খেতে জ্বলে ওঠা আগুনের সোনালি লালচে আলো তীব্রভাবে আকাশ ছুঁতে চায়। শিখা থেকে ছিটকে পড়া ছোট ছোট আগুনের ফোঁটা ফুলকি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কালো ধোঁয়ায় চারপাশটা গাঢ় অন্ধকারে ডুবেছে যেন। অন্ধকার কাটাতে হিমশিম খেতে হয় লণ্ঠনের দুর্বল আলোদের। উচ্চারিত শব্দগুলো পড়তেই নীরবতা নামে হঠাৎ বৃষ্টি নামার মতোই। থমথমে পরিবেশ ভেঙে পরপর চিৎকার পড়ে,
‘ছোটোলোকের বাচ্চা……’
বাক্যের সমাপ্তিও হয় না, এরমধ্যেই রণবীর হিমালয়ের মতন চেয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের বিশাল দেহের পেছনে আড়ালে সুরক্ষিত রেখেছে চেয়ারে বসে থাকা নির্লিপ্ত, নির্বিকারের চূড়ায় থাকা নারীকে। রণবীরের চোখে আগুন, ঠোঁটের ভাঁজ শক্ত। নীরব হুঁশিয়ারিতে অন্যসময় কাজ হলেও এবারে হলো না। রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকা এহসান খানের মাথা ফাঁকা। সে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য প্রায়। তেড়েমেড়ে এগুতে চাইলে —পেছন থেকে কেউ সন্তর্পণে তার কনুই চেপে ধরে। কানের কাছে চাপা কণ্ঠে আর্তনাদের সুরে সতর্ক করে,
‘সাবধান, মালিক! শান্ত হোন। একটু বোঝেন। রাগের মাথায় এমন কাজ কইরেন না যেন পস্তাইতে হয়। মনে রাখেন, ওই চেয়ারে আর খান বাড়ির অযত্নে ফেলা রাখা মাইয়াডা নাই। আগের তপোবর্ণা আর নাই। এখন সে মাতবর বাড়ির বড়ো বউ। রেহতাব মাতবরের বউ। এই পরিচয় ভুইলেন না। দোহাই লাগে। বাড়ি ফিরা বড়ো মালিক, ছোটো মালিকের লগে আলোচনায় বইলে বিহিত করতে পারবেন।’
এহসান সাহেবের চোখ দিয়ে তখন আগুন ঝরছে। রাগান্বিত তার চোখমুখ হলদে আলোয় ভয়ংকর এক দানবের মতোই লাগছে। ক্ষ ত বিক্ষ ত এই দানব যেন হামলা চালাতে প্রস্তুত। তিনি দাঁতে দাঁত পিষে সংযত কণ্ঠে আওড়ান,
‘মাদারচোদের বাচ্চার এতো সাহস হইছে! আমাগো বিপক্ষে যায়। আমারে চ্যালেঞ্জ করে, আমারে!’
ওই ভয়ংকর চোখমুখ দেখে মুখের একচুল পরিবর্তন হয়নি তপোবর্ণার—ভয় পাওয়া বড্ড দূরের বিষয়। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ভা্রী সুন্দর করে। কিঞ্চিৎ হাসেও এবেলায়। হাঁটার তালে ভাঁজে-ভাঁজে দোলে তার কোমল হাতে সাজানো শাড়ির কুঁচিগুলো। পেছনে হালকা বাতাসে উড়ছে আভিজাত্যে মোড়ানো আঁচল। সামনে থেকে রণবীর সরে যেতেই চার কদম এগিয়ে যায় শান্ত গতিতে। রাগে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো রক্তিম হয়ে যাওয়া চোখ দুটোতে চেয়ে বেশ মিষ্টি কণ্ঠে শুধায়,
‘আমার চাচাজান, ভালো আছেন? শরীর ভালো আছে? কত দিন পর দেখলাম আপনাকে! একদম পরিবর্তন হোননি, জানেন? লা—’
এতটুকু বলতেই তপোবর্ণার মিষ্টি হাসিটুকু মুছে যায় ঠোঁট থেকে। ক্রুর চোখে চেয়ে চাপা স্বরে বাদবাকি কথাটুকু বলে ফেলে,
‘দুশ্চরিত্র, লাফাঙ্গাদের মতন ছিলেন, আজও তাই আছেন। দেখে ভালোই লাগছে।’
এক মুহূর্তের মধ্যে, চোখের পলকে এহসান সাহেবের হাত উঠে যায় তার সামনে নির্ভীক মুখে দাঁড়ানো ভাইঝির গাল বরাবর। তপোবর্ণা সরে না, নড়ে না…পড়ে না তার দৃঢ় চোখের পলক। তার গাল ছুঁতেও পারে না এহসান সাহেবের পুরুষালি হাতটা। ঝড়ের বেগে রণবীর সিংহের মতন ছুটে এসে মুহূর্তেই খাবলে ধরে তার মালকিনের দিকে ওঠানো হাতটা। এক ঝটকায় হাত ঘুরিয়ে বেঁকে ধরে এহসান সাহেবের পিঠের পেছনে। আচানক এমন আক্রমণে হতভম্বও হতে পারেননি এহসান সাহেব। তীব্র ব্যথায় গুঙিয়ে ওঠেন। একেবারে হাতের হাড়টা ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছে। পরমুহূর্তেই ঘৃণায় ভরে ওঠে তার অন্তর। এক চাকরবাকর তার ওপর হাত ওঠানোর সাহস করেছে! হুংকার ছাড়েন তিনি,
‘এতো বড়ো স্পর্ধা তোর! চিনোস আমারে! তোরে আমি জিন্দা মাটিতে পুঁতে দেব জানোয়ারের বাচ্চা।’
রণবীর টলল না, কিচ্ছুটি বলল না, ছাড়লও না। শক্ত মুখে শুধুমাত্র হাতটা বেঁকিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তপোবর্ণা ভারী দুঃখের সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেজার মুখে আরেকটু এগিয়ে গেল এহসান সাহেবের খুব কাছে। স্নেহের চোখে চেয়ে, কান্নারোধ করা কণ্ঠে বলল,
‘চাচা, আমার না খুব কষ্ট হয়। খুউব। আপনারা আমাকে এতো যত্নে লালনপালন করলেন, তার বিনিময়ে আমি কিচ্ছুটি করতে পারলাম না। আমি কিছু করতে চাই জানেন? খুব করে চাই আপনার জন্য, ছোটো চাচার জন্য, আমার বাবা রমজান খানের জন্য…ওহ আরও আছে। আমার সৎ মা, সৎ বোন, ভাই…সবার জন্যই কিছু না কিছু করতে চাই। কী করা যায় বলুনতো?’
এহসান সাহেব রাগ সংবরণ করতে দু'চোখ বুজলেন কিছুক্ষণের জন্য। র ক্তাক্ত চোখজোড়া মেলে যখন তাকালেন, তখন সেখানে শান্ত দৃষ্টি। শীতল কণ্ঠে বললেন,
‘খুব বাড় বাড়ছিস। এর পরিণতি ভালো হইব না।’
তপোবর্ণা হাসে। শব্দ করেই হাসে। দু’চোখ ভরে দেখে রেগে আগুন হয়েও কিচ্ছুটি বলতে না পারা, বিপরীতে কিচ্ছুটি করতে না পারা এহসান সাহেবকে। অসহায়, দুর্বল ভাবে সহ্য করা তার এই রূপ তপোবর্ণাকে আনন্দ দিচ্ছে। পৈশাচিক আনন্দ। নিজের অতীত মনে করে পরমুহূর্তেই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়,
‘এইবারে শুধুমাত্র খেত পুড়িয়ে ছেড়ে দিলাম। আমার লোকদের গায়ে দ্বিতীয় বার হাত তোলার সাহস করলে—পুরো খান বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবো।’
তপোবর্ণা রণবীরকে ইশারা করে হাঁটা ধরল বিপরীত পথে, মাতবর বাড়ির উদ্দেশ্যে। মালকিনের ইশারায় রণবীর এহসান সাহেবের হাত ছেড়ে দিলো। এহসান সাহেবের ক্রোধ উপেক্ষা করে নুহুল ইতোমধ্যে চেয়ার উঠিয়ে নিয়েছে তার কাঁধে। সবগুলো হাঁসের মতন পিছু নিলো তপোবর্ণার। সেই দৃশ্যে ক্রমাগতই রাগে ফুঁসছেন এহসান সাহেব। দু’হাত মুঠো করে পাশের বটগাছটায় শক্তি দিয়ে ঘুষি বসান। ব্যথায় হাত অবস হলেও, ক্ষিপ্ত হৃদয়.. রাগিত মস্তিষ্ক সেই ব্যথা অনুভব করতে পারল না।
—————
চাঁদ মিহি গলায় বলে,
'এতো সুন্দর কাপড় আমি আগে কক্ষনো দেখিনাই, মালকিন। কী কাপড় এইডা? কতো মসৃন! ইশ, মাখনের মতন। আর ওপরে সাদা রঙের ফুলের ছাপা গুলা কতো জীবন্ত! এই কাপড়টা দিয়া একটা শাড়ি বানাইলে মেলা ভালো দেখাইবো। আপনারে বেশ মানাইবো।’
পালঙ্কে চোখ বুজে আধশোয়া থাকা তপোবর্ণার কোনো নড়চড় হয় না। মেলে তাকায় না বন্ধ চোখজোড়া। ভীষণ বাজে মন খারাপ তার— তা বুঝে নিয়েছে চাঁদ। তখন ওপর থেকে সবটাইই দেখেছে, পরে শুনেছে নুহুলের কাছ থেকে। ওই খান বাড়ি সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়তেই এমন মনমরা হয়ে যায় তাদের মালকিন। চাঁদ দৃষ্টি উঠিয়ে তাকায় তপোবর্ণার দিকে। নিঃসন্দেহে একজন রূপবতী নারী। যেই রূপ নিঃশব্দে কাউকে পুড়িয়ে মা রার ক্ষমতা রাখে। জানালা থেকে আধো চাঁদের জ্যোৎস্নায় ভাসা তপোবর্ণাকে বেশিক্ষণ দেখার স্পর্ধা করে না চাঁদ। দৃষ্টি নামিয়ে চতুরতার সাথে.. ভারী চাপা গলায় বলে,
‘বড়ো মালিক মুগ্ধ হইব।’
এবারে চট করে চোখ মেলে তাকাল তপোবর্ণা। ঝটপট সোজা হয়ে বসতেই ঘনকালো খোলা চুলগুলো পালঙ্কে ছড়িয়ে পড়ল তার। অগোছালো শাড়ি সরে সামান্য উন্মুক্ত হলো ধবধবে ফরসা শীর্ণ, মেদহীন পেটের একাংশ। সেদিকে ধ্যান নেই। বরঞ্চ নির্লিপ্ত, নির্বিকার মুখে, ডাগর চোখে এখন আকাশ সমান আগ্রহ। কণ্ঠে চঞ্চলতা—
‘সত্যি বলছিস? মুগ্ধ হবেন তিনি?’
চাঁদ মনে মনে দিব্যি হাসল নিজের মালকিনের এমন অবস্থায়। অথচ ওপরে বেশ শান্ত, স্থির চিত্র ধরে রেখেছে। এতক্ষণ যাবত তাজের পা’জোড়া মালিশ করতে থাকা রূপালির দিকে চেয়ে বলে,
‘বিশ্বাস না হইলে রূপারে জিগান। এই রূপা, বল তুই। ঠিক বলছি কি-না?’
রূপালি ক্রমাগত মাথা দুলিয়ে মুখেও বলল, ‘মালকিন, আপনি যাই পরেন না ক্যান অপ্সরা লাগে। আর এইডাতো চমৎকার কাপড়। ফুলটাও দারুণ ফুটছে। ভালো লাগব না কন? তার ওপর মালিক বাইরে দেশ থেইকা আনাইছে যে।’
তপোবর্ণা হাত বাড়িয়ে কাপড়টা নরম আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। রংটা লাল-সাদার মিশেলে এক চমৎকার সৃষ্টি। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তৃপ্তি নিয়ে মাথা দোলায়। হুকুম করে,
‘তাহলে আগামীকালই দর্জিকে ডাক পাঠা্স। শাড়ি, ব্লাউজ উনি ফিরে আসবার আগেই বানানো চাই আমার।
চাঁদ হেসে দ্রুত মাথা দোলায়। বলে, ‘কালই আইতে কমু। মালকিন, রাত হইছে এইবার ওঠেন। ঘুমানোর সময় হইছে। এমনিতেও আইজ আপনার ওপর ধকল গেছে।’
প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ তপোবর্ণা। নীরবে তাকায় জানালার দিকে। জীবন্ত চাঁদটার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে, ‘উনি কী করছেন এখন? ঠিকমতো খাচ্ছেন কি-না, কে জানে!’
—————
গ্রামের মানুষ বলে বেড়ায়, রেহতাব মাতবরের ইশারা মানে হুকুমের ঝড়। বৃষ্টি নামবে কি না, তাও যেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠিক হয়। পাঁচগ্রাম-সাতপাড়া জুড়ে তার নামে কাঁপে চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে গাজী বংশের মানুষও। অথচ, নেহাত এক ভদ্রলোকের নিবাসে থাকা রেহতাব মাতবর বেশ ভদ্রসভ্য, এক শান্তশিষ্ট মানুষ হিসেবে নিখুঁত পরিদর্শন। মৃদু হাসি যার ঠোঁটে লেগেই থাকে, নম্রতা যার কণ্ঠে জিইয়ে রয়, ভদ্রতা যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যাকে রাগতে দেখা যায়নি, উঁচু আওয়াজে কথা বলতে শোনা যায়নি…মারধর-গালিগালাজ বড়ো দূরের বিষয়। এমন এক রেহতাবকেই সবাই জেনেছে, চিনেছে..ভয় করেছে, ভালোবেসেছে সাথে শ্রদ্ধাও। তবে গোপনে, অজানায় কে কেমন তা জানে ক’জনা? রাজনীতির গভীরতায় ভদ্রলোক বলতে কোনো শব্দ নেই। ভদ্রলোকের নিবাসেই যেন ঘোরে সব অভদ্রলোকের অস্তিত্ব, অজানা বিশ্রী চেহারা। রেহতাব মাতবর রাজনীতির বিশেষ এক অংশ। সে কী তবে সেই প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন?
রাত দুটো পয়ত্রিশ। ঢাকার পূব দিকের বাংলোটা বেশ পুরোনো আমলের। গাঢ় শ্যামলা রঙের মসৃণ দেয়ালগুলোতে পুরনো দিনের স্মৃতির ছাপ। অনেক জায়গায় চুন খসে পড়েছে, ফাটল ধরেছে দেয়ালে। পিলারগুলো গোল করে গড়া। একেকটা পিলার যেন ব্রিটিশ আমলের সাক্ষী। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ঘিরে ফেলেছে বাংলোটাকে। গাছগাছালির আড়ালে ভূতের বাড়ির মতো নির্জন, নিষ্প্রাণ। অন্ধকারে ডুবে থাকা বাংলোর আশেপাশে কেনো দূরদূরান্ততে মানুষ মাত্র নেই। এইখানটা দিয়ে দিনদুপুরেও মানুষ যাতায়াত করতে ভয় পায়। এলাকার মানুষ থেকে শোনা যায় নিশীথে বাংলো থেকে অদ্ভুত আর্তনাদের ধ্বনি ভেসে আসে। এই মুহূর্তেও নীরবতা ভেঙে ভেসে এলো চাপাস্বরের এক করুণ আর্তনাদ। বাংলোর ভেতরের সবগুলো জানালা, দরজা বন্ধ। টিমটিম করে জ্বলছে লণ্ঠনের বাতি। হলদে বাতির সামনে চেয়ারে বসা পুরুষের মুখখানা সুদর্শন বটে। শক্ত চোয়ালটা ছাঁচা। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। নাক, ঠোঁটের মধ্যিখানে মোটা করে মোছ রাখা। তীরের মতো লম্বা নাক, ঘন পাপড়ির আড়ালে থাকা চোখদুটো ছোটো। মোটা ভ্রু, চওড়া কপাল। ঘনকালো চুলগুলো পরিপাটি ভাবে আঁচড়ে রাখা। পরনে সাদা ফকফকে পাজামা-পাঞ্জাবি। একটি দাগ, কুঞ্চন মাত্র নেই পাজামা-পাঞ্জাবির কোথাও। চকচকে জুতো পরিহিত পায়ের তলে আপাতত একটি হাত। আর্তনাদ করছে জমিনে চার-পাঁচটা ঘুষি খেয়ে পড়ে থাকা রাদিদ। বেশ দুর্বল শরীরের ওর। অল্প ব্যথাও মেনে নিতে পারে না। অথচ সামান্য কারণ ধরে তাকে এভাবে মেরেছে! তপোবর্ণাকে ও পছন্দ করতো, হ্যাঁ মানছে এখনো করে..এরজন্য এভাবে মা রবে? মানুষ কী মানুষকে পছন্দ করতে পারে না? কোন জনমের এক চিঠি পেয়ে তাকে আপদমস্তক শায়েস্তা করতে এসেছে! ব্যথাটুকু সহ্য করে বহু কষ্টে রাদিদ বলে,
‘তপোবর্ণা জানতে পারলে কী হবে, মাতবর সাহেব? যাকে ও ফেরেস্তার মতন মনে করে পাগলের মতো ভালোবাসতেছে.. ওই লোক একটা ভণ্ড। সাধারণ বিষয় ধরে আমাকে তুলে এনে মে রেছেন। দুই চেহারা নিয়ে ঘোরা এক বদমায়েশ।’
রেহতাবের দু'হাতে ধবধবে সাদা গ্লোভস পরা। ধুলোবালিতে তার এলার্জি আছে। অপরিষ্কার কিছু ধরলেও গা রিনরিন করে ওঠে। সে পা-টা সরিয়ে নেয় রাদিদের হাত থেকে। ডান পায়ের ওপর বাম পা-টা অবহেলায় ফেলে রাখে। তাকায় নির্বিকার দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টিতে অর্থ নেই। পরিবেশ শীতল করে ফেলার মতন কণ্ঠে শুধায়,
‘ওকে জানাবে কে? তুমি?’
ব্যথিত হাতটা কোনোরকমে কোলে নিয়ে উঠে বসে রাদিদ। ওর সারা শরীর ব্যথায় জর্জরিত। মার একটাও অন্যদিকে পড়েনি। সব ওর পাতলা শরীরে পড়েছে। রেহতাবের পেছনে দাঁড়ানো দানবের মতন বিশালদেহী লোকগুলোকে আরেকটিবার দেখে নেয়। মিনমিনে গলায় বলে,
‘আমি সম্পর্কে তপোবর্ণার মামাতো ভাই হলেও তেমন কাছের নই। দিনশেষে সাধারণ একজন মানুষ। আপনার মতো প্রভাবশালী মানুষের বিপক্ষে যাবার স্পর্ধা আমার নাই। আমি শুধুই ভবিষ্যতের কথা বলছি, মাতবর সাহেব। সারাজীবন মিথ্যে গোপন থাকে না। তপোবর্ণা বুদ্ধিমতী। কখনো না কখনো জানতে পারবেই।’
রেহতাব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ডান ভ্রু তুলে বলে,
‘কী জানবে? মিথ্যে কোথায়? আমি তো খারাপ কোনো কাজে লিপ্ত নই। না আছে খারাপ স্বভাব। জীবনেও কোনো মেয়েকে ছুঁয়ে দেখিনি, নিজের স্ত্রী ব্যতীত। তাহলে?'
রাদিদ আহম্মকের মতন পাশে তাকাল। মার খাওয়া লোকটা ওইখানে দিব্যি পড়ে আছে। সেই দৃশ্যের সামনে বসে বলছে, ‘মিথ্যে কোথায়?’ শা লার ভণ্ডর ঘরে ভণ্ড। মিথ্যেবাদী। রেহতাব যেন রাদিদের নিরবতা পড়ে নিলো। সরল কণ্ঠে বলল,
‘ওকে আমি মা রিনি। মারধর আমি করি না। মে রেছে এইযে ---ওরা। এই বল, কেনো মে রেছিস?’
সোহেব যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে বাধ্য তবে নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল,
‘বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ভাইজানকে ধোঁকা দিছে। তাই একটু শায়েস্ত করছি। ম রে নাই। বাইঁচা আছে। সকাল বেলা দৌড়াইব।'
রাদিদের মুখের ভেতরটা তিতে লাগল। সে নিজ চক্ষে দেখেছে, কীভাবে গ্লোভস পরে একের পর ঘুষিতে ওই লোকের নাকমুখ ফাটিয়েছিল। আর এখন সব অস্বীকার করছে। আর একটু আগে কীভাবে ওর হাতটা পাড়া মে রে ধরেছিল! ভয়ে শুকিয়ে এলো রাদিদের ভেতরটা। কোনোরকমে বলল,
‘আপনিওতো তপোবর্ণাকে ধোঁকা দিচ্ছেন! দিচ্ছেন না? মানছি বাধ্য হয়ে, পরিস্থিতির কারণেই হোক না কেনো…বিয়ে করে ওকে বাঁচাইছেন ওই জাদরেলদের থেকে। কিন্তু, আপনিও কী ওদের মতো নন? আদতেও ওকে মন থেকে চান নাকি ব্যবহার করছেন নিজের স্বার্থে? আপনি যা প্রকাশে করতে পারবেন না তা করার পাওয়ার দিয়ে রেখেছেন ওকে। তাই তো?’
চেয়ারের হাতলে বাম হাতের কনুই রেখে তালুতে বাম গাল রেখে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল রেহতাব। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল রাদিদের। ওর প্রাণপাখি বোধহয় মা রা যাবে এইমুহূর্তেই। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল পেছনে। রুহ কেড়ে নেবার মতো দাম্ভিক রেহতাব উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল পিছুতে থাকা রাদিদের দিকে। ওর সামনে দু'পায়ের ওপর উঁচু হয়ে বসল। গ্লোভস পরিহিত ডান হাতের আঙুল গুলো ধরল ওর চোয়াল। স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘রেহতাব মাতবর কখনো পরিস্থিতির স্বীকার হয় না। কখনো বাধ্য হয় না। সে যা চায়, তাই হয়।’
রাদিদ চমকায়। রেহতাব ওর চোয়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবারে ধীর স্বরে আওড়ায়,
‘আমি মনেপ্রাণে ওরে চাইছিলাম। পুরো দুনিয়া বুঝে নিছে, এটা চাওয়া না, এটা ছিল আমার দাবি। রেহতাব মাতবরের দাবি। যা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এই দুনিয়ার হয় নাই।’
সে থামে ফের আওড়ায়, ‘তপুর জন্মই হয়েছে এই রেহতাব মাতবরের বউ হবার জন্য।'
·
·
·
চলবে.......................................................................................