সুমনার কোল জুড়ে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান শুয়ে আছে। ক্ষীণ নিঃশ্বাসে ওঠানামা করছে ছোট্ট বুকটা। সে যেন পৃথিবীর সব শব্দ থেকে দূরে এক নিঃশব্দ আলোয় ডুবে আছে। চোখদুটো বন্ধ, পাতলা দুটি ঠোঁট ফাঁকা, সাদা তোয়ালে জড়ানো ক্ষুদ্র শরীর। অবিশ্বাস্যরকম ছোট পা, পায়ের আঙুল পর্যন্ত এত সূক্ষ্ম আর নিখুঁত যে সুমনার ভয় করে—একটুও চাপ লাগলে যদি ব্যথা পায়। এই অনুভূতিটা আগে কখনো হয়নি। আনন্দে, দুচোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সে জানে, এই শিশুটিই তার অস্তিত্বের নবজন্ম। আশ্চর্য হলেও সত্য, বাচ্চাটির মুখ অবিকল সুমনার মতো। কপালের ভাঁজ, নাকের গড়ন, ঠোঁটের রেখা—সবই যেন মায়ের প্রতিচ্ছবি। নিজের ভিতর থেকে জন্মানো এই শিশুটি তাকে এতটা নিখুঁতভাবে অনুকরণ করবে তা সুমনা কল্পনাও করেনি।
রাজ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ছিল, কাঁদতেই মা'য়ের কোলে দেয়। এখন শান্ত হতেই আবার নিজের কোলে নিয়ে নিলো। মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে,
“আমার ছোট্ট বাবা? এই ছোট্ট গলা দিয়ে এত জোরে কীভাবে কাঁদো তুমি?”
বাবার কথা বাচ্চাটা কি বুঝলো কে জানে। ওমনি সাথে সাথে ঠোঁট উল্টিয়ে ফেললো। তা দেখে রাজ দ্রুত বলে,
“না না না! আমার বাবা ভালো ছেলে। গুড বয়। বড় হলে তোমাকে আমি বড় একটা গাড়ি কিনে দিব ঠিক আছে?”
এমনি আরো অনেক কথা বলতে লাগলো সে। সুমনা পাশ ফিরে তাকায়। তার চোখে অবিশ্বাস, মুগ্ধতা, অতীতের ক্ষত সব মিলেমিশে এক জ্যোতির রেখা। রাজকে দেখে তার বুক ভরে ওঠে। সে কথা বলে না, শুধু চেয়ে থাকে। এই মুহূর্তে হাসপাতালে কেউ নেই। রাজ নিজেই দায়িত্ব নিচ্ছে সবকিছুর। সুমন রহমান বাড়ি গেছে খাবার আনতে। সবাইই ছিলো একটু আগে। এখন গেছে বাড়িতে। ভিতরে শুধু এরা তিনজন—একটা মায়া-জড়ানো পৃথিবী। রাজ শিশুটির ছোট্ট হাত নিজের আঙুলে পেঁচিয়ে নেয়, রাজ দেখে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তখনি আলগোছে আরো যত্ন করে নিজের কাছে রাখলো। যাতে ঘুম না ভাঙে। সুমনার পাশে বসে একটু চুপ করে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে—
“তুমি কেমন আছো এখন? ব্যাথা কমেছে? ”
সুমনা চোখ তুলে তাকায় রাজের দিকে। মাথা হেলিয়ে হালকা করে বলে,
“ভালো আছি।”
“কিছু খাবে?”
“নাহ্, আমাকে সব খেতে বারণ করেছে।”
“ঠিকআছে।”
রাজ একটু থমকে যায়। এরপর শিশুটির গায়ে তোয়ালেটা একটু ঠিকঠাক করে দিয়ে বলে।
“আমি ভাবছি তোমায়, বাবুকে বাসায় নিয়ে যাবো, ছুটি দিলে।”
সুমনা সাথে সাথেই মাথা নাড়ে—
“না। এখন না। আমার পুরো শরীরে খুব ব্যথা, কি যন্ত্রণা! নড়তে পারছি না।”
রাজ বলে—
“আমি আছি তো।”
সুমনা তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। সে জানে তাকে দেখা মাত্রই রাজের মা হাত গুটিয়ে বসে থাকে। বড়জোর এক সপ্তাহ? তারপরেই কাজের অর্ডার দিবেন ভদ্রমহিলা। অর্ডার দিয়েই খালাস হউন, কি হয় না হয় আর দেখেন না! এই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সাথে নবজাতক বাচ্চাকে নিয়ে সুমনা কিছুতেই পারবে না! তারই এখন যত্নের প্রয়োজন সাথে বাচ্চাও আছে। এখন কিছুতেই না, এবার নিজের কথা ভেবে নিঃশব্দে বলে—
“তবুও না। এত তাড়াতাড়ি না রাজ। আমি একটু পুরোপুরি সুস্থ হই? আর কয়েকটা দিন।”
“কিন্তু সুমনা আমার বাচ্চা**
“তুমি যতটা সহজ ভাবছো ততটাও নয়! একটু ধৈর্য্য ধরো। তোমার বাড়িতে তোমার বড় বোনও নেই। শুধু আম্মা আছেন! তাই বলছি।”
রাজের ভ্রু কুঁচকে যায়। ঠোঁট চাপা দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মুখ নিচু করে বলে—
“ঠিকআছে! তোমার সুস্থতাকেই প্রাধান্য দিলাম।”
রাজের সুরটা যেন একটু রাগী, বিরক্ত।
সুমনা চুপ থাকে। তার ভেতরে ক্ষোভ জেগে ওঠে না। কোনো কথা ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হয় না। শুধু নিজের শরীরটার দিকে একবার তাকায়। নিজের নিজের পেট—যেটা কেটে এই শিশুটাকে বের করা হয়েছে। এখনই হঠাৎ নড়াচড়া করলে ব্যথা যেন গা ছুঁয়ে চলে যায় মাথার ভিতর পর্যন্ত। এই মুহূর্তে তর্ক করে কী হবে? রাজ জানে না এই যন্ত্রণা কেমন। জানে না কাল যখন ভর্তি হলো, ডাক্তার চেকআপ করে বলেছিলো,
“রিস্ক আছে, সিজার করে ফেলাই ভালো।"
রাজ তখন কোথায়? সুমনা যখন ওটিতে যাচ্ছে, চোখে মুখে আতঙ্ক, বুকের গভীরে জমে থাকা একখণ্ড ভয়—সে চারপাশে তাকিয়ে শুধু একটা মুখ খুঁজেছে—রাজ। কোথাও পায়নি তাকে।
মনে হচ্ছিল, যদি রাজ না আসে? যদি আর কোনোদিন তাকে না দেখতে পায়? কত শত চিন্তা মনে! ভয়ে ভয়ে কেঁদেছে মেয়েটা!
মোবাইলে বারবার কল করেছে। কল ধরে নাই। পরে জেনেছে রাজ মিটিংয়ে ছিল, মেসেজ দেখেনি। সকালে রওনা দিয়ে জ্যামে আটকে পড়ে দুপুরের আগে পৌঁছাতে পারেনি। আর ততক্ষণে শিশুটি পৃথিবীর আলো দেখে ফেলেছে। অপারেশন শেষে যখন এনেস্থেসিয়ার প্রভাব কেটে যায়, সুমনার শরীর কাঁপছিলো। খিচূনী উঠে গেছিলো, বুক ভারী, পেট ছেঁড়া যন্ত্রণায় সে সোজা হয়ে শুতে পারছিল না।সে কি যন্ত্রণা! বলে বোঝানোর মতন না। যেন এর চেয়ে মৃত্যু ও ভালো ছিলো। এখন সন্ধ্যা। ব্যথা কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। এই শরীর, এই হাল, এই অবস্থা নিয়ে সে রাজের বাসায় গিয়ে নতুন করে কীভাবে মানিয়ে নেবে? তারউপর রাজ যতই বলুক খেয়াল রাখবে, সে তো দিনের পুরোটা সময়ই অফিসে থাকবে! তারউপর এটা প্রথম বাচ্চা! কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সব মিলিয়েই সুমনা বলে আর কিছুদিন পর যাবে। কারণ এই সময় তার নিজের মা'কে খুব প্রয়োজন। যেটা রাজের মা যতই ভালো হউন না কেন, সুমনার মায়ের মতন যত্নটুকু করতে পারবে না।
তারপর কেটে যায় অনেকগুলো দিন.....
বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেককিছু বদলায়নি, তবে সুমনার জীবনের চিত্রপট একেবারেই পাল্টে গেছে। সিজারিয়ানের যন্ত্রণা এখনও মাঝে মাঝে ব্যথা দেয়। সেলাইয়ের অংশে খোঁচা লাগে হঠাৎ, কাঁপিয়ে তোলে পুরো শরীর। তবুও এখন সে হাঁটতে পারে।
ধীরে ধীরে, ব্যথাকে সঙ্গী করে সে বিছানা থেকে উঠে আসে। তবে দ্রুত গতি, ভারি কোনো কাজ বা শিশুকে একা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকা—এখনও কঠিন। বাচ্চাটি এখন দিনভর ঘুমোয়, আর রাতভর কান্না করে। দিনের আলোয় তার চোখ আধবোজা, কিন্তু সূর্য ডুবে গেলে হঠাৎ করে যেন তার শরীরে প্রাণ আসে। কান্নার এক অদ্ভুত ছন্দে সে জেগে ওঠে। কখনও গলায় আওয়াজ ওঠা কান্না, কখনও নিঃশব্দ উউউউ শব্দ—সেটা কখনো বোঝা যায় না ঠিক কী কারণে। প্রস্রাবের পরিমাণ এত বেশি যে রাতেই কাঁথা অনেক ভিজে যায়।
ডায়াপার পরানো যেত, কিন্তু বাচ্চার কোমরে রেশ উঠেছে—একেবারে লাল হয়ে জ্বালাপোড়া করে। তাই মাও অনুমতি দেন না। সারা রাত পর পর কাঁথা, জামা, বদলাতে হয়। এমন সময় সুমনার পাশে তার মা থাকেন বলেই সে এখনো খানিকটা নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। ছেলে যখন আধো কান্না দিয়ে ওঠে, সুমনার মা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন। শিশুটার পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। সুমনা বিরক্ত হলেও তিনি সুমনাকে বলেন,
“এই বয়সে এমনই করে। তুই যেমন করেছিলি। আমি তোকে কোলে নিয়েই কাটিয়েছি, কত রাত! মায়েদের ধৈর্য্য ধরতে হয়।”
সুমনা তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখে। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার সেইসব কথা, যখন মা প্রায়ই বলতেন—
“মা হওয়া এত সহজ না। তুই যখন মা হবি তখন বুঝবি।”
সেই কথার প্রতিটি অক্ষর যেন এখন বাস্তব হয়ে গেছে। নিজেকে এখন আর আগের সেই স্বপ্নে ভেসে বেড়ানো মেয়েটি মনে হয় না। সে এখন একজন মা।
একজন ক্লান্ত, রাতজাগা, শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া, সন্তানের মুখ দেখে তৃপ্ত হয়ে যাওয়া মা।
একদিন রাতে, ছেলেটা কান্না থামায় না। সুমনা কোলের দোলায় ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করে। মা এসে পাশে বসেন। সুমনা চোখ নামিয়ে নেয়। সত্যিই তার শরীর আর চোখে ক্লান্তির রেখা ঘন হয়ে জমেছে। কিন্তু এতটুকু ছেলেটার পাশে না থেকে কি ঘুমাতে পারবে সে? পারেও না। রাত গভীর হয়। বাচ্চা হালকা ঘুমে ঢোকে। মা তার পাশে বসে থাকে। সুমনা হেলান দিয়ে শুয়ে থাকে। কখনো সখনো ঘুমিয়ে ও পড়ে।
নিজের শরীরটাকে যেন আর চেনে না। বুকের ভেতর এক ধরনের কষ্ট জমে আছে—ভালোবাসার কষ্ট, দায়িত্বের কষ্ট, জন্ম দেওয়ার রক্তাক্ত আনন্দের কষ্ট।
মা হওয়া শুধু শরীরের ভেতর আরেকটা প্রাণ ধারণ করার নাম নয়। মা হওয়া মানে দিন রাতের বিনিদ্র যুদ্ধ। রাজ মাঝেমধ্যে কল করে। অভ্যাসে পড়ে গেছে যেন—দু-একদিন পরপর একটা ফোন, নিছক দায়বদ্ধতা। কিন্তু সেই ফোনালাপগুলো আর আগের মতো প্রেমময় হয় না। শুরুতে কিছু সৌজন্যমূলক প্রশ্ন—
তারপর হঠাৎ করেই আবহাওয়া বদলে যায়।
কণ্ঠের ভার বদলে যায়। একটু মতবিরোধ, একটুখানি অভিযোগ, কিংবা বাচ্চা নিয়ে মতের অমিল.. আর তারপর—ঝগড়া। ঝগড়াগুলো এমনই যেন ওটাই রুটিন। ঝগড়ার মধ্যেই মিশে গেছে সম্পর্কের ভাষা। কথা বলতে বলতেই লাইন কেটে যায়, কিংবা রাগে গলা চড়িয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে সুমনা বোঝে, আর বোঝাতে চায় না।
সেদিন দুপুরে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সুমনা জানালার পাশে বসে কিছুক্ষণ নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। হাতের মোবাইলটা তুলে রাজকে কল দিলো না, বরং একটা মেসেজ করলো—
“আমি এখন যেতে চাই, শরীর প্রায় ঠিকআছে, তুমি আসবে নিতে?”
সুমনার সোজাসাপটা কথা। মাঝে কোনো অভিযোগ বা আবেগ জুড়ে দেয়নি।
অপেক্ষা করলো। আধাঘণ্টা পর রাজের রিপ্লাই এলো,
“এখন পারব না। ব্যস্ত আছি। পরে বলো।”
যেন সম্পর্কটা আর তেমন গুরুত্ব রাখে না।
সুমনা ফোনটা একপাশে রেখে দিলো। হয়ত এ সত্যটা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝে গেল সে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো, বাচ্চা হলে রাজ বদলে যাবে। একটা নতুন জীবন তো বদলায় অনেক কিছু। কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায়নি। রাজ এখনও আগের মতোই—বিচ্ছিন্ন, খাপছাড়া, হিসেবের বাইরের মানুষ।
সুমনার মাথায় প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—
এই সংসারটা আদৌ টিকবে তো?
শুধু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কি আর সারাজীবন চুপ করে থাকা যায়?
কতদিন সে বুঝিয়ে যাবে রাজকে? কতবার বলবে—‘আমি কষ্টে আছি, একটু বোঝার চেষ্টা কর!’
আর কতকাল এমন ‘পরে বলবো’-এর ভিতর নিজের সমস্ত আশা, আবেগ আর অপেক্ষাকে গিলে ফেলবে সে?
বাচ্চাটা হালকা আওয়াজ করে। সুমনা কোলে তুলে নেয়।সুমনা দোলায় বাচ্চাটাকে, নিজের ভিতরটা নিঃশব্দে গুমরে ওঠে— এ সংসার, এ সম্পর্ক, এ নিঃশব্দ ধ্বংস... কীভাবে যে কী হবে, সে নিজেও জানে না। তবে এটুকু জানে— সে আর আগের সুমনা নেই। তাকে বদলে দিয়েছে মাতৃত্ব, বদলে দিয়েছে একাকীত্বের দায়।
সন্ধ্যার নরম আলোয় ঘরটা ভরে আছে শিশুর নিঃশ্বাসে। সুমনা বসে আছে জানালার পাশে, কোলে ঘুমন্ত সন্তান। রাজের ফোন আসল হঠাৎ।
“বাবু কি করছে?”
“ঘুমাচ্ছে!”
“আমি দেখতে চেয়েছিলাম একটু।”
সুমনা দম নিয়ে বলে,
“ওর রুটিনই এটা, সন্ধ্যায় ঘুম যাওয়া।”
“উঠলে কল দিও। কালকে বাবুকে দেখিনি তো।”
“ঠিকআছে দিব।”
“কিছু লাগলে বল***
“কি বলবে? তোমাকে বলেছি না, কফি খেতে আসতে? আসো।”
সুমনা চুপচাপ শুনছিল। মেয়েলি হাসির আওয়াজ ভেসে আসছিল স্পিকারের ফাঁক দিয়ে—চেনা কণ্ঠ।
অচেনা নয়, খুব চেনা। অস্বস্তিকরভাবে চেনা।
“রাজ, কার সাথে কথা বলছিলে?”
প্রশ্নটা নরম স্বরে করলেও তার ভিতরে ঝড় বইছে।
রাজ একটু থমকে গিয়ে বললো,
“ও নিশিতা।”
সুমনার মুখ হঠাৎ শুকিয়ে যায়। রাজের প্রাক্তন।
যার জন্যে! সে আজ আবার... আর রাজ এখন তার সঙ্গে ফোনে এত হাসাহাসি করছে?
সুমনা গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
“তাহলে এখনো যোগাযোগ আছে তোমাদের?”
রাজ একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
“কাজের একটা ব্যাপার ছিলো। সিরিয়াস কিছু না।”
“কফি খাওয়ানো কাজ?”
“কলিগরা মিলে খাচ্ছিলো, তাই আমায় বললো!”
সুমনা আবারো বলে,
“সেজন্য এই একজনই? আর কেউ নেই?”
“উফ! আবার শুরু হয়েছে তোমার? এভাবে হলে চলবে না সুমনা! তুমি তোমার মতন থাকছো না? সব পাচ্ছ, আর কি চাই?”
কল কেটে যায়। নিশিতার সাথে এত হাসির কী? রাজ কি সত্যিই কাজ নিয়ে ব্যস্ত? নাকি শুধু তার সাথেই সে এখন বিরক্ত? আমি মা হয়েছি বলেই কি আমি এখন তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই? একটা শিশুকে জন্ম দিয়ে, রাত জেগে, নিজের শরীরের যন্ত্রণায় ছটফট করেও, আমি কি এতটাই নিষ্প্রয়োজন?
সুমনা ছেলের মুখের দিকে তাকায়। সে তো এখনো কোনো কিছু বোঝে না। তবে তার এই নীরব ঘুমের মধ্যে যেন নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি আছে। যেটা রাজ তাকো দিতে পারছে না।
সুমনা ভাবতে থাকে—
রাজ কি সত্যিই পাল্টে গেছে?
নাকি আমি-ই ভুল করে ফেলেছিলাম, ভেবেছিলাম একটা বাচ্চা আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে?
ভুল করেছিলাম এই বিশ্বাসে যে, একজন বাবা হয়ে সে বুঝবে দায়িত্ব মানে কী। কিন্তু রাজ বুঝল না।
আজও সে হাসছে সেই মেয়েটির সঙ্গে, যার সঙ্গে সুমনার জায়গা নিয়ে লড়াই হয়েছিল একদিন।
চোখের কোণে জল আসে না। সুমনা এখন কান্না করে না সহজে। বরং তার ভেতরে কেবল জমে ওঠে এক নিরব প্রশ্ন—
"এই সম্পর্কটা কি আমার একারই বোঝা হয়ে গেল?" আর কতদিন এভাবে যাবে?
“সুমনা? খেতে আসবি না?”
বাবার কন্ঠস্বর শুনে সুমনা নিজেকে স্বাভাবিক করে। সুমন রহমান রুমে চলে এসেছে।
“বাবা, সায়র সবে ঘুমিয়েছে। ওর তো কাঁচা ঘুম। কেউ পাশে না থাকলে উঠে পড়ে। মা আসলে আমি খাবো।”
সুমন রহমান তখন মেয়েকে আশ্বস্ত করে।
“তুই খেতে যা, তোর মা এক্ষুনি আসছে।”
সুমনাও চলে যায়। মনে মনে একটা কথাই আসে,
“মা ছাড়া মা হওয়া, আসলেই যায় না!”
—————
বাচ্চাটার পেটে গতকাল রাত থেকেই গ্যাসের সমস্যা। কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ ফুলে গেছে। একটানা কান্নায় নিজেও ঘুমাতে পারেনি সে। ভোর হতেই মাকে ডেকে, রেডি হয়ে যায় সুমনা। সকালে রিকশায় করে বাড়ি থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে তারা এসেছে এক নামকরা শিশু চিকিৎসকের কাছে। হাসপাতাল নয়, চেম্বার। গলির ভেতর হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন। বাইরে একটি ছাউনির নিচে বসার জায়গা। ছোট ছোট বাচ্চার কান্না আর ভিড়ে জায়গাটা। সুমনা নিজের কোলেই সন্তানটিকে ধরে আছে। সায়রের মুখটা অস্বস্তিতে কুঁচকে আছে, মাঝে মাঝে পেট মোচড়ায় কান্না শুরু করে। ডাক্তার ভেতরে ব্যস্ত। সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থেকে পিঠে ব্যথা জমেছে, কোমর ঝিম ঝিম করছে। মা সামনের দোকানে গেছে বাচ্চার জন্য কটন, লোশন, আর ড্রপার কিনতে।
হঠাৎ তৃষ্ণা পায় সুমনার। ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সন্তানের গায়ে ওড়নাটা ঠিকঠাক করে পাশের দোকানে একটু পানি কিনবে বলে এগোয়। আর তখনই আঁটকে যায় তার চোখ।
ভিড়ের ভেতর, রাস্তার ওদিকটায়, এক ক্লিন শেভড যুবক দাঁড়িয়ে আছে। একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। আলো ছায়ার মাঝে চেহারাটা অস্পষ্ট, তবুও ভুল করার উপায় নেই। ওই কাঁধটা, ওই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা, ওই চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা গাম্ভীর্য—সব যেন এক অচেনা সময়ের চেনা হাহাকার। রাজ!
তার মুখে কোনো ক্লান্তি নেই, কোনো অস্থিরতা নেই।
সুমনার বুকটা ধপ করে নামে। গলার ভেতর একটা জোর ধাক্কা খায়। মুহূর্তের ভেতর চারপাশের শব্দ, আলো, রাস্তার ধুলাবালি, এমনকি সন্তানের নড়াচড়াও দূরে সরে যায়। সে শুধু তাকিয়ে থাকে।
রাজ হাসছে এমনভাবে, যেন পৃথিবীতে তার কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। কেউ নেই! যেন একটা মেয়ের জীবন এলোমেলো করে দিয়ে সে দিব্যি রাজা হয়ে বাঁচছে। সুমনা নড়তে পারে না। শিশুটি তখন তার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ওঠে। সেই কান্না যেন রাজের কানে পৌঁছায় না। হয়ত পাশে তার নতুন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত সেই নতুন মানুষ, যার জন্য সুমনাকে বলেছিল,
"উপায় না থাকলে তুই ছেড়ে দে, না হলে আমি তালাক দিয়ে দিব!"
সুমনার চোখ জ্বলে ওঠে। তবে সে কাঁদে না। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। বুকের শিশুটির মুখে ওড়নাটা টেনে দেয়। তারপর একবার গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। রাজ এখনও তাকে দেখতে পায়নি।তবু সে আর দাঁড়িয়ে থাকে না। পানি না নিয়েই ফিরে যায় ডাক্তার চেম্বারের দিকটায়।
সন্ধ্যার আলো তখনও পুরোপুরি গাঢ় হয়নি, আকাশের কিনারায় একটু কমলা, একটু সোনালি রঙ লেগে আছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বাচ্চাকে কোলে করে হাঁটতে হাঁটতে সুমনা যখন বাসায় ঢোকে। তার মুখে কথা নেই। তার মায়ের চোখও বোঝে—এই চুপচাপটা স্বাভাবিক নয়। সুমনা তার সন্তানকে বুকের ওপর শোয়ায়, ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়। বাচ্চার ছোট্ট নিঃশ্বাসের শব্দে আশ্রয়ের মতো কিছু আছে? কিন্তু আজ তাতেও তার শান্তি আসছে না।
হাসপাতালের সেই মুহূর্ত বারবার মনে পড়ছে—সুমনা যখন দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ সামনে থমকে দাঁড়ায়। কী যেন এক অবচেতন টানে চোখ যায় ডানদিকে, রাস্তার ওপারে। পরিপাটি পোশাক, মুখে উজ্জ্বলতা, চুলে খোঁপা করা, হাতে রাজের হাত। হাসছে। সেই চেনা হাসি। রাজও হাসছে। সেই মুখভঙ্গি, সেই ভঙ্গিমা, সেই স্বাচ্ছন্দ্য—যেন এক দম্পতি বহু বছরের সুখী সঙ্গী।
যে মানুষটাকে নিয়ে সব স্বপ্ন বুনেছিল সে, যে মানুষটির হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল, সমাজ ছেড়েছিল, পিতামাতা সব ছেড়েছিল—সে মানুষটা আজ অন্য কারও সঙ্গে? এতটা সহজে?
চোখের কোণে পানি গড়িয়ে পড়ে। বুকের শিশুটার মুখের দিকে তাকিয়ে নেয় সুমনা। মনে হয়, এই শিশু ছাড়া তার কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন।
রাত বাড়ে। শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়। ঘড়িতে রাত দশটা পেরিয়েছে। জানলার পাশে বসে সুমনা মোবাইলটা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে অবশেষে সাহস করে কল দেয় রাজকে।
দূর থেকে রাজের গলা—
“হ্যাঁ, বলো।”
সুমনা একটু থেমে বলে,
“আজকে তো কল দিলে না!”
“কাজের চাপ এত! সময় পাইনি। মনে হয় প্রমোশন হয়েই যাবে।”
রাজের কথা শুনে সুমনা স্মিত হাঁসলো। এতই ব্যস্ত? সেজন্যই রাস্তার পাশে মেয়ে নিয়ে ঘোরাঘুরি?
“ছেলেটা কি করছে?”
“সায়র এখন ঘুমিয়ে আছে। গ্যাসের জন্য কষ্ট পাচ্ছিল। ডাক্তার দেখালাম।”
রাজের গলা এবার একটু কোমল,
“এখন কেমন আছে?”
“ভালো। ঘুমাচ্ছে এখন।”
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। রাজ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। একটু থেমে সুমনা বলল,
“তোমার তো এখন সময় হয় না। বাচ্চার মুখটাও দেখতে আসো না।”
“সুমনা! ও আমার সন্তান নয়? এভাবে কেন বলছো? আমি সময় পেলে চলে আসতাম!”
সুমনা তাচ্ছিল্য করে বলে,
“অথচ বাইরে ঘোরা ঠিকই হয়! তাই না? তার প্রাক্তন নিশিতার সাথে, ঘোরার সময় হয়!”
সুমনা জানে না মেয়েটি তার প্রাক্তন কিনা! আন্দাাে ঢিল মারার মতন প্রশ্ন ছুড়লো। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। রাজ শান্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ।”
অভিমানী মেয়েটির কণ্ঠে এবার ব্যথার রেখা, প্রশ্ন হয়ে বের হলো—
“ প্রাক্তনকে নিয়ে ঘোরাঘুরি?”
“এখন শুরু হবে!”
রাজের এরকম খাপছাড়া কথায় সুমনা নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। গলার স্বর উচু করে একনাগাড়ে বলে,
“তাহলে আমাকে কেন আনলে জীবনে, রাজ? যদি নিশিতা এখনো থেকে যায় মনের মধ্যে, তাহলে আমায় কেন আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলে? কেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে এনেছো আমায়? প্রাক্তনের সাথে প্রেম যদি আজও এতটাই জীবন্ত, তাহলে তাকে বর্তমান বানাতে চেয়েই বা আমাকে কেন অতীত করছো?”
“এসব কি কথা?”
“সত্যি কথাই! তুমি প্রাক্তনের সাথে ঘোরাঘুরি করতে পারো ঠিকই, বউ বাচ্চার জন্য সময় হয় না!”
রাজ নিচু স্বরে বললো,
“আসলে নিশিতা, এমন ভাবে বললো! ওর নাকি মুড অফ তাই অফিস থেকে একটু দূরে নিয়ে গেছিলাম।”
”বাহ্ রাজ! ভালো করেছো! অথচ আমি? আমার কথা মনে পড়ে না? ভুলে গেছো আমাকে?”
“উফফ! এসব বাজে কথা বলে, বিরক্ত করিও না!”
সুমনার রাগ দুঃখ সব এবার একাকার হয়ে গেলো! ফের শুধোয়,
“তাহলে তাকে নিয়েই থাকতে। আমাকে কেনো এনেছো? বিয়ে কেনো করেছো? কেনো আমার জীবনটা নষ্ট করেছো? কেনো সবার চোখে আমাকে খারাপ বানিয়েছো! কেনো,রাজ? কেনো!”
“আচ্ছা যা, আমি তোকে এনেছি তো? যা তাহলে তোকে মুক্তি দিচ্ছি! সবকিছু থেকে মুক্তি! এক তালাক! দুই****
শব্দগুলো ছিলো বজ্রপাতের মতো। আর সহ্য করতে না পেরে কল কেটে দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিলো! পুরোপুরি শোনার সহ্য ক্ষমতা নেই সুমনার!
শব্দটা কানে বাজলো আবারও— বুকের ভিতর ধ্বসে পড়লো সমস্ত নিরাপত্তা, সমস্ত আশ্রয়। নীরব হয়ে গেল সে। কণ্ঠ হারিয়ে গেল কোথাও। জিভ শুকিয়ে এলো, ঠোঁট কেঁপে উঠলো—কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। বিছানার এক কোণে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে নিঃশব্দে। অন্য কোণে বসে থাকা মা হয়ে সুমনা শুধু ভাবছে—
“রাজ সত্যিই বলল? তালাক?”
চোখে জল নেই, তবু বুকের ভিতর পাহাড়সম চাপা কান্না। সেই কান্না কোনো শব্দ করে না। শুধু স্তব্ধতা হয়ে নেমে আসে, একজন মায়ের কোলজুড়ে।
সেই রাত্রি এক নিস্তব্ধ বিষণ্ণতা হয়ে ছড়িয়ে ছিল চারপাশে। এক চিলতে বাতাসের ধাক্কায় জানালার পর্দা দুলছে, কোথাও একটা কুকুর ডাকছে দুরে—নীরবতার গাঢ়তাকে আরেকটু গাঢ় করে। অথচ এই ঘরের মাঝে কেবল একটা মন কাঁদছে—অপ্রকাশ্য, অশ্রুহীন এক দীর্ঘ কান্না। সবাই ঘুমাচ্ছে। রাজ নিশ্চিন্ত হয়তো, হয়তোবা ঘুমে না, তবুও স্বস্তির অনুপাতে আড়ষ্ট, বিছানায় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর সুমনা? এক দিন নয় দু দিন, এক দু মাসও নয়! আজকে কতগুলো রাত সে এসবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে! যেখানে একটা মেয়ের প্রেগন্যান্সিতে সর্বচ্চ খেয়াল, সার্পোট তার স্বামীর থেকে আশা করে তা পেয়েও পায়নি সুমনা! আজকে কতগুলো মাস, এই মান অভিমানের খেলা। অভিমান বললেও ভুল হবে! ঝগড়া রাগ আর বিরক্তিকর পর্যায়ে এসে ঠেকেছে তাদের সম্পর্কটা! আর কত সহ্য করবে সে? কম তো হয় নি! অনেকগুলো মাসই পেরিয়ে গেলো। সে তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আর মানুষেরও এক সময় এসে ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে যায়!
সুমনা শুধু বসে আছে ছেলের পাশে। অন্ধকারে আধো আলোয় ছেলেটার মুখ যেন দেবশিশুর মতো শান্ত। যতটুকু তার আছে, এ তো সেই…! নিজের শরীর থেকে জন্ম নেওয়া, রক্তে মাংসে গড়া এক টুকরো ভালোবাসা। আজ সেও যেন দূরে যাচ্ছে কারো অজান্তে। কপালে হাত বুলিয়ে দেয় স্নিগ্ধ পরশে। মনে হয়, এ যেন শেষ আদর, শেষ ভালোবাসা। তার বুকের ভেতর থেকে হু হু করে বেদনা ওঠে। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে গাঢ় নিদ্রায়। সুমনা তার দিকে চেয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে উঠে পড়ে। আলমারির মাথা থেকে নামায় একটা পুরনো শিশি। আরেকটা জিনিস, তার জীবনের সবচেয়ে গোপন সঙ্গী, সেই ডায়েরি
ডায়েরি খুলে, কলম চালিয়ে দেয় সুমনা।
“একটা সম্পর্ক এত তুচ্ছ হয়ে যায়! জানা ছিলো না! যার জন্য সব ছেড়ে এসেছিলাম, সেই মানুষটাই আমায় ছেড়ে দিলো? তিনটি শব্দে ভেঙে গেল একটা গোটা জীবন।
ভেঙে গেল আমার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা, সমস্ত অপেক্ষা।
যার জন্য আমি আমার পরিবার ছেড়ে এসেছিলাম, আমার পরিচিত পৃথিবীটাকে উপড়ে এনে এক অচেনা পৃথিবীতে পা রাখলাম! সেই মানুষটাই আমায় ছেড়ে দিলো!
এইভাবে? এত সহজে? তিনটা শব্দে শেষ হয়ে গেল
আমাদের গল্প,
আমাদের ভালোবাসা,
আমাদের ভবিষ্যৎ,
এমনকি আমাদের সন্তানের অস্তিত্বও কি?
যার কাছে আমি সবার দেওয়া দুঃখ বলতাম, সেই মানুষটাই যে আমাকে ভেঙে চুরে শেষ করে দিলো! এবার এই দুঃখের কথা আমি কাকে বলবো?
রাজ, তোমার বলা, শব্দটার ওজন আমি আগে জানতাম না। জানলে হয়তো প্রেমের আবেগে সব পুড়িয়ে দিতাম না। আজ আমি বাপের বাড়িতে, কোলে আমার ছেলে। সবাই বলছিলো, "মেয়ে ভুল করেছিলো, শুধরে নিতে! আমি তাও শুনিনি। কত কটু কথা, সব সহ্য করে এসেছি। শুধু এটা ভেবে একদিন সব ঠিক হবে। আমাদেরও সুন্দর একটা সংসার হবে! আর রাজ? তুমি ভালোবেসে ছিলে কি না, সে প্রশ্ন আজ অবান্তর। তবে জেনে রেখো, তোমার জন্য আমি সব ছেড়েছিলাম, আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন করলে সেটা ভুল! তুমি ভাবতেও পারবে না, তুমি আজ আমার অস্বস্তি কীভাবে মুছে দিলে! ভেঙে চুরেই তো ছিলাম রাজ? আজ অস্তিত্ব টুকুও কেঁড়ে নিলে? নিজের পরিবার, বাপ, মা সবাইকে ছেড়ে আসার প্রতিদানে তবে এটাই আমার প্রাপ্য ছিলো!
বাবা, তোমার কাছে আমার কিছু কথা আছে।
তুমি আমাকে যতটা ভালোবাসতে, আমি কি আসলেই তোমাকে ততটা ভালোবেসেছিলাম সন্তান হিসেবে? আমি তোমার সে ভালোবাসার মর্যাদা দেইনি ঠিকঠাক। আজ বুঝি, অথচ আমি শুনিনি তোমার কথা, তোমার চোখের আকুতি। এখন আমিও সন্তানের মা। তোমার হাত ধরে হাঁটা শিখেছিলাম, সেই তোমার হাতই ছেড়ে দিয়েছি কি অনায়াসে! আরেক জোড়া হাত ধরার জন্য! হয়ত সেটার ফল পাচ্ছি। বাবা? ও বাবা আমার খুব কষ্ট হয় জানো তো বাবা? তোমার মতন করে দ্বিতীয় পুরুষটা আমায় কেন ভালোবাসলো না বাবা?
তোমার কষ্টটা বোধহয় উপলব্ধি করছি। যেটা আমি দিয়েছি! জীবনে দ্বিতীয়বারের মতন আরো একটা ভুল হয়ত করতে যাচ্ছি। তোমাকে একেবারে সন্তানহারা করে! আমায় ক্ষমা করো, তোমার এই হতভাগা সন্তানের সহ্য ক্ষমতা নেই! আমি নেই তোমার কাছে, তাই তোমার কাছেই ফিরিয়ে দিচ্ছি আমার সবচেয়ে প্রিয় ধন—আমার সন্তান। সে নাকি দেখতে আমার মতো। তোমার মেয়ের দুঃখ কমাতে পারবে হয়তো। তার চোখের ভেতর যদি খুঁজে পাও আমার ছায়া, তবে তাকে ভালোবেসো, তাকে আগলে রেখো। ভাবো, আমি হারিয়ে যাইনি। সে আমারই অবিরত প্রলম্বিত ধ্বনি। তার দিকে তাকালেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে।
তাকে তুমি মানুষ করো, মনের মতন মানুষ। যেরকম চেয়েছিলে আমাকে করতে! যেন কোনওদিন সে কাউকে এমন কষ্ট না দেয়, যেন সে হয় সম্মানিত, দায়িত্ববান, ভালোবাসায় পূর্ণ। তোমার কোলে দিয়ে গেলাম আমার সবটুকু। তুমি শক্ত থেকো। ওকে মায়ের অভাব বুঝতে দিও না। ভালো থেকো বাবা। এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তুমি ছিলে, কিন্তু আমি আর থাকতে পারলাম না। আমি ক্লান্ত বাবা। খুব ক্লান্ত। এই কষ্ট, এই বেঁচে থাকাটা খুব ভারী হয়ে উঠেছে। আমি আর পারছি না। আমায় ক্ষমা করো তোমরা সবাই।”
সুমনার হাতের কাঁপন থেমে গেছে। কৌটার ঢাকনাটা নিঃশব্দে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে একটা ঘূর্ণির মতো শব্দ তুলে স্তব্ধ হয়ে গেল। বিষের কৌটায় আর কিছু নেই—দেহে ঢুকে পড়েছে অন্ধকার, চোখদুটো খোলা, বুকের উঠান নামা থেমে গেছে। নিথর হয়ে পড়ে আছে সে, তার একমাত্র সন্তানের পাশেই। যে পৃথিবীতে আলো নেই সুমনার চোখে, সেখানে ঘুমও নেই—চিরদিনের জন্য চোখ বন্ধ করে দিয়েছে সে।
পাশেই ছোট্ট বাচ্চাটা ঘুম ভেঙে উঠেছে। ঘরের নিঃশব্দতাকে ছিন্ন করে ছড়িয়ে পড়ছে এক মর্মান্তিক কান্না। মায়ের বুক খুঁজছে সে। ক্ষুধার্ত! দুধের তৃষ্ণায় মুখ টানছে বাতাসে। অথচ, সেই মায়ের বুকটা আজ নিথর। উত্তাপ নেই, সাড়া নেই।
ছোট্ট হাত দুটো মায়ের গায়ে পড়ছে বারবার, হাত পা ছুড়ছে। মমম শব্দ করে কেঁদে উঠছে। সেই অক্ষর এখনও স্পষ্ট নয় তার মুখে, কিন্তু ডাকটা বোবা কষ্টে আকাশ ছুঁয়ে যায় যেন। এই ছোট্ট শিশু জানে না, মৃত্যু কী। সে জানে না যে মায়ের ঘুমটা এত দীর্ঘ হতে পারে। সে জানে না এই নিঃসাড়তা চিরস্থায়ী, চূড়ান্ত। তার বোঝার বয়স হয়নি যে, মা আর কখনো ফিরে আসবেন না, কোলে নেবেন না, বুকের ভিতর গুটিসুটি করে জড়িয়ে রাখবেন না, তার হাসিমুখ দেখে নিজেও হাসবেন না। হয়তো বুঝতেই পারছে না কিছু। জানে না, তার মা এই কান্না শুনে তাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখবেন না, মাথায় হাত বুলিয়ে গাইবেন না মেঘলা দুপুরের ঘুমপাড়ানি গান। সে শুধু অনুভব করে, আজ কোথাও কেমন যেন শূন্যতা। বুকের দুধের বদলে সে পাচ্ছে না কিছুই। অনাহার আর চেনা উষ্ণতার অভাব তাকে কাঁদিয়ে তুলেছে। উষ্ণতার বদলে একটা ধূসর, শীতল নিঃসঙ্গতা যেন তার চারপাশে জড়িয়ে ধরেছে।মায়ের নিঃসাড় শরীরের গায়ে ছোট্ট দুটো হাত পড়ছে বারবার—নরম হাত, কাঁপতে থাকা, বুকের দুধের গন্ধের খোঁজে উদভ্রান্ত। কখনো মুখ ঘষে, কখনো ছোট্ট আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরে মায়ের জামার কোণা। কিছুই হয় না। মা জেগে ওঠেন না।
বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠে! এমনভাবে যেন তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। মুখ লাল হয়ে উঠছে, নিঃশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। তবু কান্না থামে না। কেন থামবে? তার ক্ষুধা পেয়েছে, কিন্তু মায়ের বুক নেই। তার ভয় করছে, কিন্তু কোলে ওঠার জায়গা নেই। সে জানে না মৃত্যুকে, জানে না না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া মানে কী। তবু সে অনুভব করছে। তার মায়ের স্পষ্ট অভাব, যা পৃথিবীর কোনো শব্দে বোঝানো যায় না। একটি দুধের শিশু, এক গভীর অন্ধকার ঘর, এক নিথর মা—এই তিনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক করুণ পৃথিবী।
কেবল কান্না। কেবল শূন্যতা...!
বাতাস এসে জানালার কাছে রাখা কাগজের পৃষ্ঠাটা উড়িয়ে ফেলে দিলো! কিছু লেখা দেখে যাচ্ছে তাতে....
❝প্রেমে পড়ে কেউ কখনো একেবারে মরে না,
তারা কেবল প্রতিদিন একটু একটু করে, নিঃশেষ হয়। এই নিঃশেষতারই নাম প্রেমদাহ।❞
যেই প্রেমদাহে নিঃশেষ হলো সুমনা! শেষ হলো দুধের ছোট্ট বাচ্চা! তার ভুলের মাশুল গুনতে গিয়ে!
·
·
·
সমাপ্ত……………………………………………………