গ্যারেজে বসে চায়ের স্বাদ নিচ্ছে রওশন মাহবুব। সঙ্গী কিশোর শফি সহ অনেকেই। মৌসুমের ঠান্ডা ঠান্ডা বৃষ্টি, গরম ধোঁয়ায় উড়ানো চায়ের স্বাদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। রওশন হাসি মুখে শফির সাথে গল্প করে সাথে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয় নেওয়া কিছু পথিক। সবার হাতেই চা। আলাপ আলোচনার মধ্যে এক মুরুব্বি নিজ বাজারের থলে দেখিয়ে বলে,
" তোমগোরে চাচি আম দিয়া খিচুড়ি খাইবো। কালাই নাই ঘরে তাই বাজারে আইছিলাম। বাদল আটক্যা নিলো। গেদার মা তো হেইডা বুজবো নি না। ক্যাট ক্যাট করবোনি যে, আমি ইচ্ছা কইরা ঢিলামি করছি!"
শফি হেসে বলে,
" চাচা মাঝে মধ্যে আপনেও গলা চড়াইয়া দুই তিনডা হুনাইবেন। দেখবেন শান্ত হই গেছে।"
" না থাক। গেদার মা গাল ফুলাইবো নে। তাছাড়া হের ক্যাট ক্যাটও খারাপ লাগে না। মধু মধু লাগে।"
মুরুব্বি স্বভাব সুলভ হেসে বলেন। রওশন চায়ে চুমুক দেয়। হঠাৎ স্বাদটা একটু বেশিই মিষ্টি মনে হয়। শফি খানিকটা মুখ মুচড়ায়। খ্যাক খ্যাক আবার কার ভালো লাগে? তাঁর বোন শাপলা একটু বাঁচাল ধরনের। একবার কথা শুরু হলে শেষ হবার নাম নেয় না। তার তো মধু মধু লাগে না? কানের নিচে বাজাইতে মন চায়। আর সিন ভাইয়ের সামনে কেউ রং ঢং করলে, আলাপ দীর্ঘ করলে মহাশয় মেজাজ হারাতে সময় নিবে না। তার ভাগ্যে এরকম বউ জুটলে বউয়ের কপালে সকাল বিকাল ঝাটার বাড়ি। ভাবতেই হি হি করে হাসে। বৃষ্টি থেমে যেতেই ক্ষণিকের অতিথি চলে যায় একে একে। গ্যারেজে শফি আর রওশন।
" শালা সিন কখন আসবে? দেড় ঘন্টার বেশি হবে বসে আছি।"
রওশনের কথায় শফি হামি তুলে বলে,
" আইবো আর এল্লা অপেক্ষা করেন। আর এতো তাড়া! কি দরকার ভাইরে? আমারে কইতে পারেন।"
"তেমন দরকার না। বেশ কয়েকদিন হলো খেয়াল করছি শালা আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। আগের মতো কথা বলে না।"
"আপনের বন্ধুর মতি গতি বুঝি না মিয়া। এই ভালো তো এই খারাপ। দিন দিন মনে হয় খিটখিটে বেশি হইয়া যাইতেছে। কথা কওয়ার আগেই হেই চেইতা ওঠে। তবে এরও মাসয়ালা আছে।"
রওশন প্রশ্নাতীত চাহনিতে চাইলে শফি দাঁত কেলিয়ে বলে,
" বউ আইলে ঠিক হইয়া যাইবো। আমি না চাচি কয়। সুর আপার বিয়া দিয়াই নবাবরে বিয়া করাইবো। মায়ের কাছে গুসুর ফুসুর করে আমার বুইন শাপলারে নিবো।"
রওশন হেসে শফির পিঠ চাপড়ে দিলো।
" ওর বউয়ের জন্য মানে তোর বোনের জন্য আমার পক্ষ থেকে এক সমুদ্র সমবেদনা। মেয়েটার জান প্রাণ একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিবে।"
রওশনের কথায় শফি হাসে। খাঁটি সরিষার তেল মাখা মাথার চুল গুলো ঠিক করে রওশনের কাছ ঘেঁষে বসে। গলার গামছাটা নাড়াচাড়া করতে করতে আমতা সুরে বলে,
" আপনের বোন আছে না? রূপসা আপা। আপায় মেলা সুন্দর। একদম পরীর লাহান। শাপলার বিয়া দিয়া আমি যদি আপনের বাপের কাছে প্রস্তাব নিইয়া যাই রাজি হইবো না? আমি যৌতুক নিমু না। তয় আপনেরা খুশি হইয়া দিলে মানা করুম না।"
রওশন ছোট ছোট চোখে তাকায়। শফি অতি আশা নিয়ে হ্যাঁ শোনার অপেক্ষায়। তবে বাগরা দিতে হাজির স্বয়ং সিনান সালেহ। এসেই শফির মাথায় থাবা মেরে খেকিয়ে ওঠে,
"আপা ডাকোস আবার বিয়া করবার শখ জাগে। মন সাফ কর শফি সাহেব। আর রমজান চাচা রাজি হইবো না মানে? রাম দা নিয়া দৌড়ানি দিবো।"
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো। শফি নাক মুখ কুঁচকে নেয়। দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে সিনানের গুষ্টির ষষ্ঠী বাজায়। তাঁর সব ভালো কাজে বদ বেডায় বাগরা দেয়। কপালে বউ জুটবে না তোমার সিন ভাই। মনে মনে বিড়বিড় করে শফি উঠে নছিমনের টায়ারের উপর বসে। সিনান টুলে বসে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে রয়। রওশনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে কি ইশারা করে। রওশন পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করে রাখে টেবিলের উপর। সিনান সালেহ লুফে নেয় তা। প্যাকেট খুলে একটা শলাকা বের করে সুখ টান দেয়। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
" কয়েকদিন হলো বালডারে ছুঁয়েও দেখি নাই। হাতটানা টানি চলছে খুব। পরে দিয়ে দিবো নে।"
"এ পর্যন্ত কত প্যাকেট টেনেছিস একটারও বিল পরিশোধ করিস নি সিন।"
সিনান গাল মুখ চুলকায়। দাঁড়ি ছাটতে হবে সেলুনে গিয়ে। নাহ্ থাক, নিজেই কেটে নিবে। কি দরকার মানষেরে ট্যাকা দেওনের!
"কত প্যাকেট গেছে? হিসেব করে আমারে বলিস। একদিন সত্যিই দিয়ে দিবো। আমি কারো কাছে ঋণী থাকবার চাই না। বড়লোক বাপের পোলার কাছে তো আরও না।"
" আচ্ছা তাই না? রিজ ভাইকে আমি বুঝিয়ে ভুলিয়ে তোর কাজ করার জন্য রাজি করালাম। যেই কাজ হলো আমি রওশন কে, তাই না? শালা স্বার্থপর।"
"তোর রিজ ভাই মুফতে কাজ করতেছে না। যতটুকু করছে তাঁর ডাবল উসুল করার ফন্দি তাঁর। আমি ব্যবসা লাটে তুইলা হের ফরমাইশ খাঁটি। এর ওর পেছনে গোয়েন্দা গিরি করি। আর আমি তোর হাতে পায়ে পড়ি নাই। তুই আগে কইছিলি রিজ ভাইয়ের সাথে কথা কবি। তাই বলছিলাম।"
সিনান সালেহের গম্ভীর গলা। রওশন একটু চিন্তায় পড়ে। রিজ ভাইয়ের মাথায় চলছে কি? তবে সে সেসব কথা বাদ দিয়ে বন্ধুর হাত থেকে শলাকা কেড়ে নিয়ে নিজেও এক টান মারে। সিনান ছোট ছোট চোখে চায়।
"সুর সিগারেটের গন্ধ সইতে পারে না।"
রওশন ত্যাছড়া নজরে চায়। সিগারেটের শলাকা ফেলে দেয় তৎক্ষণাৎ। ধোঁয়া ছেড়ে খুকখুক করে কেশে ওঠে।
" এই বালছাল কে খায়। ইয়াক! কি গন্ধ। থু থু থু! আমিও পছন্দ করি না। তার যা পছন্দ না সেটা আমারও অপছন্দের তালিকায় পড়ে যাবে। একটু টাফ বাট অসম্ভব নয়"
সিনান কিছু বলে না। অল্প হাসে শুধু। আরেকটা শলাকায় আগুন ধরায়। শফির কান সজাগ সাথে মস্তিষ্ক যেন যন্ত্রের গতিতে চলে। মনে পড়ে রওশন ভাই সুর আপারে বিয়া করবার চায়। আবার রিজ ভাইও সুর আপারে চোক্ষে হারায়! ইয়া খোদা! এটা তো সে ভাবেই নাই! তার চোখের আকার ক্রমশই বড় হয়। দুই ভাইয়ে যে তার সুর আপার পিছনে পড়ে আছে।
°°°°°°°°°°°°
শান্তি বেগমের মুখখানি থেমে নেই। ধমকে যাচ্ছেন মেয়েকে এক নাগাড়ে। যুবতি মেয়ে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা মুরগি হয়ে বাড়ি ফিরেছে তাও আবার খোড়াতে খোড়াতে। কিভাবে পড়েছে জিজ্ঞাসা করলেও বলছে না। উনুন পাড়ের ছাউনী হতে রান্না করতে করতে বকে যাচ্ছেন তিনি। সুরেলা একটু দূরে কল পারে দাঁড়িয়ে কাঁদা মাখা হিজাব খুলে নেয়। বোরখা খুলে হাঁক ছাড়লো,
" মা পড়ে গাল দিস। জামা, ওড়না দিয়া যা আগে। ঘর থেন বালতি মগটাও আনিস.."
থেমে যায় সুরেলা। দোচালা টিনের ঘরের বাম দিকের কোণা গলি জায়গা দিয়ে আগত মানবটিকে দেখে তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। কাঁদা মাখা হিজাব তুলে গায়ে জড়িয়ে চোখ পাকিয়ে চায়। নওরিজ মাহবুব থেমে গেছে শুরুতেই। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো কি? এই রুম ঝুম ঠান্ডা বৃষ্টির পরশেও কেন উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে বেহায়া তনু মনে। হাতের মুঠো শক্ত হয়। প্রেয়সীর গরম চাহনিতে যেন মনের আকাশে রামধনু ছড়ায়। সিদ্ধান্ত নেয় জুতো জোড়া এখানে রেখেই চলে যাবে। পা বাড়াবে এমন সময় শান্তি বেগম ডাক দেয়। অগত্যা এগিয়ে আসতে হয়। সুরেলা মায়ের হাত থেকে জামা কাপড় নিয়ে শাপলাদের উঠোনে কলপাড়ে চলে যায়। সেখানে কলপাড় চারদিকে টিনের বেড়া আছে। তবে সুরেলা কান খাঁড়া করে রাখে। লোকটা উল্টোপাল্টা বলে গন্ডগোল না বাঁধায়। কোনো ভরসা নেই খুঁতখুঁতুনি লাট সাহেবের উপর।
শান্তি বেগম বাঁকা নজরে নওরিজের আপাদমস্তক দেখে নেয়। বৃষ্টিতে ভিজে জুবজুবা।চুল বেয়ে টপ টপ পানি পড়ছে। শার্টটা গায়ে লেপ্টে আছে; তাতে কিছু কাঁদা মেখে আছে এখনো। হাতের দিকে তাকাতেই সন্দেহ গাঢ় হয়। এ যে সুরেলার চপ্পল। নওরিজ মাহবুব খেয়াল করে ভদ্রমহিলার বাঁকা দৃষ্টিকে। অভিজ্ঞ তার বুঝতে বাকি রয় না ভদ্রমহিলার মনে কি চলতে পারে। সে এখন যতই সাফাই দিক উনি সন্দেহ রাখবেই মনে মনে।
" চাচি এই নিন আপনার গুনধর মেয়ের জুতো। এই বৃষ্টির মাঝে পিচ্ছিল আল বরাবর হেঁটে আসছিলো। আমি বামের রাস্তা দিয়েই গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম। দূর থেকে খেয়াল করি পড়ে গেল কাঁদায়। একবার না দুইবার। একা বসেই কাঁদছিল। এগিয়ে এসে দেখি নেই আপনার মেয়ে। আমি তো হার্ট অ্যাটাক করতে বসেছিলাম। কোথায় গেলো? জুতো জোড়া পড়েছিল দেখে স্বস্তি ছিলাম পেত্নি নয় তাহলে।"
এতগুলো কথা বলে নওরিজ একটু নয় বেশিই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। সে কি ভয় পাচ্ছে? নাকি অহেতুক উদ্দীপনা নিউরন অকার্যকর হয়ে পড়েছে? ঠিকঠাক সিগন্যাল দিতে অক্ষম হচ্ছে নিশ্চয়ই। সে মৃদু কেশে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। শান্তি বেগম বিশ্বাস করলেন কি-না বোঝা গেলো না। তিনি ভদ্রতার সাথে বসতে বলেন। নওরিজ বসে না। কলপাড়ে গিয়ে কিছু পল দাঁড়িয়ে থাকে। কল চেপে আজলায় পানি ভরে মুখে ছিটিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করতেই কিছুপল আগের মুহূর্ত যেন আবারও মস্তিষ্ক বরাবর আঘাত করে। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বিড়বিড় করে,
" আর সম্ভব নয়। কবুল বলে তাকে বুকে লুকিয়ে রাখলেই এই রক্তক্ষয়ী আগুন নিভে যাবে ধীরে ধীরে।"
টিনের বেড়ার ফাঁকে সবটাই অবলোকন করে সুরেলা। খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোকটার হাতে নিজ কাঁদা মাখা ছেঁড়া জুতো জোড়া দেখে একটু থমকে ছিল। সে চটজলদি গায়ে পানি ঢেলে জামাকাপড় পরিবর্তন করে নেয়। বৃষ্টি থেমে গেছে; অল্প গুঁড়ি গুঁড়ি গাছে জমা ফোঁটা পড়ছে। সুরেলা ভেজা চুল গামছায় বেঁধে অতি সাবধানে পা ফেলে ঘরে যায়। চৌকিতে উঠে বসে ধরাম করে। কাঠের জানালার খিল খুলে উঁকি দেয় বাইরে। যদি দেখা যায়? দূরে কাঁচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর মানবটার মুখে ক্ষীণকায় প্রাপ্তির হাসি। ভেজা চুলে হাত গলিয়ে পা বাড়ায়। সুরেলা চোখ মুখ খিঁচে জানালা বন্ধ করে। কি দরকার ছিলো পাকনামি করার! নিজের মাথায় চাটি মেরে চৌকি থেকে নামে। অজান্তেই অধর কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে। কান্তিমান আঁখি যুগ্ম জ্বল জ্বল করে অচাওয়া স্বপ্নের ছোঁয়ায়। স্বপ্নে বিভোর আঁখি যুগ্ম সম্মুখে দন্ডায়মান মায়ের সন্দিহান চাহনি দেখে কিঞ্চিত ঘাবড়ায়।
" সত্যি কইরা ক দেহিন। চেয়ারম্যানের পোলার লগে কোনো লটর পটর নাই তো? কেঁদোয় মাখামাখি হইয়া বাড়ি ফিরলি। হেও পিছু পিছু আইলো তোর ছেঁড়া জুতা নিয়া!"
মায়ের ক্ষুর ধারালো বাক্যে কিশোরী ঘাবড়ালেও বুঝতে দেয় না। তেজস্বী ঠাঁঠ বজায় রেখে জবাব দিলো,
" কি কস তুই মা? আমি তো হেরে দেখিই নাই। আর আজেবাজে কথা কবি না আমার নামে। আমিও ভাত মাছ খাই। ভাইয়ের হাতে জবাই হওয়নের শখ নাই। সর তো? মেজাজ গরম কইরা দিলি।"
শান্তি বেগমের সন্দেহ তবুও কমে না। চুল যে তাঁর এমনিতেই পাক ধরে নি। গন্ডগোল তো কিছু একটা আছেই। ভয় হয় তাঁর। ছেলে জানলে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিবে। সালেহউদ্দিনের হঠাৎ ডাকে সন্দেহ বীজ রেখে দেয় শান্তি বেগম। বেরিয়ে এসে দেখে স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ। দুই হাত ভর্তি বাজার। বড় একটা সিলভার কার্প ঝুলছে হাতে।
"শান্তি নে বাজার। বড় সিলকাপ মাছ আনছি। গাসির গোশত আনছি। সুরের পছন্দ না? তার লাইগা। বাজার পাতিও আনছি টুকটাক। ধর ধর? আর সুর কই?"
বাবার গলার আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে আসে সুরেলা। তাঁর জন্য খাসির মাংস এনেছে শুনে ভালো লাগলো। বাবা সচরাচর তাঁর জন্য কিছুই আনে না। শান্তি বেগমও খুশি মনে সব উনুনে রেখে দেয়। সালেহউদ্দিন হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে। সুরেলা গামছা বাড়িয়ে দেয় বাবাকে। সালেহউদ্দিন হাসিমুখে মুখ হাত মুছতে থাকে। পকেট থেকে কচকচা দু'টো একশ টাকার নোট বের করে সুরেলার দিকে বাড়িয়ে দিল।
" একশ দিছিলি ডাবল দিলাম রে গেদি। খুশি হইছস?"
সুরেলা অবাক হয়। জোলা বাড়িতে টুকটাক সুতো তুলে একশ টাকা আয় করেছিল; জীবনের প্রথম আয়। সেদিন বাবা চাওয়ায় মানা করতে পারে নি। ভাবে নি কখনো ফেরত পাবে।তাও ডাবল। সে ইতস্তত বোধ করে তবে টাকাটা নেয়। সালেহউদ্দিন আরেকটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
" দেখ তো গেদি পছন্দ হয় কি না?"
সুরেলা এবার যেন বিস্ময় প্রকাশের অবকাশ পায় না। প্যাকেট খুলে দেখে একজোড়া নুপুর। তাঁর চোখের আকার বড় হয়। বাবার দিকে অবাক চোখে চায়। সালেহউদ্দিন দাঁত কেলিয়ে বলেন,
" ওই মেলাদিন আগে মায়ের কাছে কুনুর কুনুর করতি নুপুর বানাই দিতে। হাতে টাকা আইলো সেকরার কাছ থাইকা কিইনা আনলাম। রুপার , পছন্দ হইছে?"
বাকহারা সুরেলা। ডাগর ডাগর চোখের কোণায় নোনাজল জমেছে। বাবা যেমনটি হোক না কেন, কিশোরী লোভি মনটার হাজারো না পাওয়ার ভিড়ে এই অপ্রত্যাশিত পাওয়া তার মনটাকে কাঁদিয়েছে। কোনোমতে মাথা নেড়ে সায় জানালো। দরজায় দাঁড়িয়ে শান্তি বেগমও অবাক হয় ঢের। তবে অবাকতা প্রকাশ না করে শুধায়,
" অনেক বাজার করছেন। আবার নুপুর। এতো ট্যাকা কই পাইলেন সিনের বাপ?"
" তোর পোলার মতো দশ বিশ টাকা কামাই করুম নাকি? একেবারে বান্ডিল কামামু। কত কইরা কই গ্যারেজ বাদ দিয়া আয় আমার লগে। কানে ঢুকে না হের। করুক আমার কি? হের কপাল হেয় খাইবো!"
বলে খুশি মনে চৌকিতে বসে সালেহউদ্দিন। শান্তি বেগম কথা বাড়িয়ে চলে যায়। কথা বাড়লেই যে অশান্তি বাড়বে।
°°°°°°°°°°°
" ভাই আপনে এত দূর থেকে ভাবিরে চিনলেন কেমনে?"
" ভাবিরে চিনবো না তো কারে চিনবো? ভাইয়ের মনের আকাশে সবসময় ভাবী উইড়া বেড়ায় যে। রিজ ভাই বহুত দিন হইলো বিয়া খাই না। আপনে জলদি ভাবিরে ঘরে তুলেন, কব্জি ডুবাইয়া বিয়ার দাওয়াত খামু।"
" ভাই বিয়াতে রোস্ট দিয়েন কিন্তু? হেইবার দলীয় সভার মিছিলের পরে বিরিয়ানির সাথে রোস্ট দিলেন ওহনো জিভে লাইগা আছে!তাই না বাবু?"
" হ হ জীবনের প্রথমবার খাইছিলাম রোস্ট। প্রথমডায় ভটকা লাগলো পরে মজাই লাগছে।"
সাঙ্গপাঙ্গদের কথোপকথনে মনোযোগ নেই নওরিজ মাহবুবের। দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে জিপ টানে।জিপের পেছনের সিটে বসা বাবু, তমাল, হারুণ আর জামাল একনাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। অন্যসময় হলে বিরক্ত হয়ে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিতো নওরিজ। আজ ইচ্ছে করছে না। আজ সে বিরক্ত হচ্ছে না।
" রিজ ভাই? আমি কয়েকদিন হলো একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাইছি। আপনি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না।"
জামাল যান্ত্রিক মানবের মতো বলে যায়। তবে সামনের ব্যাক্তির প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আবারও শুধায়,
" ভাই? শুনছেন? কথাটা ভাবীকে নিয়ে। আপনি অনুমতি দিলে বলবো।"
"বল?"
স্বাভাবিক ভাবেই বলে নওরিজ। জামাল দেরি না করে বলে,
" চেয়ারম্যান চাচা সপ্তাহ খানেক আগে মহিরের তরফ থেকে ভাবীর জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিল।"
" আচ্ছা। তারপর কি হলো?"
কেমন দায়সারা ভাবে বলল যেন। পেছন থেকে বাবু, তমাল ও হারুণ যেন হুমরি খেয়ে পড়ে। জামালকে চেপে ধরে সবটা শুনে নেয়। বাবু রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
" ভাই আপনে অনুমতি দিলে ওই মহিরের বিয়া করবার শখ ঘুচাই দিমু। কত্তবড় সাহস আমগোরে ভাবীর দিকে নজর দেয়। ওর চোখ আমি তুইলা নিমু!"
" ভাই এমন হাল করমু হুমুন্দি বিয়া করার কথা মাথায় আনা দূর মাইয়া মানুষ দেখলেই লুঙি তুইলা দৌড় দিবো।"
তমাল বলে ওঠে। হারুণও হুমকি দেয়। নওরিজ শুনেও না শোনার ভাব ধরে বসে। জামাল এবার চিন্তিত স্বরে বলে,
" ভাই আপনে কিছু বলবেন না? ভাবীর জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিল ওই মহির!"
স্টেয়ারিংয়ে থাকা হাত শক্ত হয়। শক্ত চোয়াল নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
" জানি আমি সব। সুরের দিকে তাকানোর ভুল করবে না আর। তাকালে কল্লা কেটে নেবো।"
জিপ গাড়ি এসে থামে চেয়ারম্যান বাড়িতে। গাড়ি দেখেই এগিয়ে আসে এক যুবা । নম্র গলায় সালাম পেশ করে দাঁড়িয়ে রয়। নওরিজ গাড়ি থেকে নেমে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
" তোরা যা? আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি গোসল সেরে।"
সবাই চলে যায় গোয়ালঘরের আড়ালে একেবারে কোণায় অবস্থিত এক ঘরে। তাঁরা জানে রিজ ভাই গোসল করবে মানে আধা ঘন্টার আগে আসবে না।
নওরিজ অন্দর মহলে প্রবেশ করে। সবার আগে নজরকাড়ে বারান্দায় সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী মানবের পানে। মুখাবয়ব প্রতিবারের মতোই হাসিখুশি বিহীন কাঠ খাট্টা। রূপসার মতে ,মুখে তেঁতুল পুরে রেখেছে। নওরিজ এগিয়ে যায়। লম্বা সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলে,
"সাদমান খন্দকার। অনেক দিন পর দেখা পেলাম। কেমন আছেন?"
" আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?"
তার ছোট্ট জবাব। ভদ্রলোকের পাশে গোমড়া মুখে দন্ডায়মান ছবির দিকে তাকিয়ে নওরিজ বলে,
" জামাই এসেছে মুখ থাকবে হাসিখুশি। অথচ শুকনো বানিয়ে রেখেছিস কেন? তোর জামাই যতই হম্বিতম্বি করুক পাঠাচ্ছি না এবার। ডেলিভারীর ক'দিন এ বাড়িতেই থাকবি।"
ছবি আড়চোখে সাদমানের দিকে তাকায়। রসকষহীন মানব তাঁর দিকেই তাকিয়ে। ছবি নজর ঝুঁকিয়ে নেয়। নওরিজ লক্ষ্য করে সবটাই।
" সাদমান ভাই, মজা করছি না। সত্যিই ছবিকে পাঠাবো না। এই সময়টায় মেয়েরা ভিতু থাকে। আর ছবি এমনিতেই ভিতু। আম্মা আর চাচি আম্মার সান্নিধ্যে থাকলে ভরসা পাবে। আর সব মেয়েরাই এই সময়টা বাপের বাড়িতেই থাকে।"
নওরিজ কথা শেষ করে জবাব শোনার অপেক্ষায়। উপস্থিত ছামিনা বেগম সহ বাকিরাও উৎসুক পানে তাকিয়ে। সাদমান ভনিতা হীন গলায় বলে,
" আম্মু অসুস্থ। কাজের মেয়েটার উপর ভরসা পাই না। নিজেও কাজে ব্যস্ত থাকা হয়। রূপালী থাকলে আমি ভরসা পাবো।"
" আর আমার মেয়েটার ভরসা কে হবে? তুমি কাজে ব্যস্ত থাকো হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে। মেয়েটা এই অবস্থায় বাড়িতে কিভাবে থাকবে? ওরও তো এই সময়টায় একটু বেশি পরিমাণে যত্নের দরকার।"
ছামিনা বেগমের কথায় সাদমান ছবির দিকে তাকায়। যে কি-না নতমুখে দাঁড়িয়ে তাঁর পাশেই। সে গম্ভীর গলায় বলে,
" রূপা যদি থাকতে চায় থাকুক। কিন্তু আমি রেখে যাওয়ার পক্ষে নই। দূরে রেখে আমিও শান্তি পাবো না এক দন্ড। বাকিটা রূপা দেখুক।"
বলে অপেক্ষা করে না ভদ্রলোক। হনহনিয়ে চলে যায় দক্ষিণা দোর বরাবর। রূপালী মাহবুব ওরফে ছবি ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসার চেষ্টা করে বলে,
" আমি থাকবো না। কয়েকদিন পর ওনাকে নিয়ে আবার এসে থেকে যাবো ক'টা দিন।"
নওরিজ হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নেয়। ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্ষিণ হেসে বলে,
" জামাইয়ের পুতুল, এতো ভয় পাস কেন? টাইট দিতে পারিস না? আর কোথাও যাচ্ছিস না। বাকিটা আমি দেখে নিবো।"
বলে সে চলে যায় নিজ ঘরের দিকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রূপসা গোমড়া মুখে। বোন জামাইয়ের উপর বেজায় রাগ হয়। ছবি ওরফে রূপালী মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে ছামিনা বেগম থামিয়ে দেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দেয়। রিজ যখন বলেছে যেতে দিবে না তারমানে সাদমান যতই তাল বাহানা করুক নিয়ে যেতে পারবে না।
°°°°°°°°°°°°°°
ময়লা একখানা লুঙ্গি পরনে। ফুটোয় পরিপূর্ণ সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি টাও হলুদাভাব এসে গেছে। জঙ্গলে ভর্তি মুখে খাবার পুরছে গপাগপ যেন কতদিনের অনাহারী। রক্তিম চোখ দু'টো ফেটে যেন রক্ত বেরোবে। পরপর চারপ্লেট মাংস ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলে লোকটা। স্টিলের গ্লাসে ঢকঢকে পানি পান করতে গলা গলা ভিজিয়ে দেয়। হে হে করে হেসে যায় আপনমনে। বাবু নাকমুখ করে বলে,
" কিরে রাম? পেট ভরলো? নাকি আরেক ডেকচা আনমু?"
আকরাম হেসে মাথা ডানে বামে মাথা নেড়ে জানালো আর আনতে হবে না।
" আমি ওহন যাই?"
" ওহনি যাওয়ার তাড়া কিসের? সবুর কর শেষ পাতে দই দিমু তো!"
" আমি দই খাই না। মিষ্টি হজম হয় না পেটে।"
আকরামের কথায় হেসে ওঠে উপস্থিত সকলে। দরজা খোলার আওয়াজে সবাই সেদিকে খেয়াল করে। নওরিজ মাহবুব এগিয়ে আসলে তমাল গিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দেয় দরজা টা।
" রাম নাকি আকরাম কোনটাতে ডাকবো তোকে?"
গম্ভীর গলা কানে বাজতেই আকরাম দুই পা বুকে জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে জবাব দেয়,
" আমগোর নাম আকরাম উদ্দিন"
" মন্দিরে হিন্দু পাড়ায় যে রাম পূজারি বলে পরিচয় দিস"
"সব মিছা কতা"
নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে পরখ করে যায়। পাগল গোছের লোকটা গাল মুখ চুলকায় আর কাঁচুমাচু হাসে। দেখে পাগল মনে হয়।
" শুনলাম ভাতের বদলে মালপানি গিলিস রোজ।"
" এইডাও মিছা কতা"
" আচ্ছা সবই দেহি মিছা কতা! তাইলে হত্যিডা কি? রিজ ভাই লাগান একখান চটকানা। সুরসুর কইরা কইবো সব।"
হারুণ যেন জ্বলে ওঠে। নওরিজ ভ্রু উঁচিয়ে চাইলে ফুঁস করে নিভতেও সময় নেয় না। নওরিজ আকরাম নামক লোকটাকে আরো বেশ কতক্ষণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। আকরাম হু হাঁ করে আর তাঁর অতিপরিচিত বাক্য 'এইডা মিছা কতা' । মেজাজ গরম হয়ে আসে নওরিজের। ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞাসা করে,
" বাজারের জিলেপির দোকানদার মন্টুরে চিনিস?"
" এইডাও মিছা কতা"
ভয়ঙ্কর থাবার স্বীকার হয় তৎক্ষণাৎ। ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে হাউমাউ খরে কান্না জুড়ে দেয় আকরাম। যেন দু'বছরের বাচ্চা। বাবু, হারুণ তেড়েফুঁড়ে এসে গোটাকয়েক লাথি মেরে বসে। নওরিজ থামতে বললে থেমে যায় তৎক্ষণাৎ। নওরিজ পকেটে হাত গুটিয়ে এগিয়ে আসে। পায়ের সাদা কেডস ঠক ঠক শব্দ করে। হাতের উপর এক পা দিয়ে খানিকটা মুচড়ে বলে,
" আমার সাথে চালাকি! ইম্প্রেসিভ। কে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে? মন্টু মিয়া নিশ্চয়ই।"
" এইডাও মিছা কতা"
বলে হড়গড়িয়ে কেঁদে ওঠে। নওরিজ পা সরায় না। তমাল হাঁটু গেড়ে বসে চুলের মুঠি চেপে বলে,
" হাছা কোনডা হেইডা কস না কে? এই জাওরা তুই সত্যিই মুসুল্লি নাকি হিন্দু ক?"
" আমি মুসলমান। আমাগোরে নাম আকরাম।"
বাবু এগিয়ে এসে বলে,
" হারুন এক কাজ কর লুঙ্গি তুইল্যা দেখ তো মেশিন কাঁটা নাকি। তাইলেই তো পরিষ্কার হইয়া যায় । "
হারুণ মুখ বিকৃত করে বলে,
" শালা তোর মাথায় শয়তানি বুদ্ধি। তুই ই দেখ।"
বাবু জামালকে ইশারা করে দেখতে। যান্ত্রিক মুখাবয়বের জামাল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে রয়। বাবু নাকমুখ কুঁচকে নিজেই এগিয়ে যাবে নওরিজ ধমক দেয়। চোখ রাঙিয়ে বলে,
" এই একে ছেড়ে দে। পরেরবার ধরলে পাছার ছাল তুলে নিবো।"
" ছেড়ে দিবেন ভাই? আরেকটু টাইট দিলেই সব বাড়াইবো..."
"যেটা বলছি সেটা কর। জামাল? জঞ্জাল সাফ করে আয়।"
জামাল তৎক্ষণাৎ কাজ করে। আকরামকে টেনে তুলে নিয়ে যায় বাইরে।ওরা বেরিয়ে যেতেই নওরিজ মাহবুব বাবু, তমাল হারুণের দিকে আঙুল তুলে হুকুম করে,
" ওর পেছনে লোক লাগা। পাগলটা যেন বুঝতে না পারে। আর মন্টু সহ ওর দোকানে যে কয়টা কাজ করে সবার উপরেই।"
°°°°°°°°°°°°°°
গোয়াল ঘরের পেছনের বাঁশঝাড় হতে কচি চিকন একটা বাঁশ কেটে আনে সিনান সালেহ। বাঁশের কুঞ্চি কেটে মাপ মোতাবেক কেটে পিঁড়ি পেতে বসে। দা দিয়ে বাঁশের ফালি পাতলা লম্বা টুকরো করে টোপা বানাতে বসে যায়। পাশের উঠোন থেকে এক কিশোরী ছুটে আসে থালা হাতে। সিনানের পাশে থালা রেখে পাশে বসে বলে,
" মা চাপড়া দিলো তোমার জইন্যে। শুকনা চাপড়া খাইতে গলায় আটকিবো তাই এক টুকরা গুঁড় আনছি। এতে যদি তোমার নিমপাতার মতো মুখডা একটু মিঠা হয়। ও সিন ভাই কি হইলো? হুনো না কেন আমার কথা? তোমারে তো একটা কথা কই নাই। সুর আপার নামে। হুনলে তুমি আসমান থাইক্যা পড়বা। তবুও গোস্বা কইরো না। যদিও সুর আপা কইছে তোমারে না কইতে তয় আমার পেট গুড়গুড় করতাইছে তাই..."
খিটখিটে মেজাজের সিনান মেজাজ হারায়। শাপলাকে থামিয়ে খ্যাক করে বলে,
" যা সামনে থাইক্যা? এক কোপে ঘার আলাদা কইরা দিমু। কামের সময় ওনাগোরে গপ্প আসে। যা ভাগ ছেড়ি?"
সত্যি সত্যিই দা তোলে সিনান। শাপলা ভয়ে হাঁটু কাঁপা কাঁপি অবস্থা। 'ওরে আম্মারে' বলে এক ছুটে চলে যায় নিজ বাড়ির দিকে। তাঁর চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে শান্তি বেগম। মাথায় আঁচল টেনে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
" শাপলা ওবা কইরা পলাইলো ক্যান? আবারও খেকি দিছোস?"
"না সোহাগ করমু বাল । যা তো এইখান থাইক্যা।"
খ্যাক করে ওঠে সিনান সালেহ। শান্তি বেগম ছেলের দিকে তাকায়। সবসময় মেজাজ চটে থাকে নবাবের। তিনি টুল টেনে এনে ছেলের পাশে বসে থাকে চুপচাপ। সিনান লক্ষ্য করে তবে কাজ করতে করতে ভ্রু কুঁচকে বলে,
" কিছু কবি? আমার কাছে কিন্তু ট্যাকা পয়সা নাই।"
শান্তি বেগম স্মিত হাসেন। এ ছেলে এমন কেন? ছেলে পেটে থাকতে তো তিনি হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি খেয়েছেন। সব মিষ্টি গেলো কই? এ ছেলের মাঝে রষকষ নাই। তিনি না বোধক মাথা নাড়েন। সিনান ঘরের দিকে তাকায় একবার। বেত টেনে কাজ করতে করতে শুধায়,
" তোর নবাব জাদি মাইয়া উঠে নাই? ইস্কুলে যাইবো না?"
" যাইবো না। ইস্কুল নাকি বন্ধ।"
" আব্বা নাকি নুপুর বানাই দিছে। তাও আবার রূপার?"
শান্তি বেগম ছোট্ট করে সায় জানালো। সিনান সালেহ মলিন হাসে। বোন নুপুরের আবদার করেছিল। একেবারেই নাছোড়বান্দা। দিতেই হবে। শাপলাকেও ওর মা বানিয়ে দিয়েছে। ওনারও চাই। মায়ের হাজারো ধমকেও আবদার ভাঙে না। সিনানের এক ধমকেই থেমে গিয়েছিল আবদার। সারাদিন না খেয়ে ছিলো। সিনান সোনা ময়না বলে মানাতে যায় নি। রাতে তাকে দেখেই ভাতের গামলা নিয়ে বসেছিল।ভেবেছিলো সামনের ঈদে বানিয়ে দিবে একজোড়া। সোনা দানা চায় নি তো! সামান্য রূপোর নুপুর। কত দাম পড়বে? হাজার বারো শো। প্রথমবারের মতো তাঁর দেওয়ার আগেই বোনের আবদার পূরণ হলো। ভালোই হয়েছে, তাঁর টাকা বাঁচবে।
" তোর মাইয়া জোলা বাড়ি যায় ওহন। তোর ঝুলিতে তো ট্যাকাই ট্যাকা। আব্বা কাল এতো এতো বাজার করলো। টাকা নিশ্চয়ই পাইছে কিছু।তোরেও দিছে তাই না? হাজার কয়েক টাকা দে? গ্যারেজে কিছু মাল তুলমু!"
শান্তি বেগম চুপ থাকে। সিনান মা'কে চুপ থাকতে দেখে ঘার তুলে তাকায়। নিশ্চুপতার মানে কি? সে জানে মায়ের কাছে টাকা আছে।
"দিছে অল্প কিছু। ভাবছি গোছামু মাইয়া বি.."
মা'কে থামিয়ে দিয়ে সিনান তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
" দিবি না সোজাসাপ্টা ক ? বাহানা দেহানের কি আছে! বড় কথা হইলো তুই দিলেও আমি নিতাম না। এমনেই জিগাইলাম খালি। আল্লাহ পাকের রহমতে দুই টাকা রোজগার করি তাতে বরকত পাই। ওই লোকের হাতে কম টাকা আসে? অথচ দেখ দুইদিন পর হেই আমার কাছেই হাত পাতবো। হালাল রুজির রহমত বলেও কিছু কথা আছে বুঝলি?"
শান্তি বেগম ভোঁতা মুখে বসে থাকে। সিনান ঘচাঘচ কাজ করে যায় ত্যাক্ত মুখে। এরই মাঝে সুরেলা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পরিপাটি হয়ে। ঢোলা ঢালা সালোয়ারের সাথে সুতি গোল জামা। বড় ওড়নায় গা গতর ঢেকে রেখেছে। কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে আসে । দুইহাত সমান তালে মুড়চে যায়। ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যায় কিছু বলবে। কিন্তু তাকে বলার সুযোগ দেয় না সিনান। কাজ করতে করতে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
"তোর মাইয়া কই যাইবো? ওই জোলা বাড়ি নাকি?"
শান্তি বেগম মেয়ের পানে ফেরে। সুরেলার কন্ঠ রোধ হয়ে আছে। ভাই কথা বলে না কত দিন হলো? যে কয়দিনই হোক তাঁর মনে হয় সে কতদিন হলো মন খুলে কথা বলে নি কারো সাথে। ইতস্তত বোধ করে বলে,
" হ্যাঁ ভাই"
সিনান টোপা বাঁধা শেষ করে ঘুরে ফিরে দেখে, হয়ে গেছে। খুব ভালো না হলেও অন্তত খারাপও হয় নি। যথেষ্ট ব্যবহারযোগ্য। সে উঠে দাঁড়ালো। কলপাড়ে গিয়ে কল চেপে হাত মুখ ধুয়ে নেয়। রশিতে টাঙানো গামছা টেনে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
" বাড়িটা আমার। আমার বাড়িতে যতদিন থাকবো আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মাইনা চলতে হইবো। আমি চুপ আছি মানে এই না যে, যেমন চাইবো চলবো। সাহস কত বড় জোলা বাড়ি যায় কাম করতে। পা বড় হইছে আমি সিনান কটতে সময় নিমু না। বাড়ি থেকে বের হইলে ওর একদিন কি আমার একদিন।"
একদম মেজাজি গলায় হুমকি। এই হুমকি কতটা বাস্তবিক সুরেলা, শান্তি বেগম কারোরই অগোচরে নয়। সুরেলা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয় সেখানেই। কাজলে আঁকা ওই ডাগর ডাগর চাহনিতে শিশির কণা জমে এবরো থেবরো করে যায় কালো রেখা। বুক থেকে যেন ভারী কিছু বের হয়ে যায়। ওড়নায় নাক মুখ মুছে দৌড়ে যায় পাক ঘরে । টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত তরকারি ভরে দাঁড়িয়ে রয় হাসিমাখা মুখে। সিনান বেড়িয়ে আসে সাইকেল নিয়ে। সুরেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও ভাবান্তর দেখায় না। সুরেলা মিনমিনে সুরে বলে,
" ভাই, দুপুরের খাবার। সময়মত খাইয়ো কিন্তু। গরমের দিন মাইরা (নরম/নষ্ট হয়ে যাওয়া) যাইবো নইলে।"
নিজেই পেছনের বসার জায়গায় বেঁধে দেয় ভালোভাবে। শফির উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে সিনান সালেহ সাইকেল টানে। পেছন থেকে বোনের সাবধান বাণী শুনে গম্ভীর মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। ভাই চলে যেতেই সুরেলা রোয়াকে বসে। গালে হাত ঠেকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে মনটা ভালো হলো। মলিন অম্বরে রঙ বেরঙের প্রজাপতি ডানা মেলে রঙে রাঙিয়ে দিলো। তাঁর রঙিন অম্বরে মেঘ জমে মায়ের এক বাক্যে। সে এক প্রকার আতঙ্কের সাথে মানা করলে শান্তি বেগম এগিয়ে এসে স্নেহের হাত মাথায় রেখে বলে,
" গিন্নী বউ যাইতে বলছে তোরে। তোর বাপে পইপই কইরা বইলা গেলো। না করিস না সোনা মা আমার। না গেলে তোর বাপে আমার উপর রাগ দেখাইবো। খালি যাবি আর আইবি।"
" তুই যা তাইলে। আমি যামু না। সিন ভাই কি কইলো হুনিস নাই? তাছাড়া আমি কাজের লোক না ওনাদের বাড়ি। খালি যাবি আর আইবি কইলেই হইলো না। ওনারা নিশ্চয়ই জামাই আদর করার জন্য ডাকে নাই। কোন না কোন কামেই ডাকছে। আমি যামু না।"
সুরেলার সরাসরি প্রত্যাহারে শান্তি বেগম আশাহত হন। তবে দমে যায় না। লোকটা কালই হাতে কতগুলো টাকা পাইলো। নিশ্চয়ই চেয়ারম্যান সাহেব দিছে। ওদের বাড়ি থাইকা ডাক পড়ছে তাইলে না গেলে কেমন দেখায়?
°°°°°°°
দুই উচ্ছ্বসিত কিশোরী হেলেদুলে হাঁটছে আর হেসে প্রায় গড়াগড়ি খায় এমন অবস্থা। রূপসার পরনে বেশি ঘেরের স্কার্ট, নীল রাঙা ফতুয়া। আর সাদা ওড়না কাঁধে ঝুলছে। পিঠ ছড়িয়ে চুল গুলো দোলা খায় মৃদুমন্দ বাতাসে। কোমল ফর্সা হাত নেড়েচেড়ে কথা বলে সখির সাথে। আশেপাশের অনেকের নজরই লাস্যময়ী কিশোরীতে নিবদ্ধ। তবে কিশোরীর দৃষ্টি আটকায় দূর কাঁচা রাস্তায় সাইকেল টেনে আনা এক সাধারণ যুবকের পানে। মলিন ফিনফিনে ঢোলা ঢালা শার্ট হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। বিরক্ত মাখা মুখটা কাঁদায় আটকে যাওয়া সাইকেল টানছে। কিশোরীর তনু মনে এই বৃষ্টিতে ভেজা শ্রাবণেও চৈত্রের খরা মৌসুমের রং ছড়িয়ে যায়। ইনিয়ে বিনিয়ে বান্ধবীর হাত থেকে ছুটকারা নিয়ে দ্রুত পা বাড়ায়। দূর হতে হাত নাড়িয়ে মৃদু স্বরে ডাক দিলো,
"এই যে সিন ভাই? শুনে যাও। দাঁড়াও আমি আসছি।"
সিনান কাঁদা থেকে সাইকেল শুকনো রাস্তায় এনেই চড়ে বসে তাতে। দ্রুত প্যাডেল চালিয়ে প্রস্থান নেয় তড়িঘড়ি। কিশোরী পিছু ডাকলো নিষ্ঠুর নির্দয় মানব শুনতে পেলো না? রূপসা দুই হাতে স্কার্টটা চেপে একটু উঁচুতে তুলে দৌড় লাগালো। আশেপাশের অনেকেই বাঁকা নজরে তাকায়। সেসবে ধ্যান ধারণা কোনো টাই কিশোরীর বোধগম্য হবার নয়। সে তো দৌড়ে যায় সাইকেলের পিছু পিছু। ডেকে যায় অসহায় সুরে,
" সিন ভাই বয়রা হলে নাকি? দাঁড়াও না একটু? ও সিন ভাই?"
অল্পক্ষণ দৌড়ে ক্লান্ত হয় দুলালী। দুহাত কোমড়ে রেখে হাঁপায়। ছলছল আঁখি যুগ্ম অভিমানের সাগরে ডুবে যায়। নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড!
°°°°°°°°°°°°°°°°
হালকা শীতল পবন গা ছুঁয়ে দিতেই কাঁটা দেয় বারবার। খালি গায়ে জড়ানো ঘিয়ে রাঙা চাদরটা ভালোভাবে মুড়িয়ে নেয় নওরিজ মাহবুব। নিজ ঘরের পাশে বারান্দায় অবস্থান করছে সে। পরিপাটি বারান্দায় শুধু একটা বেতের চেয়ার। সেথায় বসে আছে উদাসীন হয়ে। উদাসী দৃষ্টি বাইরে অবস্থিত বড় জবা গাছের উপরে। লাল ফুল কেমন নুইয়ে আছে। সাথে তাঁর মনটাও। আশ্চর্য! আগে জ্বর কখনো এভাবে কাবু করতে পারে নি তাকে। তবে এক রাতের জ্বরে শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সবেতে বিতৃষ্ণা জাগে। ধবধবে সাদা রঙে লেপ্টে থাকা দেয়াল গুলো কেমন যেন বিষন্ন রাতের হাতছানি দেয়। নওরিজ মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ বিষন্নতা কিসের বুঝতে বাকি নেই তাঁর। এখন তো ঘরটাও একা একা অনুভব করে। নিশ্চয়ই কারো আগমনের প্রহর গুনছে গুন গুন গুন। দরজা হতে ঠক ঠক আওয়াজ ভেসে আসায় নওরিজ গলা উঁচিয়ে বলে,
" কে? আম্মা? আমি বারান্দায় আছি।"
নাহ্ রেবেকা বানু নয়। রূপসা দাঁড়িয়ে আছে। সে এক ভ্রু উঁচিয়ে কি শুধাতেই মিষ্টি হেসে বলে,
"সুর আপা এসেছে একটু আগে।"
বিষন্ন মনটা পুলকিত হলো কি? তবুও ঠাঠ বজায় রেখে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,
"হঠাৎ?"
"চাচি আম্মা ডেকে পাঠিয়েছে। পাকা তাল পড়েছে অনেক গুলো। তাই তালের পিঠা বানাবে দুলাভাইদের জন্য। সুর আপা কত সুন্দর নকশি পিঠা বানাতে পারে। তাঁর হাতের পিঠা এতো মজা হয়! কি বলবো মনে হয় গালে টুপ করে চুমু দিই!"
নওরিজ খানিক বাঁকা নজরে তাকায়। রূপসা গালে জিভ ঠেকিয়ে অপ্রস্তুত হাসে। নওরিজ মাহবুব গাম্ভীর্য ভাবটা বজায় রেখে বলে,
"কোনো বাহানায় পাঠিয়ে দে এখানে।"
রূপসা হেসে মাথা নাড়ায়। রিজ ভাই নিশ্চয়ই সুর আপাকে দেখার জন্য ছটফট করছে। বুকটা দ্রিম দ্রিম করে বাজছে। একদম সিনেমার মতো। আর জ্বরে আক্রান্ত অসুস্থ রিজ ভাই প্রেয়সীর প্রেমময়ী বদনখানি দেখে পুলকিত হবে। সব জ্বর গায়েব হয়ে যাবে মুহূর্তে। এতো সুর আপা নয়; রিজ ভাইয়ের নাপা এক্সট্রা। সে উচ্ছ্বসিত দ্যুতি ছড়িয়ে চলে যায়। ভালোবাসা দেখতে ভালোই লাগে তাঁর।
রূপসা চলে যেতেই নওরিজ গা হতে চাদর সরিয়ে ফেলে। উন্মুক্ত হয় বলিষ্ঠ গতর খানি। একটু আগে শীতলতার আবেশে গা শিরশির করলেও এখন উষ্ণতায় পুড়ে যাচ্ছে। চাদরের উপর সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে আওড়ায়,
" সুরেলা! ছোট্ট নামটাই যথেষ্ট ছিলো ঠান্ডা অনুভূতিকে উষ্ণতায় কনভার্ট করার জন্য। ধিক্কার তোমার উপর! গায়ে লেপ্টে থেকেও উষ্ণ করতে পারো নি। তোমার তো দোতলা থেকে লাফিয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়া উচিৎ। "
চাদর খানা ছুঁড়ে ফেলে দেয় দোতলা হতে। নিজ ঘরে ফিরে আসে। আলমারি হতে শুভ্র ফুল হাতা গেঞ্জি বের করে পরে নেয়। ঠক ঠক আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই সজাগ হয়। এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে পরিপাটি করে বলে,
" কাম?"
কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেখা মিলে না । ঘরে প্রবেশ করে রেবেকা বানু। আঁচলে চাবির গোছা টুংটাং শব্দে সুর তুলে এগিয়ে আসে। ছেলের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে। উদ্বিগ্ন স্বরে মমতা ঢেলে শুধায়,
" জ্বর এখনো আছে। ঠান্ডাও লেগেছে দেখছি। কি দরকার ছিলো কাল বৃষ্টিতে ভেজার। খারাপ লাগছে?"
"নাহ্ আম্মা। ঠিক আছি আমি। টেনশন করবেন না। আব্বা বেরিয়েছে সদরের উদ্দেশ্যে?"
"হ্যাঁ। সেই ভোর বেলাই। রমজান ভাইকেও সাথে পাঠিয়েছি। তুই নিচে চল। পিঠা বানাবে। গরম গরম দু'টো খেয়ে ওষুধ খাবি লক্ষী ছেলের মতোন। হুঁ?"
মায়ের আহ্লাদী গলায় অল্প হাসে নওরিজ। পর পর দিয়ে হাঁচি রুমালে নাক মুছে বলে,
"চাচি আম্মা বানাবে পিঠা? নাকি নওরিন?"
" শান্তির মেয়ে কি যেন নাম সুরমা না কি যেন.."
" সুরেলা নাম তাঁর!"
নওরিজ সুধরে দেয়। রেবেকা বানু খানিক বাঁকা নজরে তাকালেও ওতশত ভাবে না। হেসে বলে,
"হ্যাঁ ওই হবে। মেয়েটা ভালোই পিঠা বানায়। তাই ডেকে পাঠিয়েছি। সকালে আসার কথা ছিলো দুপুর গড়ালে এলো। ডেকে পাঠালেই এদের ভাব হয়। যে যাক তুই নেমে আয় জলদি।"
রেবেকা বানু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে নওরিজের কথায় থমকে যায়।
" আম্মা মেয়েটা এখন বড় হয়েছে। বড় কথা হলো শান্তি চাচি আর এ বাড়িতে কাজ করে না। তুমি ওনার মেয়েকে কাজের মেয়ে ভেবে বসো কেন? তোমার নিশ্চয়ই কাজের লোকের অভাব নেই। থাকলে বলতে পারো আমি ব্যবস্থা করছি।"
রেবেকা বানুর মুখটা থমথমে। ফিরে এসে ছেলের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়,
" মুফতে ডাকি নি। পারিশ্রমিক দিয়েছি। আর কাজের লোকের মেয়েকে কাজের মেয়ে ভাববো না তো কি ঘরের বউ ভেবে মাথায় তুলে রাখবো রিজ? মাঝে মাঝে কেমন বেখাপ্পা কথা বলো।"
" ঘরের বউ ভেবে রাখতে পারো মাথায়। মেয়েটা অযোগ্য নয় মোটেই।"
নওরিজের শান্ত বাক্যে রেবেকা বানু বুলি হারিয়ে ফেলতে নিয়েও ফেলেন না। ভাবে হয়তোবা রওশনের কথা জানে ছেলেটা। তিনি আর তর্কে জড়ান না।
" কে কতটা যোগ্য তা আমরাও বুঝি রিজ। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে।"
বলে চলে যান ভদ্রমহিলা। নওরিজ উষ্ণ শ্বাস ফেলে স্বচ্ছ আয়নায় আবারও দেখে নেয় নিজেকে। নাকটা লাল হয়ে আছে। হবে না? হাঁচি দিতে দিতে জানহারা। আবারও হাঁচি দিয়ে রুমাল ব্যবহার করে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। নিচ তলায় নেমে দক্ষিণ দিকের আলিশান দরজা ঠেলে বারান্দায় যায়। ব্যস্ত নয়ন যুগল চেনা পরিচিতদের ভিড়ে খুঁজে যায় প্রিয়াকে। খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হয় না। ছোট উঠোনে মোড়া পেতে বসে হেঁসেলে লাকরি ঠেলছে। দাউ দাউ করে প্রজ্বলিত হেঁসেলের উজ্জ্বল আলোয় শ্যামল মুখটা যেন জ্বল জ্বল করে ওঠে। রৌদ্রজ্জ্বল মায়াবিনী সুশ্রী মুখটার দর্শনে গা জুড়ে আবারো সেই শিরশির অনুভূত জেগে ওঠে। মাথা চাড়া দিতেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সে যে সর্বনাশা জলোচ্ছ্বাস!
.
.
.
চলবে......................................................................