অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ১৭ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          শুনসান নীরবতায় মোড়ানো কক্ষের চারপাশ। অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে আছে ঘরটা। ফ্লোরের সবটা জুড়ে কাঁচের শত শত খণ্ডাংশ অবলীলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নৈঃশব্দ্যের মাঝে শোনা যাচ্ছে কেবল ফুঁপিয়ে কান্নার মৃদু আওয়াজ। নিঃসঙ্গ রোজ একা একা ফ্লোরে বসে আছে। মাথাটা ঠেকেছে আধ ভাঙ্গা সেন্টার টেবিলের উপর। শরীরের কিছু অংশে কাঁটা ছেঁড়ার দাগ স্পষ্ট। হাত দুটো রক্তাক্ত। 

হান্টস প্যালেসের রাজকীয় ভাবে সজ্জিত ড্রয়িং রুমের সোফায় চিন্তিত মুখে বসে আছেন রাইমা হান্টস এবং রবিন হান্টস। মেয়ের মনের অবস্থা বুঝলেও কীভাবে যেন সবটা হাতের বাইরে চলে গেছে। সবটা অদ্ভুতভাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে এখন। এদিকে ছেলের দেখা নেই। আজ তো প্যারিসে ব্যাক করার কথা ছিল। কিন্তু কই? ঘরের ভেতরে কাউকে যেতে দিচ্ছে না রোজ। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম রবিন হান্টসের। ওনাকে হাইপার হতে দেখে কাঁধে হাত রাখলেন রাইমা হান্টস। আশ্বাস দিলেন,

"এতো চিন্তা করো না তুমি। বাবু চলে আসবে। দেখবে ও সবটা ঠিক করে দিবে। এভাবে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।"

"কী ঠিক করবে? ভালোবাসা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বস্তু নয়। মেয়েটা আমার ভেতর থেকে মরে যাচ্ছে রাইমা।"

"বিয়ে ছেলেখেলা নয়। একপক্ষের কথায় কখনো কিছু হয় না। রোজ'ই হবে ভ্লাডিমির ইম্পায়ারের প্রিন্সেস।"

"রৌহিশের মাথার উপর তুলে দিবে নাকি? অবশ্য তোমরা, মা, ছেলে এটা করতে পারদর্শী আছ। তবে কার সাথে লাগতে চাইছ সেটা ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু। দিন শেষে নিজেদের অস্তিত্ব ও খুঁজে পাবে না।"

এমন কথায় মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠল রাইমা হান্টসের। গম্ভীর নারী কণ্ঠে বললেন, "তুমি ভুলে যেও না আমার ছেলে 'আলড্রিক ইম্পায়ারের' প্রিন্স। সে রৌহিশের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমার সহ পুরো ইম্পায়ারের শক্তি আমার ছেলে।"

"তোমার ছেলে? আমার কেউ না? হাহ্!" কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠস্বর রবিন হান্টসের অথচ চোখ দু'টোতে প্রশ্নাত্মক চাহনি স্পষ্ট।  

উত্তরে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলেন না রাইমা হান্টস। বুকচিরে বেরিয়ে এলো ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস। ছেলে-মেয়ে দুটোর কষ্ট যে মা নামক নারীর সহ্য হয় না। তাই তো তাদের সবরকম কাজে সঙ্গ দেন। হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ। বিবেকবোধ আজকাল সিকিতে তুলে বিক্রি করেছেন বোধহয়। রয়ে সয়ে জবাব দিলেন, 

"আমাদের ছেলে, আমাদের বাবু।"

উত্তরে কেবল তাচ্ছিল্য হাসলেন রবিন হান্টস মুখে কিছুই বললেন না। তৎক্ষণাৎ উপর থেকে ভেসে এলো রোজের আর্তনাদ। সাথে ভাংচুরের বিকট শব্দ। মেয়েটা কীভাবে কাঁদছে! রাইমা হান্টস এর চোখের কোণে জল জমল। সেকেণ্ডের ব্যবধানে গড়িয়েও পড়ল। হঠাৎ করেই রবিন হান্টসের ফোনটা টুংটাং শব্দে বেজে ওঠে। মেসেজ নোটিফিকেশন চেক দিতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন,

"এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। একঘণ্টার মাঝেই ফ্লাইট ল্যাণ্ড করবে। অর্ধেক গার্ডস থাকছে এখানে। কোনো প্রয়োজনে ওদের ইনফর্ম করবে। আমার কাছে বাবুর সেফটি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।" মুখের কথা শেষ করে গটগট পায়ে সামনে অগ্রসর হলেন। 

"আকাশসম ভালোবাসা মনে লালন করেও বাবা, ছেলের মাঝে এতো দুরত্ব কেন?"

রাইমা হান্টসের প্রশ্নটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই না চাইতেও ওনার চলন্ত পদ যুগল থেমে গেল। মৃদু হাসলেন অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

"সবটাই তোমার নিজ হাতে সৃষ্টি করা দুরত্ব। এই দুরত্ব মিটবার নয়।"

আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন। দাঁত খিচে আঁখি জোড়া বুঁজে সোফায় মাথা এলিয়ে দিলেন রাইমা হান্টস। ছোট্ট একটা কার্যসিদ্ধি, ছোট্ট একটা ভুল অথচ এক জীবনের দুরত্ব। নিজের প্রাণ দিয়ে দিলেও যে এই পাপ মোছা যাবে না। মানুষের জীবন এমন অদ্ভুত কেন? দুটো গল্প নিজের মাঝে লালন করে বেঁচে থাকে। একটা সবাইকে শোনায় তো আরেকটা লুকায়। জীবনের সমীকরণ বড্ড জটিল। সবটা মিলেও যেন কোথাও অমিল রয়ে যায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে স্বধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল। অনুতপ্তে জর্জরিত আত্মার আর্তচিৎকার নিঃশব্দে ঝরে চলল আপনমনে। এই থেকে আমৃত্যু মুক্তি নেই।

—————

ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে। মধ্যরাতে তন্ময়ীর নেত্রে ঘুম নেই। শরীরখানা বিছানা স্পর্শ করলেও একদণ্ড শান্তি পাচ্ছে না। মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। হঠাৎ করেই এমনটা অনুভব করার কারণ ও উদঘাটন করতে পারেনি। কেবল মনে হচ্ছে ওর জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। যা ওকে ওর অবস্থান চিহ্নিত করে দিবে। ভাবনার দোলাচালে একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে ও উঠে বসল। ব্যালকনির দিকে হাঁটা ধরল। ঘরের মাঝে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ব্যালকনির একপাশে পেতে রাখা ডিভানে নিজের অবস্থান গাড়ল। রাতের আকাশে শশীর অস্তিত্ব থেকে থাকলেও এখান থেকে তার ছিটেফোঁটাও দেখা দুষ্কর। হাঁটু জোড়া ভাঁজ করে সেথায় মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইল মেয়েটা। পেরোল কিয়ৎসময়। হঠাৎ করেই ঝিরিঝিরি করে বয়ে চলা পবনের সাথেই অদূর থেকে ভেসে এলো গিটারের সুর। পরপরই শোনা গেল ভাঙা পুরুষালী গলায় গাওয়া পছন্দের ইংরেজি গানের কিছু লাইন,

He's a villain 
By the devils law
He's a killer just for 
Funny, fun, fun, fun

The man's a snitch
And unpredictable 

He's got no conscience 
He got none, none, none, none

Oh , I know, should've 
Let go, but no

Cause he's a bad boy 
With a tainted heart 
And even I know 
This ain't smart 

But mama 
I'm in love with a criminal 
And this type of love isn't rational 
It's physical 

Mama please don't cry 
I'll be alright 
All reason aside 
I just can't deny
Love the guy

পুরুষালি কণ্ঠে গানটার গাম্ভীর্য কয়েক গুণ বেড়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পুরোটা শুনল তন্ময়ী। আস্তে ধীরে গানের সুর মিলিয়ে গেল বেনামি হাওয়ায়। এতক্ষণে মন, মস্তিষ্ক সতেজ লাগছে তন্ময়ীর তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সুরের উৎস খোঁজার ফুরসৎ অবধি পেলো না ও। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এলো ফোনের কর্কশ ধ্বনি। প্রথমবার ইচ্ছে করেই ধরল না। ঠাঁয় বসে রইল। কিন্তু দ্বিতীয়বার কল আসতেই আর বসে থাকতে পারল না। শ্লথগতিতে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। ফোনটা ওঠাতেই মায়ের নাম্বারটা চক্ষুগোচর হলো। এতো রাতে মা কেন কল করেছে? সবটা ঠিক আছে তো? ভাবনার মাঝেই রিসিভ করেছে কলটা। ওপাশ থেকে ভাসমান হলো আরাধ্যা শেখের ক্রন্দনরত ভঙ্গুর কণ্ঠস্বর,  

"তনু তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। অবস্থা ভালো না। ওও তনু কোথায় তুমি? আমার পৃথিবী শূন্য লাগছে। আমার আশেপাশের আলো গুলো বেরঙিন হয়ে যাচ্ছে তনু। কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি? ভুল মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি আমি কয়জনম ধরে পাব মা?"

কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন উনি। ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে ছোট্ট তন্ময় কেঁদে কুটে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কে কাকে দেখবে? তন্ময়ীর বুকটা যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে উঠল। চিন চিন করে মন জ্বালা করা একধরণের ব্যথা শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে চলল। বেশি কিছু বলতে পারল না মেয়েটা। কেবল অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,

"তোমার পৃথিবী আবার আলোকিত হবে মা। আমি আসছি। বাবা তার আম্মাকে ভুলে যেতে পারে না।"

কল কেটে ওই অবস্থাতেই কোনোরকমে বেড সাইড বক্সের উপর থেকে নিজের ব্যাগটা, ঘুমন্ত স্নোবেল, বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগ এবং হেলমেট নিয়ে দৌড় লাগাল। দরজার নিকট আসতেই কাঁচ ভাঙার আওয়াজ শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভেসে এলো। থেমে গেল ব্যাকুল পা দুটো। পিছু ফিরে তাকাল। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আধভাঙা আয়নার দিকে। যেখানে রক্ত দিয়ে লেখা,

"ডোন্ট গো। আ কার্জ অ্যাওয়েটস ইউ।"

লেখাটা পড়ে শেষ করতেই ঝনঝন শব্দ তুলে আয়নার অবশিষ্ট কাঁচটা ভেঙে ওর দিকে ছুটে এলো। ভয়ে তন্ময়ী হাত জোড়া উঁচু করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেই কাঁচের টুকরো গুলো শূন্যেই ভাসমান হয়ে স্থির হয়ে গেল। যেন ওর হাতের আদেশেই থেমেছে ওগুলো। পরক্ষণেই ঝুরঝুর করে ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল তন্ময়ীর। তবে সেটা এই মুহূর্তে ওকে কাবু করতে অপারগ। মন, মস্তিষ্কে 'বাবা' শব্দটা ছাড়া আর কোনোকিছুর আনাগোনা নেই। আর দাঁড়াল না। উল্টো ঘুরে ঝড়ের গতিতে নিচে নেমে গেল। যত সামনে এগোচ্ছে ততই বাড়িটার প্রতি অদ্ভুত এক টান অনুভব করছে ও। মনে হচ্ছে ওর খুব কাছের কিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পরিচিত একটা সুবাস নাকে ভেসে আসছে। তবে ওটা কিসের সুবাস সেটাই মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতে পারছে না। অকস্মাৎ খুব কান্না পাচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু নিজেকে ঠিক সামলিয়ে নিলো। বাড়ির আঙিনায় এসে দ্রুত হাতে সব ঠিকঠাক করে বাইকে উঠে বসল। কী যেন ভেবে একবার দোতলার দিকে তাকাল। দোতলার সামনের রুমের জানালা ঘেঁষে একটা অবয়ব দৃশ্যমান। তবে সবটা আঁধারে ডুবে থাকায় অস্পষ্ট। তন্ময়ী কেবল সবটা দেখল, অদৃশ্য একটা টান অনুভব করল। বড়ো একটা শ্বাস ফেলে ছুটে চলল নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে ও আসতেই মেইন গেটটা নিজ থেকে খুলে গেল। আজ অনেক কিছুই বুঝল, অনুভব করল তন্ময়ী। তবে আফসোস আরেকটু ঘেঁটে সাক্ষাতের সুযোগটা হলো না। তবে শিঘ্রই হবে। হ্যাঁ, তন্ময়ী চাইলে ঠিক হবে। 

—————

প্যারিস সহ সমগ্র ফ্রান্সের প্রধান, বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে 'শার্ল দ্য গোল বিমানবন্দর'। যেটা বর্তমানে শতাধিক গার্ডসের দ্বারা ঘেরাওকৃত। কিছুক্ষণ আগেই ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। সবাই তাদের প্রিন্সের মুখ দর্শনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনে চলেছে বিগত একঘণ্টা ধরে। হঠাৎ করেই চারপাশে বাতাসের ঘনত্ব বাড়ল। প্রকৃতি গুমোট রুপ ধারণ করল। লাল, কালোর সংমিশ্রণে একটা আবরণ আশেপাশের সবকিছু গ্রাস করে নিলো। প্রিন্সের আগাম বার্তা পেতেই সকলের মাঝে বিরাজমান গুঞ্জন থেমে গেল। 

উপস্থিত সকলে একবুক আশা, উৎকণ্ঠা নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু সময়ের ব্যবধানেই উঁচু থাকা দৃষ্টি নেমে ফ্লোরে নিবদ্ধ হলো। তবুও একজোড়া চোখ আড়দৃষ্টি তাক করে ফাঁকফোকর দিয়ে সামনে তাকাল। চোখের পর্দায় ভাসল ব্ল্যাক, হোয়াইট কম্বিনেশনে নিজেকে আচ্ছাদিত করা এক যুবক। যার চারপাশে কম করে হলেও বিশজন গার্ডস। ব্ল্যাক স্যুটের মাঝ থেকে হোয়াইট শার্টটা উঁকি দিচ্ছে। চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস। ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুলগুলো জেল দিয়ে খাড়া করে রাখা। ভেইনি হাতে পাটেক ফিলিপ ব্র্যান্ডের ওয়াচটা জ্বলজ্বল করছে। মুখের বাম পাশের কালো কুচকুচে তিলটা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। পুরুষালি সৌন্দর্যে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেল ওনার। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। বিড়বিড় করে আওড়াল,

"প্রিন্স ডুরান্ড জ্যাইন রোনিত। "

—————

যামিনীর শেষ প্রহর। হসপিটালের করিডোরে উদাস চিত্তে বসে আছে তন্ময়ী। হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ অথচ থরথর করে কাঁপছে। মস্তিষ্কে অদ্ভুত এক যন্ত্রণার স্রোত বয়ে চলেছে। দৃষ্টি নিবদ্ধ ফ্লোরে। পাশেই চুপচাপ বসে আছেন আরাধ্যা শেখ। ওনার কোলে ঘুমাচ্ছে ছোট্ট তন্ময়। বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে অবশেষে ঘন্টা খানেক আগে ঘুমিয়েছে। ওকে ঘুম পাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আরাধ্যা শেখকে। স্নোবেল পাশের চেয়ারে শুয়ে ঝিমুচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ, শেখ সাদমানের অপারেশন ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন আশংকা মুক্ত।একটা হার্টের ধমনীতে ৭৫% ব্লকেজ থাকায় রিং পরানো হয়েছে। প্রায় আধাঘণ্টা আগে ওনাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ডক্টর, নার্সের অবজারভেশনে আছেন।

তন্ময়ী নিউজটা শোনার একঘণ্টার মাঝেই হসপিটালে উপস্থিত হয়েছে। আরাধ‌্যা শেখের সাথে প্রয়োজনীয় কথপোকথন শেষ করে সেই তখন থেকেই এভাবে বসে আছে। কী চলছে মনের মাঝে কে জানে? আরাধ্যা শেখ ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ নীরবে পর্যবেক্ষণ করলেন অতঃপর বললেন,

"তোমার ডক্টর দেখানো উচিত তনু। হেল্থ কন্ডিশন ভালো লাগছে না সোনা। আমার সাথে চলো।"

উনি কথাটা বললেও অপরপক্ষ নির্লিপ্ত। যেন কিছুই শোনেনি। স্থির হয়ে বসে আছে। আরাধ্যা শেখ সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েকে আজ একটু অদ্ভুত লাগল বৈকি!

"ডক্টর মনের অসুখ সারতে পারবে তো মা?"

মেয়ের করা প্রশ্নে কিছু সময়ের জন্য থমকালেন উনি। তন্ময়ী এতক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে ওনার দিকে চাইল। চাহনি মৃত। নেই কোনো প্রাণ আছে শুধু একবুক হাহাকার, বেদনা, ঘৃণা, সংশয়। মেয়ের মনোভাব আরাধ্যা শেখ ঠিক বুঝলেন না। হাত বাড়িয়ে তন্ময়ীর ডান হাতটা ছুঁয়ে দিলেন। মায়ের স্পর্শে মুষ্টিবদ্ধ হাতটা খুলে গেল। 

"কী হয়েছে সোনা? তোমাকে কি নিজের অজান্তে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? একটাবার ক্ষমা যায় না এই অভাগীকে? তোমাদের ভালো করতে এসে আমি কি শুধু খারাপ'ই করে গেলাম সোনা?"

"তুমি বেস্ট মা। তোমার মতো কয়জন হতে পারে মা? সবাই যে নিজের স্বার্থ খোঁজে মা। তোমার মতো নিজের সবটা দিয়ে সবাই আগলিয়ে রাখতে পারে না।"

মেয়ের এমন কথায় আরাধ্যা শেখের চোখের কার্নিশ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ল। তন্ময়ীও ম্লান মুখে ক্ষীণ হাসল। মা, মেয়ের সুন্দর মুহূর্ত টুকুর খুশি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে ওখানে উপস্থিত হলো একজন নার্স। আরাধ্যা শেখের উদ্দেশ্যে বললেন,

"ম্যাম, স্যারের জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা সকালে ওনার সাথে দেখা করতে পারবেন।"

সুসংবাদ টা জানিয়েই চলে গেল নার্স। তময়ী মুচকি হাসল, আরাধ্যা শেখ এবার খুশিতে কেঁদেই দিলেন। দু'জনে সমস্বরে পড়ল, "আলহামদুলিল্লাহ।"

—————

কেবিনে অর্ধচেতন হয়ে ঘুমিয়ে আছেন শেখ সাদমান। এখনো চোখজোড়া মেলে তাকাননি। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাবধানে ওনার পাশে ভেসে উঠল একটা অবয়ব। অসুস্থ শেখ সাদমানের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলেন। গুনগুনিয়ে কাঁদছেন আর অস্পষ্টভাবে কিছু একটা বলছেন।পেরোল কিয়ৎসময়। মস্তিষ্কে কিছু বিষাক্ত স্মৃতি হানা দিতেই ওইভাবেই কর্কশ কণ্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

"বিট্রেয়ার!"

শব্দটা ভীষণ আঘাত হানল মস্তিষ্কে। শান্তির নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাল। একটু সময় নিয়ে আঁখি জোড়া খুলে তাকালেন শেখ সাদমান। চারপাশে সাধ্যমতো কোনোরকমে নজর বোলালেন। কিন্তু না কোথাও কেউ নেই। তাহলে ওটা কী ওনার মনের ভ্রম ছিল? অসুস্থ বলেই হয়তো এমনটা হচ্ছে। মনকে বোঝালেও তবুও কোথাও একটা কিন্তু রয়ে গেল। নাকি উনি যেটা ভাবছেন সেটাই? হয়তো! হয়তো না! কে জানে সামনে কী ঘটতে চলেছে? অন্তর ভয়ে ভীত হলো। তবে উনি নিজের দেওয়া কথাতে অটল। যা হবে দেখা যাবে।

—————

অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমের ফ্লোরে পড়ে আছে নির্জীব দেহখানা। কোনো নড়াচড়া নেই। প্রাণ আছে কিনা বোঝা দুষ্কর। তৎক্ষণাৎ মৃদু শব্দ তুলে রুমের দরজাটা খুলে গেল। রুম জুড়ে বয়ে গেল হাড়হিম করা দমকা হাওয়া। শিরশির করে উঠল শরীর। ঈষৎ নড়ল কায়া। নাসারন্ধ্রে পরিচিত একটা ঘ্রাণ ভেসে আসতেই রোজ অস্ফুট স্বরে আওড়াল, "ভাইয়া!"

শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই নিজেকে কারোর বাহুডোরে অনুভব করল এবং পরপরই নরম বিছানায়। রুমের ড্রিম লাইটটা জ্বলে উঠল। আবছা আলোয় ঘরটা আরও বেশি আঁধারে নিমজ্জিত হলো। রোজ পিটপিট করে ফুলো রক্তিম নেত্র দুটো খুলে তাকাল। চোখের পর্দায় ভাসল একটা পরিচিত মুখ। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মানুষ, যার কাছে ওর প্রায়োরিটি সবার ঊর্ধ্বে। ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা, 

"ভাইয়া, রৌহিশ আর আমার নেই।"

ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল রোজ। মাথার চুলগুলো বারবার অবস্থান পরিবর্তন করছে পুরুষালি হাতের স্পর্শে। 

"তোর শরীরের এই অবস্থা কেন রেড রোজ?" গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বরে আরও ভারী হলো ঘরের নিস্তব্ধ পরিবেশ। কান্না বাড়ল মেয়েটার। আস্তে করে ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো,

"আমি ভালো নেই ভাইয়া।"

"ওকে চায় তোর?"

"হুঁ।"

"লাভ নাকি ইমোশন?"

"পিওর লাভ।"

"ওকে ডান।"

"তুমি বেস্ট ভাইয়া। লাভ ইউ।"

"লাভ ইউ ঠু। মম'কে পাঠিয়ে দিচ্ছি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রেস্ট নে।"

"আচ্ছা।"

জবাব পেতেই বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল জ্যাইন। এতক্ষণে ভাইয়ের দিকে তাকাল রোজ। শরীরে এখনো স্যুট জড়ানো। তারমানে বাসায় মাত্রই ফিরেছে। একটা ঝড়ো বাতাসের সাথে হারিয়ে গেল জ্যাইনের অস্তিত্ব। ব্যথিত শরীর টেনে সোজা হয়ে বসল রোজ। আলগোছে মুচকি হাসল। এতক্ষণে মন, মস্তিষ্কে একটু স্বস্তি মিলল। বিড়বিড় করে ভাঙা গলায় আওড়াল, 

"আই সোয়্যার তুমি আমার না হলে আমি কারোর হতে দিবো না। যা আমার তা কেবল আমার'ই।"

—————

সকাল সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। কেবিনের মাঝে বেডের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়ী। পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছেন আরাধ্যা শেখ। শেখ সাদমান ভালো আছেন এখন। বেডের সাথে বালিশ রেখে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। ছোট্ট তন্ময় বাইরে আছে মিরা এবং ক্লারার সাথে। ওরা দু'জন এসেছে সকালেই। তন্ময়কে ওরাই সামলাচ্ছে। বাচ্চা তো সবকিছুর এত কী আর বোঝে! স্নোবেল ও ওদের কাছেই আছে।

শেখ সাদমান মেয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। বুকটা এখন শীতল। প্রশান্তিতে ছেয়েছে। এতগুলো দিন উনি যে কীভাবে ছিলেন সেটা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। মেয়েকে ছাড়া ওনার একেকটা সেকেন্ড ও এক বছরের সমান। সুখকর অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মস্তিষ্কে একটা কথা উঁকি দিতেই মুখটা শুকিয়ে গেল। মলিন মুখাবয়বে লোচনদ্বয় বুঁজে চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে রইলেন। কিছু একটার হিসাব কষলেন। তবে সমীকরণ মেলাতে ব্যর্থ হলেন। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চোখ দুটো খুললেন না সেভাবেই তন্ময়ীর উদ্দেশ্যে বললেন,

'"একটা কথা রাখবেন আম্মা?"

তন্ময়ী বাবার দিকেই তাকিয়ে ছিল। জবাব দিলো তৎক্ষণাৎ, "বলো বাবা।"

"আমার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই আম্মা। দেখছেন তো সবটা। আপনার জীবন ও মাঝ নদীতে ভাসমান। কেন বলছি এমনটা সময় হলে ঠিক জানতে পারবেন, বুঝতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন। আপনার একটা বিশ্বস্ত আশ্রয়ের প্রয়োজন আম্মা। যেখানে আপনি নিরাপদ থাকবেন। থাকবে না কোনো বিশ্বাসঘাতকতা। তবেই আমার মনের শান্তি মিলবে।"

বাবার এমন কথায় ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল তন্ময়ীর। কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল, "ক্লিয়ারলি সবটা বলো বাবা। তোমার সাথে ধোঁয়াশা শব্দটা যায় না।"

"ভালো একটা পরিবার আপনার জন্য বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছে। রাজি হয়ে যান আম্মা। আপনার খারাপ আমি চাইব না। এতটুকু বিশ্বাস আমার উপর আছে না আপনার?"

অকস্মাৎ ওনার এমন কথায় বজ্রপাত আঘাত হানল রুমটাতে। বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় চমকালেন আরাধ্যা শেখ এবং তন্ময়ী। হতভম্ব হয়ে গেলেন দু'জনে। আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল দুই জোড়া চোখ। আরাধ্যা শেখ মুখের কথাটা বলতেও ভুলে গেছেন। নিজের কানে ভুল শুনলেন না তো? কার মুখে কী শুনছেন? এ কীভাবে সম্ভব? মানুষটা পাগল হলো নাকি? যেই কলিজার টুকরোকে কখনো নিজের দৃষ্টির আড়াল করে না তাকে বিয়ে দিতে চাইছে? তাও এত দ্রুত? ওনার নয়ন জোড়া অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অথচ তন্ময়ী সংস্রবশূন্য। অবাক হলেও ভীষণ শান্ত আনন। নিস্পৃহ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল,

"কার পক্ষ থেকে এসেছে বাবা?"

"ডুবইস আর্থারের পক্ষ থেকে। ওনার ছেলে ডুবইস রৌহিশ রৌনকের জন্য আপনাকে পছন্দ করেছেন।"

শেষের নামটা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই তন্ময়ীর মানসপটে ভাসল একটা গম্ভীর সুদর্শন মুখ। তন্ময়ীর হৃৎস্পন্দন থমকাল। কেমন যেন উদ্ভট একটা অনুভূতি প্রবাহিত হলো শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায়। পর মুহূর্তেই কিছু একটা ভাবল। দন্ত দ্বারা অধর চেপে নিজের হিসাব মেলাল। অধরপল্লবে বক্র হাসির রেশ ছড়াল। অপরদিকে আরও একবার চমকালেন আরাধ্যা শেখ। না এইবার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। উনি মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই সবাইকে আরও একবার চমকে দিয়ে ভেসে এলো অপ্রত্যাশিত উত্তর,

"আমি রাজি।"
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp