কয়েক মাস পর…
ইদানীং অফিস থেকে প্রিয় সোজা বাসায় আসে। পেট্রা ও স্মরণকে একসঙ্গে দেখার পর থেকে সে আর জিমে যায় না। স্মরণের মুখ দেখতে চায় না সে। কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়েই শুদ্ধর রুমে গিয়ে ঢুকল। শুদ্ধ কাঁদছে। ঘটনা কী? ছেলেটা কেন কাঁদছে!
‘কী হয়েছে, শুদ্ধ? তুই একা একা বসে কাঁদছিস কেন? নিকিতা কই?
‘নিকিমা ভার্সিটিতে। বাবা, আজ পর্যন্ত তুমি বা মা যে যা বলে সিক্রেট রাখতে বলেছ, আমি রেখেছি।’
প্রিয় হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা তো জানি। কিন্তু আজ কী হয়েছে?
একটা কথা আমি আর সিক্রেট রাখতে পারছি না। আমার খুব কান্না। পাচ্ছে মায়ের জন্য।
প্রিয়র বুক কেঁপে উঠল। বলল, কী হয়েছে মায়ের?
‘মা মালয়েশিয়া চলে গেছে, বাবা।
‘কী বলছিস? কেন?
‘ওখানে চাকরি নিয়েছে।
‘কবে গেছে?
‘কয়েকমাস আগে।’
‘এত দিন বলিস নি কেন আমাকে?
‘মা বলতে না করেছিল তো।’
প্রিয় শুদ্ধর শেষ কথাটা আর শুনতে পেল না। পাগল হয়ে গেল। একটার পর একটা ফোন করতে লাগল প্রিয়াঙ্কা ও রায়ানকে। কিন্তু ওরা কেউই ফোন ধরল না। প্রিয় শুদ্ধকেই জিজ্ঞেস করল, ‘জানি, তোর মায়ের সাথে যোগাযোগ আছে। প্লিজ বল কীভাবে যোগাযোগ করিস?’
‘আমার ট্যাবে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, স্কাইপে–এসব দিয়ে।
ফোন নম্বর আছে?
‘আছে।’
‘এক্ষুনি দে।’
শুদ্ধ নম্বর দিল। প্রিয় টাইপ করতে করতে জিজ্ঞেস করল, তোদের প্রতিদিন কথা হয়?
‘না, বাবা। মা খুব বিজি থাকে। কয়েক দিন ধরে কথা হয় না।’
প্রিয় নম্বরটাতে ডায়াল করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পেল সেই চেনা কণ্ঠ…
‘Hello, this is Cleopatra Zenny Rozario. I’m busy now. Please leave a message.’
পেট্রার ভয়েস মেইল শুনে ফোন রেখে বসে পড়ল প্রিয়। পেট্রা তাকে বলে পার্মানেন্টলি দেশ ছাড়ল! একবার বলে গেলে কী হতো? বলবেই বা কেন, পেট্রা তো এখন তাকে হিসাবেই ধরে না। এসব ভাবনার মাঝে প্রিয়াঙ্কা ফোন করল।
‘সরি প্রিয়দা। ফোনের কাছে ছিলাম না, তাই ধরতে পারি নি।
‘প্রিয়াঙ্কা, তুই আমাকে বল পেট্রা মালয়েশিয়া কেন গেল?
‘চাকরি নিয়ে গেছে। অনেক ভালো একটা চাকরি পেয়েছে।
‘পার্মানেন্টলি গেছে?
‘আপাতত। পরে ওখান থেকে সব গুছিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে সেটেল হওয়ার ইচ্ছা।’
‘বাংলাদেশে আর ফিরবে না?
‘না, তবে বেড়াতে আসবে।
প্রিয়র বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। দেশে থাকলেও সেভাবে দেখা হতো না। তবু দূর থেকে দেখতে তো পারত। বলল, ও আমাকে না জানিয়ে চলে গেল। চলে যাওয়ার আগে তোরাও একবার জানালিও না আমাকে? তোদের তো নিজের আপন ভাইবোনের মতো দেখে এসেছি। তোরাও সব খবরাখবর দিতি। আর আজ এত বড় একটা কথা জানালি না?
‘মাফ করো, দাদা। জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পেট্রা কঠিনভাবে নিষেধ করেছিল তোমাকে জানাতে। আমরা জানালে আমাদের ওপর রাগ
করত। হয়তো আমাদেরও না বলে চলে যেত। ওকে তো চেনো।
‘ও কি একা গেছে?
‘হ্যাঁ।’
‘ও বিয়ে করবে কবে?
‘ও বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে। এত বোঝালাম, কোনো লাভ হলো না। বলে, ওর জীবনে নাকি কোনো পুরুষমানুষের দরকার নাই।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল প্রিয়র। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘পেট্রার অফিসের এক কলিগ ওর জন্য পাগল। ওর পেছনে লেগেই থাকত। বিয়ে করতে চেয়েছিল, এমনকি মা বেঁচে থাকতে ভাইয়াটা তার মাকে নিয়ে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। মা অবশ্য রাজি হয় নি–ছেলে মুসলিম, তাই। এদিকে পেট্রা তো আগাগোড়া কখনো তাকে পাত্তাই দিল না। এই বিয়েটা পেট্রার করা উচিত ছিল। ভাইয়াটা ওকে অনেক ভালোবাসত।
‘স্মরণের কথা বলছিস?
‘হ্যাঁ। তুমি জানো তার কথা?
প্রিয়র এবার নিজেকে খুন করতে ইচ্ছা হলো। সে পেট্রাকে এভাবে ভুল বুঝেছিল!
প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে কথা শেষ করে সে স্মরণকে ফোন করল। কেন মিথ্যা বলেছিল জিজ্ঞেস করতেই স্মরণ বলল, ‘দেখেন ভাই, আমি কী বলেছি, তার জন্য আপনার কাছে জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই। আপনার ভাগ্য ভালো পেট্রা আমাকে বিয়ে করে নি। করলে আপনাকে আমি ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল।
এ কথা বলে প্রিয় কিছু বলার আগেই স্মরণ ফোন রেখে দিল। প্রিয় স্মরণকে নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করল না। ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। শুদ্ধ এখনো চুপচাপ বসে কাঁদছে। প্রিয়র মাথায় ঢুকছে না এত বাজেভাবে কী করে বুঝল সে পেট্রাকে! পেট্রা স্মরণকে পাত্তা দেয় না তো বাসায় নিয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল? ওই ঝড়বৃষ্টির রাতে স্মরণকে নিয়ে বাসায় যেতে দেখেই তার মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পেট্রাও তো ভুল বোঝার সব রাস্তা খুলে দিয়েছিল। যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল, যা সে আগে কখনো করে নি। ভুল না ঠিক, তা জানার জন্যই ফোন করেছিল, ফোনটাও বন্ধ ছিল। পরেরবার ধরে নি। তবু, তবু সে কী করে পারল পেট্রাকে ভুল বুঝতে? রাগে মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ সে আলমারির আয়নায় প্রচণ্ড একটা ঘুষি দিল। সঙ্গে সঙ্গে আয়নাটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ল। শুদ্ধ একটা চিৎকার দিল। প্রিয় আবার সেই ভাঙা আয়নায় এলোপাতাড়ি ঘুষি দিতে দিতে নিজের হাতকে রক্তাক্ত করল। কত কাঁচের টুকরো যে প্রিয়র হাতে ঢুকে গেল, তার হিসাব নেই। হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়তে লাগল। তবু প্রিয়র রাগ, অস্থিরতা কমছে না। অবশেষে সব রাগ, কষ্ট ও অসহায়তা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।
—————
প্রিয় হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় বসে আছে। ডাক্তার চলে যেতেই বাবর খান বললেন, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, প্রিয়? এসব কেন করেছ?
প্রিয় আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল, ‘বাবর খান, এই কাঁচের টুকরোগুলো যদি আমি তোমার বুকে ঢোকাতে পারতাম, তাহলে আমার শান্তি হতো।
‘ঠিকাছে, সব হবে। আগে নিজে সুস্থ হও।
প্রিয় বিস্ফারিত চোখে তাকাল, বাবর খান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিকিতা অনেক্ষণ ধরে কেঁদেছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। শ্বশুর বেরিয়ে যেতেই সে প্রিয়র কাছে এসে বসল। বলল, তুমি কেন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে?
প্রিয় স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘শুধু কষ্ট দিয়েছি। আমার তো নিজেকে খুন করা উচিত এখন।
‘কী এমন হয়েছে, আমাকে বলে? অনেক দিন ধরেই দেখছি তুমি খুব আনমনা, বিষণ্ণ। আর আজ তো…’
‘তুমি বুঝবে না, নিকিতা। শুদ্ধ কোথায়?
‘ওর টিচার এসেছে। পড়তে বসেছে।
‘আচ্ছা
নিকিতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই প্রিয়র ফোনটা বেজে উঠল। নম্বর কোড +৬০ দেখেই বুকের ভেতরটায় কেমন করে উঠল। প্রিয় বলল, ‘নিকিতা, তুমি একটু বাইরে যাবে?
নিকিতা বাইরে চলে গেল। প্রিয় শুদ্ধকে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছিল এই নম্বর থেকে। এটা প্রিয়র নতুন অফিসের নম্বর। পেট্রা জানে না। শুদ্ধ লিখেছিল ফ্রি হয়ে কল করতে, মেসেজ পেয়েই বোধ হয় কল করেছে। ফোন ধরতেই পেট্রা বলল, ‘হ্যালো, শুদ্ধ?
প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধর বাবা।
পেট্রা কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না। প্রিয়ও চুপ। হঠাই লাইনটা কেটে গেল। তারপর থেকে ফোনটা বন্ধ পাওয়া গেল।
পেট্রা লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে দিল। কত দিন পর প্রিয়র গলা শুনল। চোখে জল এসে গেল তার। চোখ মুছে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল। তাকে শক্ত হতে হবে। অনেক শক্ত। শুদ্ধর সঙ্গে অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করতে হবে। ল্যাপটপ নিয়ে বসল। তারপর শুদ্ধকে একটা মেসেজ দিল যে বাবাকে ফোন নম্বর দেওয়াটা ঠিক হয় নি, রাতে ঘুমানোর সময় যাতে একা নক করে।
—————
আগামীকাল থাইল্যান্ড যাচ্ছে প্রিয়। সেখান থেকে মালয়েশিয়া। মূলত থাইল্যান্ডে তার কোনো কাজ নেই। কিন্তু বাবর খান যাতে বাধা না দিতে পারে, তাই অফিস থেকে থাইল্যান্ডে কাজে পাঠাচ্ছে বলেই যাচ্ছে। ভাগ্যিস, মালয়েশিয়ান ভিসা ছিল তার। নতুন করে করাটা সম্ভব হতো না মন্ত্রী সাহেবের জন্য। যদিও এখনো সে নিশ্চিত না সে সত্যিই যেতে পারবে কি না। সত্যিটা টের পেলে কখনোই যেতে দেবে না। সব সময় স্পাই তো লাগিয়েই রাখে। কিন্তু স্পাইটা যে কে, আজও বের করতে পারল না। হয়তো চোখের সামনেই আছে, সে ধরতে পারছে না। রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিল প্রিয়। নিকিতা হঠাৎ কপালে হাত রাখল। বলল, ‘ঘুম আসছে না?
‘না।
‘বিশ্বাস করো, পেট্রা আপু যখন শুদ্ধর সাথে দেখা করল, আমাকে বলে নি যে সে চলে যাবে। এমনকি শুদ্ধকে কখন বলেছে আমি জানি না। আমি জানলে তোমাকে বলতাম।’
‘জানি।’
নিকিতা প্রিয়র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিকিতা, তুমি কি জানো প্রথম দিন আমি তোমার সাথে রাগের মাথায় ওসব করেছিলাম।’
‘সেদিন বুঝি নি। পরে বুঝেছি।’
‘তুমি তো জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি না। তারপরও তোমার খারাপ লাগে নি?
‘খারাপ লাগবে কেন? ভালো বাসো বা না বাসো, তুমি আমার স্বামী, আমি তোমার স্ত্রী। পবিত্র কালেমা পড়ে কবুল করেছ। আমাদের দুজনেরই অধিকার আছে।’
‘কিন্তু আমি তো তোমাকে স্ত্রী বলেও মানি না, তুমি জানো। তারপরও ইন্টিমেট হচ্ছি। তোমার কি মনে হয় না আমি তোমাকে ইউজ করছি?
‘মানো আর না মানো, আমরা তো স্বামী-স্ত্রী হয়েই গেছি। আমি যখন অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমাকে কোলে করে তোমার বিছানায় এনেছিলে, সেবা করেছিলে। রিদিমার বউভাতের দিন যখন মামির সাথে ঝগড়া করছিলাম, তুমি আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে এনেছিলে। তোমার ছেলে আমাকে মা বলে ডাকে। যে-কোনো বিপদে তুমিই আমার কাছে এগিয়ে আসো, আগলে রাখো। তুমি নিজের অজান্তেই এসব করেছ, যা স্বামীরা স্ত্রীদের জন্য করে। শুধু মুখে বলেছ আমাকে স্ত্রী বলে মানো না। তোমার অমন মৌখিক স্ত্রী আমার না হলেও চলবে। আমি তোমার সাথে থাকতে পারছি, নিজেকে তোমার স্ত্রী বলে গর্ব করে পরিচয় দিতে পারছি, তোমার বুকে ঠাই পেয়েছি। আমি আর কিছু চাই না।’
প্রিয় অবাক হয়ে গেল নিকিতার কথা শুনে। এবার নিকিতা প্রিয়র আরও একটু কাছে এসে বলল, ‘আমি তোমার স্ত্রী বলেই রাগের মাথায় হোক আর যে কারণেই হোক, আমার সাথেই করেছ। কারণ, তুমি জানো এটা তোমার অধিকার, এ জন্য তোমার কোনো পাপবোধও হয় নি। তা ্না হলে দুনিয়াতে তো আর মেয়ের অভাব ছিল না। আমার সাথেই করতে গেলে কেন? স্ত্রী বলেই তো। আর স্বামী এসব করতে এলে স্ত্রী কখনো সেটাকে ইউজ করা ভাবতে পারে না।’
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ দুটো বন্ধ করল। সম্পর্ক ও অদৃষ্টের খেলা এত জটিল কেন?
·
·
·
চলবে....................................................................................