামলাতে পারবে তো? পরক্ষণেই ভাবল না পারার কি আছে? হি ইজ আ ম্যান আফটার অল। কিন্তু দেখা করার কথা নিহিনকে বলবে কীভাবে? এই কদিনে কতবার ফোন করতে চেয়েছে, ফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছে অসংখ্যবার। কোথায় যেন একটা জড়তা। অফিস থেকে ফিরে কাপড় না পালটেই শুয়ে পড়েছে কলরব। শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছিল। এমন সময় কলরবের বাবা শওকত সাহেব এসে বললেন,
“কিরে অফিস থেকে এসেই শুয়ে পড়লি? শরীর টরির খারাপ করেনি তো?”
“না বাবা, এমনি ভালো লাগছে না।”
“কেন? অফিসে কিছু হয়েছে?”
“না, সব ঠিক আছে, জাস্ট ক্লান্ত লাগছে খুব।”
“কী বলছিস? তুই তো সহজে ক্লান্ত হোস না।”
কলরব হেসে বলল,
“বুড়া হয়ে যাচ্ছি বোধহয়।”
“নিজের বাপের কাছে বলছিস এ কথা? সাহস তো কম না!”
শওকত সাহেব কলরবের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“কিছু কি হয়েছে? কদিন ধরেই তোকে অন্যমনস্ক দেখছি।”
“তেমন কিছু না বাবা।”
“নিহিন রিলেটেড কিছু?”
“আমি তোমাকে বলব, একটু সময় দাও।”
“না মানে নিহিন ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে তোকে এত অস্থির হতে দেখিনি কখনো। তাই বললাম।”
কলরব হেসে বলল,
“কে বলেছে তোমাকে? মা মারা যাওয়ার সময় আমার কী অবস্থা হয়েছিল তা কি তুমি ভুলে গেছ? তারপর কল্প ছোটবেলায় যখন বসুন্ধরা সিটিতে হারিয়ে গিয়েছিল আর গত বছর যখন এক্সিডেন্ট করেছিল, তখন তো শুধু অস্থির না পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।”
“সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তোর মা তো কবেই গেছে, আর কল্প তো বাসায়ই আছে, ভালো আছে। তো নিহিন ছাড়া তোর অস্থিরতার আর কোনো কারণ দেখছি না।”
“আচ্ছা, কল্প কোথায়?”
“ওর টিচার এসেছে, পড়ছে। কথা ঘুরাস না। বিরক্ত লাগছে।”
কলরব হাসল.. শোয়া থেকে ওঠে বসে বলল,
“হ্যাঁ নিহিন! ফোন করেছিল কয়েকদিন আগে।”
“হঠাৎ!”
“জানি না, তবে বলল ওর বাবা নাকি সব বলে দিয়েছেন ওকে। ওর হয়তো খারাপ লেগেছে আর তাই ফোন করেছে।”
“নাম্বার পেল কোথায়?”
“জানি না বাবা। এ ব্যাপারে ও কিছু বলেনি, আর আমিও সেভাবে জিজ্ঞেস করিনি। আসলে ও কী বলেছে আর আমি কী বলেছি কিছুই জানি না। মাথাটা কাজ করছিল না তখন
“সেটাই তো স্বাভাবিক। যাই হোক ওর কি আসলেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?”
“এগুলো কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি বাবা। তবে বিয়ে তো হয়েছেই, তাছাড়া যদি বিয়ে না হতো ওর বাবা নিশ্চই আমার সাথে যোগাযোগ করত। কারণ যেদিন সে জানতে পেরেছিল সত্যি কোনো যোগাযোগ না করে ৪ বছর ধরে আমি অপেক্ষা করেছিলাম, আর সে তার দেওয়া কথা ভুলে গিয়েছিল তখন কিন্তু সে অপরাধবোধে ভুগছিল, সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট ছিল এবং সে স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছিল। যাই হোক আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি।”
“তাহলে কী বলেছিস? এতদিন পর মেয়েটা ফোন করল, আর এসব খোঁজ খবর নিবি না?”
“মাথা কি তখন ঠিক ছিল বাবা? ওর প্রতি আমার অনুভূতিগুলো তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তাই এসব প্রশ্ন তোমার মুখে মানায় না।”
একটু থেমে শওকত সাহেব বললেন,
“কল্পর কথা বলেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“এখনই ওর কথা বলতে গেলি কেন?”
“বাবা, এখন কল্পই আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আর বাবা তুমি বড্ড বেশি ভেবে ফেলছ। এজন্যই তোমাকে বলতে চাইনি। আমাকে একলা ছেড়ে দাও প্লিজ।”
খানিকটা রেগে গেল কলরব। শওকত সাহেব বললেন,
“আচ্ছা, সরি। কিন্তু তুই উঠবি তো। ফ্রেশ হয়ে নে, তারপর কল্পর নামে নালিশ আছে, একটা ব্যবস্থা এবার করতেই হবে।”
“কেন আবার কী করেছে?”
বিছানা ছেড়ে ওঠে টাই খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল কলরব। শওকত
সাহেব বললেন,
“নতুন এক বায়না ধরেছে, তুই বকবি বলে এতদিন তোকে বলিনি। এখন আর না বলে পারছি না। এত বাড়াবাড়ি করছে।”
“বায়নাটা কী?”
“ওর ফেসবুক একাউন্ট চাই। ওর সব ফ্রেন্ডের নাকি আছে।”
চমকে উঠে একটু জোরেই বলে উঠল,
“কী?”
“হ্যাঁ।”
“ওর কলিজাটা কি ইদানীং একটু বেশি বড় হয়ে গেছে নাকি? ফেসবুক একাউন্ট খোলার কথা আমাকে বলতে বলবে।”
“দ্যাখ, ওকে কিন্তু তুই একটু বেশিই শাসন করিস। বকিস না তো, তোকে তো ভয় পায়, তুই বুঝিয়ে বললেই বুঝবে।”
“শাসন করি দেখেই তো ভয় পায়, নাহলে জীবনেও মানত না। তাছাড়া খালি শাসন করি তা তো না। কয়টা বাবা তার ছেলের সাথে এত বন্ধুর মতো মেশে দেখাও দেখি।”
“কেন আমিই তো তোর সাথে বন্ধুর মতো মিশি, আবার শাসনও করি না।”
“কেন বাবা কল্পকে আদর করার সময় তো উজার করে করি, তখন মানা করো না কেন?”
“তোর ছেলে, তুই যা ভালো বুঝিস কর। আমার বাবা বাচ্চাদের এত শাসন করা একদম পছন্দ না।”
একথা বলেই গজগজ করতে করতে বেড়িয়ে গেলেন শওকত সাহেব। কলরব কাপড় বদলে হাত মুখ ধুতে গেল। মুখে পানির ঝাপটা দিয়েই হেসে ফেলল কলরব। কল্প ফেসবুক ব্যবহার করতে চাইছে। কী দুনিয়া এলো! তারপর হঠাৎ একটা ঝটকা লাগল, মনে হলো নিহিনকে ফেসবুকে খুঁজে দেখলেই তো হয়, খুঁজে পেলে বর্তমান ছবি দেখা যাবে। আর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠাবে। অ্যাড নিশ্চই করবে। তখন কথা বলাটা অনেক সহজ হবে। না জিজ্ঞেস করেও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে! হাতটা কোনোরকমে মুছলো ট্রাউজারে, মুখে তখনও পানি। ঝটপট ঘরে গিয়ে সার্চ দিয়ে ফেলল, যথারীতি হাজারটা নিহিন চলে এলো। পুরো নামটা যেন কী! হ্যাঁ মনে পড়েছে, নিহিন ফারিয়া। আবার সার্চ দিলো, এখনও অনেকগুলো নিহিন ফারিয়া চলে এলো কিন্তু নিজের জনকে চিনে নিতে সমস্যা হয়নি কলরবের। অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক বড় হয়েছে, আর এত বেশি সুন্দর হয়েছে যে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। পরিপূর্ণতা যেন ঠিকরে পড়ছে। সেই বাচ্চা মেয়েটা তো নেই তবে সে চাহনি, সে ভুবন ভুলানো হাসি সবই আগের মত হাজারটা কথা বলে। বুকের মধ্যে কাঁপন দিয়ে উঠল কলরবের।
ছবিগুলোতে প্রাইভেসি দেওয়া তাই আর কোনো ছবি দেখতে পেল না। কী মনে করে হঠাৎ ‘এবাউট’ এ চলে গেল। দেখতে পেল রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিংগেল। তার মানে কি ও বিয়ে করেনি! তবে ওর বাবা যে বলেছিলেন ওর বিয়ে হয়ে গেছে? অবশ্য ফেসবুকে অনেকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিংগেলই দিয়ে রাখে। কিন্তু নিহিনও কি তাই করেছে? দ্বিধায় পড়ে গেল কলরব। যাই হোক, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলো, অ্যাড করুক তারপর টাইমলাইন ঘেঁটে সব প্রশ্নের উত্তর বের করা যাবে। টাওয়াল নিয়ে মুখটা মুছে আবার নিহিনকে দেখতে লাগল। এমন সময় লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকল কল্প। বলল,
“পাপ্পা, আমাকে ডেকেছ?”
কল্পকে বকতে বা শাসন করতে আর ইচ্ছে হলো না কলরবের। কাছে আসতেই ওকে কোলে তুলে নিল কলরব। হেসে বলল,
“কি রে তোর নাকি ফেসবুক একাউন্ট লাগবে?”
“তুমি না করলে লাগবে না।”
মাথা নিচু করে বলল কল্প। কলরব বলল,
“দাদাভাই যে বলল তোর লাগবে।”
“এক্চুয়েলি পাপ্পা, আমার সব ফ্রেন্ডদের ফেসবুক একাউন্ট আছে। কিন্তু আমার নেই বলে আমি কারো সাথে কানেক্টেড থাকতে পারি না।”
হেসে ফেলল কলরব। বলল,
“কেন? তোর ফোন তো সবসময় দাদাভাইয়ের কাছে থাকে, ফোন করে কানেক্ট করবি ওদেরকে।”
“ওক্কে পাপ্পা।”
মন খারাপ করে বলল কল্প। কলরব কল্পকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই ক্লাস সিক্স-সেভেনে উঠলেই তোকে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেবো। তার আগে এটার দরকার নেই বাবা।”
“ওক্কে পাপ্পা।”
“তোর তো অনেক কিছু আছে যা তোর ফ্রেন্ডদের নেই, যা ওরা কারোর কাছে চেয়েও পায় না। তাহলে তুই সামান্য ফেসবুকের জন্য মন খারাপ করবি?”
“আমার যা আছে ওদেরও তো তা আছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“ওদের কি আমার কল্প সোনার মতো বিউটিফুল হ্যান্ডরাইটিং আছে?”
“আশফাকের আর হৃদির হ্যান্ডরাইটিংও বিউটিফুল।”
“ওকে, ওদের কি কল্পর মতো সুইট গানের গলা আছে?”
“ইশিকার গানের গলা বেস্ট।”
“ওকে দেন.. ওরা কি কল্পর মত সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হয়?”
“না।”
মুখে হাসি ফুটল কল্পর। কলরব আবার জিজ্ঞেস করল “ওরা কি কল্পর মত এভরি উইকেন্ডে ঘুরতে যেতে পারে?”
“না।”
হাসির রেখা বড় হলো কল্পর। কলরব আবার জিজ্ঞেস করল, “ওদের কি কল্পর দাদাভাইয়ের মত দ্যা গ্রেট দাদাভাই আছে?”
“না।”
হেসে হেসে বলল কল্প। কিন্তু হঠাৎই হাসিটা কোথাও মিলিয়ে গেল। কলরব জিজ্ঞেস করল,
“আবার কী হলো?”
“ওদের সবার মা আছে পাপ্পা।”
থেমে গেল কলরব। আর কিছুই বলার রইল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল কলরবেরও। কল্প বোধহয় বুঝতে পারল, সাথে সাথে কোল থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে কলরবের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাট মাই পাপ্পা ইজ দ্যা বেস্ট পাপ্পা ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। কারোর নেই এমন পাপ্পা, কারোর নেই। আই এম সরি পাপ্পা। আমি কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু না, প্লিজ স্মাইল।”
·
·
·
চলবে...................................................................................