সোহাগি সাঁঝমল্লার - পর্ব ১১ - মিথিলা মাশরেকা - ধারাবাহিক গল্প

          দুপুর দুইটা। আজ দুপুরের খাবারটা চার তালুকদার একসাথে খাচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে বসা অভ্র কেবল চুপ। মাশফিক, আসিফ আর মোশাররফ তালুকদার নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। মিসেস মোশাররফ কিচেন থেকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন, সাঁঝ সেগুলো এনে টেবিলে রাখছে৷ রুবি ড্রয়িংয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসা৷ ও গতদিন হাসপাতাল থেকে এসেছে। বসেবসে তালুকদার পুরুষদের আলাপ করতে দেখছিল ও। আর দেখছে এই আলাপের সাথে বেমানান সাঁঝকে। ওর নিরবতাকে রুবির তালুকদার পরিবারে চাঁদের গায়ে কলঙ্কের মতো মনে হয়৷ খাবার আনা শেষ হলে অভ্রর পাশের চেয়ারে বসে গেল সাঁঝ। কিছু বলবে সে আশা করে তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। কিন্তু অভ্র কিছু বলল না। মাশফিক হয়তো লক্ষ করলো সেটা। নিজের প্লেটটায় খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,

– ব্যপার কিরে অভ্র? এত চুপচাপ হয়ে গেছিস যে? 

– কই? চুপচাপ হয়ে যাব কেন?

মাশফিক হাত থামিয়ে ভাইয়ের দিক তাকাল। কিন্তু অভ্র চোখ তুলল না। আসিফ তরকারীর বাটি মোশাররফ তালুকদারকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

– অভ্র চুপচাপ হয়নি। আজকাল সুজিও ভদ্র হয়ে গেছে, তাই আমাদের অভ্রও ভালো হয়ে গেছে। তাইনা অভ্র?

সাঁঝ চোখ ঘুরিয়ে কিচেনের জানালায় বসে হাতপা চাটতে থাকা সুজিকে দেখল। রুবি যতটা সময় নিচতলায় থাকবে, ও ওখান থেকে একচুলও নড়বে না। কিকরে যেন ও বুঝে গেছে, ছোট বাচ্চার ধারেকাছে যাওয়া ওরজন্য বারণ। মোশাররফ তালুকদার অভ্রর পাতে বড় মাছের মাথাটা তুলে দিতে দিতে বললেন,

– এই প্রথম এমন খারাপ রেজাল্ট হয়নি তোমার অভ্র। তাহলে এতবেশি মনখারাপ করে আছো কেন?

আরেকটা মাছের মাথা সাঁঝের প্লেটে আসলো। মাথানিচু করে রইলো সাঁঝ। আর কেউ না জানলেও ও তো জানে, অভ্রর মন খারাপের কারণ কেবল খারাপ রেজাল্ট না। দিবার সাথে কথাবার্তা না হওয়া। এ কদিনে ও অনেক চেষ্টা করেছে অভ্রর সাথে কথা বলার। কিন্তু সে ছেলে প্রয়োজন ছাড়া আর কিছুতেই শোনেনি ওর কথা। সাঁঝ অসহায় ছিল। ওর নিজেরই অপরাধবোধ হচ্ছিল এটা ভেবে যে ওর জন্যই সায়াহ্ন হামিদ অভ্র-দিবার সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। আর অনেক চেষ্টা করেও ছোটভাইয়ের কাছে এই অপরাধবোধটুকোর কথা বলতে পারেনি ও। মাশফিক খাবার খেতে খেতে অভ্রকে বলল,

– যা হওয়ার, হয়েছে। এখন মনখারাপ করে কি লাভ?

– সেটাই। তুমি শুধুশুধু মন খারাপ করছো। রেজাল্ট নিয়ে আমরা কেউ কিন্তু কখনোই তোমাকে প্রেশারাইজ করিনি। আমরা কেউ বলিনি তোমাকে টপ করতে হবে। একটা ক্লাসের সবাই টপার হতে পারে না। আর সবাই কেবলমাত্র টপার হওয়ার জন্যই পৃথিবীতে আসে না। পড়াশোনা যা করছো, তার ফিডব্যাক একদিন না একদিন পাবে। এবং আমাদের জন্য সেটা যথেষ্ট। এই সহজ হিসেবটাকে জটিল বানিয়ে দিয়ে, জীবনকে অবহেলার আমি কোনো কারণ দেখছি না অভ্র৷ 

অভ্র বাবার দিকে তাকাল। কথা শেষ করে মোশাররফ তালুকদার নিজের মতো খাওয়ায় ব্যস্ত। মাশফিক দুনিয়ার সব স্বাদ নহয়ে আঙুল চাটতে চাটতে বলল,

– হ্যাঁ। বাবা ঠিকি বলেছে৷ ইন্টারে ফেল করলে রিকশা চালাবি। সমস্যা কি?

সবার অগোচরে হেসে খাবারে মনোযোগ দিলো অভ্র। কিন্তু সে হাসিটা সাঁঝের চোখে পরেছিল। ও বুঝে গিয়েছিল, এবার হয়তো কথা বলা যাবে অভ্রর সাথে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে অফিসে, দোকানে চলে যায় তিন তালুকদার। বিকেলের দিকে ছোটভাইয়ের দরজায় নক করলো সাঁঝ। অভ্র তখন পড়ার টেবিলে। বোনকে একপলক দেখে পুনরায় বইয়ের দিকে মনোযোগের ভাব করলো ও। সাঁঝ ভেতরে ঢুকতেই সুজি ওর কোল থেকে ঝাপিয়ে নিচে নেমে গেল। সাঁঝ এগিয়ে এসে ভাইয়ের টেবিলে হেলান দিয়ে দাড়াল। তারপর গাল ফুলিয়ে, দুহাতে দুকান ধরে সরি বুঝাল। অভ্র তখন বোনের দিকে তাকানো। সাঁঝ খেয়াল করলো, ওর চোখ ক্রমশ ভরে উঠছে৷ হঠাৎইচেয়ার পেছনে ঠেলে দাড়িয়ে গেল অভ্র৷ হুট করেই জড়িয়ে ধরলো বোনকে। সাঁঝ বিমূঢ়। ওরচে বাড়তি উচ্চতার ছোটভাই ওর কাধে নাক ঠেকিয়ে বাচ্চার মতো ফুপাতে শুরু করেছে। হতবিহ্বল সাঁঝ অভ্রর পিঠে হাত রাখতেই সে হিচকি তুলে কাদতে কাদতে বলল,

– আ'ম সরি আপুই! সরি!!!

সাঁঝ কয়েকদন্ড কিছু বলল না। ও বুঝেই উঠছে না, কেন অভ্র ওকে এভাবে সরি বলছে। সরি তো ওরই বলার কথা। ওর জন্যই তো অভ্র দিবার সাথে কথা বলতে পারছে না। চিন্তিত হয়ে কিছুসময় পরই ভাইকে ছাড়িয়ে নিলো সাঁঝ। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,

– কি হয়েছে? তুই কেন সরি বলছিস?

– সরি তো আমারই বলা উচিত! আমিই. . . 

– তোর কেন সরি বলা উচিত? কি হয়েছে বলবি তো!

– সায়াহ্ন ভাইয়া ঠিকই বলেছে! আমি সত্যিই তোকে দেখে রাখতে পারি না আপুই! আমি তোর ভাই হওয়ারই যোগ্য না! মাশফিক ভাইয়ার মতো আমি তোকে আগলে রাখি না! আমি. . . 

বলতে বলতে নাকমুখ ঢেকে আবারো কান্না শুরু করে দেয় অভ্র। সাঁঝের এবার অবাক হওয়ার পালা। ওরচে বছর পাঁচেকের ছোট ভাই ওকে নিরাপত্তা না দিতে পারার অপরাধবোধে এ কয়দিন ওরসাথে চোখ মেলায় নি। এখন এইভাবে কাদছে! সাঁঝ ব্যস্তভাবে অভ্রর মুখ থেকে হাত সরালো। ওর কাধ ধরে ঝাঁকিয়ে বুঝাল চুপ করার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অভ্র একবার কান্নার বেগ কমায়, আবারো কি ভেবে শব্দ করে কেদে ওঠে। বেশকিছু সময় পরও ও শান্ত হচ্ছিল না। সাঁঝ একটা দম ফেলল। গায়ের জামাটার বড় হাতা টেনে মুঠোতে করে, ভাইয়ের দুচোখ মুছে দিলো। অভ্র একটু দমে। সাঁঝ ইশারায় বলল,

– আমি নিজেকে আগলে রাখতে পারি না, সেটার দায় আমার অভ্র! তোর না! 

– না! আমারই দায়! তুই আমার বোন! 

– তো? তো কি? বোন বলে তোর নিজের কোনো জীবন থাকবে না? সবসময় আমাকে ঘিরেই বাঁচতে হবে? হ্যাঁ মানছি আমার একটা দূর্বলতা আছে। কিন্তু তারমানে এই না যে এইকারনে তোরা সবসময় আমাকে নিয়েই মাতামাতি করবি! নিজেদের জীবন ছেড়ে আমাকে চোখেচোখে রাখবি!

—————

– তোরা আমার সাথে আছিস বলে ওপরওয়ালা আমাকে বোবা বানায় নি অভ্র। নাইবা আমি বোবা বলে তোদেরকে আমার গার্ডিয়ান বানিয়েছে। তাছাড়া কিই বা হয়েছে ওখানে? এমন কিছুই হয়নি যেটার জন্য তোকে এতো অপরাধবোধ করতে হবে, এমন কান্নাকাটি করতে হবে। আমি কামরুলকে পাশ কাটাচ্ছিলাম তো! ওই ছেলেগুলোকে পাশ কাটাচ্ছিলাম তো! মাঝখান থেকে ঝামেলা তো করলো ওই সায়াহ্ন হামিদ!  

– হু। 

সায়াহ্ন হামিদকে খারাপ বললে আপাতত শান্তি লাগছে অভ্রর। যেকারনে বোনের কথায় একমুহুর্তের জন্য ভাবনায় পরে গিয়েছিল ও। না বুঝেও একটু বোঝার মতো ভাব করেছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর বুঝে আসে, সাঁঝ ওকে অপরাধবোধ থেকে উদ্ধার করতে এসব বলছে। অভ্র তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,

– কিন্তু তারপরও আমি তোর ভালো ভাই না!

পুনরায় হুহু করে কাদতে থাকে অভ্র। এভাবেই চলল আরো সময়। ভাইকে একেবারেই সামলাতে না পেরে কপালে হাত দিয়ে আশপাশ দেখল সাঁঝ। তখনই ওর চোখে পরলো, সুজি অভ্রর পড়ার টেবিলের খোলা বইয়ের উড়তে থাকা পাতার দিকে মনোযোগ তাক করে বসা। যখনতখন ঝাপিয়ে পরবে, এমন অবস্থা। এই দৃশ্য অভ্র দেখলে দ্বিতীয়দফায় কাহিনী হবে ভেবে সাঁঝ ভয়ার্ত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। অভ্র তখনই নাক টেনেটেনে বলল,

– মালটাকে কোলে তোল প্লিজ। নাহলে ও আমার বইটার দফারফা করে দেবে। 

পরিস্থিতি স্বাভাবিক বুঝে সাঁঝ মৃদ্যু হাসলো। সুজিকে কোলে তুলে, আবারো ভাইয়ের দিক তাকালো৷ অভ্র তখন একবার নাক ডলছে আরেকবার হাতের তালু দেখছে। সাঁঝ সুজিকে একহাতপ ধরে আরেকহাতে ইশারায় বুঝাল,

– দিবার সাথে কথা হয়েছে?

– না। রেজাল্টের দিনই লাস্ট নক করেছিল। আমি তো রিপ্লাই করিনি, ওউ আর কিছু বলেনি। ওর ভাই মনেহয় ওকেও যোগাযোগ করতে মানা করে দিয়েছে। ভালোই হয়েছে। আমিও আর নক দেবো না। 

ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো সাঁঝ। তারপর উৎসাহ নিয়ে ভাইকে বুঝাল,

– তুই এক কাজ কর। দিবাকে তাহলে ম্যাসেজ কর! বল যে তুই বুঝে গেছিস তোকে দিবার ভাই পছন্দ করে না। সে চাইছে না তুই ওরসাথে আর যোগাযোগ করিস। এজন্য তুই আর ওরসাথে যোগাযোগ করবি না। ও যেন তোকে আর ম্যাসেজ না করে। 

– বলার প্রয়োজন নেই।

– আছে! তুই ম্যাসেজ কর! 

– কেন?

– নাহলে আমি বিশ্বাস করব না যে তুই সত্যিই দিবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছিস।

অভ্র হাতের পিঠে গাল, গলা মুছলো। টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে সেটা বোনকে এগিয়ে দিলো ও। ম্যাসেজ টাইপ করে সেটা সেন্ড করলো সাঁঝ। দশ সেকেন্ডের ভেতর সিন হয় ম্যাসেজটা। নীল টিকদুটো দেখে অভ্রর বুক ফাটছিল যেন। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সংবরণ করছিল ও। কিন্তু সাঁঝ মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে মোবাইলের স্ক্রিন আর ভাইয়ের চেহারা দেখল। তারপর অভ্রর মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে, সেগুলো এলোমেলো করে দিয়ে, সুজিকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো ওঘর থেকে। 

—————

সায়াহ্ন জিহ্বা দিয়ে দাঁতের মাড়ি খোঁচাতে খোঁচাতে একবার পাশে দাড়ানো দিবাকে দেখল, একবার চোখের সামনে ধরে রাখা ফোনটাকে। দাঁতে দাঁত চেপে ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে দিবা। এ কয়দিনে অভ্রর সাথে সত্যিই যোগাযোগ করে নি ও। এমনকি কলেজেও কথা বলেনি। দু একবার আড়চোখে তাকালেও, চোখাচোখি অবদি হয়নি ওদের। কিন্তু আজ অভ্রর পাঠানো ম্যাসেজটা দেখে সব এলোমেলো লাগছে দিবার। এটারনিটি বলা সম্পর্কের এই ব্রেকআপ ম্যাসেজটা সায়াহ্নকে দেখানো ছাড়া আর কিই বা করতো ও? সায়াহ্ন পুরো ম্যাসেজ পড়ে বোনের দিকে আগ্রহে তাকালো। দিবা বলল,

– তুই কি এটাই চাইছিলি?

– হুম।

– মানে? তুই না বলেছিলি এই রিলেশনশিপ নিয়ে তোর কোনো সমস্যা নেই। তাহলে আমাদের ব্রেকআপ চাইছিস কেন?

উচু গলায় বলতে গিয়েও আওয়াজ কমায় দিবা। আড়মোড়া ছেড়ে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো সায়াহ্ন। ট্রাউজারের দু পকেটে হাত গুজে, ঘাড় কাৎ করে বোনকে বলল,

– আমি তোদের ব্রেকআপ চাইনি। আমি অভ্রর এমন একটা ম্যাসেজ চাইছিলাম। 

– আর এটা একটা ব্রেকআপ ম্যাসেজ!

– না। এটা একটা কনফেশন ম্যাসেজ। এবং তোর মাথামোটা বয়ফ্রেন্ড এখানেও ডাব্বা মেরেছে।

– মানে?

– মানে মাই ডিয়ার বেহনা. . . 

সায়াহ্ন হেলেদুলে সোফা ঘুরে বোনের পাশে আসলো। দিবার হাত থেকে ওর ফোনটা নিয়ে, সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে দিবাকে সীমাহীন নিশ্চয়তার সাথে বলল,

– এই ম্যাসেজ তোমার প্রেমিকের না, তার বোনের লেখা।

দিবার চাওনি প্রসারিত হয়। সায়াহ্ন অদ্ভুতভাবে হেসে ফোন বোনের হাতে ধরিয়ে দিলো। দিবা ম্যাসেজটা আরেকবার পড়ে নিয়ে ভাইকে বিস্ময়ে শুধাল,

– তুই কিকরে জানলি এটা সাঁঝ আপু লেখা?

– ওপরের অভ্রর লেখা বাংলিশের হালাত দেখ। এক বাক্যের পাঁচটা শব্দের চারটাই ও সংক্ষেপে লেখে। আর এই ম্যাসেজে সব ঠিকঠাক বানানে লেখা। তাছাড়া তোর প্রেমিক বাক্যের শেষে দুইটা করে কমা ইউজ করে। এটাতে সুন্দরমতো ফুলস্টপ দিয়ে লেখা। এই লেখা জীবনেও অভ্রর না৷ আর ও বাদে ম্যাসেজ লেখার মতো আর একজনই আছে। ওর বোন। সাঁঝ!

ভাইয়ের হিসেব শুনে থ হয়ে দাড়িয়ে রইল দিবা। তখনই মিসেস সরোয়ার তৈরী হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। সায়াহ্ন দিবার ফোন সোফায় ছুড়ে মাকে শুধাল,

– কোথায় যাচ্ছ?

– হাটতে। এখানে আসার পর বিকেলের হাটাহাটি বাদ যাচ্ছে। 

– একাই?

– সঙ্গী কোথায় পাব? মেয়ে তো যাবে না। আর ছেলের বউও নেই!

– ছেলে তো আছে মা!

হতাশা নিয়ে, সেন্টার টেবিল থেকে ফোন আর ওয়ালেট তুলে মায়ের সাথে বেরোলো সায়াহ্ন। এলাকার সরু রাস্তাটা দিয়ে একথা সেকথায় হাটতে থাকে ওরা। দিবা বেশি বাপি বাপি করে। মায়ের প্রতি টানটা তুলনামূলক কম দেখায় ও। আশানুরূপভাবে সায়াহ্ন হয়েছে ওর উল্টোটা। বরাবরই মায়ের খুব কাছের। বেশকিছুটা সময় হাটাহাটির পর একটা ঝুড়ি নিয়ে বসা আমের দোকানীকে চোখে পরে মিসেস সরোয়ারের। তিনি ছেলেকে বললেন,

– আমগুলো দেখে ভালো মনে হচ্ছে। নেবো?

– হ্যাঁ নাও গিয়ে! আমি একটু আসছি। 

আম নিয়ে আগ্রহ নেই সায়াহ্নর। ওর মনে পরছে, অনেকটা সময় ওর সিগারেট খাওয়া হয়নি। এজন্যই মাকে ব্যস্ততায় পাঠালো ও। মিসেস সরোয়ার এগিয়ে গিয়ে সেখানে দাড়ানো আরেক লোকের সাথে আম বাছতে লাগলেন। দাঁড়িপাল্লায় মাপে উঠিয়ে দোকানী কেজিতিনেক আম ব্যাগে করে তাকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু ব্যাগ নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, পাশ থেকে কেউ তার হাত সরিয়ে বাধা দেয়। কিছুটা বিস্ময়ে পাশে তাকালেন মিসেস সরোয়ার। গাঢ় খয়েরী রঙের থ্রিপিস পরিহিত বাইশ-তেইশের এক যুবতী ওনাকে হাত দিয়ে থামতে বুঝাল। অতঃপর আমের ঝুড়ির ওপর রাখা দাঁড়িপাল্লাটা তুলে, তার নিচে হাত দিয়ে চুম্বক বের করলো একটা। চকিত চোখে চেয়ে রয় দোকানদার। আর মিসেস সরোয়ারের দৃষ্টি প্রসারিত হয়। চুম্বক নিজের কাছে রেখে মেয়েটা দাঁড়িপাল্লাটা নামিয়ে রাখল। বাহাতের পলিথিনে আমগুলো উচিয়ে, ডানহাতে সেটা দেখিয়ে, প্রথমে তিনআঙুল, পরে বৃদ্ধাঙ্গুলি না সূচক নাড়ালো।

– কিরে? তোরে তো আগে এদিকে দেখি নাই। একদিন পাড়ায় আসলি আম বেঁচতে, আর ওই একদিনই মাপে চিটারি করোস? তোরে তো শালা জেলে দিমু!

ওখানে দাড়ানো অন্য খদ্দের লোকটা ক্ষেপে যায়। ওনাকে ক্ষিপ্ত দেখে দেখে মিসেস সরোয়ার একপা পিছিয়ে গেলেন। কিন্তু মেয়েটা এগিয়ে এলো। দোকানদারকে আরকিছু না বলার জন্য লোকটাকে অনুনয় করতে লাগল ও। লোকটা শুনল ওর কথা। মেয়েটার হাতের আমগুলো আবারো দোকানদারকে দিয়ে বলল,

– জোচ্চর ব্যাটা! ঠিকঠাক মাপ দে!

গুটিসুটি মেরে বসে সে লোক তাই করলো। ঠিকঠাক মাপে আম নিয়ে মেয়েটা চলেই যাচ্ছিল। তবুও কি ভেবে যেন পাশ ফিরল সে। মিসেস সরোয়ারের দিক মিষ্টি করে হেসে, আঙুলে একবার আম, আরেকবার থামস্ আপ দেখালো। অতঃপর একহাতে আমের পলিথিন, আর আরেকহাতে নিচে দাড়ানো লোমশ বিড়ালটাকে কোলে তুলে হাটা লাগালো। মিসেস সরোয়ার ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে খদ্দের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন,

– কে মেয়েটা?

– মোশাররফ তালুকদারের মেয়ে, আসিফ তালুকদারের ভাতিজী, অভ্র আর মাশফিক তালুকদারের বোন। সাঁঝ!

বিস্ময়ে পাশ ফিরলেন মিসেস সরোয়ার। কেননা জবাবটা তার ছেলের কাছ থেকে এসেছিল। যাকে অনেকেই চিনলেও, সে কাউকে চেনে না। আর এরচেয়েও বড় বিস্ময় যেটা, তা ছিল সায়াহ্নর চাওনি। এইভাবে কোনো মেয়ের চলে যাওয়া দেখা, এই সায়াহ্ন মিসেস সরোয়ারের অচেনা। পকেটে দুহাত গুজে, অমায়িক একটা হাসির সাথে সাঁঝের চলে যাওয়া দেখছে সে। মিসেস সরোয়ার বুঝে উঠলেন না, সাঁঝের প্রতি ঠিক কি ছিল সায়াহ্নর চোখে? প্রসন্নতা? নাকি মুগ্ধতা? প্রসন্নতায় তো উপকৃত হতে হয়। কিন্তু উপকৃত না হয়েও কারো দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা, এটাকে তো মুগ্ধতা বলে। তাইনা?
·
·
·
চলবে……………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp