তোমার নামে যাতনা - পর্ব ০৭ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


!!১১!!

          সূর্যটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। ধীরে ধীরে আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কমলা রঙের আভা। পাখিরা উড়ছে আকাশের বুকে, উড়ে বেড়াচ্ছে একপাশ থেকে অন্যপাশে গিয়ে মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে। এখন বিকেলবেলা। ঘড়িতে সময় ৫ টা। লোকমান রহমানের ঠিক সামনে বসে আছে আশবিন। লোকমান রহমানের সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি কথা আছে বলেছে বিধায় আশবিনকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছেন লোকমান রহমান নিজে। আশবিন মাথা নিচু করে রাখছে। লোকমান রহমান তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আশবিনের জরুরি কথা কি শোনার জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরে চলেছে। প্রায় দশ মিনিট গড়িয়ে গেল। কিন্তু আশবিন এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি, তার এই চুপ থাকা দেখে বিরক্ত হচ্ছেন লোকমান রহমান। কথা বলতে এসে চুপ করে থাকার কোনো মানে হয়? 

লোকমান রহমান কণ্ঠে গাম্ভীর্যের ভাব বজায় রেখে বললেন, 'আশবিন চুপ করে আছো কেন? কথা বলো। তুমি জানো, সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। যা বলতে এসেছ জলদি বলো।'

আশবিন চোখ তুলে তাকাল। আশবিনের কণ্ঠে দৃঢ়তা, 'আপনি রাগ করেছেন কেন? আমি আপনাকে মোটেও রাগাতে আসিনি।'
'কি জন্য এসেছ?'
আশবিন চোয়াল শক্ত করে বলল, 'আমি এখন যে কথা বলব তার সাথে আমার পুরো জীবন জড়িয়ে আছে।'
লোকমান রহমান ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, 'যা বলার বলে তাড়াতাড়ি বিদায় হও।'

 লোকটা বেশ বুদ্ধিমান! ইতিমধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছে আশবিন কি বলতে চায়। আশবিন ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তারপর শুধালো, 'এত চটছেন কেন মশাই?'

এসময় হৃদা এলো। তার হাতে একটা ট্রে আছে। ট্রে’টা টেবিলের উপর রেখে পাশে দাঁড়িয়ে গেল হৃদা। মেম্বার বাড়িতে কোনো অতিথি এলে কোনোভাবেই তাকে খালি মুখে যেতে দেওয়া হয় না। সামান্য খাবার হলেও খেতে হয়। এই নিয়মটা মেনে চলেন সুলতানা। তার মায়ের বানানো নিয়ম ছিল। তিনি তা পালন করছেন বছরের পর বছর ধরে। আশবিনকে দেখে হৃদপিণ্ডটা জোরে জোরে লাফাচ্ছে হৃদার। আশবিন কেন এসেছে? জানে না সে। ভয় লাগছে। আশবিন উল্টাপাল্টা কথা বললে বাবা ভীষণ রেগে যাবেন। রাগে চেচামেচি করবেন। হৃদা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ড্রয়িং রুম জুড়ে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল আশবিন। লোকমান রহমানের চোখে চোখ রেখে সে বলল, 'হৃদাকে আমি ভালোবাসি। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।'
বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন লোকমান রহমান। একটু থেমে তিনি উচ্চ গলায় বললেন, 'তুমি কি বলছ আশবিন? তুমি জানো না হৃদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?'
আশবিন শান্ত গলায় বলল, 'আমি জানি। আর জানি বলেই আজ সরাসরি কথা বলতে এসেছি। আমি হৃদাকে বিয়ে করতে চাই।'
লোকমান রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, 'তোমার চাওয়া আর না চাওয়ায় কিছুই আসে যায় না। আমি তোমার মতো বেকার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না। তুমি এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।'
আশবিন বোঝার চেষ্টা করল, 'আপনি শান্ত হোক। আমার কথাটা অন্তত শুনুন।'
লোকমান রহমান রাগান্বিত গলায় বললেন, 'তোমার একটা কথাও শুনতে চাই না। যে ছেলেকে তার বাবা, নিজের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। সে ছেলেকে আমি জামাই করব? অসম্ভব।'

মূহুর্তে রেগে গেল আশবিন। রাগে দাঁতে দাঁত কটমট করে শব্দ করছে সে। শুধু মাত্র হৃদার মুখের দিকে তাকিয়ে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো আশবিন। লোকমান রহমান শুরু থেকেই জানতেন আশবিনের বাবা মন্ত্রী শাজান সিকদার। সেজন্যই তিনি এতমাস আশবিনের সব কটুকথা, বেয়াদবি সহ্য করেছেন। কিন্তু এখন আর তা সহ্য করতে চাইছেন না। তিনি বুঝে গেছেন আশবিন তার বাবার জন্য মূল্যহীন। আফসান-ই তার বাবার সব। আর সে ছেলের সাথেই বিয়ে হবে হৃদার। সেভাবে বিষয়টি ভেবে দেখলে আশবিনকে গণনা করার কোনো প্রয়োজনই নেই। যাকে তার নিজের পরিবার ফেলে দিয়েছে। তাকে কেন সম্মান করবেন তিনি?

আশবিন গম্ভীর সুরে বলল, 'হৃদা আমার শুধু আমার। আমি ওকে ভালোবাসি। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া ওকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।'
'বের হয়ে যাও।'
আশবিন রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
'আমার সাথে হৃদার বিয়ে দিবেন না?'
'কখনওই না।'
আশবিন উঠে দাঁড়িয়েছে। সে হৃদার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই লোকমান রহমান নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। আশবিন হৃদার চোখে তাকিয়ে বলল, 'আমি বেঁচে থাকতে ওকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। প্রয়োজনে আমি ওকে তুলে নিয়ে যাবো। কার এত দম যে আমাকে আটকাবে?'
আশবিন ঘুরে দাঁড়াতেই লোকমান রহমান কোষে থাপ্পড় মারলেন তার গালে। টাল সামলাতে এক পা পিছিয়ে গেল আশবিন। লোকমান রহমান হিসহিসিয়ে বললেন, 'আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকো তুমি। নইলে এরচেয়ে খারাপ অবস্থা হবে তোমার।'
'আপনি শুধুমাত্র হৃদার বাবা বলে আপনার সব রকম অবজ্ঞা আমি সহ্য করছি। আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিবেন না আর দয়া করে। 
'বের হয়ে যাও নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো।'
ঠান্ডা কিন্তু কঠিন স্বরে বলল আশবিন, 'আমাকে আপনার বাড়ি থেকে তো বের করে দিতে পারবেন মেম্বার সাহেব, কিন্তু আপনার মেয়ের মন থেকে কিভাবে বের করবেন? হৃদার মনে একমাত্র আমি রাজত্ব করি। আর কেউ তা করতে পারবে না। মেম্বার সাহেব কথা দিচ্ছি, প্রয়োজন হলে নোট করে রাখুন। আমি আশবিন সিকদার, হৃদার একমাত্র স্বামী হবো।'
লোকমান রহমান গর্জে উঠলেন। আশবিন তাকে পাত্তা না দিয়ে হৃদার দিকে তাকাল। আশবিন নরম গলায় বলল, 'তুমি শুধু অপেক্ষা কোরো। আমি আসবো। তোমাকে নিজের করে নিয়ে যেতে আমি ঠিক চলে আসবো। আমি তোমাকে অন্য কারো হতে দেবো না। বিশ্বাস রেখো!'
আশবিন লোকমান রহমানের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই চলে গেল। লোকমান রহমান মেয়ের দিকে তাকায়। তিনি বললেন, 'তুমি কি ওই বেয়াদবটাকে পছন্দ করো? মিথ্যা বলবে না, হৃদা।'

হৃদা কোনো জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সে। চোখে জল টলমল করছে। লোকমান রহমান গলার স্বর উঁচু করে এবারও একই প্রশ্ন করলেন। হৃদা ঢোক গিলে বলল, 'আমি তাকে ভালোবাসি বাবা। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি ওকে জানিয়ে দিয়েছি, আপনি যা সিদ্ধান্ত নিবেন আমি তাই মাথা পেতে মেনে নেবো।'

লোকমান রহমান ধমকের সুরে বললেন, 'ওকে দেখলেই আমার বিপি হাই হয়ে যায়। আর তুমি তারেই ভালোবাসো। আবার সে কথা নির্লজ্জের মতো আমাকে শোনাচ্ছ? লজ্জা করছে না বলতে?'
হৃদা কেঁদে ফেললো। কম্পিত গলায় বলল, 'বাবা।'
'ভেবেছিলাম তোমার বিয়ে, তোমার পরীক্ষার পরে ফেলব। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না। যা পরিস্থিতি দেখছি যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করব। তুমি আজ থেকে বাড়ির বাহিরে যাবে না। তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ।'
লোকমান রহমান হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হৃদা ফ্লোরে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুলতানা। হুদাকে দেখে দ্রুত ছুটে এলেন। হৃদার গালে হাত দিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?' হৃদা জবাব দিলো না। সুলতানা হৃদার চোখের জল মুছে দেয়। ফের জিজ্ঞেস করলেন, 'ভাই কিছু বলেছে? বকেছে?'
হৃদা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। হাউমাউ করে কাঁদছে সে। অস্ফুটস্বরে কি সব বলছে? কিছুই বুঝতে পারছেন না সুলতানা। 

লোকমান রহমান বাগানে আসেন। তিনি শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিলেন আফসানকে। একটু সময় নিয়ে কল রিসিভ করে আফসান। সালাম দিলো না রাফসান। দৃঢ় গলায় বলল, 'বলুন, কি জন্য কল দিয়েছেন?'

লোকমান রহমান গলা নামিয়ে সব কথা আফসানকে জানায়। আফসান চোখ কুঁচকে বলল, 'আর কিছু ঘটেছে?'
'না।' লোকমান রহমান চিন্তিত গলায় বললেন, 'কিন্তু আশবিন হুমকি দিয়ে গেছে। বলেছে, হৃদাকে সেই বিয়ে করবে। দরকার হলে তুলে নিয়ে যাবে।'
আফসান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, 'ও তা পারবে না্'
'বাবা।'
'জ্বি?'
'আমি বলছিলাম কি বিয়েটা এই সপ্তাহের মধ্যে হলে ভালো হতো। আমিও দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতাম। তুমি বললে, এই শুক্রবারেই বিয়ের তারিখ ফেলি?'
আফসান বলল,
'আপনি সব ব্যবস্থা করুন। আমি এই শুক্রবারেই বিয়ে করব।'
আফসান কল কেটে দিলো। আফসানের ঠিক পাশেই বসে আছে প্রিয়ল। সে আফসানের সব কথাই শুনেছে। এবং প্রিয়ল আশবিনের স্বভাবের সাথেও পরিচিত। প্রিয়ল ধীরে ধীরে বলল, 'আশবিনকে হালকা করে নিস না। আশবিন ছাত্র দলের নেতা। ও ইতিমধ্যে বিরাট বিরাট কারবার করেছে। সে যখন বলেছে তুলে নিয়ে যাবে, সে কথা আশবিন রাখবেই। বিয়েতে একটা ক্যাচাল অবশ্যই পাকাবে।'
'এ অবস্থায় আমি কি করব? ওকে আটকাবো কি ভাবে? তীরে এসে আমি তরী ডুবাতে চাই না। তুই একটা উপায় বল।'

আফসান প্রিয়লের সাথে পরামর্শ করল। প্রিয়ল বলল, 'বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আশবিনকে বন্দী করে রাখ।'
'মানে?'
'মানে খুব সহজ। আশবিন যেহেতু ছাত্র দলের সাথে যুক্ত আছে। তাকে একটা মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দে। জেলে বসে সে কিছুই করতে পারবে না। বিয়ে হওয়ার ঠিক পর মূহুর্তে বের করবি। ওর হারবে আর তুই জিতবি।'
আফসান ভাবলো। মাথা নাড়ল। বুদ্ধিটা দারুণ লেগেছে তার। সে এটাই কাজে লাগাবে।

!!১২!!

চারদিন পর। 
বুধবার বিকেল সাড়ে চারটা। 
আশবিন আর নিশান রাস্তার পাশে একটি টং দোকানে বসে আছে। মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। নিশান দুধ চা খাচ্ছে। আড়চোখে আশবিনের দিকে তাকায় সে। নিশান বলল, 'কি খেলাটাই খেলল আফসান সিকদার! শুরুতে একটুও সন্দেহ হতে দেয়নি। তলে তলে কত কিছু করে ফেলছে।'

আশবিন ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সে বলল, 'আমি টেনশনে আছি হৃদাকে নিয়ে। চারদিন ধরে ওকে একবারও দেখিনি। শালা ওর বাপ! আমার লাভ স্টোরিতে ভিলেন হয়ে এন্ট্রি নিয়েছে।'

নিশান খোঁচা দিয়ে বলল, 'শালা বলে আর কত গালি দিবি মেম্বাবকে?'
'যতদিন বিয়ে না করছি।'
নিশান হাসলো। বলল, 'তোর ওই শালা বিয়ে উপলক্ষে বাড়িঘর সাজিয়ে ফেলেছে।'
আশবিন রাগী গলায় বলল, 'তুই আমার মাথা গরম করিস না। হাত উঠে যাবে। এমনিতেই অনেক টেনশনে আছি। কি করব? কিছুই বুঝতে পারছি না।'
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চারজন ছেলে ঝগড়া করছে। তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় আশবিন। একটু পরেই তাদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়। একজন আরেকজনকে মারছে। রাস্তার পাশে অনান্য লোকজন দাঁড়িয়ে তা দেখছে। আশবিন আর বসে থাকতে পারলো না। সে ওদিকে এগিয়ে গেল। ছেলেদের মাঝে ঢুকে সে তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। এক মূহুর্তে একজন ছেলে আরেকজন ছেলের মাথায় ইট মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। আশবিন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই মূহুর্তে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে গেল। ঘটনা বিস্তারিত না শুনেই আশবিন সহ বাকি তিনজনকে এরেস্ট করে, আহতকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তাদের নিয়ে থানায় চলে যায়। নিশান ভিড়ের মধ্য থেকে দেখল সবটা। ভারী নিঃশ্বাস ফেললো নিশান। এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে? কে সাহায্য করবে তাকে? নিশান দ্রুত ছুটে গেল। ছাত্র দলের দুজন নেতার সঙ্গে দেখা করল সে। কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এলো না। ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে চলে যায়। নিশান ছুটে গেল উকিলের কাছে। আশ্চর্য জনক! কোনো উকিল আশবিনের কেসটা নিতে চায় না। তারা একবাক্যে না করে দেয়। এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে করতে বেজে গেল এগারোটা। নিশান বুঝতে পারছে এটা একটা চক্রান্ত! এই চক্রান্ত করেছে আফসান সিকদার। নিশান তখন বাড়ি ফিরে গেল। আশবিনকে যে করে হোক বের করতেই হবে তার। যা করার কালকের মধ্যেই করবে। 

নিশান সারাদিন ধরে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে সন্ধ্যার দিকে থানায় যায়। আশবিনের সাথে দেখা করে। আশবিন জানে, তাকে আটকে রাখার জন্য আফসান এই ষড়যন্ত্র করেছে। আজ হৃদার হলুদের অনুষ্ঠান, আজ যে করে হোক তাকে বের হতে হবে। আশবিন বের হওয়ার কোনো উপায় দেখছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে আশবিন নিশানকে পরামর্শ দেয়, সে যেন তার মাকে বিষয়টি জানায়। এই পরিস্থিতিতে তার মা'ই তাকে সাহায্য করতে পারবেন। সমস্যা হলো, নিশানের কাছে আশবিনের মায়ের ফোন নম্বর নেই। আশবিন জানালো, তার বেডরুমে একটা নোটপ্যাড রাখা ওটায় মায়ের নম্বর লেখা আছে। নিশান থানা থেকে বেরিয়ে সোজা আশবিনের বাসার দিকে রওনা দেয়। নিশানের কাছে বাসার এক্সট্রা চাবি ছিল, তাই তার ভেতরে ঢুকতে কোনো অসুবিধা হবে না। নিশান দরজার লক খুলে, ঘুরে মেম্বার বাড়ির দিকে তাকায়। দেখল সেখানে চলছে ধুমধাম আয়োজন। নিশান চোখ সরিয়ে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে। খুঁজে খুঁজে নোটপ্যাডটা বের করে, তারপর সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে সোফিয়া খাতুনের নাম্বারে। 

সোফিয়া খাতুন ফোন ধরেন। নিশানের পরিচয় শুনে তিনি চিনতে পারেন। উদ্বিগ্ন হয়ে ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নিশান একটু থেমে আশবিনের কথা জানায়। ছেলে জেলে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। এখন তিনি কি করবেন? ভেবে পাচ্ছেন না। সিকদার বাড়িতে এখন কেউ নাই। সবাই গেছে মেম্বার বাড়িতে। সোফিয়া খাতুনের মূহুর্তে মনে পরলো বাড়িতে আফসান আছে। তিনি ওর কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। সোফিয়া নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে আফসানের ঘরের দিকে ছুটে গেলেন। আফসানের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন সোফিয়া খাতুন। ঘরের ভেতর থেকে তিনটি পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসছে। তিনি শুনতে পেলেন। তারা ব্যালেচার পার্টি করছে। আফসান মধ্যপান করেছে। প্রিয়ল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তারা প্ল্যান করে আশবিনকে জেলে ঢুকিয়েছে কথাটি আরও দুজনকে জানাচ্ছে। আফসান সে সঙ্গে ঘটনাটি বিস্তারিত বলল। সোফিয়ার ভেতরটা কেমন নিঃশব্দ হয়ে এসেছে। তিনি দু পা পিছিয়ে গেলেন। নিজ হাতে পেলেপুষে একটা কালসাপকে বড় করেছেন তিনি। সোফিয়া ঘরে ফিরে এলেন। তার মাথা ভনভন করে ঘুরছে। তার একমাত্র ছেলে জেলে। বুক ফেটে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে চাচ্ছেন। সোফিয়া খাতুন দু'হাতে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তিনি বললেন, 'হে আল্লাহ! আমি কি এমন পাপ করেছি যার শাস্তি আপনি আমার ছেলেকে দিচ্ছেন? ও আমার আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে আর কষ্ট দিবেন না। ওর সব কষ্ট আমাকে দিন। আমি মা হয়ে তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আপনি আমাকে শাস্তি দিন।'

রাত এগারোটার দিকে রুমে এলেন শাজান সিকদার। সোফিয়া খাতুন তখন তাকে সবটা খুলে বলেন। সোফিয়া খাতুন কাঁদতে কাঁদতে শাজান সিকদারের পায়ে পড়ে যান। শাজান সিকদার গভীর শ্বাস ছাড়লেন। কপাল কুঁচকে বললেন, 'এই কাজ আফসান করেছে। তুমি নিজের কানে ওদের কথা শুনেছ?'
'হু।' সোফিয়া খাতুন বললেন, 'আমার ছেলেকে মুক্ত করুন। ওকে জেল থেকে বের করুন। আমি মা হয়ে আপনার পা ধরে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেকে জেল থেকে বের করুন। আমার যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।'
শাজান সিকদার নিঃশব্দে মাথা নত করে ফেলেন। ছেলে দুটো অনেক বড় হয়েছে , বাপের কোনো কথাই তারা শোনে না। কাকে কি বলবেন? দুটো কথা শোনার মতো মন মানসিকতা তাদের নেই। পারলে দুটো কথা শুনিয়ে দেয় তারা। 

শাজান সিকদার মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন৷ 'আমি বিষয়টি দেখব। তুমি এই ব্যাপারটা সবার কাছে গোপন রাখবে।কাউকে কিছু বলবে না। আর আফসান যেন কোনোভাবেই জানতে না পারে।'
'আমি কাউকেই বলব না।'
'আমি আশবিনকে বের করে আনবো। তুমি দুঃশ্চিন্তা কোরো না। এখন হাতমুখ ধুয়ে নাও। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছ।'
'আপনি আমাকে কথা দিন। আমার ছেলেকে জেল থেকে বের করবেন।'
শাজান সিকদার গম্ভীর গলায় বললেন,
'কথা দিলাম।'
·
·
·
চলবে…………………………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp