কিছুদিন পর সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে ঠিক হলো। কিন্তু আমি সদ্য নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। অনেক দায়িত্ব, এমন অবস্থায় যাওয়া সম্ভব না। দিতিয়া সবাইকে যেতে বলল। আমি যেহেতু যেতে পারছি না তাই ও থাকবে। আমি বললাম,
“তুমি যাও। আমার একা থাকতে সমস্যা হবে না।
“জানি। কিন্তু তবুও আমি যাব না।”
মা বলল,
“ঠিকই আছে। তুই যাবি না, তোকে একা ফেলে আমরা যাব কীভাবে? দিতিয়া থাকলে নিশ্চিন্তে থাকব।”
আমি বললাম,
“আমার কোনো সমস্যা নাই। থাকলে থাকবে, গেলে যাবে।”
সবাই দলবেঁধে বেড়াতে গেল। দিতিয়া গেল না। প্রথমদিন সব কিছু স্বাভাবিকই ছিল। দ্বিতীয় দিন হসপিটাল থেকে ফিরে দেখি দিতিয়াকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি কি অসুস্থ!”
ও বলল,
“না”
“তো এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন?”
“কী জানি! বাদ দাও, এখন খাবে নাকি পরে?”
“এখনই খাব। তুমি রেডি করো, আমি গোসলটা করে আসি।”
গোসল করে ফিরে এসে দেখি দিতিয়া ড্রইং রুমে নেই। ঘরেও তো ছিল না। গেল কোথায়? রান্নাঘরে যেতেই দেখি রান্নাঘরের ফ্লোরে দিতিয়া পড়ে আছে। ওর কাছে গিয়ে ডাকলাম,
“দিতিয়া এই দিতিয়া?”
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অদ্ভুত মেয়ে একটা! যখন জিজ্ঞেস করলাম অসুস্থ কিনা তখন বলল না। আর এখন ফিট হয়ে পড়ে আছে! গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর আছে কিনা। জ্বর নেই। চুলায় তরকারি দিয়েছিল বোধহয় গরম করার জন্য। পুড়ে গেছে। চুলা নিভিয়ে দিয়ে ওকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলাম। তারপর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গ্লাস থেকে পানি নিয়ে চোখেমুখে ছিটালাম। ও চোখ খুলল। পরক্ষণেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। আমি বললাম,
“এখন কি একটু ভালো লাগছে?”
ও মুখে কিছু বলল না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ওর শরীর কাঁপছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
“দিতিয়া, এই দিতিয়া…তাকাও।”
ও তাকালো। আমি বললাম,
“এত দুর্বল হলে কী করে? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করোনি না?”
ও কিছু বলল না। প্রেসার মেপে দেখলাম প্রেসার অনেক লো। বললাম,
“চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। আমি আসছি।”
রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে করে ভাত নিয়ে এলাম। ওকে বললাম,
“একটু খেয়ে নাও।”
ও তাকিয়ে বলল,
“খাব না।
ওর কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম না। ঠোঁট নাড়ানো দেখে বুঝলাম। আমি বললাম,
“খেতে হবে। না খেয়ে খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে।”
আমি ভাত মেখে ওর মুখের সামনে ধরতেই ও অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমি বললাম,
“তাড়াতাড়ি নাও। তোমাকে খাইয়ে আমি খাব।”
জীবনেও খেত না বোধহয়। আমার হাতে খাওয়ার লোভে খেলো। তারপর ওষুধ খাইয়ে, কম্বল গায়ে দিয়ে বললাম,
“ঘুমিয়ে পড়ো।”
দিতিয়াকে খুব খেয়াল করে দেখে আমার যা মনে হলো, সবাই গ্রামে যাওয়ার পর ও খাওয়াদাওয়া একদম করেনি। একা থাকায় জোর করারও কেউ নেই। এমনকি রাতে খাওয়ার সময় ও যদি বলত ও খেয়েছে আমি সেটাই বিশ্বাস করে নিতাম। এজন্যই ও এত দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি কেমন মানুষ! একটু তো খেয়াল রাখা আমারও উচিত ছিল।
আমি খেয়েদেয়ে শুতে গেলাম। ঘরে ঢুকেই দেখি দিতিয়া কাঁদছে। ও বিছানার বাম পাশে শুয়েছিল, আমি ডান পাশ দিয়ে উঠে ওর মাথার কাছে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী হলো কাঁদছ কেন? কষ্ট হচ্ছে?”
ও হঠাৎ ফুঁসে উঠল,
“আমি তোমাকে বুঝতে পারি না কেন?”
আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“মানে?”
“কখনো বুঝতে পারি না। এই তুমি রেগে যাও, এই তুমি কাছে আসো, আবার দূরে চলে যাও, এই তুমি আবার বকো, এই তুমিই আবার খাইয়ে দাও।”
কাঁদতে কাঁদতে প্রচণ্ড আক্রোশে কথাগুলো বলছিল। অনেকদিনের জমানো রাগ যেন ঝরে পড়ছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
“শান্ত হও। এত বুঝতে হবে না, এখন ঘুমাও। ঘুম খুব দরকার তোমার।” হঠাৎ দিতিয়া উঠে বসল। আমার শার্টের কলার খাঁমচে ধরে বলল,
“কীভাবে ঘুমাব আমি? তুমি কোনোদিন আমাকে আদর করেছ? সেই কবে এসেছ! একসাথে ঘুমাচ্ছি প্রতিদিন…একবারো ছুঁয়েছ আমাকে? কেন ছোঁওনি? আমার কি ছোঁয়াচে রোগ আছে? আমি কি ছোঁয়াচে?”
আমার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। মেয়ে বলছে কী! ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? দিতিয়া আরো রেগে গিয়ে বলল,
“এই খবরদার চোখ বড় করবে না। তোমার বড় বড় চোখ আমি ভয় পাই। সত্যি কথাই তো বলছি। জানো কত ছেলে পাগল ছিল আমার জন্য? আর আমার স্বামী কিনা আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।”
এবার আমি হেসে দিলাম। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“কে বলেছে তুমি ছোঁয়াচে? এই তো ছুঁয়েছি।”
দিতিয়া আমার বুকে মাথা রেখে শান্তি পেল কিন্তু রাগ কমেনি। একই সুরে সে বলে গেল,
“কচু ছুঁয়েছ! এখন আমি অসুস্থ বলে একটু ঢঙ করছ। তুমি কোনোদিনও আমাকে আদর করবে না, আমি জানি।
“তাই? কীভাবে জানলে?”
“জানি আমি। অনেকদিন তোমার সাথে শুয়েছি। তুমি একটুও আদর করোনি। আমার প্রতি তোমার কোনো আকর্ষণ নেই।”
একথা বলেই ও আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। আমি ওর মুখটা তুলে কপালে চুমু দিলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে। ৭ বছর আমি কীভাবে থেকেছি তুমি জানো? প্রতিদিন মনে হতো তুমি যেভাবে না বলে গিয়েছিলে সেভাবে না বলেই চলে আসবে। কিন্তু তুমি আসতে না। সবার মধ্যেও আমি একা ছিলাম। প্রতিটা রাত আমি কাঁদতাম। অনন্যার দুটো বাবু ছিল, আর আমার একটাও ছিল না। থাকবে কীভাবে? বাবু কি আকাশ থেকে লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে পড়বে? আমার স্বামী তো আমার শরীরটাকে ঘৃণা করে। তাই কোনোদিন এই শরীরটাতে একটু নজরও বোলায়নি।
ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রথম আমি ওর জন্য ভালোবাসা অনুভব করেছিলাম। আসলেই ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়। ১ মিনিটও লাগে না। ওর জন্য আমার যা হলো তা সত্যিকারের ভালোবাসা, কোনো মায়া না। ওর ধৈর্যের কাছে হার মেনেছিলাম। সত্যি কোনোদিন এভাবে ভেবে দেখিনি। কীভাবে সম্ভব কোনো আশা ছাড়া কারো জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করা! আমি ওকে শুইয়ে দেয়ার জন্য মাথাটা আমার বুক থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলাম। ও এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“নাহ, আমি তোমাকে এবার যেতে দেব না।”
“আমি যাচ্ছি না। আমি শোব, আর তোমারও ঘুম দরকার তাই…”
ও আমাকে থামিয়ে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম তোমার বুকে আরেকটু থাকব। তুমি এমন করো কেন? আমি কি অনেক ভারী?”
ওর অসংলগ্ন কথাবার্তায় একদিকে যেমন মজা লাগছিল, অন্যদিকে তেমন খারাপও লাগছিল। কতটা কষ্ট নিয়েছিল মেয়েটা। আজ ও অসুস্থ না হলে ওর মতো মেয়ে হয়তো এভাবে জ্বলে উঠত না। সারাজীবনেও হয়তো ওর প্রতি ভালোবাসাটা আসত না আমার। আমি ওকে সরাতে পারলাম না তাই ওকে নিয়েই শুয়ে পড়লাম। তারপর ওকে আমার বুকের ওপর তুলে নিলাম। ওর পা আমার পায়ের ওপর ওর পুরো শরীর আমার শরীরের ওপর। ওর মাথাটা আমার বুকের ওপর রেখে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“এবার খুশি?”
ও চোখ তুলে আমার চোখের দিকে চাইল। আমিও চেয়ে থাকলাম ওর চোখে। তারপর ও উঁচু হয়ে শাড়ির আঁচলটা বুকের ওপর থেকে সরিয়ে আমার একটা হাত টেনে নিয়ে কোমর ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“একটু আদর করোনা প্লিজ!”
আমার বুকটা এবার কেঁপে উঠল। কতটা কষ্টের পর ওর মতো একটা লাজুক মেয়ে এই কাজটা করতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। আমি ওর আঁচলটা উঠিয়ে দিয়ে ওকে আবার শুইয়ে দিলাম আমার বুকে। তারপর ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“তুমি এখন খুব অসুস্থ। আগে সুস্থ হও, তারপর আদর করব। অনেক অনেক আদর করব। এত আদর করব যে তুমি সারাজীবন মনে রাখবে।”
“ঠিক আছে, আমি তো তোমার সব কথাই শুনি। একদিন কাঁদতে নিষেধ করেছিলে, তোমার কষ্ট হয় বলে… আমি শত কষ্ট হলেও আর কাঁদিনি।”
“আমি জানি তো তুমি একটা লক্ষ্মী মেয়ে! এখন ঘুমাও।”
তারপর ওর কান্না থেমে গিয়েছিল। চুপচাপ শুয়ে ছিল। হঠাৎ চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বুকে অনেক আরাম!”
“হুম! সেজন্যই তো ঘুম আসবে এখন তোমার।”
আমি ওর মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আবার তাকালো, এবার সরাসরি আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল। এর বেশি তো ওর পক্ষে সম্ভব না। আমি বুঝতে পেরে হেসে দুহাতে ওর গাল ধরে একদম কাছে টেনে আনলাম। ও এবার আমার চোখের দিকে তাকালো, তারপর আবার ঠোঁটের দিকে। তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। ওর নিঃশ্বাস আমার নিঃশ্বাসে মিশে গিয়েছিল। ও অপেক্ষা করছিল, ওর ঠোঁট কাঁপছিল, অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। আমি তবুও ইচ্ছে করেই ওকে অপেক্ষা করাচ্ছিলাম। ওর ধৈর্য দেখছিলাম। শেষে ও চোখ মেলে তাকালো আর ওর ধৈর্যটা চোখ ফেটে জল হয়ে বেরিয়ে এল। ঠিক তখন আমি ওর ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলাম! তারপর ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি ঝুঁকে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেলাম। অপেক্ষা করানোর কষ্টটা পুরোপুরি পুষিয়ে দিলাম। তারপর ওর পাশে শুয়ে ওকে কোলের ভেতর নিয়ে বললাম,
“এবার ঘুমাও।”
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। আমার শরীর ও মন দুটোই ওকে চাইছিল। দিতিয়া তো চাইছিলই কিন্তু আমি কিছু সুন্দর মুহূর্ত দিতিয়াকে দেয়ার জন্যই আর কিছু করলাম না। দিতিয়ার এখন মাথা ঠিক নেই। অসুস্থতা, রাগ সবকিছু মিলিয়ে ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। আগে ঘোর কাটুক। সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ওকে ওর প্রাপ্য দেব যার জন্য ওর এত প্ৰতীক্ষা!
কখন ঘুমিয়েছি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে পেলাম। সবসময় ও আমার আগে উঠেছে, কখন উঠে যেত টের পেতাম না, তাই ওর ঘুমন্ত মুখটা কখনো দেখিনি। আজ বুঝলাম এই মুখটাতেও অনেক মায়া। যে মায়াজালে আমি দ্বিতীয়বার পড়তে চাইনি সে মায়াজালে আমি নিজের অজান্তেই কখন যেন পড়ে গিয়েছি!
·
·
·
চলবে..........................................................................