ইফা নিজ মনে বকতে বকতে শেরাজের ঘরের দিকে আসছে মুখে বিরক্তির ঝাঁঝ, "খালি আমাকে দিয়ে কাজ করায়! এই কর, সেই কর! যেন আমার আর কোনো কাজ নেই!"
রাগে গজগজ করতে করতে দরজায় ঠেলা দিতেই কিছু একটা দেখে থমকে গেল সে। শেরাজ এলোমেলোভাবে নিচে পড়ে আছে, শরীরের ভঙ্গি অদ্ভুত। মাথাটা খাটে শুধু আর শরীরের অর্ধেক ফ্লোরে। ইফা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, "ভাইয়া! কী হয়েছে তোমার?"
শেরাজ চিৎকার শুনে ধড়ফড়িয়ে করে উঠে বসল। ইফা এক দৌড়ে ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ভাইয়ের বাহু ধরে নাড়িয়ে বলল, "কি হয়েছে ভাইয়া তোমার?"
শেরাজ পাশে পড়ে থাকা সিরিঞ্জ আর শিশির বোতলটা বোনের নজরের আড়ালে ঠেলে দিলো খাটের নিচে। যদি এগুলা ইফার চোখে পড়ে তাহলে বাড়ি মাথায় তুলবে নিশ্চিত! ইফা ভাইয়ের অস্থিরতা টের পেলেও বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। আরো উদ্বিগ্ন হয়ে ভাইয়ের হাত ধরে নাড়িয়ে বলল, "কি হলো কথা বলছো না কেন?"
শেরাজ বিরক্ত হয়ে বলল, "এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?"
"চেঁচাবো না তো কী করব? যেই ভাবে চিৎপটাং হয়ে পড়ে ছিলে আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!" ইফার স্বরে এখনো আতঙ্কের ছাপ।
শেরাজ আঙুল দিয়ে চোখ চেপে ধরে এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "কি হয়েছে বল?"
"বাবা ডাকছে তোমাকে।"
শেরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল, "কেন?"
ইফা "চ" সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল, ''তা তো জানি না!"
শেরাজ ধীর স্বরে বলল, "তুই যা, আমি আসছি।"
ইফা যেতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। ভাইয়ের লালচে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "ভাইয়া! তোমার চোখ লাল কেন?"
শেরাজ এক মুর্হূতের জন্য থমকালো। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে ধমকের স্বরে বলল, "কাঁচা ঘুমে থাকা একটা মানুষের কাছে যদি কেউ এসে এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচায়, তাহলে সেই মানুষটার চোখ লাল থাকবে না তো কি থাকবে?"
ইফা একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, "তুমি এভাবে শুয়ে ছিলে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম…"
"হয়েছে এবার যা।"
ইফা সন্দিহান চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শেরাজ আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখ কি বেশি লাল হয়ে আছে? কপাল চেপে ধরে নিজেকে স্থির করতে চাইল। নিজেকে এতোটা নিয়ন্ত্রণ করার পরেও কি করে এই কাজটা করতে পারলো? এর উত্তর নেই তার কাছে। শেরাজ এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।
—————
শেরাজ বাবা-মায়ের রুমে ঢুকতেই ইহসান মির্জা সামনে রাখা ফাইল বন্ধ করে ছেলেকে দেখলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, "বসো।"
শেরাজ চুপচাপ বাবার মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করল, "কেন ডেকেছো?"
ইহসান মির্জা সোজা হয়ে বসে বললেন, "তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।"
শেরাজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, "কি কথা?"
"তুমি কি একেবারের জন্য দেশে ফিরে এসেছ?"
শেরাজ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাথা ঝাঁকালো, "হুম।"
ইহসান মির্জা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ালেন, যেন কিছু চিন্তা করছেন। তারপর বললেন, "ঠিক আছে। যখন এসেছ, তখন বিজনেসের দায়িত্ব বুঝে নাও। আমি একা কত দিক সামলাবো?"
শেরাজ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ছেলেকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে ইহসান মির্জা কপাল কুঁচকে বললেন, "কী হলো, দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?"
শেরাজ স্বাভাবিক স্বরে বলল, "নিবো দায়িত্ব, সমস্যা নেই।"
ইহসান মির্জা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, "তাহলে আগামীকালকে জয়েন করো।"
শেরাজ এবার ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে বলল, "করব। কিন্তু আমার একটা গাড়ি লাগবে।"
ইহসান মির্জা অবাক হয়ে বললেন, "গ্যারেজে তো অনেক গাড়ি আছে যখন যেটা মন চায় নিয়ে নিও।"
শেরাজ মাথা নাড়ল, "নতুন গাড়ি চাই।"
ইহসান মির্জা এবার ভ্রু কুঁচকালেন, "নতুন গাড়ি? এত গাড়ি থাকতে আবার নতুন গাড়ি কেন?"
এবার শাহানা বেগম ফোড়ন কাটলেন, "এমন করছো কেন তুমি? ও তো তোমার কথা শুনে বিজনেসে যোগ দিতে রাজি হয়েছে। আর তুমি ওর সামান্য একটা ইচ্ছা পূরণ করতে পারছো না! পাঁচ বছর পর ছেলেটা বাড়িতে এসেছে আমার আর কিছু চেয়েছে আর সেটা তুমি দিতে পারছো না?"
ইহসান মির্জা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন, বুঝতে পারলেন বিষয়টা নিয়ে আর তর্ক করার মানে নেই। অবশেষে জিজ্ঞেস করলেন, "কোন মডেলের গাড়ি চাও?"
শেরাজ এক মুহূর্তও দেরি না করে বলল, "মার্সিডিজ বেঞ্জ G63 AMG। তিন বছর যাবত ধরে যেই গাড়ি প্যারিসে ব্যবহার করে এসেছি সেই গাড়ি।"
ইহসান মির্জা তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে, তারপর ধীর স্বরে বললেন, "ঠিক আছে ব্যবস্থা করে দেবো।"
—————
তমসাচ্ছন্ন রাত। নিশাচর প্রাণীদের ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে। পুরো শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, কিন্তু মেহুলের ঘরের লাইট জ্বলছে। সে অ্যাসাইনমেন্ট করতে ব্যস্ত। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন আগামীকাল। তাই পায়ের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে অ্যাসাইনমেন্ট করছে। এই পা নিয়ে ভার্সিটিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে না তার, কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট গুলা জমা দেওয়ার জন্য হলেও তাকে যেতে হবে ভার্সিটি। এটাই বাস্তবতা।
লেখা প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এমন সময় দরজায় হালকা শব্দ হলো। কলমের খসখসানি থেমে গেল। মেহুল থমকে গিয়ে শোনার চেষ্টা করল। কে হতে পারে এত রাতে? দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো মেহুলের। একটু দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কে?"
কোনো উত্তর এলো না দরজার ওপর প্রান্ত থেকে। মেহুল আবারো জিঙ্গাসা করলো কিন্তু এবারও কোনো সাড়া এলো না। কেউ কি আদৌ এসেছে নাকি তার মনের ভুল। মেহুল নিজের মনের ভুল ভেবে আবারো লেখায় মনোযোগ দিলো। বারো মিনিট পর অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে মিনিটের কাঁটা ত্রিশের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। মেহুল পুরো অ্যাসাইনমেন্টটা চেক করে যত্ন সহকারে রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উদ্দেশ্য ওয়াসরুমে গিয়ে নিজেকে ফ্রেশ করে ঘুমাতে যাওয়া। মেহুল ওয়াশরুমে ঢুকে চশমাটা বেসিনের পাশে রেখে মুখে পানি ছিটালো। ঠান্ডা পানিতে ক্লান্তি কিছুটা কমলো। তারপর মুখটা ক্লিক করার জন্য মুখে ফেসওয়াশ দিলো। ওয়াশরুমে ঢোকার মিনিট পাঁচেক পর আবারো একটা শব্দ হলো এবার শব্দটা যেন মনে হলো কেউ লাফ দিয়ে নিচে নেমেছে। মেহুল চমকে উঠে। থমকে গেছে সে পুরোপুরি। কি হচ্ছে এসব? বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে। ভয় যেন পুরো শরীরের শীতল স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। এগুলো কি সত্যি নাকি তার কল্পনা? মেহুল চশমা চোখে দিয়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে দেখে কিছুই নেই। চারপাশ নিস্তব্ধ তবু মনে হচ্ছে কেউ যেন তার আশেপাশে আছে। মেহুল শুকনো ঢোক গিলল। কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ ফিসফিস করে বলে উঠল, "এখনও ঘুমাস নি দাদার নাতনি?"
মেহুল আতঙ্কে চমকে উঠলো! দ্রুত পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো শেরাজ দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে সেই অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। মেহুল কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, "শেরাজ ভাই তুমি!"
শেরাজ ভ্রু উঁচিয়ে মুচকি হাসল, "চমকে গেলি কেন? ভয় পাচ্ছিস নাকি?"
মেহুল শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, "তুমি কি করে এলে ঘরের ভেতর দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ?"
শেরাজ আলগোছে বেডে এসে বসলো। এক পা অন্য পায়ের ওপর তুলে নরম স্বরে বলল, "মিলিয়ে মিলিয়ে!"
মেহুল বেলকনির দরজার দিকে তাকালো। দরজা খোলা। তার মানে শেরাজ বেলকনি দিয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ যেই যেই শব্দ গুলা শুনেছে সেই সব শব্দ শেরাজ করেছে। মেহুল ঢোক গিলে কণ্ঠ শক্ত করে বলল, "তুমি প্লিজ এখান থেকে চলে যাও। বাড়ির কেউ জানলে সমস্যা হবে।"
শেরাজ ধীরেধীরে উঠে দাঁড়ালো। মেহুল তার নড়াচড়া দেখে আনমনেই এক পা পিছিয়ে গেল, "ভয় পাস আমায়?"
মেহুল জবাব দিলো না। শেরাজ নৈঃশব্দ্যে হেসে বলল, "ভয় পাস তাহলে আমায়? বেশ! ভয়টা রেখে দে কাজে লাগবে!"
মেহুল অনুনয়ের সুরে বলল, "প্লিজ, তুমি যাও এখান থেকে।"
শেরাজ ঠান্ডা গলায় বলল, "কেন?"
মেহুল বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাল। শেরাজ এবার আরেক ধাপ এগিয়ে এসে হিম শীতল কন্ঠে বলল, "গায়ে কলঙ্ক লাগবে বলে ভয় পাচ্ছিস, মেহুল? কিন্তু তোর গায়ে তো সেই পাঁচ বছর আগেই কলঙ্কের দাগ লেগে গেছে।"
মেহুলের চোখে নোনা জল চিকচিক করছে। আর ঠিক তখনই শেরাজ পাগলের মতো হেসে উঠল। একটা অদ্ভুত হাসি যে হাসির মানে বোঝা বড় দায়। মেহুল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল শেরাজের দিকে। এ যেন অন্য এক শেরাজ।
মেহুল ধরা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, "প্লিজ, তুমি এই ঘর থেকে চলে যাও!"
শেরাজ ঠান্ডা স্বরে বলল, "চলে যাবো কিন্তু আমার উত্তর চাই!"
মেহুল অবাক হয়ে তাকাল, "উত্তর? কিসের উত্তর?"
শেরাজ গম্ভীর গলায় বলল, "তুই দাদা ভাইকে মিথ্যা কথা বলেছিস কেন?"
মেহুল ভ্রু কুঁচকালো, "আমি মিথ্যা বলেছি? কখন?"
শেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, "তুই পায়ে কিভাবে ব্যথা পেলি, সেই সত্যি কথাটা না বলে মিথ্যা কথা বললি কেন?"
মেহুল চুপ রইল। শেরাজ এবার রাগে ধমক দিয়ে বলল, "আনসার মি, মেহুল! মিথ্যা বললি কেন?"
মেহুল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, "আমি... আমি তো আসলে..."
"আমি তো আসলে কী?" শেরাজ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
"তুই কী ভেবেছিস? দাদা ভাই যদি সত্যিটা জানে, তাহলে আমাকে বকাঝকা করবে আর আমি সেই ভয়ে গুটিয়ে যাবো? তাহলে ভুল ভেবেছিস! আমাকে একদম দয়া দেখাতে আসবি না মেহুল! তোর দয়া তোর কাছে রেখে দে, দরকার পড়লে প্যাকেটে ভরে সেই দয়া আলমারিতে তুলে রাখ! আর নেক্সট টাইম মিথ্যা বলার আগে দু’বার ভাববি বুঝলি?"
বলেই দরজা খুলে ধপধপ পায়ে বেরিয়ে গেল শেরাজ। মেহুল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। শেরাজ ভাই তার উপর এতটা রেগে আছে? সে তো শেরাজের ভালোর জন্যই সত্যি কথাটা বলে নি। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরেছে। আর নানা ভাই যদি জানতো এই বিষয়টা তাহলে রাগারাগি করতো বাড়িতে অশান্তি হতো যেটা সে চায় নি। আর শেরাজ কিনা ভেবে বসে আছে সে তাকে দয়া দেখিয়েছে? আর একবারও জিজ্ঞেস করল না, তার পায়ের অবস্থা কেমন? এতো নিষ্ঠুর মানুষটা? কত গুলা তিক্ততা ভরা কথা তাকে শুনিয়ে চলে গেলো। মেহুল এসব ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখের জল মুছল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু চোখের জল যেন নিজে থেকেই গড়িয়ে পড়ছে। শেরাজ ভাই তাকে শুধু রাগ দেখিয়ে যায় নি বরং মনে করিয়ে দিয়ে গেছে পাঁচ বছর আগের সেই বিভীষিকাময় ঘটনা...। যেটার জন্য একটা রাতটাও সে শান্তিতে ঘুমাতে পারে নি। বার বার সেই সব দৃশ্য গুলা চোখের সামনে বাস্তব রূপে ভেসে ওঠে।
·
·
·
চলবে...................................................................................