তাবাসসুম রোবটের মতো বসে আছে বিছানার উপর৷ নিজের ভিতর কোনো অনুভূতি আপাতত টের পাচ্ছে না সে। পাথরের মূর্তির মতো বসে তনুর দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে। তনু তাবাসসুমে হঠাৎ এমন মূর্তিধারী রূপ দেখে তাবাসসুমকে ধাক্কা মেরে বলল,
“কি হলো তোমার? এমন ভ্যাটকাইয়া গেলা কেন?”
তাবাসসুম কিছু বলল না। তার মস্তিষ্ক বারবার বিয়ের কথাটাই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিসের বিয়ে? কবে সিদ্ধান্ত হলো বিয়ের কথা? পাত্রপক্ষই বা কবে দেখতে এলো তাকে? সবকিছু কি ম্যাজিকের মতো হচ্ছে? পাত্র পাত্রীকে দেখা নেই, পাত্রী পাত্রকে দেখা নেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল? আশ্চর্য ব্যাপারস্যাপার!
“বিয়ের কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে, জীবনের বিদায় দিলা নাকি?”
তনুর কথায় তাবাসসুম টনক নড়িয়ে তনুর দিকে তাকালো এবার। সহসা তাবাসসুমের মনে হলো তনু ফাজলামি করছে। ফাজলামি নাহলে, বিয়ে কিভাবে ঠিক হবে? তাও সে জানেনা?
মেয়েটা একমুহূর্তের জন্য হার্টে বাড়ি খাইয়ে দিয়েছিলো। একটুর জন্য বের হয়ে যায়নি। তার প্রণয় পুরুষের কথা ভেবেই তো বুক ভার হয়ে আসছিলো। হৃদয় খন্ডিত হতে যাচ্ছিল৷ তাবাসসুম জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলল। তনুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ফাজলামি করছিস? সবসময় ফাজলামি ভালো লাগেনা।”
তনু অবাক হয়ে বলল,
“ওমা! ফাজলামি কেন করবো তোমার সাথে। তুমি দেখতে পারছো না তোমার বিয়ের কথা শুনে আমার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। আহা! বিয়েটা যার সাথেই হোক। একটা বিয়ে তো হচ্ছে।”
“তনু ফাজলামি করবি না। বিয়ে কখন ঠিক হলো? আর আমার বিয়ে ঠিক হলো আমি জানলাম না?”
“আরেহ, তোমাকে তো অবাক করে দিতে চেয়েছিল ভাইয়া।”
তাবাসসুম অবাক স্বরে বলল,
“ভাইয়া? কিসের ভাইয়া?”
“এই দেখছো কেমন অবাক হচ্ছো। থাক আমি আর ওতশত বলবো না। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার কাছ থেকেই শুনে নিও। আমি যাই শপিং প্লান করি।”
বলেই তনু নাচতে নাচতে চলে গেল। পিছন থেকে তাবাসসুম তনুকে ডাকতে লাগলো। তনু কানেই ঢোকালো তাবাসসুমের কথা। নিজের মতো নাচতে নাচতে চলে গেল৷
তাবাসসুম বিছানা থেকে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো। ফাজলামো পেয়েছে নাকি মেয়েটা? কিসের ভাইয়া? কিসের অবাক করা? বিয়ে? কিসব বলে গেল! আর বিয়েই বা কার সাথে? আর ওর বিয়ের খবর ও জানেনা? আশ্চর্য!
—————
তাবাসসুম মায়ের ঘরে এসে দেখল, মমতা বেগম আর মুনায়া বেগম ঘরে বসে গল্প করছেন। দুজনের মুখে হাসি লেগে আছে। তাবাসসুম দুজনের কথা বলার মাঝেই ঘরে ঢুকল। তাবাসসুম কে দেখে মমতা বেগম জিজ্ঞেস করলেন—
“তোহা? কিছু বলবি?”
তাবাসসুম মাথা ঝাকালো দ্রুত। মুনায়া বেগম মেয়ের পানে তাকিয়ে বললেন,
“কি বলবি?”
তাবাসসুম কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলো। তনু ফাজলামি করেছে নাকি সত্যি বলেছে সেটা তো জানেনা। এখন হুট করে মুনায়া বেগমকে যদি বলে, তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করেছে? খবরটা মিথ্যে হলে নিশ্চয়ই ফুফু আর মা এখন হেসে কুটিকুটি হবেন। তাবাসসুম কিছুক্ষণ ভাবলো৷ ভেবে না বলার সিন্ধান্ত নিলো। পাত্রী ছাড়া কিভাবে বিয়ে হয়?
মুনায়া বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে কি বলবি?”
“না কিছুনা?”
বলেই তাবাসসুম বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। মমতা আর মুনায়া বেগম পুনরায় গল্পে মজলেন।
—————
তাবাসসুম উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হাতে ফোন। বিয়ের কথাটা সত্যি না হয়ত। তবুও তাবাসসুমের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছে। একের পর এক মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে তার প্রণয় পুরুষকে। কিন্তু সিন করছে না। তাবাসসুম আবার মেসেজ দিতে লাগলো একের পর এক।
“কোথায় তুমি? এখন আমি কি করবো বলো? কান্না পাচ্ছে আমার। বাবা-মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়েই যাবে। কোথায় তুমি?”
তাবাসসুমের একের পর এক মেসেজ তার প্রণয় পুরুষ দেখল আরও মিনিট দশেক পর। তাবাসসুম ততক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, তার প্রণয় পুরুষের রিয়েকশন কেমন হবে? সে কি সত্যি বিশ্বাস করে নিবে বিয়ের কথাটা? বিশ্বাস করলেও পরে কি করবে?
তাবাসসুমের ভাবনাচ্যুত করে ফোন বেজে উঠল। দেখন তার প্রণয় পুরুষের কল। তাবাসসুম সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করলো। তৎক্ষনাৎ ওপরপ্রান্ত থেকে ব্যগ্র কন্ঠস্বর,
“ফাজলামি করছো বসন্ত কন্যা?”
তাবাসসুম নিজের গলা যথেষ্ট ভাঙা ভাঙা করার চেষ্টা করে কান্নারত সুরে বলল,
“আমি কি করবো বুঝতেছি না। বাবা-মা প্রচন্ড সিরিয়াস বিয়েটা নিয়ে। বিয়েটা বোধহয় হয়েই যাবে।”
“মানে কি এসবের? হঠাৎ বিয়ের কথা কোথা থেকে আসছে? এই মজা করছো তুমি আমার সাথে?”
তাবাসসুম ঠোঁট টিপে হাসল। গলা ভেঙে বলল,
“মজা কেন করবো বলো? আজকে সকালে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল আমাকে। তারপর বাবারা মিলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেছে। সামনের সপ্তাহেই হয়ে যাবে বোধহয়।”
তাবাসসুমের কথা শেষ হতেও ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। বেশ কিছু সময় নিরবতা পালন করে ওপরপ্রান্ত থেকে বলে উঠল,
“সকালে তুমি ছাদে ছিলে। দেখতে আসার চান্স নেই। ফাজলামি বন্ধ করো। এক মুহুর্তের জন্য জানটা বের করে দিচ্ছিলে!”
তাবাসসুম ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় বললো,
“তুমি জানলে কিভাবে সকালে আমি ছাদে ছিলাম?”
“তোমার সব খবরই তো আমার কাছে থাকে।”
“তাহলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলে কেন?”
“তোমার ওতগুলো মেসেজ দেখে। হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। নেক্সট টাইম এমন ফাজলামো যেন না দেখি? হুম?”
“ভেবে দেখি। আপনার ভীত কন্ঠস্বররা কিন্তু প্রচন্ড সুন্দর!”
বলেই ঠোঁট টিপে হাসলো তাবাসসুম। ওপরপাশ থেকে ধমকের স্বর ভেসে আসলো,
“ফাজিল মেয়ে।”
“ভালোবাসো?”
“জীবনের সমান।”
তাবাসসুম হাসলো। তৃপ্তির হাসি।
“তবে ভয় করোনা। তোমার বসন্ত কন্যা কেবল তোমার নামেই থাকবে।”
তাবাসসুম আরও কতক্ষণ গল্প করলো তার প্রণয় পুরুষের সাথে। ফোন রাখতে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। তাবাসসুম দরজায় তাকিয়ে দেখল, শাফান দাঁড়িয়ে আছে। তাবাসসুম বিছানা থেকে উঠলো। শাফানকে ভিতরে আসতে বলল। শাফান ভিতরে আসল।
“কার সাথে কথা বলছিলি?”
“ফ্রেন্ডের সাথে।”
“ওহহ।”
শাফান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,
“তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিলো। ছাদে আসতে পারবি?”
“হ্যাঁ। আপনি যান আমি আসছি।”
শাফান তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মুখটা জ্বলজ্বল করছে। আজকে সব কথা তাবাসসুমকে বলবে। ভালোবাসার কথা, বিয়ের কথা সব বলবে। সব!
শাফান মুচকি হেসে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তাবাসসুমও বের হচ্ছিল তখনই তার ফোনে মেসেজ এর টুংটাং আওয়াজ আসে। তাবাসসুম বিছানার কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, তার প্রণয় পুরুষের মেসেজ।
“বসন্ত কন্যা ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি। খুশির একটা খবর শুনবে? তবে আজকে তোমার ইচ্ছে তে শোনাই। দেখা করছি।”
তাবাসসুম মেসেজটার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। দেখা করছি? দেখা করছি আমরা? কথাটা মাথায় ঢুকতে তাবাসসুম লাফিয়ে উঠল একপ্রকার। তার প্রণয় পুরুষকে দেখতে পারবে? তাবাসসুমের হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফানো শুরু করলো এবার।
·
·
·
চলবে……………………………………………………