"এক্সকিউজ মি?"
কৌশিক স্যারের আচমকা ডাক দেওয়াতে অনন্যার পা আপনেতেই থেমে গেলো। অন্তরে খুঁতখুঁতুনি শুরু হয়ে গেল। নোহারা নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বললো,
"আমি আসছি। ক্যান্টিনে অপেক্ষা করবো। তুই ধীরে সুস্থে আয়।"
অনন্যা মাথা নাড়ালো। নোহারা প্রস্থান করলো। ধীর গতিতে পা ঘুরিয়ে পিছনে ফিরলো অনন্যা। কৌশিক স্যার হাত ভাঁজ করে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। অনন্যা কয়েক কদম এগিয়ে গেলো স্যারের দিকে।
কৌশিক মুখ খুললো,
"আপনার শরীর কি বেশি খারাপ ছিল?"
অনন্যা উপর নিচ মাথা নাড়লো।
"তাহলে শেষের ক্লাসটা করলেন কি করে? বাসায় চলে যেতেন।"
অনন্যা মুখ খুললো। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে কাশি এসে পড়লো। সে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
"বাসায় যাওয়ার অবস্থায় ছিলাম না। অনেক খারাপ লাগছিল। তারপর আবার শরীর ঠিক হলে ক্লাস করতে এসে পড়লাম।"
কৌশিক ঘড়ি দেখে বললো,
"আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার ক্লাস ইগনোর করছেন। আজকের ক্লাসেও তো আসলেনই না। এর আগের ক্লাসেও আপনাকে পাওয়া যায়নি। এর মানে কি বোঝায় আপনিই বলুন? এরকম হলে ক্লাস পারফরম্যান্সে মার্কস জিরো আসবে।"
অনন্যা মাথা নিচু করে বললো,
"স্যরি, স্যার!"
"তার মানে আপনি আমাকে ইগনোর করছেন?"
অনন্যা মুখ তুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বললো,
"না। আপনাকে আমি ইগনোর করবো কেনো?"
"আমাকে ইগনোর করার কথা বলিনি। আমার ক্লাস ইগনোর করছেন আপনি?"
অনন্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কি বলছে এই লোকটা? মাথা কি ঠিক আছে নাকি বুঝতে পারছে না অনন্যা। একবার বলছে আমাকে ইগনোর করছেন আবার বলছে আমার ক্লাস ইগনোর করছেন! অদ্ভুত!
অনন্যা হতচকিত অবস্থায় উত্তর দিলো,
"না, স্যার! সেটাও আমি করিনি।"
কৌশিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"ঠিক আছে। তাহলে আমার এই ক্লাসটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তৃতীয় তলার কনসাল্টেশন রুমে দেখা হচ্ছে আপনার সাথে।"
"কিন্তু স্যার আমার শরীরটা তো ভালো লাগছে না।"
"এতোক্ষণ বাসায় যাননি কেন? এতোক্ষণ যখন অপেক্ষা করতে পেরেছেন আরো পঞ্চাশ মিনিটও ঠিক অপেক্ষা করে নিবেন। "
অনন্যা স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের পলক তার জমে গেলো। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে উঠেছে। কৌশিক একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। বরং নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ল্যাপটপটা পাশে সরিয়ে দ্রুত চলে গেলো। অনন্যা ঠোঁট ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো। মনের ভেতর একটা অকারণ বিরক্তি জমে উঠেছে। ওর প্রতিটি পায়ে ভারী অভিমান ঝুলছে।
‘এই মানুষটা যদি সত্যিই কৌশিক স্যার না হয়, তাহলে চোখের সামনে থাকারই বা অধিকার কোথা থেকে আসে তার?’ এই প্রশ্নে ভিতরটা উত্তাল হয়ে উঠলো। ফুঁসতে ফুঁসতে ক্যান্টিনের দিকে রওনা হলো অনন্যা।
ঠিক তখনই ফোনে টুং করে মেসেজ এলো। পূর্ব লিখেছে,
"তিনদিনের মধ্যে বাংলাদেশ ফিরছি। বাবাও আসছেন।"
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভালো দিক এই তাকে আর একা থাকতে হবে না। পরিবার ফিরলে অন্তত একরকম নির্ভরতা ফিরে আসে। বাসায় গিয়ে কি খাবে এই চিন্তা ভাবনা করতে করতে খাওয়ার সময় পার হয়ে যায়। শেষমেশ পুরনো সঙ্গী নুডলস-ই চুলায় চাপানো হয়।
সহজ, তাড়াতাড়ি এবং নিঃসঙ্গতা ভুলিয়ে দেয়ার মতো একমুঠো স্বস্তি। কিন্তু সবসময় তো আর ভালো লাগে না।
এইভাবে আর কতদিন? কয়েকদিন ধরে মন থেকে, শরীর থেকেও খাওয়া-দাওয়া সঠিকভাবে হচ্ছে না। সবকিছুতেই শূন্যতা জমে উঠছে। অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে একাকীত্বের।
ঠিক পঞ্চাশ মিনিট পর,
নোহারার সাথে কথাবার্তা বলে কনসাল্টেশন রুমে এসেছে অনন্যা। নোহারাকে সে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এমনিতেও মেয়েটাকে রেস্ট নিয়ে আবার কাজে যেতে হবে। তাছাড়া অনন্যা একলাই তো পারবে। কিন্তু পঞ্চাশ মিনিটের অধিক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও কৌশিক স্যার ফিরছে না দেখে অনন্যা রেগে গেলো। বিরক্তের সাথে টেবিলে মাথা রেখে দিলো। তাছাড়া খিদেও লেগেছে বেশ। পেট থেকে আওয়াজ ও হচ্ছে।
অন্যদিকে কৌশিক ক্লাস শেষে কনসাল্টেশন রুমের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক সহকর্মী শিক্ষকের সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যায় কৌশিকের। তিনি কিছু কথা বলতে বলতে কৌশিককে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে কিছু জরুরি আলোচনা চললো, প্রায় বিশ মিনিট কেটে গেলো তাতে। অবশেষে কনসাল্টেশন রুমের দিকে ফিরে এলো কৌশিক। ধীরে এবং নিঃশব্দে রুমের দরজাটা খুললো সে। আজ এই রুমে সাধারণত কেউ থাকার কথা না। শুধু অনন্যা ছাড়া। কৌশিক ভেতরে প্রবেশ করে টেবিলের দিকে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ালো।
কমলা রঙের দেয়ালে কয়েকটা ছবি টাঙ্গানো রয়েছে কনসাল্টেশন রুমে। রুমের মাঝে লম্বা মিটিং টেবিলের মতো রাখা। অনন্যা বসেছে মাঝের একটা চেয়ারে। মাথা নিচু করে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। কৌশিক কোনো শব্দ করলো না। তার পায়ের শব্দও থেমে গেছে আচমকা। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো অনন্যার দিকে। চেয়ার ছুঁয়ে মাথা নামিয়ে রাখা অনন্যার মুখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি জমে আছে। মুখটা ফ্যাকাশে, চোখের নিচে হালকা গর্ত পড়েছে। নিস্তেজ আর নিঃসহায় এক মুখশ্রী।
এক মুহূর্তের জন্য কৌশিকের বুকটা হিম হয়ে গেলো।
এই নিষ্প্রাণ মুখ, এই দুর্বল ঘুম সব কিছু চিৎকার করে তাকে কিছু বলে যাচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই শুনতে পারছে না। শুধু একটা চাপা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে তার ভেতরটা জুড়ে। চোখ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কৌশিক। মেয়েটা কিছু খেয়েছে কিনা কে জানে? কৌশিক অক্ষিপট ঘুরিয়ে আরো একবার চাইলো অনন্যার দিকে।
প্রথম দিন বেশ অপমান করে বসেছিল অনন্যা কে। শুধু প্রথম দিন নয় প্রায়ই অজান্তেই করে ফেলছে। আসলে হুট করে কারো হাসবেন্ড হয়ে যাওয়া কৌশিকের কাছে অসম্ভবপর বিষয় বলেই মনে হচ্ছে। এছাড়া ওর যদি বিষয়টা মনে থাকতো তাহলেও হতো। ওর তো কিছুই মনে নেই। কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খেয়াল করলো অনন্যার ছোট ছোট চুলগুলো চোখের সামনে এসে খুব জ্বালাচ্ছে ওকে। হাত এগিয়ে ঠিক করে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কৌশিক করলো না।
পাশের চেয়ারটা টেনে চুপচাপ বসে পড়ল কৌশিক। গালে হাত ভর দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনন্যার দিকে। কৌশিকের চোখে জ্বলজ্বল করছিল কিছু অনুচ্চারিত প্রশ্ন আর কিছু অপূর্ণ বলা।
সেদিন আরণ্যককে দেখা করতে বলেছিল কৌশিক। ক্লাস শেষে আরণ্যক টিচার্স রুমে এসে দাঁড়িয়েছিল। কৌশিক স্যারকে খুঁজে এগিয়ে এসেছিল তার কাছে। আরণ্যক কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না কেনো তাকে ডাকা হয়েছে। কৌশিক আরণ্যককে আসতে দেখে ওকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
টিচার্স রুমের দোরগোড়া পেরিয়ে, রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে কৌশিক। পেছন পেছন আরণ্যকও অবুঝ কৌতুহলে এগিয়ে যায়। বারান্দায় এলোমেলো হাওয়ার ধাক্কায় কৌশিকের শার্টের কোণা দুলে ওঠে কিন্তু সে মুখভঙ্গিতে সম্পূর্ণ নির্বিকারই থাকে।
আরণ্যক বুঝতে পারছিল না এই নিঃশব্দতা কি কোনো অভিযোগের মুখপত্র? না কি, কোনো না বলা কষ্ট জমেছে কৌশিক স্যারের মনের গভীরে।
কৌশিক হাত ভাঁজ করে গম্ভীর স্বরে বলল,
"অনন্যাকে তুমি কীভাবে চেনো?"
প্রশ্নটা আরণ্যকের বুকের ভেতর সজোরে ধাক্কা দিল। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে তাকাল কৌশিক স্যারের দিকে। অনন্যা কে সে চিনবে না তা হয় নাকি? অনন্যার জীবনে কৌশিক স্যারের পূর্বে তার উপস্থিতি ছিল আর ইনি জিজ্ঞেস করছেন অনন্যাকে তুমি কীভাবে চেনো? তাছাড়া এতটা সরাসরি প্রশ্ন! তাও স্যারের মুখে শুনে এক প্রকার চমকে উঠল আরণ্যক।
কৌশিক কিছুটা এগিয়ে এসে আরণ্যকের কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। গলার স্বরটা নরম হয়ে এলো ওর,
"ভয় পেও না। আমি জানি, আমাকে নিয়ে তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি নিজেও সব উত্তর জানি না। তাই তোমার কাছেই জানতে এলাম।"
একটু সময় নিয়ে কাঁপা গলায় আরণ্যক বলল,
"আমি অনন্যাকে ভালোবাসি, স্যার। একসময় আমরা একসাথে ছিলাম অর্থাৎ আমি ওর বয়ফ্রেন্ড ছিলাম। কিন্তু আপনি এলেন, আর অনন্যার মনে অন্য অনুভূতি তৈরি করে দিলেন। যাই হোক, এসব খুব পুরোনো কথা। ও আপনাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। আপনিও তো একদিন ওকে ভালোবেসেছিলেন তাই না? কিন্তু হঠাৎ আপনি দূরে সরে গেলেন। কেন গেলেন জানি না। শুনেছি কিছু একটা হয়েছিল আপনার সাথে। তবে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি চাই না অনন্যা কষ্ট পাক। ও তো কোনো দোষ করেনি। তাহলে কেন অনন্যা এই শাস্তি ভোগ করছে? প্লিজ, ফিরে যান অনন্যার কাছে। ও আপনাকে আজও আগের মতোই ভালোবাসে।"
কৌশিক আর কিছু বলল না। কৌশিকের হালকা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় নড়ল না। চোখ স্থির হয়ে রইলো এক স্থানেই। শুধু মনে মনে একটা ভার জমে রইল। কী বলবে? কীভাবে বলবে? নিজের জীবনটা এখন যেন একটা ভাঙা আয়নার মতো। আয়নার প্রতিফলনে তো নিজের মুখটাই চিনতে পারে না। আর তাই, আজ এই প্রশ্নটা আরণ্যককে করে ফেললো। নিজের মন বোঝার পথ খুঁজছিল সে অথবা কেউ একজন যদি তাকে বুঝে ফেলতো অথবা ধরিয়ে দিতো সঠিক দিক তাহলেই একটু হালকা হতো কৌশিকের ভেতরটা। কিন্তু আরণ্যকের উত্তর শুনে আরও জট পাকিয়ে গেল ভিতরের গলিপথগুলো।
আচমকা কৌশিক খেয়াল করলো, অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগছে ওর। সে জানে না এই মেয়েটার সাথে তার কি করে সম্পর্ক তৈরি হলো। কি করে দুজনে এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো। শুধু জানে কিছু তো আছে যা বারবার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনন্যার প্রতি। বারবার ভাবতে ইচ্ছে করছে এর শুরুটা কি করে হয়েছিল।
কৌশিকের পায়ের নাড়াচাড়াতে অনন্যার চেয়ারটা খানিক নড়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ সজাগ হয়ে গেল অনন্যা। হকচকিয়ে উঠে বসলো সে। কৌশিক ও থতমত খেয়ে গেল। মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনন্যা চক্ষু দ্বয় ডলতে ডলতে বললো,
"আমাকে ডাকেন নি কেনো?"
"ঘুমিয়ে পড়েছেন ডাকলে বলবেন ঘুম নষ্ট করেছি।"
কৌশিক অন্যদিকে অগোছালো দৃষ্টি ফেলে ঝটপট জবাব দিলো।
অনন্যা তেতে উঠল,
"আশ্চর্য! এখানে কি আমি ঘুমাতে এসেছি?"
কৌশিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"কে জানে হয়তো ঘুমাতেই এসেছেন!"
অনন্যা এবার কটমট করে তাকালো। ভুলেই গেলো এই লোকটা সম্পর্কে ওর স্যার হয়।
কঠোর গলায় বললো,
"অদ্ভুত তো! আপনি ডেকেছেন বলে আমি এসেছি নাহলে আপনার জন্য বসে থাকার এক ফোঁটাও ইচ্ছে আমার ছিল না।"
"আচ্ছা তাই? তো এবার একটা কথার উত্তর দিন।"
কৌশিক চেয়ার ঘুরিয়ে অনন্যার দিক করে বসলো।
অনন্যা ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"ডেকেছেন কেনো সেটা বলুন!"
"গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল বলেই ডেকেছিলাম, মিসেস!"
"ঠিক আছে বলুন!"
অনন্যা মাথা নাড়লো।
কৌশিক কিছুক্ষণ সময় নিলো। অনন্যার দিকে এগিয়ে এসে নেশাময় কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
" ম্যাডাম! কি ডাকনামে ডাকবো আপনাকে?"
আচমকা স্যারের নেশালো কণ্ঠের এই বাক্য শুনে অনন্যা চমকে গেলো, থমকে গেলো। হৃদয়ের ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কাঁচগুলো কিছু না করতেই, কোনো যত্ন না নিতেই কেমন জানি জুড়ে গেলো সবটা। মনের প্রজাপতিরা আলগোছে উড়তে লাগলো। বুকের ধুকপুকানিটা বেড়ে গেলো। মনে হলো না সে ভুল করেনি। সে ভুল করেনি মানুষ চিনতে। সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে এক দেখায় চিনতে পারবে না তা হয় নাকি? সে ঠিক ছিল একদম প্রথম দিন থেকেই। কৌশিক স্যারের চোখের মণি পরিবর্তন হয়ে গেলেও অন্তরের দিক দিয়ে মানুষটা যদি সেই একই থেকে থাকে তাতেই অনন্যার স্বস্তি।সে এই ভিন্ন ধরনের মানুষটাকেও বেছে নিতে রাজি আছে। শুধু সেই আগেকার প্রিন্সটা ফিরে আসলেই চলবে!
অনন্যার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। সে চেয়ার টেনে আরো কিছুটা এগিয়ে আসলো। কৌশিকের হলুদ ফর্সা মুখমণ্ডলে নরম মোলায়েম হাত স্পর্শ করে বললো,
"ভালোবাসি!"
কৌশিকের আঁখিপল্লব ও নড়লো না কতক্ষণ। সে অনন্যার স্পর্শে পেয়ে বড় ধরনের একটা ঝটকা খেলো। ভালোবাসি শব্দটা পুরো শরীরকে নাড়া দিয়ে গেলো। চোখে ভেসে উঠলো দুজনের কিছু পুরোনো স্মৃতি। ধাপে ধাপে সিনেমার মতো চোখে ভেসে উঠলো স্মৃতিগুলো। আর কৌশিককে তাড়া করতে লাগলো অবুঝের মতো। চোখের মধ্যে ভাসমান স্মৃতিগুলো মস্তিকে চোট পাইয়ে দিলো। প্রচণ্ড ব্যথায় কৌশিক আর্তনাদ করে উঠলো। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
কড়া গলায় বলে উঠলো,
" আর ইউ ওকে? হোয়াট আর ইউ সেয়িং?"
অনন্যাও দাঁড়িয়ে পড়লো। এই না একটু আগে লোকটা অনন্যার কাছে ডাকনাম জানতে চাইছিল। কত সুন্দর করে কৌশিক স্যারের মতো নেশালো কণ্ঠে বলেছিলো কথাটা। অনন্যার তো এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল সেই পুরাতন পাগলটাকে খুঁজে পেয়েছে সে। কিন্তু হঠাৎ কি হলো আবার? অনন্যা এগিয়ে এসে ধরতে চাইলো কৌশিককে। কিন্তু কৌশিক হাত বাড়িয়ে বললো,
"ডোন্ট! ডোন্ট টাচ মি!"
কৌশিক কনসাল্টেশন রুম থেকে তড়িঘড়ি করে প্রস্থান করলো। যাওয়ার পূর্বে অনন্যাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলো আবার ও সেই আশা বিহীন জীবন। অনন্যা অবুঝের মতো ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। চোখ দিয়ে এখন খুশির অশ্রু নয়, না পাওয়ার বেদনা ঘিরে ধরলো তাকে।
*******
আকাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। হালকা ধূসর আলোয় শহরের ব্যস্ততা মিশে আছে নিঃসঙ্গতার ছায়ায়।
অনন্যা হেঁটে চলেছে ফুটপাথ ধরে। পা চলছে, কিন্তু মন নেই। একটা অন্যমনস্ক ক্লান্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি তার। শরীরটা ভারি লাগছে, মাথাটা কেমন টলটল করছে। পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে বারবার। মুখে তেতো স্বাদ লাগছে। তাও কোনো মতে নিজেকে সামলে রাখছে অনন্যা।
চারপাশের যানবাহন হুশ করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে।কেউ থামছে না, কেউ তাকাচ্ছে না। অনন্যা দু-একবার ডাক দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গলার স্বরও আজ বেঈমানি করছে। টু শব্দটিও বের করতে পারছে না। কণ্ঠস্বর সে যেন কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। শেষমেশ, শরীর আর সায় দিল না। রাস্তার মাঝখানেই হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল সে। আর মুহূর্তেই মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এলো সকালের জোর করে খাওয়া কিছুটা খাবার।
রাস্তায় পড়ে রইল অনন্যা। পাশেই গাড়ির আলো হেঁকে গেল, কেউ খেয়াল করল না। অন্ধকারে নিস্তব্ধ, ধুলোমাখা রাস্তায় অনন্যার শরীরটা নিথর পড়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। একটা ক্লান্ত আত্মার মতো যাকে এই ভূখণ্ডে, এই মূহুর্তে কেউ খুঁজে ফিরছে না।
কৌশিক ভার্সিটির বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে মাঠে হাঁটছিল আনমনেই। গন্তব্য অবশ্যই নিজের বাড়ি। প্রতিদিনকার মতো দাঁড়িয়ে গাড়ি ধরতে হবে। এই চিন্তায় ই করছিল সে। তখনই ফোনে একটা মেসেজ আসলো। কৌশিক ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখতে পেলো নুহাশ মেসেজ করেছে। মেসেজ খুলে দেখলো নুহাশ লিখেছে,
"পার্কিংয়ের দিকে আসো, ভাই!"
তারপরই কৌশিক পার্কিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। নুহাশকে গাড়িতে বসে থাকতে দেখা গেলো। কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে গাড়িতে চড়লো। নুহাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
"হঠাৎ গাড়ি নিয়ে উপস্থিত?"
"কি আর করবো? তোমাকে সুস্থ সবল রাখতে হবে এই মায়ের আদেশ। তাই গাড়ি নিয়ে ছুটে আসলাম। ড্রাইভার ভাইকে ছুটি দিয়ে এসেছি। আজ প্রচুর ঘোরা হবে।"
কৌশিক ছেলেটাকে থামিয়ে বললো,
"উমম! তুই বললেই হলো? আমি অনেক ক্লান্ত! বাসায় যাবি নাহয় গাড়ি থেকে নেমে পড়বো।"
"হ্যাঁ? সামান্য ক্লাস করেই ক্লান্ত হয়ে গেলে? সামনে বউ এলে সামলাবে কি করে?"
কৌশিক নুহাশের মাথায় বারি দিয়ে বললো,
"ছিঃ! ভাইয়ের সাথে এসব কথা বলতে লজ্জা করে না তোর?"
"লজ্জা করবে কেন? তুমি তো ভাইই আমার! লজ্জা তো করবে আমার বউয়ের সাথে! তোমার সাথে না। যাই হোক আমি খুব এক্সাইটেড ভাবীকে নিয়ে। কবে আনছো বলো!"
কৌশিক মাথা ঘুরিয়ে বাইরে তাকালো। ধমক দিয়ে বললো,
"চুপ থাক তো! এমন ভাব করছিস যেন আমি বিয়ে করে বসে আছি শুধু ঘরে আনা বাকি!"
ঠিক সেই সময়েই কৌশিকের চোখ চলে গেল রাস্তায়।
গাড়ির জানালা দিয়ে অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মাঝে সে দেখতে পেল কোনো এক মেয়ে পড়ে আছে রাস্তায় নিথর হয়ে। চোখের দৃষ্টিটা এক লহমায় বদলে গেল তার।
"নুহাশ, গাড়ি থামাও! তাড়াতাড়ি!"
তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল সে।
নুহাশ কিছু না বুঝেই ব্রেক কষল। গাড়ি থামতেই কৌশিক দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় পড়ে থাকা অনন্যাকে দেখে মুহূর্তেই ঘাবড়ে গেল সে।
"অনন্যা শিকদার!"
একাধিকবার ডেকে উঠলো সে। যতবার মেয়েটাকে এই অবস্থায় দেখছে বুকটা যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠছে কৌশিকের। মনে হচ্ছে যত ভুল সব সে করেছে। ওর জন্যেই অনন্যার এই হাল হয়তোবা।
পিছন থেকে নুহাশও গাড়ি পার্ক করে ছুটে এলো।ভাইয়ের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে মুহূর্তেই সে বুঝে গেল মেয়েটিকে কৌশিক ভালোমতোই চেনে।
নুহাশ নিচু হয়ে নরম গলায় অনন্যার গালে আলতো চাপড় দিয়ে বলল,
“এক্সকিউজ মি? হ্যালো?”
কিন্তু কৌশিক তৎক্ষণাৎ নুহাশের হাত চেপে ধরল।
চোখে কঠোরতা দেখা গেলো কৌশিকের। নুহাশ খেয়াল করলো ভাইয়ের চোখ দুটিতে এই মেয়েটার জন্য মায়া জড়িয়ে আছে, স্পষ্ট ভালোবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই বিষয়টা বুঝতে নুহাশের বেশি সময় লাগলো না।
নুহাশ থেমে গেল,হাত আলগোছে সরিয়ে নিলো সে। কিছু বলল না ভাইকে।
আলতো হাতে অনন্যাকে কোলে তুলে নিল কৌশিক। সেই ছায়াসম সন্ধ্যায় অনন্যা ওর কৌশিক স্যারের বুকে নিথর হয়ে আছে। একটা ভেঙে পড়া বিশ্বাসের মতো স্থির হয়ে আছে সে। কোনো হুশ জ্ঞান নেই। নুহাশ তাড়াতাড়ি অনন্যার ব্যাগটা তুলে নিল।
কৌশিক অনন্যাকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসল। মেয়েটার জ্ঞান নেই শরীরটা ঢলে পড়ছে বারবার।
কৌশিক শেষমেশ নিজেই অনন্যাকে ধরে রাখল। নিজের ঘাড়ে অনন্যার মাথাটা রেখে যত্নে ঠাঁই দিল।
নুহাশ গাড়িতে এসে বসে ব্যাগটা পাশের সিটে রাখল। এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো সে।
“আমি সামনের একটা হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।”
কৌশিক কিছু বলল না। তার যতসব ধ্যান এখন অনন্যার দিকে।
·
·
·
চলবে.................................................................................