গাড়ির ধাতব গায়ে গুলনূরের পিঠ ঠেকতেই তার নিঃশ্বাস গুলিয়ে যায়। জাওয়াদ মুহূর্তেই তার গালের দু'পাশ ধরে ফেলে। আঙুলের চাপে গুলনূরের গালদুটো খানিকটা ডেবে যায়। সে অশ্রুসজল চোখে কিড়মিড় করে বলে, 'ছলনাময়ী।'
ব্যথার তীব্রতায় ছলছল চোখে তাকায় গুলনূর। তার ওই মন কেমন করা দৃষ্টি দেখে জাওয়াদের চোখেও অদ্ভুত কুয়াশা জমে ওঠে। অশ্রুর ভারে ভারী হয়ে আসে পলক। বুকের গভীরে অবাধ্য প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। হঠাৎই, সব অনুভূতির ধারাকে ছিন্ন করে, গুলনূর ক্ষিপ্র গতিতে ডান হাত তোলে জাওয়াদের মুখের ঠিক কেন্দ্রে—নাকের ওপর—বজ্রাঘাতের মতো ঘুষি বসায়। চটাস শব্দে চারপাশে ঝাঁকুনি লাগে। জাওয়াদ দুলে গিয়ে এক পা পিছিয়ে যায়, শরীরের ভারসাম্য টলতে টলতে শেষ মুহূর্তে ধরে ফেলে নিজেকে। নাক থেকে গরম, ঘন, লালচে রক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে এসে ঠোঁটের কোণে থামে। সে চোখ তোলে তাকায় বিস্ময় নিয়ে।
গুলনূর পালাতে ঘুরে দাঁড়ায়। তার পা কাঁপছে। শরীর, মন যুদ্ধ করছে সাহস আর আতঙ্কের টানাপোড়েনে। জাওয়াদ নাকের রক্ত হাতের পিঠ দিয়ে মুছে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলনূরের দুই হাত মচকে এমনভাবে পেছনে মুরিয়ে ধরে যে পালানোর পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মুখটা গুলনূরের কানের কাছে এনে সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলে, 'যে রক্ত আমার বুক থেকে ঝরিয়েছ… তার হিসাব না চুকিয়ে কোথায় পালাবে তুমি?'
গুলনূরের বুকের ধুকপুকানি কানের পর্দা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চাইলে সে এখনই জাওয়াদের অণ্ডকোষ বরাবর এক লাথি মেরে ওভারকোটের ভেতরে লুকানো দ্বিতীয় ছুরিটা বের করে এক ঝটকায় আঘাত করতে পারে। তার ছুরির হাত নিখুঁত, নির্দয়। কাঁধ, কব্জি, নিতম্বের কোন অংশ ছিন্ন করলে মানুষ কতক্ষণ টলতে টলতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সব তার নখদর্পণে।
কিন্তু জাওয়াদের সামনে সেই দক্ষ, স্নায়ু-মজবুত হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার হাত কাঁপছে না, অথচ মন কাঁপছে। এই মানুষটার বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলা সম্ভব নয়। কতদিন পর দেখছে তাকে! কতদিন পর তার সান্নিধ্যে এসেছে! অদ্ভুতভাবে মুখ খুলেও কিছু বলতে পারছে না। নিজের অজান্তে সেই পুরনো বোবা গুলনূর হয়ে গেছে, যে অভিনয় করে দীর্ঘদিন কথা বলা বন্ধ রেখেছিল।
এমন সময় পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। গুলনূর প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করে ছোটার জন্য, জাওয়াদের আগ্রাসী শক্তির কাছে তা ব্যর্থ হয়। কাটা কাটা গলায় জাওয়াদ বলে, 'চুপচাপ হাঁটো। ওদের হাতে পড়লে কিন্তু বেঁচে ফিরতে পারবে না।
মিথ্যে নয়! জাওয়াদের হাতে পড়লে অন্তত প্রাণটা রক্ষা পাবে, কিন্তু ইলিয়াসের হাতে ধরা পড়া মানেই নির্মম মৃত্যু। সেই তুলনায় জাওয়াদের সঙ্গে যাওয়া ঢের ভালো। জাওয়াদ ধাক্কা দিতেই গুলনূর হুড়মুড়িয়ে পা চালায়। মনে পড়ে অরিজিতের কথা—ক্লাবের পেছনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল তার। আছে কি সে? এটাই কি সেই পেছনের রাস্তা?
মনের ভেতর প্রশ্নের ঢেউ তুলতে তুলতে গুলনূর এগিয়ে চলে বাতির আলো মিলিয়ে যাওয়া গলিপথ ধরে। চারপাশ জনশূন্য, নীরবতার শ্বাসরোধী ভারে ঢেকে আছে সব। অরিজিতের কোনো চিহ্ন নেই! কীভাবে ছাড়া পাবে জাওয়াদের হাত থেকে? জাওয়াদের আঙুলগুলো শেকড়ের মতো তার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে আছে।
ধমকের সুরে বলে, 'ডান দিকে হাঁটো।'
গুলনূর বাধ্য হয় ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকতে। কিছুদূর পর সেই নীল গাড়িটির সামনে এসে থামে তারা। পেছন থেকে দরজা খুলে জাওয়াদ হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে গুলনূরকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। ঠাণ্ডা চামড়ার সিটে ধাক্কা খেয়ে তার শরীর সামান্য কেঁপে ওঠে, ঠোঁট থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে হালকা কাশি বের হয়।
গুলনূর আর নীরব থাকতে পারে না। উঠে বসে, জাওয়াদের চোখে চোখ রেখে বলে, 'তোমার আর আমার জীবন আলাদা। আমার জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িও না। দয়া করে আমাকে আমার পথে যেতে দাও।'
এদিক-ওদিক অস্থির চোখে তাকানো জাওয়াদ হঠাৎ থমকে যায়। তার চোখ বিস্ফারিত হয়! অবিশ্বাসের ভারে ভারী হয়ে তাকিয়ে থাকে গুলনূরের মুখের দিকে। গুলনূর… কথা বলছে? এই মেয়েটা কথা বলছে? তার ভেতরের কোনো অদৃশ্য অংশ যেন কেউ হাতুড়ির বাড়ি মেরে চূর্ণ করে দিয়েছে। অথচ একসময় সে প্রাণপণে চাইত গুলনূর কথা বলুক, একটুখানি উত্তর দিক। তবে কি সবটাই মিথ্যে ছিল? কিছুই সত্য ছিল না? অবশ্য যে মেয়ে তাকে, তার পরিবারকে অসম্মানিত করার উদ্দেশ্য বিয়ের মঞ্চ থেকে পালিয়ে যেতে পারে, তার জীবনে আর কত অজানা অধ্যায়ই না লুকিয়ে থাকতে পারে!
জাওয়াদের বিদ্রূপমিশ্রিত হাসি হাসে। নিজেকে ভয়ানক বোকা মনে হতে থাকে৷ এই গুলনূরের ভালোর জন্য সে কতকিছুই না করেছিল! আক্ষেপে, কষ্টে শুধু বলে, 'শালার কি বোকাটাই না বানিয়েছ!'
গুলনূর চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
জাওয়াদ রাগে তাকে ধাক্কা দিয়ে আরও ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা জোরে বন্ধ করে ভেতর থেকে লক করে দেয়। নিজে গিয়ে বসে ড্রাইভারের সিটে। ধাক্কার আঘাতে গুলনূরের শরীর ব্যথায় ছটফট করে ওঠে, কপাল অনিচ্ছায় কুঁচকে যায়। চেঁচিয়ে বলে, 'কী সমস্যা তোমার? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?'
'জাহান্নামে।'
'ওখানে তুমি এমনিই যাবে… একজন নারীকে অপহরণ করার দায়ে।'
বলেই সে মরিয়া হয়ে দরজার লক খোলার চেষ্টা করে। বারবার ধাক্কা দিতে থাকে দরজায়, তার শরীরের প্রতিটি পেশি আতঙ্কে টানটান হয়ে আছে। হতবুদ্ধি হয়ে জাওয়াদ হঠাৎ ব্রেক কষে গাড়ি থামায়। এক ঝটকায় গুলনূরের হাত মাথার উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যায় পিঠের দিকে, শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। রশির নির্মম আঁটুনি কাঁধ, বাহুতে এমন ব্যথা ছড়িয়ে দেয় যে গুলনূর হালকা কেঁপে ওঠে, 'কী করছো? ব্যথা পাচ্ছি!'
কোনো উত্তর না দিয়ে জাওয়াদ আবার চাবি ঘোরায়। গাড়ি গর্জন তুলে সামনে ছুটে যায়। গুলনূর কতক্ষণ হতবাক হয়ে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হেলান দিয়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? কী করবে তার সাথে? কীভাবেই বা সে জাওয়াদের হাতে ধরা পড়ল? নানা চিন্তার ভিড়ে নওয়াজ বাহাদুরের কথা এসে ধাক্কা মারে মস্তিষ্কে! উনি কি ক্লাব থেকে বের হতে পেরেছেন? তাকে না পেলে কী করবে? কোথায় যাবে? প্রশ্নে প্রশ্নে গুলনূরের মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে যায়।
গভীর রাত। নিশুতি নিস্তব্ধতায় ডুবে থাকা শহরের রাস্তায় একা একা ছুটে চলছে গাড়িটি। চারদিকে শুধু অন্ধকার আর মাঝে মাঝে রাস্তার পাশের হ্যালোজেন স্ট্রিট লাইটের মলিন আলো। বৈদ্যুতিক লাইন থেকে ঝুলে থাকা তারগুলো বাতাসে দুলছে। গাড়ির সিল করা হেডলাইট দুটো অন্ধকারের মধ্যে হলদেটে আলো ছড়িয়ে পথ দেখাচ্ছে। স্টিয়ারিং-এর পেছনে বসা জাওয়াদ মাঝে মাঝে চোখের কোণে তাকাচ্ছে পাশের সিটে বসে থাকা গুলনূরের দিকে।
যে মেয়েটার জন্য সে পাগলের মতো এই গাড়ি নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, রিকশা-টেম্পোতে চড়ে খুঁজে ফিরেছে প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি চায়ের দোকানে - সেই মেয়েটাই এখন তার পাশে বসে আছে। অথচ তার মুখে কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই, চোখে-মুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। গাড়ির জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। জাওয়াদের বুকের মধ্যে ঢেউ খেলে যাচ্ছে নানা রকমের অনুভূতি। কখনো ভালোবাসার তীব্রতা, কখনো অভিমানের জ্বালা, কখনো বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা। গুলনূরকে খুঁজে বের করার জন্য কত পথ হেঁটেছে সে! বিয়ের দিন গুলনূর হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরের দিনই তার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল একটা হাতে লেখা চিঠি। খামের ওপরে কোনো নাম ছিল না। শুধু ভেতরে একটা কাগজে কালি আর কলম দিয়ে লেখা ছিল রাজধানীর নাম। আর কিছুই ছিল না - না কোনো ছবি, না কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকানা বা নম্বর। শুধু একটা ছোট্ট ইঙ্গিত — কপালের ডান পাশে লম্বাটে কাঁটার দাগ।
এই একটা চিহ্নের সাহায্যে, এই একটুকুই অবলম্বন করে জাওয়াদ শুরু করেছিল তার অসম্ভব খোঁজযাত্রা। দিনের পর দিন সে ঘুরেছে রাজধানীর এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। কখনো রিকশায় চড়ে, কখনো টেম্পোতে, কখনো বাসে, কখনো নিজের গাড়িতে। প্রতিদিন সকালে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পড়তো, দুপুরে রাস্তার ধারের হোটেল থেকে ভাত খেতো, সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে চা খেতো আর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতো, 'ভাই, কপালের ডান পাশে লম্বা কাঁটার দাগ আছে এমন কোনো মেয়েকে চিনেন?'
এই প্রশ্নটা সে করেছে হাজার বার। রাস্তার চায়ের দোকানদার, রিকশাওয়ালা, দর্জি, মুদির দোকানদার, পানের দোকানদার - সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে। রাস্তার মানুষজন তাকে দেখে অবাক হতো। অনেকেই বলতো, 'দাগ দেখে কী আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়? এই শহরটা এত বড়, মানুষ এত, দাগ-মাগ কার না থাকে!’
কিন্তু জাওয়াদ হাল ছাড়েনি। গ্রাম থেকে যে টাকা এনেছিল, তা দিয়ে কিছুদিন ছিল সস্তা একটা মেসে। আর কিছুদিন ঢাকা থেকে দূরে একটি পুরনো বাড়িতে। দিনে দুবেলা খেতো, রাতে ফিরে এসে ডায়েরিতে লিখে রাখতো কোন এলাকায় গেছে, কার সাথে কথা বলেছে। পুরো শহরের একটা ম্যাপ কিনে নিয়েছিল, সেখানে লাল কলম দিয়ে দাগ দিয়ে রাখতো কোন কোন এলাকায় খোঁজ শেষ। প্রতিদিন রাতে শুয়ে ভাবতো গুলনূরের কথা। কখনো চোখ দিয়ে পানি পড়তো ভালোবাসার আকুলতায়, আবার কখনো বালিশে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতো। মাঝে মাঝে রাগে-দুঃখে দেওয়ালে মুষ্টি মারতো।
কয়েক মাস পর একদিন হঠাৎ করে মনে পড়ে পুরনো একটা ঘটনা। যেদিন গুলনূরকে নিয়ে রাজধানীতে এসেছিল, সেই রাতেই আহত অবস্থায় সন্ত্রাসীদের ধাওয়া খেয়ে রাস্তায় জ্ঞান হারিয়েছিল। যখন হুঁশ ফিরেছে, তখন আবিষ্কার করে, একটা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। সামনে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন অচেনা মানুষ। কিছুদিন পর আবার সেই লোকগুলোর মধ্যে দুইজনকে নিজের গ্রামেও দেখতে পেয়েছিল। কোনোভাবে কি তাদের সঙ্গে গুলনূরের যোগাযোগ ছিল? প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই পরদিন সেই হাসপাতালে ছুটে যায়। সেখানকার রেজিস্ট্রার রুমে গিয়ে বলে, 'স্যার, অমুক তারিখে আমাকে কিছু লোক এখানে ভর্তি করিয়েছিল। তাদের ঠিকানা আমার খুব প্রয়োজন।'
রেজিস্ট্রির লোকেরা প্রথমে রাজি হয় না। বলে, 'এসব তথ্য আমরা দিতে পারি না।'
জাওয়াদ অনুরোধ করে, 'স্যার, আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। প্লিজ সাহায্য করুন।'
তাতেও যখন রাজি হয় না। শেষমেশ এক পরিচিত দারোগার সাহায্যে হাসপাতাল থেকে পায় নওয়াজ বাহাদুর নামের একজনের নাম আর তার টেলিফোন নম্বর। একটা টেলিফোনের দোকান থেকে সেই নম্বরে কল করতেই ওপাশে একজন মেয়ে ফোন ধরে। লাইন খারাপ, আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।
জাওয়াদ উঁচু গলায় কথা বের করতে আন্দাজে বলে, 'হ্যালো, এটা কি সিরাজপুর?'
মেয়েটা একটু অবাক হয়ে বলে, 'না! কাঠালতলী। কে বলছেন?'
জাওয়াদ বলে, 'আমি রাশেদ নামের একজনকে খুঁজছি। আপনার নাম কী?"
মেয়েটা দ্রুত বলে, 'এখানে রাশেদ নামে কেউ নেই। রং নম্বর।' বলেই লাইন কেটে দেয়। জাওয়াদ আর ফোন করে না। ভাবে, যদি সত্যিই গুলনূর ওই পরিবারের কাছে থাকে, যদি তারা সন্দেহ করে, তাহলে হয়তো জায়গা পালটে ফেলবে। তাই পরের দিনই রওনা দেয় কাঠালতলীর দিকে।
কাঠালতলীর প্রতিটি সরু অলিগলি, প্রশস্ত রাস্তা, ভিড়ভাট্টার বাজার সব জায়গায় সে চোখ রেখেছে। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছে, খুঁজেছে পরিচিত কোনো মুখের দেখা। টানা তিনদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমেও যখন কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি, তখন হতাশা তার মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। চতুর্থ দিনের বিকেলবেলা, যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, তখনই কাঠালতলীর একটি পরিচিত মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ চোখে পড়ে পরিচিত মুখ। অরিজিত! তার হৃদয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এত দিন যে আশার আলো খুঁজছিল, সেটা যেন হঠাৎ করেই জ্বলে উঠল।
জাওয়াদ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, অরিজিতকে আর চোখের আড়াল করা যাবে না। তাই যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, নিঃশব্দে তার পিছু নিতে শুরু করে। অরিজিত মাঝেমধ্যে কৌশলে পেছন ফিরে তাকায়, কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না যাচাই করতে। প্রতিবারই জাওয়াদ দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে আশপাশের ভিড়, দোকান কিংবা দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে, যেন তার উপস্থিতি টের না পায় অরিজিত।
দীর্ঘ পথচলার পর অরিজিত এসে পৌঁছায় বাঁশতলা রোডে। কাঠালতলী থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত এই রাস্তা তুলনামূলকভাবে শান্ত, জনসমাগমও কম। কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণে জাওয়াদ বুঝতে পারে, অরিজিতের এখানে আসা নিছক কাকতালীয় নয়। প্রতিদিনই সে একই সময়ে, একই পথে এসে হাজির হয়।
অরিজিতের গন্তব্য হলুদ রঙের একটি পুরানো বাড়ি। বাড়িটি আকারে বড়সড়। দেয়ালে আভিজাত্যের ছাপ রয়ে গেছে, যদিও রঙ অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। চারপাশ ঘিরে উঁচু প্রাচীর, লোহার গেট। প্রবেশপথে সবসময় এক বা দুইজন কড়া চোখের পাহারাদার দাঁড়িয়ে থাকে।
অরিজিত প্রতিদিন বাড়িটির ভেতরে ঢোকে, ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে, তারপর চলে যায়। জাওয়াদ বহুবার চেষ্টা করেছে সুযোগ বুঝে ভেতরে প্রবেশ করতে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।
·
·
·
চলবে……………………………………………………