সেই সময় আমি সবার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যারা আমার কথা ভাবেনি, আমিও তাদের কথা আর কোনোদিনও ভাবব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি। নিজের মা-বাবা না হলেও তো জন্মের পর থেকে তাদের আদরে, যত্নে বড় হয়েছি। অনেক ঋণ! অনেক মায়া!
মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি, আমার সব ইচ্ছে মরে গিয়েছিল, কিন্তু মনে হয়েছে যদি আমি মায়ের সাথে কথা বলি তাহলে মায়ের হয়তো ভালো লাগবে। তাই ইউএসএ যাওয়ার সাড়ে আট মাস পরে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। ফোনটা মা ধরেছিল। আমি হ্যালো বলতেই মা তার স্বভাববশত কেঁদে ফেলেছিল। আমি বললাম,
“শুধু কাঁদবে নাকি একটু কথা বলবে?”
বুঝতে পারছিলাম মা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। কোনোরকমে বলেছিল,
“তুই কোথায় বাবা?”
“আমি আমেরিকায়।”
“ওখানে কেন? আর যাবিই যদি একবার কি বলে যেতে পারতি না? তুই কি বুঝিস না সারাক্ষণ তোর জন্য চিন্তা করার মতো কেউ কেউ এখনো আছে?”
এক নিঃশ্বাসে আরো কত কথাই না বলেছিল মা! তারপর যখন আমার সুযোগ এসেছিল তখন অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুজিয়ে মাফ চেয়ে নিয়েছিলাম। একসময় মা বলল,
“আমি দোষ করেছিলাম, দিতিয়া তো কোনো দোষ করেনি। একটাবার ওর সাথে কথা বল প্লিজ।”
“ইচ্ছে করছে না মা, অন্য কোনো একদিন বলব।”
“নাহ তোকে এখনই বলতে হবে।”
জোর করে দিতিয়াকে ডেকে ধরিয়ে দিল। বোধহয় বলেওনি যে আমি ফোন করেছি, সেটা দিতিয়ার বিস্মিত কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পেরেছিলাম। ও হ্যালো বলতেই আমি বললাম,
“হ্যালো। কেমন আছ?”
ও বেশ অনেকক্ষণ চুপ করেছিল। আমি বললাম, “হ্যালো, আছ?”
ও বিস্ময় কাটিয়ে শুধু একটা কথা বলতে পেরেছিল,
“তুমি!”
তারপর আবার চুপ। আমি বললাম,
“জানতে চাইবে না আমি কোথায় আছি?”
“মায়ের কাছ থেকে জেনে নেবো।”
“কেন? আগে প্রশ্ন করলে শুধু বকা দিতাম তাই?”
“না, মায়ের কাছ থেকে তো জানতে পারব। এখন অন্য কথা বলো…তোমার শরীর ভালো আছে?”
“হুম, খুব ভালো। তোমার?”
“ভালো।”
কেমন যেন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওরও বোধহয় একই অবস্থা। শেষমেষ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা খুঁজে পেয়ে বলেছিলাম,
“কষ্ট ছাড়া কিছুই তো পেলে না আমাকে বিয়ে করে। তুমি এখনো পড়ে আছ কেন ওবাড়িতে? ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। নতুন সংসার পাততে পারো।”
ও হেসেছিল। বলেছিল,
“তুমি না থাকলেও এখানে বাবা-মা আর অন্য সবাই আছে। যা পাইনি তা পাওয়ার আশা করিও না। যা পেয়েছি তাই নিয়েই ভালো আছি। এ সম্পর্ক আমি কখনো ছিঁড়ব না। তুমি যদি কাউকে বিয়ে করতে চাও তাহলে অবশ্য অন্য কথা। তুমি যা চাইবে তাই হবে।”
—————
তারপর থেকে আমি সপ্তাহে একবার ফোন করতাম মাকে। অন্যদের সাথে কথা বলতাম অল্পস্বল্প। দিতিয়ার সাথে কেমন আছ ভালো আছি এই পর্যন্তই কথা হতো। তবু মেয়েটা কোন আশায় পড়ে আছে কে জানে! আজও অবাক লাগে। সাত বছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসি। এই সাতটা বছর আমি ওখানে কীভাবে থেকেছি তা শুধু আমি জানি। যন্ত্রমানব হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো অনুভূতি ছিল না। অন্য দেশ থেকে আসা বন্ধু, বাংলাদেশ থেকে আসা বন্ধু সবাইকে দেখতাম দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে থাকতে। কেউ দেশে ফেলে আসা নতুন বউয়ের জন্য কষ্ট পেত। কেউ সদ্য জন্মানো নিজের সন্তানকে দেখতে না পেয়ে কষ্ট পেত। কেউ মায়ের জন্য কষ্ট পেত। কেউ সারা সপ্তাহের আয় উইকেন্ডে বার ক্যাসিনোতে গিয়ে উড়িয়ে আসত। আমার কেন জানি কোনো কিছুই গায়ে লাগত না। পড়াশোনা ঠিকমতোই করেছিলাম আমি। যখন শেষ হলো তখন আর ওখানে থাকতে ইচ্ছে হয়নি। সবার ওপর থেকে রাগ নেমে গিয়েছিল। সত্যি বলতে সব ঘাই শুকায়, সময় আর সুযোগ দিতে হয় শুধু।
যেভাবে কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিলাম সেভাবেই কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম। আমাকে দেখে মোনা সবার আগে ছুটে এসেছিল। খুশি যেন ওর উপচে পড়ছিল। হৈচৈ শুনে মা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এসে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। এতবছর পর মাকে কাঁদতে দেখে অনুভব করলাম এতদিন মায়ের জন্য কষ্ট হয়েছে আমার। কিন্তু বুঝতে পারিনি। আমি বলেছিলাম,
“এর চেয়ে বোধহয় না এলেই ভালো হতো।”
অতঃপর মায়ের কান্নাকাটি পর্ব শেষ হলো। তখন সৌরভ এসে বলল,
“ভাই আমি কি একটু চান্স পাব?”
সৌরভকে জড়িয়ে ধরতেই ও আমাকে অবাক করে দিয়ে কেঁদে ফেলল। বলল,
“কী করে থাকলি এতগুলো বছর আমাদের ছাড়া? তোর সাথে বড় হয়েছি অথচ বুঝিনি তুই এতটা নিষ্ঠুর!”
কী বলব? চুপ করেই ছিলাম। অনন্যা পাশেই দাঁড়িয়ে হাসছিল। আর বাচ্চাপার্টি অবাক হয়ে দেখছিল ‘এ আবার কে’ টাইপ দৃষ্টি দিয়ে। দূরে দাঁড়িয়ে দিতিয়া সবটাই দেখছিল। ওর চোখেমুখে সে যে কী অভিব্যক্তি ছিল তা লেখার ভাষা আমার নেই। পরীক্ষায় সবসময় ফেল করা বাচ্চাটা যদি কোনোভাবে একশ তে একশ পেয়ে যায় তাহলে তার অভিব্যক্তি যেমন হয় অনেকটা ওরকম ছিল। দূর থেকে দেখেই বুঝেছিলাম ওর হার্টবিট তখন কোন পর্যায়ে! সন্ধ্যায় বাবার সাথেও দেখা হলো। বাবা শুধু একটা কথাই বলল,
“তুই দিতিয়ার সাথে খুব অন্যায় করেছিস, খুব।”
—————
রাতে শুয়ে ছিলাম, ঘুম আসছিল না। জায়গা বদলের কারনেও হতে পারে। আর এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে দূরে চলে যাওয়ার অনুশোচনায়ও হতে পারে। দিতিয়া ঘরে এসে বলল,
“আমি কি আলাদা বিছানা করব?”
“কেন?”
“তোমার যদি কোনো সমস্যা হয় আমি পাশে শুলে, তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“তুমি যদি ভাবো আমি তোমার জন্য চলে গিয়েছিলাম তাহলে ভুল ভাবছ। আমি নিজেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম সবকিছু থেকে।”
“আমি কিছুই ভাবছি না। তুমি যা ভালো বুঝেছ করেছ। আমার কিছু বলার নেই।”
“আচ্ছা, অন্য কোথাও শুতে হবে না। এখানেই শোও যদি তোমার কোনো সমস্যা না হয়।”
ও আমার পাশে শুয়ে পড়েছিল কিন্তু উল্টো দিকে ফিরে। আমার ঘুম আসছিল না। হঠাৎ মনে হলো দিতিয়া কাঁদছে। শব্দ হচ্ছে না, কিন্তু গা কাঁপছে। আমি আগের মতো আর ওর সাথে সহজ হয়ে ওর কান্না থামাতে পারিনি। ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম। এভাবেই চলতে থাকল।
নীরব ইশতিয়াক
২৭ এপ্রিল, ২০১৬
·
·
·
চলবে........................................................................