পেট্রার লাগেজ গোছানো যদিও হয়ে গেছে, তারপরও প্রতিদিন এটা-ওটা টুকটাক জিনিসের কথা মনে পড়ছে, পরে সেগুলো নিচ্ছে। গোছগাছের মাঝেই রায়ান দরজায় নক করল! পেট্রা বলল, ‘কিরে, এত রাত হয়ে গেছে, ঘুমাস নি?
‘কত ঘুমাতে পারব! তুই তো কদিন পরেই চলে যাবি।
পেট্রা হেসে বলল, ‘গল্প করতে এসেছিস?
‘হ্যাঁ।
‘বসে পড়।’
রায়ান বসতে বসতে বলল, ‘আজ সন্ধ্যায় তুই যখন চা বানাতে গেলি, স্মরণ ভাই আমাকে কী বলেছে, জানিস?
‘কী বলেছে।’
‘বলেছে…’
‘আমতা আমতা করিস না। কী বলেছে সে?
‘এখনো আমাকে বলে তোকে বিয়েতে রাজি করাতে! প্রিয়াঙ্কাদির ফোন নম্বরও চাইল।
‘যত্ত সব! প্রিয়াঙ্কার নম্বর কেন আবার?
‘ওনার ধারণা, প্রিয়াঙ্কাদি চাইলে তোকে রাজি করাতে পারবে হয়তো। এ জন্য উনি দির সাথে কথা বলবে ব্যাপারটা নিয়ে।’
‘বিরক্তিকর ছেলে একটা। এতবার বলার পরও বোঝে না। এই জন্য এসব ছেলেপেলেকে সহ্য হয় না আমার। সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।’
‘দি, আসলে ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে, এই কদিনে আমি এটুকু বুঝেছি।’
‘রায়ান, তুই কি ওর হয়ে অ্যাডভোকেসি করতে এসেছিস?
পেট্রার ধমকে ঘাবড়ে গেল রায়ান। বলল, ‘না, দি। তুই যেটা ভালো বুঝবি, অবশ্যই সেটা করবি। আমি তো শুধু…’।
‘রায়ান, আমরা এখন টিনএজে নেই যে এ রকম অসম সম্পর্কে যাব। এবং দিওয়ানা হয়ে যাব। তা ছাড়া স্মরণের এটা কোনো ভালোবাসাই না, নিছক পাগলামি। বড়লোকের ছেলে, যখন যা মন চেয়েছে, করেছে। জীবনকে কতটুকু চেনে সে? আমাকে বিয়ে করলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি সে হবে, তার কথা তো এখনো ভাবতেই পারছে না। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবে জানি এসব। সবচেয়ে বড় কথা, আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। আল্লাহ বাঁচাচ্ছে, যাচ্ছি, আপদ ঘাড় থেকে নামল।
‘সারা জীবন একা থাকবি? প্রিয়দা তো…’
‘রায়ান! সারা জীবন আমি একা থাকব, না কী করব, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। এ ব্যাপারে তোরা কেউ কোনো কথা বলবি না। প্রিয়র সম্পর্কেও কিছু বলবি না। প্রিয়র পরিস্থিতি বোঝার মতো বয়স বা
ম্যাচিওরিটি কোনোটাই তোর এখনো হয় নি।
‘সরি দি।
‘কদিন পর চলে যাব। এর আগে তোকে বকাবকি করতে চাই নি আমি। কিন্তু তুই…’।
পেট্রা কথা শেষ করার আগেই রায়ান পেট্রাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ছোটবেলা থেকে প্রিয়দার কাঁধে, কোলে চড়ে বড় হয়েছি। দাদাকে তোর হাজব্যান্ড ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। তাকে অন্য কারও সাথে আমি সহ্য করতে পারি না। তুই কীভাবে করিস?
পেট্রা রায়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্রিয়কে ভুল বুঝিস না ভাই। কাউকে বাইরে থেকে দেখে তার ভেতরের রক্তক্ষরণ বোঝা যায় না।’
—————
বছরে এই একটা দিন, যেদিন প্রিয়র কথা ভেবে মন খারাপ হয় না পেট্রার। আর এই দিনই পেট্রা প্রিয়কে নিয়ে বেশি ভাবে। সারা রাত ঘুমাতে পারে না উত্তেজনায়। এদিন ওদের বিয়ে হয়েছিল, বাসর হয়েছিল। পেট্রার চেয়ে বেশি নার্ভাস ছিল প্রিয়। দুজনই অনভিজ্ঞ, কিছুই করতে পারছিল না। সারা রাত প্রচেষ্টা ও গবেষণার পর ভোরবেলা সফল হয়েছিল। মনে পড়তেই নিজের অজান্তে হেসে ফেলল। বাইরে এখনো তুমুল বৃষ্টি। একটু শীত শীত করছে। পেট্রা বালিশটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল সেই রাতের কথা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল। প্রিয়কে আসতে বলতে ইচ্ছা হলো। পরক্ষণেই থেমে গেল। মনে হলো, কী ভুলটাই না করতে যাচ্ছিল ও। এখন প্রিয়কে এভাবে ডাকা মানে ওকে প্রশ্রয় দেওয়া। এত দিন কষ্ট করে যতটুকু দূরত্ব বাড়িয়েছিল, তা একনিমেষেই শেষ হয়ে যাবে। পেট্রা মনে মনে প্রার্থনা করল, ‘হে ইশ্বর, ধৈর্য দাও, শক্তি দাও।
—————
নিকিতা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রিয় সারা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারে নি। গত নয় বছর ধরে বিশেষ এই রাতে সে কখনো ঘুমাতে পারে নি। প্রথম তিন বছর পেট্রাকে আদর করে, গল্প করে এবং পরের ছয় বছর ওকে মিস করে করে কেটেছে। ওর আদরের জন্য বড় কাঙাল ছিল পেট্রা। সেই পেট্রা আজকাল কী করে কাটায় একেকটা রাত ওকে ছাড়া? স্মরণ-পেট্রা কবে বিয়ে করবে? ওকে কি জানাবে না? নাই-বা থাকল ওদের সম্পর্ক, ওরা তো বন্ধুও ছিল, সেই অধিকারেও কি জানতে পারে না? করুক তারা বিয়ে, সুখী হোক। পেট্রার জীবনটা তো ওর জন্যই এমন হয়েছে। কিন্তু স্মরণ ওকে সুখে রাখবে তো? নিঃশ্বাসটা আটকে আসছে। এত কেন মিস করছে পেট্রাকে? পেট্রাও কি মিস করছে? না করে যাবে কোথায়? যত স্মরণই আসুক ওর জীবনে, প্রিয়কে কখনো ভুলতে পারবে না…এতটাই তো ভালোবাসা দিয়ে রেখেছে সে। এসব ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রিয়। ঘুম ভাঙল দেরিতে। ছুটির দিন বলে কেউ ডাকেও নি। দ্রুত গোসল করে বের হয়ে দেখল, শুদ্ধ আর বাবা অলরেডি নামাজে চলে গেছে। অবশেষে সে একাই গেল।
ঘুম থেকে ওঠার পর নিকিতার সঙ্গে দেখা হয় নি। লাঞ্চের সময় দেখা হলো এবং প্রিয় খেয়াল করল, নিকিতা লজ্জা পাচ্ছে, ওর দিকে তাকাচ্ছে না। এত লজ্জার কী আছে? এত দিন যা চাইছিল, তা-ই তো সে পেয়েছে। এত দিন চাওয়ার সময় তো লজ্জা পায় নি।
চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল প্রিয়। বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ এসে দাঁড়াল। প্রিয় সিগারেটটা ফেলে দিয়ে শুদ্ধকে কাছে টেনে নিল। দুই বাপ-ছেলেতে কিছুক্ষণ ধরে গল্প হলো। শুদ্ধ বলল, ‘জানো বাবা, দাদাভাই বলেছে, পাশের রুমটা এখন থেকে আমার। আমি ওখানেই থাকব। কী সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে!
প্রিয় বেশ অবাক হলো। বলল, ‘কেন? তুই আমার সাথে ছিলি, আমার সাথেই থাকবি।’
‘না বাবা, আমি ওই রুমেই থাকব। আমি তো অনেক বড় হয়ে গেছি। আমার বয়স এখন নয় বছর। এখনো কেউ বাবার সাথে থাকে নাকি? এখন তো সবাই একাই থাকে, আমার বন্ধুরাও তো।’
প্রিয় আর ঘাটাল না। এভাবে আসল কথাটা বের করা যাবে না, অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে। শুদ্ধ খেলতে চলে গেল। শুদ্ধ চলে যাওয়ার পর প্রিয় ঘরে ঢুকল। ঠিক তখনই নিকিতাও ঘরে ঢুকল। প্রিয় পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে নিকিতার হাতে দিল। নিকিতা বলল, ‘কী এটা?
‘প্যাকেটটা খোলো। এটা কন্ট্রাসেপটিভ পিল।
নিকিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রিয় বলল, ‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কোনো বাচ্চা চাই না, আমার একটা বাচ্চা আছে, তাতেই হবে। রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।’
নিকিতা আমতা আমতা করে বলল, ‘একবারেই কিছু হয় নাকি?
‘ব্যাটে-বলে মিলে গেলে একবারই যথেষ্ট।
পানি এগিয়ে দিল প্রিয়, ‘নাও, এক্ষুনি খাও, আমার চোখের সামনে।
নিকিতা মন খারাপ করেই পিলটা খেয়ে নিল। প্রিয় বলল, ‘আচ্ছা নিকিতা, বাবা শুদ্ধর জন্য আলাদা রুম দিয়েছে?
‘ও হ্যাঁ, এটা কালই বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু…’
‘শুদ্ধ রাজি হলো কীভাবে? আর শুধু রাজি না, ওকে দেখে অনেক খুশি মনে হলো।’
‘আমিও তো তাই ভাবছি। কদিন আগেও তো বলত বাবাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না।’
‘তুমি সত্যি জানো না?
‘খোদার কসম। যদি এই ঘটনার সাথে কোনোভাবে জড়িত থাকি, তুমি আমাকে খুন করে ফেলল।
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী হলো ছেলেটার কে জানে! দিনদিন যত বড় হচ্ছে আমার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বাবার সাথে কথা বলতে হবে।’
এ কথা শুনে হঠাৎ মনে পড়ায় নিকিতা বলল, ‘শোনো, বাবা শুদ্ধকে একটা ট্যাব কিনে দিয়েছে কাল।’
‘হোয়াট?
‘নতুন ঘর, নতুন ফার্নিচার, নতুন স্কুলব্যাগ, নতুন জামাকাপড়, সাথে একটা ট্যাব।’
‘এই ব্যাপার তাহলে?
‘কী ব্যাপার?
‘আগে আমি নিশ্চিত হয়ে নিই।
প্রিয়র মনে হচ্ছে শুদ্ধ ট্যাব দিয়ে রাতে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে বলে আলাদা রুম পেয়ে খুশি।
প্রিয় বিছানায় শুয়ে পড়ল। এখনো ঘুম পাচ্ছে তার। নিকিতা তার পাশে গিয়ে বসল। প্রিয় চুপ। নিকিতা হঠাৎ প্রিয়র বুকের ওপর ঝুঁকে বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?
প্রিয় মনে মনে ভাবল, কী সহজে সে নিকিতাকে কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। অবশ্য এটার দরকার ছিল। নিকিতা আরও কাছে আসুক। পেট্রা খালিঘর পূরণ করেছে, এবার তার পালা। প্রিয় নিকিতার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী আবার হবে? কিছু হয় নি।
নিকিতা প্রিয়র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্বপ্নপূরণ হলে অদ্ভুত লাগে। পাগল করে দিলে কাল রাতে তুমি আমাকে।’
প্রিয়ও নিকিতার চোখে চোখ রেখে বলল, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি না নিকিতা। কখনো ভালোবাসতে পারবও না।’
নিকিতা আরও একটু কাছে এসে বলল, ‘আরে, রাখো তোমার ভালোবাসা। কে চাইছে? দুনিয়ার সব স্বামী কি স্ত্রীদের খুব ভালোবাসে?
প্রিয় হেসে বলল, ‘মতলব কী তোমার? নিকিতা প্রিয়র বুকে মুখ লুকাল। প্রিয় বলল, ‘দূরে থাকো নিকিতা।
নিকিতা বলল, ‘ইশ, বয়েই গেছে! আমার হাতে এখন সময় নেই। রেডি হতে হবে। কিছুক্ষণ পরই শুদ্ধ আর আমি বাইরে যাব।
‘কোথায় যাবে?
নিকি হেসে বলল, ‘পেট্রা আপু শুদ্ধর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। আজ।
‘শুদ্ধর জন্মদিনেই না দেখা হলো? আবার আজ কেন?
‘তা তো জানি না।’
‘আচ্ছা।
‘এই, তুমি যাবে?
নিকিতাকে উৎসাহী দেখাল। প্রিয় বলল, ‘না, তোমরা যাও।
—————
প্রিয়র সঙ্গে নিকিতার এখন স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। কিন্তু নিকিতা বোঝে, এর মধ্যে প্রিয়র কোনো ভালোবাসা নেই, প্রিয় অবশ্য নিজ মুখে বলেছেও। ইদানীং প্রিয় সারাক্ষণ খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকে। নিকিতা আজও জানে না কেন প্রিয় হঠাৎ করেই ওর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে এল। কিন্তু এর চেয়ে আগে যখন বন্ধুর মতো ছিল, তখনই ভালো ছিল। অন্তত প্রিয়র মুখে হাসি ছিল।
প্রিয়র পানির পিপাসা লেগে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে দেখল নিকিতা বিছানায় নেই। পানি খেয়ে ঘড়ি দেখল। রাত ৩টা ৪৫ মিনিট বাজে। এত রাতে ও গেল কোথায়? রুম থেকে বের হয়ে আশপাশে কোথাও দেখতে পেল না। তারপর গেল শুদ্ধর রুমে। শুদ্ধ আলাদা রুমে ঘুমানো শুরু করার পর থেকে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না প্রিয়। রাতে দু তিনবার এসে ছেলেটাকে দেখে যায়। শুদ্ধর ঘরে ঢুকে প্রিয়র মনটা কানায় কানায় ভরে গেল। নিকিতা শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। শুদ্ধ যত দিন ওদের কাছে ছিল, শেষের দিকে শুদ্ধ ওকে না, নিকিতাকেই জড়িয়ে ধরে ঘুমাত। বুকভরা ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়।
·
·
·
চলবে...................................................................................