মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৬৭ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          কৌশিক বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু তার হাবভাব একেকটা চলন্ত ঝড়। কৌশিকের প্রচন্ড রাগে আকাশের রং বদলে গেছে আর ল্যুমিস নদী তার ক্রোধের সুরে আবারো জেগে উঠেছে। বাইরে আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি পড়ছে, নদীর উপর ঘূর্ণিবাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাড়ির প্রতিটি দেয়াল তার উগ্র আচরণে কেঁপে উঠছে। দরজাগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আসবাবপত্র ছিটকে পড়ছে।

ভেনোরার ঘর ফাঁকা দেখা গেলো। কোথাও নেই সে।
কৌশিক অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে লারা আর তামংকে জিজ্ঞেস করলো,
"ভেনোরা কোথায়?"

দুজনেই ভীত কণ্ঠে মাথা নাড়লো, জানে না তারা।
কৌশিক কিছু সময় চিন্তিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সবকিছু মিলিয়ে বুঝে গেলো ভেনোরা এখানে নেই। সে আছে বিপরীত দিকের সেই বাড়িটায়। যে বাড়ির অস্তিত্ব জানে খুব কম মানুষ। কয়েকদিন আগে অনন্যাও জেনে গিয়েছিলো। সেই বাড়িটিতে ভেনোরার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। সবকিছু পরিষ্কার কৌশিকের কাছে। আর দ্বিধার সুযোগ নেই। কৌশিক ছুটে চললো জঙ্গলের বুক চিরে। ছায়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই বাড়ির দিকে। আজ আর থামবে না কৌশিক। আজ এই খেলা শেষ করতেই হবে। ভেনোরার জন্য, অনন্যার জন্য, নিজের দুঃস্বপ্নের শেষ অধ্যায় লিখতে। কৌশিক আর সময় নষ্ট করলো না। বৃষ্টির মধ্যে আগাছা ঠেলে, কাঁটা ছিঁড়ে, ছায়ার ভেতর দিয়ে সে এগিয়ে গেলো জঙ্গলের ঐ বাড়িটির দিকে। আজ হয় ভেনোরার শেষ, নয় তার নিজের। 

বাড়ির ভেতরে পা রেখেই কৌশিক চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল ভেনোরাকে। ভেনোরা তখন নিরবে বসে ছিল নিজের কামরায়। মন জুড়ে এক বিষণ্ণ অস্থিরতা। কী করবে, কোন পথে যাবে তার ঠিক নেই। একবার মনে হয়েছিল আগের মতোই সব ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। কিন্তু ভেনোরা ভালোই জানে এই সময়ে পালিয়ে যাওয়া মানে আগুনে ঘি ঢালা। কৌশিকের সময়টা সংকটময় চলছে, এখন চলে যাওয়ার নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। তাইতো নিজের আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তা মাটি চাপা দিয়ে সে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু যখন কৌশিকের তীক্ষ্ণ, উত্তপ্ত কণ্ঠ ভেনোরার কানে পৌঁছালো তার শরীর কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতর স্রোতের মতো ভয় ছুটে গেল।
ধীরে ধীরে, অসহায় পায়ে, ঢোক গিলে দরজার দিকে এগিয়ে এলো সে। দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলেই চোখে পড়লো কৌশিকের আগুন জ্বলা দৃষ্টি।

ঠিক তখনই আকাশ বিদীর্ণ করে এক বৃহৎ বজ্রপাত চমকালো। ভেনোরা থমকে গেলো, চোখ তুলে উপরে তাকালো। বুকের ভিতর কাঁপুনি আরও বাড়লো। ধারণা করতে পারলো কৌশিকের রাগ সম্বন্ধে।

কৌশিক গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
"How dare you to harm my wife?"

ভেনোরা এগিয়ে এলো দু’পা।
ভাঙা গলায় বললো,
"আমি তো তোমার জন্যই সব করেছি, কিয়ান। তোমায় বাঁচানোর জন্য।"

ভেনোরার কথা শেষ হতেই পাশে থাকা একটা ঝাড়বাতি প্রচন্ড শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলো। ভেনোরা সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূক্ষেপ করলো না। কৌশিকের রাগ উঠলে সে অনেক কিছুই করে। এসবে মনোযোগ দিতে হয় না। ভেনোরা কৌশিকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"আমি তোমার ভালো চাই, কিয়ান। তোমার ভালো অনন্যাতে নেই তুমি বিশ্বাস করো সেটা?"

কৌশিক ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ভেনোরার দিকে। ঠান্ডা এবং জ্বলন্ত কণ্ঠে বলল,
"আমি কি তোমাকে কোনোদিন বলেছিলাম আমার ভালো চাইতে?"

ভেনোরা অসহায়ভাবে বলল,
"কিন্তু এটা তো আমার কর্তব্য! তুমি আমার বন্ধু। তোমার ভালো চাওয়াই তো আমার কাজ।"

কথাগুলো শুনেই কৌশিকের চোখ আরও লাল হলো। এক ঝটকায় ভেনোরার গলা ধরে দেয়ালের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল সে। কাঁপতে থাকা ভেনোরার শরীর দেয়ালে ঠেকে গেল। বাইরে মেঘের গর্জন, ঘর জুড়ে অন্ধকার। কৌশিকের চোখে তখন ঝড়।

ভেনোরা কষ্টে গলা সরু করে বলল,
"একটা সাধারণ মেয়ের জন্য তুমি আমার সঙ্গে এটা করতে পারো?"

কৌশিক দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল,
"কিছু করার আগে তার পরিণতি নিয়ে একবারও ভাবোনি, ভেনোরা? আজ যা হয়েছে, তার মূল্য শুধু তুমি নয় আমাকেও দিতে হবে।"

ভেনোরা তীব্র সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?"

"অনন্যার এই অবস্থার কারণ তুমি! কিন্তু ফল ভোগ করতে হবে আমাদের দুজনকে! বুঝলে?"

কৌশিক আরও শক্ত করে ভেনোরার গলা চেপে ধরলো। ভেনোরার শ্বাস রুদ্ধ হতে লাগলো, চোখের সামনে অন্ধকার নামছিল। শেষমেশ বাধ্য হয়ে ভেনোরা পায়ে আঘাত করলো কৌশিকের হাঁটুর কাছে। কৌশিক ব্যথায় একটু নড়ে গিয়ে গলা ছেড়ে দিলো। সেই ফাঁকে ভেনোরা দু’হাত দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ছুটলো।

কৌশিক থেমে রইলো না। কয়েক মুহূর্ত থেমে নিঃশ্বাস সামলে সে ভেনোরার পিছু নিলো। ভেনোরা তখনই বাড়ির গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কৌশিক ঝড়ের মতো ছুটে এসে ভেনোরার ঘাড় চেপে ধরলো পেছন থেকে।

ভেনোরা পেছনে হেলে পড়েছে। সে শ্বাস কাঁপিয়ে বললো,
"কিয়ান! তোমার হুশ আছে?"

কৌশিক ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বললো,
"আমার হুশ পুরোপুরি ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ভুলের শাস্তি আজ তুমি এড়াতে পারবে না।"

ভেনোরা আবারও কৌশিককে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গেলো। চোখ দু’টো বন্ধ করতেই তার পেছন থেকে ঈগলের মতো বিশাল পাখনা প্রসারিত হলো। ঘন বর্ষার ভিতরেই উড়ে পালাতে চাইলো সে। কিন্তু কৌশিক এত সহজে ছাড়বার নয়। তার রাগ, ক্রোধ, প্রতিশোধ সব একসাথে বিস্ফোরিত হয়েছে। এক লাফে কৌশিক ভেনোরার পাখনার ডগা আঁকড়ে ধরলো। তার হাতের নখ মুহূর্তেই বেড়ে গেলো। ধারালো শিকারের মতো হয়ে উঠলো। এক প্রবল আঁচড়ে ছিঁড়ে ফেললো ভেনোরার একপাশের পাখনা। ভেনোরার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো হৃদয়বিদারক ঘন চিৎকার। সেই চিৎকারে জঙ্গলের নীরবতা ভেঙে গেলো। আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো। পিঠ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ঝরনার মতো। 

ভেনোরা ব্যথায় কুঁকড়ে পড়ে রইল। চোখের কোণ বেয়ে টলমল অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় দহন, তীব্র যন্ত্রণায় নিশ্বাস পর্যন্ত ভারী লাগছে। কৌশিক ও নিচে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। বৃষ্টিতে তার ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। মুখটা গভীর শ্বাসে থমথমে। মনে হচ্ছে ঝড়ের পর সময়ের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে ওর ভেতরে।

ভেনোরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফিসফিস করে বলল,
"আমি তোমাকে সুস্থ করেছিলাম তোমার ভালো চেয়েছিলাম, কিয়ান। এসব দেখার জন্য?"

ভাঙাচোরা কাচের টুকরর ন্যায় ভেনোরার স্বর কাঁপছিল। সে কষ্টে চোখ বন্ধ করল। ব্যথায় পিঠটা কুঁকড়ে গেল।

"তুমি জানো আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে?"

কৌশিক ধীর দৃষ্টিতে ভেনোরার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে কোনো উত্তর নেই। দৃষ্টির আড়ালে কোনো দয়া নেই। শুধু নিঃসঙ্গ এক শীতলতা।ভেনোরা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। চিৎকার করে বললো,
"আমি তোমার এই প্রতিদান কখনোই ভুলবো না, কিয়ান। মনে রেখো আমাকে ডাকলেও পাবে না।"

ভেনোরা পিঠে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ক্ষতস্থান জ্বলছে তার। বৃষ্টির পানিতে দহন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। পিঠের গভীর ক্ষত থেকে ধীরে ধীরে রক্ত গলে পড়ছে। কিন্তু সে থামল না। একবার সামনের দিকে তাকাল। তারপর টলতে টলতে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তবে এক পাখনা দিয়ে ওড়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৌশিক উঠে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তার ব্যর্থ চেষ্টা দেখতে লাগল। দৃষ্টি শীতল এবং কণ্ঠে গভীর দৃঢ় শোকের রেশ,
"আই এম সরি, ভেনোরা। কিন্তু তুমি যা করেছ, তা ঠিক ছিল না। অনন্যার জীবন আজ সংকটময় হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র তোমারই জন্য।"

ভেনোরা ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখের মণি আচমকা সবুজাভ আগুনে জ্বলে উঠল। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে। কণ্ঠস্বরে গর্জনের মতো তীব্রতা নিয়ে বললো,
"আমি তো ওকে মেরেই ফেলতে চেয়েছিলাম। সময় থাকতে শুধরে যাও, কিয়ান। নাহয় তোমার শেষ সময় এসে গেছে!"

বলেই ভেনোরা এক পাখনা নিয়েই ঝড়ের মাঝে উড়ে চলল। শরীরের ব্যথা প্রতিটি ধমনীতে চিৎকার করে উঠলেও, সে তাতে কর্ণপাত করল না। বাতাসে দুলতে দুলতে বহু দূর গিয়ে আচমকা নিচে ধপ করে পড়ে গেল।

কৌশিক স্থির দাঁড়িয়ে রইল। দূর থেকে দেখল ভেনোরার নিস্তেজ দেহ। বৃষ্টির জলে ভিজে আরও অনড় হয়ে গেছে সে। কিন্তু হঠাৎই ভেনোরা আবার নড়ে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল সে। গা থরথর করছে। তবুও দৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে তীব্র প্রতিজ্ঞায়।

কৌশিক এক পা বাড়িয়ে থেমে গেল। কিছু সময় ভেনোরার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল। প্রবল বর্ষণের নিচে দাঁড়িয়ে গা ভিজিয়ে নিল সম্পূর্ণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল ধীরে ধীরে সে একা হয়ে যাচ্ছে। খুব একা। চারপাশে পানি দিয়ে ভরে যাচ্ছে, বাতাসের হাহাকার। অথচ কৌশিকের ভেতরে এক শুষ্ক মরুভূমি।

*****

তিন দিন কেটে গেছে। অনন্যাকে ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে। ওর মা খবর পেয়েছেন পরের দিনই। তারপর থেকে হাসপাতাল ছাড়েননি। কান্নায় চোখ ফুলে গেছে। কণ্ঠ কাঁপছে ক্লান্তিতে। পূর্ব বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু মায়েদের তো আবেগ থামানো কঠিন। চোখের নিচে গভীর কালি। দেহে ক্লান্তি নিয়েই হাসপাতালে বসে থাকে। নোহারা বারবার বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পরই তিনি ফিরে আসেন।

কৌশিক সবকিছু নীরব দৃষ্টিতে দেখতে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। কেবিনের বাইরে এক কোণে বসে থাকে নিঃশব্দ, অনড় হয়ে। নিক কতবার চেষ্টা করেছে ওর মুখ থেকে একটা শব্দ বের করতে, কিন্তু কৌশিক নির্বিকার। শুধু মাঝে মাঝে উঠে অনন্যাকে দেখে আসে, তারপর আবার ফিরে আসে সেই নিস্তব্ধতায়। 

সেদিন রাতে আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। চারপাশে খুশির আমেজ। কিন্তু সকলের মনেই কি খুশি থাকে? কোথাও কোথাও তো ঝড় ও বয়ে যায়! নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। অনন্যার মাকে জোর করেই বাসায় পাঠানো হয়েছে। পূর্ব থেকে গেছে তার জায়গায়। নোহারাও বাড়ি ফিরে গেছে। নিক ই তাকে এখানে শুধু শুধু বসে থাকতে মানা করে। হাসপাতালের করিডোরে নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে যন্ত্রের একঘেয়ে শব্দ কানে ভেসে আসে।

ডাক্তার এসে অনন্যার হাতে ধীরে ধীরে ইনজেকশন পুশ করলো। ঠিক তখনই কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটল। অনন্যার শ্বাসপ্রক্রিয়া হঠাৎ দ্রুত হয়ে উঠলো। অক্সিজেন মাস্ক পরা অবস্থাতেই সে ছটফট করতে লাগলো। শরীর কুঁকড়ে উঠলো প্রচণ্ড যন্ত্রণায়, ছটফট করতে থাকলো অনন্যা। নড়েচড়ে উঠল হাসপাতালের পরিবেশ। ডাক্তার নার্সদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। ইলেকট্রিক শক থেরাপি দেওয়া হলো, মনিটরের শব্দ আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠলো।

কৌশিক এতক্ষণ বাইরে বসে ছিল‌ কিন্তু যখন কাঁচের দেয়ালের ওপারে অনন্যার শরীর ছটফট করতে দেখল তখন আর স্থির থাকতে পারল না। সিট থেকে উঠে ছুটে গেল রুমের সামনে। কাঁচের দেয়ালে হাত রেখে তাকিয়ে রইল অনন্যার দিকে। ধীরে ধীরে অনন্যার শ্বাস কমে আসছে। মনিটরের রেখাগুলো অনিয়মিত হয়ে আসছে।
কৌশিকের অভ্যন্তরীণ কিছু একটা ভেঙে পড়তে লাগলো। মাথা ঠিক থাকলো না তার। মুহূর্তেই দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঢুকে গেল সে। কেউ কিছু বোঝার আগেই প্রবল শক্তিতে ডাক্তার-নার্সদের সবাইকে বাইরে ছিটকে ফেলল। পুরো কেবিন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল কৌশিক আর অনন্যা মুখোমুখি। মাঝখানে দুলতে থাকা জীবন-মৃত্যুর এক অদৃশ্য সেতু। কৌশিক অনন্যার হাত চেপে ধরলো। কৌশিক নিচুতে ঝুঁকলো। অনন্যার নিস্তেজ এবং শুকনো চেহারা ভেঙে চুরমার করে দিলো কৌশিককে। কৌশিকের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। ভেনোরাকে দেওয়া শেষ কথা সে রাখতে পারলো না। বারবার কানে বাজতে থাকলো বিভিন্ন কথা।

একদিকে ডাক্তার বলছে,
"অনন্যা বাঁচলেও না বেঁচে থাকার মতো।"

অন্যদিকে ভেনোরা বলছে,
"কিয়ান, তোমাকে রক্ষা করার জন্য এবার কিন্তু আমি নেই। সাবধান।"

অনন্যার নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে আচমকাই কৌশিকের মনে ভেসে উঠলো তাদের কাটানো মধুর স্মৃতিগুলো। কতবার যে অনন্যার হাসি তার সমস্ত যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে। কতবার যে সেই কোমল স্পর্শ তাকে অন্ধকার থেকে টেনে এনেছে সব মনে পড়তে লাগলো একে একে।

কৌশিকের শরীর যার প্রতিটি শিরা-উপশিরা জ্বলেপুড়ে ছাই হওয়ার মতো ছিল সেই দহন শান্ত করেছিল একমাত্র অনন্যাই। অনন্যাই আবার তার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে কৌশিক জানতো না। অনন্যাই তো এসে কৌশিকের হৃদয়কে মানুষ করেছিল, তাকে শিখিয়েছিল, বেঁচে থাকার জন্য একটুকরো অনুভূতিই যথেষ্ট। কিন্তু যদি সেই অনুভূতির উৎসই হারিয়ে যায়, তাহলে আর বেঁচে থাকার মানে কী?

নিক ফিরে এসেছে। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। কৌশিকের চোখের ভাষা আর তার সমস্ত অস্তিত্বের ছটফটানি সবকিছু বলে দিচ্ছে সে কি করতে যাচ্ছে। নিক কেবিন রুমের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই এক অদৃশ্য শক্তি তাকে থামিয়ে দিলো। শুধু নিক নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার ও নার্সরাও কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না।

নিকের শরীর হিম হয়ে এলো। সে জানে, কৌশিক যদি সত্যিই অনন্যাকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাকে আটকানো সহজ হবে না। কিন্তু কৌশিক যদি অনন্যাকে আবারো শক্তি দেয় এর পরিণতি কী হবে সে ভাবতেই পারছে না। 

নিক জোরে গলায় বললো,
"কৌশিক, ডোন্ট! "

কৌশিক কোনো উত্তর দিলো না। তার তীক্ষ্ণ আকাশি মণির দৃষ্টি নিবদ্ধ রইলো অনন্যার নিস্তেজ হয়ে থাকা ফ্যাকাসে মুখের ওপর। নিঃশব্দে সে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিলো। ধীরে ধীরে সে অনন্যার কপালে আঙুল ছোঁয়ালো।

নিচু হয়ে অনন্যার কানে ফিসফিসিয়ে বললো কৌশিক,

"প্রিন্সেস, তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে যদি আমি মানবকুলের জন্য অভিশাপও হয়ে উঠি, তাতেও আমার একটুও আপত্তি নেই। আমার একমাত্র ভয় এই পৃথিবী যদি তোমাকে ছাড়া শূন্য হয়ে যায়! তোমাকে সুস্থভাবে দেখতে পারলেই আমার চাওয়া পূর্ণ হবে। এর বেশি কিছু চাই না আমি। তোমার প্রিন্স শুধু তোমাকে চায়। যেমন করে বারবার তোমাকে রক্ষা করেছি ভবিষ্যতেও করতে থাকবো। "

নিক শক্তি প্রয়োগ করেও অদৃশ্য বাধা ভাঙতে পারছিল না। রাগে, হতাশায় সে চিৎকার করে উঠল,
"কৌশিক প্লিজ তুমি কিছু করো না। ডাক্তারকে দেখতে দাও। তুমি এমনটা করলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যাবে না।"

কৌশিক উন্মত্ত কণ্ঠে চিৎকার করে বললো,
"আই ডোন্ট কেয়ার! আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট দা ওয়ার্ল্ড। দা অনলি থিং আই কেয়ার এবাউট ইজ দিস গার্ল। অনন্যার কিছু হলে আমার বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।"

নিক হতাশ কণ্ঠে বলল,

"কৌশিক, মানুষ ক্ষণস্থায়ী। ওদের জীবন আমাদের মতো নয়। কখন যাবে, সেটাও আগেই ঠিক হয়ে গেছে। তুমি থামিয়ে রাখার কে? প্লিজ, সবটা নিয়তির হাতে ছেড়ে দাও। আমরা মানুষ নই, যে মানুষের মতো একজনে আটকে থাকব। আমরা ওদের মতো নির্বোধ নই!"

কৌশিক শান্তভাবে তাকাল নিকের দিকে, তারপর একটানা বলে গেল,

"কিন্তু আমি নির্বোধ, নিক। আমি এই মেয়েটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। তো হ্যাঁ, আমি নিশ্চিতভাবেই একজন বোকা!"

কৌশিক এক টানে অনন্যার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলল। অনন্যার অনিয়মিত শ্বাস ধীরে ধীরে আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। যন্ত্রণায় তার শরীর ছটফট করছে। কৌশিক কোনো দ্বিধা না করে অনন্যার ললাটে হাত রাখল। চোখ বন্ধ করল শক্ত করে। মুহূর্তের মধ্যেই অনন্যার শরীর শিথিল হয়ে এল। গভীর প্রশান্তিতে ঢলে পড়ল সে। শ্বাস স্বাভাবিক হতে শুরু করল মনে হলো দীর্ঘকাল পরে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছে।

কিন্তু কৌশিক তার শরীরে ধীরে ধীরে ভয়ংকর এক পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। বরফের মতো শীতল ছিল তার দেহ, এখন তা আরও জমে যাচ্ছে, বরফের থেকেও শীতলতর হয়ে উঠেছে। শরীরে বিভিন্ন স্থানের শিরাগুলো কালো হয়ে নীলচে হয়ে গেছে। অন্ধকার ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বেরিয়ে আসছে শরীর থেকে। ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। কৌশিকের ঠোঁট বেগুনি বর্ণ ধারণ করেছে। আঙুলগুলো কাঁপছে। কিন্তু তারপরও হাতটা ললাট থেকে সরাচ্ছে না সে। এদিকে অনন্যা নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে। শ্বাস নিচ্ছে স্বাভাবিকভাবে। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে সে যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু সত্যিটা অন্যরকম। অনন্যার মস্তিষ্কে প্রবল ঝড় বইছে। এক লুকায়িত শক্তি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। স্মৃতির অতলে কোথাও লুকিয়ে থাকা এক অজানা অধ্যায় ধীরে ধীরে চোখের সামনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আলো-অন্ধকারের সেই অতল গভীরে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে প্রতিশোধ দেখতে পাচ্ছে অনন্যা।
·
·
·
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp