স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা - পর্ব ৩০ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


“আপনি কি জাদু করেছেন বলুন তো? কেন আমি আপনাকে ঘৃণা করতে পারছি না?”

জাওয়াদ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার অনুভূতিগুলো জড় হয়ে আছে যেন। চিংকি তাকে ছেড়ে ভালো করে দেখলো তাকে। দু হাতে মুখখানা হাতের আদলে নিলো সে। উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত স্বরে বললো,
 “এ কি অবস্থা করেছেন নিজের? একেই আপনার সেদিনের অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয় নি, আবার এই রক্ত কেন? আমাদের হাসপাতালে যাওয়া উচিত”
 “তুমি তো কিছু না বলেই নীরবে চলে যাচ্ছিলে। তুমি কি আমাকে এতটাই ঘৃণা করো? যে বিদায়ের একটি শব্দও উচ্চারণের প্রয়োজন অনুভব করো নি?”

জাওয়াদের কণ্ঠ কাঁপছে। তার চোখ টলমল করছে বিষন্নতায়। তার শরীর কাঁপছে। চিংকি বিমূঢ় চেয়ে রইলো। সে কোনো উত্তর দেবার পূর্বেই জাওয়াদ আবার বিষন্ন স্বগোতক্তি করলো,
 “দীপশিখা আমি ভেবেছিলাম, যদি অনুভবগুলো একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারি—তাহলে তুমি বুঝতে পারবে, তুমি হয়তো ফিরে তাকাবে…আমি ভেবেছিলাম, আমার ভালোবাসাটা যদি ঠিকভাবে বোঝাতে পারি তাহলে তুমি আমাকে শেষ সুযোগটা দিবে……যদি নিজের অনুভূতিগুলো একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারি, তাহলে তুমি একদিন ঠিক বুঝবে। একদিন ঠিক মেনে নেবে… আমার ভালোবাসা, আমার অপেক্ষা। আমি জানতাম না, কতোটা সময় লাগবে—তবু বিশ্বাস করেছিলাম… একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তুমি এভাবে চলে যাও, তাহলে তো আমি কোনো সুযোগই পাবো না—আমার চেষ্টা করারও তো কোনো অবকাশ থাকে না। আমার হৃদয় একটা শেষ সুযোগ পাবারও যোগ্য নয়?”

কথাটা বলতে বলতেই তার চোখ ভিজে এলো। কণ্ঠে দলা পাকিয়ে গেলো। থামলো একটুক্ষণ। মাথা নত করে বলতে লাগলো, 
 “তোমার সেদিনের শেষ “আসছি” বলাটা কি চিরকালের জন্য ছিলো? আর আমি গাধার মতো… গাধার মতো ভাবছিলাম তুমি আমাকে আসছি বলেছো। তুমি আমাকে বিদায় জানানোর কথা ভেবেছিলো। আহাম্মকের মতো সেটাকে একটা আশার কিরণ ভেবে কত কি ভেবে ফেলেছি। তোমার চলে যাওয়াই উচিত ছিলো চিংকি। অন্তত আমার মতো মানুষের থেকে মুক্তি পেতে, যে জোঁকের মতো তোমার পিছু ছাড়ছিলো না। অবশেষে তুমি আমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারতে। কেন এলে তুমি? এটাই আমার প্রাপ্য ছিলো। আমার চিরকালের শাস্তি। আমিও তোমার মনের অবস্থাটা অনুধাবণ করতে পারতাম— অনুভব করতে পারতাম কেমন অনুভব হয়েছিলো যখন আমি তোমার হৃদয় ভেঙ্গেছিলাম, তোমার ভালোবাসাকে যখন নিজের অহঙ্কারে পিষে দিয়েছিলাম, তোমার অনুভবগুলোকে ‘তুচ্ছ’ বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম… কেন ফিরলে তুমি? কেন?”

বলতে বলতেই জাওয়াদ চিংকির হাতগুলো নিজের হাতে নিয়ে মাথা ঠেকালো। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। চিংকি এতটা সময় নিজেকে সামলালে আজ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলো। এতোটা দিন নিজের বক্ষমাঝে সব দুঃখ জমিয়ে রাখতে রাখতে যেন সে ক্লান্ত। এতোকাল সে নির্বিকার, নিরুদ্বেগ সত্তা সে ধরে রেখেছিলো তা মুহূর্তেই দুমড়ে মুচড়ে গেলো। আকাশ সমান অভিমান নিয়ে শুধালো,
 “আমি কেন ফিরে এলাম? এখন আমাকে দোষ দিচ্ছেন আপনি? আমার দোষ? সব দোষ আপনার। আপনি বলেছিলেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, অথচ পরদিন বললেন আমাকে ভালোবাসেন। কি ভেবেছেন আমাকে? আমার মনের, আমার অনুভূতির কোনো দাম নেই? আপনি যদি সত্যি আমার মনের অবস্থা, আমার অনুভূতির কথা ভাবতেন তাহলে বিয়ে ভাঙ্গার পর কখনো আমার সাথে দেখা করতেই আসতেন না। ইনফ্যাক্ট আপনি আমাকে বিয়ে করতেই চাইতেন না। সব কিছু আপনার স্বার্থপরতা। আপনার ধারনা আছে আমি কতটা কষ্ট করে নিজেকে গুছিয়েছিলাম। আপনার যখন মনে হয় তখন আমার সামনে উপস্থিত হন, যখন মনে হয় আমাকে তচনচ করে চলে যান। আপনি যদি বিয়ে ভাঙ্গার পর আমার সামনে না আসতেন, কোনো যোগাযোগ না করতেন আমি আপনাকে ভুলে জীবন নতুন করে শুরু করতে পারতাম…”

দীপশিখার কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ অশ্রুসিক্ত। অভিমান, অভিযোগগুলো অশ্রুর রুপে বয়ে যাচ্ছে যেন। ফুঁপাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, তবুও মন শান্ত হচ্ছে না। বক্ষস্থলের সব অভিযোগগুলো জলচ্ছ্বাসের রুপ নিয়েছে যেন। গোছানো, সজ্জিত হৃদয় বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। অভিমানের হাতুড়ির আঘাতে নিজেকে অনড় রাখা দীপশিখা আজ চূর্ণবিচূর্ণ। দলা পাকানো স্বরে বললো,
 “প্রথম থেকে দোষ আপনার। আপনার স্বপ্ন, আপনার খারাপ দিনের জন্য আপনি আমার কাছে এসেছিলেন। ভালো না বেসেও আমাকে ভালোবাসার মরীচিকা দেখিয়েছিলেন। আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম আপনাকে। ভুলে গিয়েছিলাম কিশোরীর হৃদয় ভাঙ্গনের কষ্টটুকু। তাহলে কেন আপনি আমার কাছে এসেছিলেন? কেন আমাকে নিজের প্রতি দূর্বল করেছিলেন! আশা দেখিয়ে, স্বপ্ন দেখিয়ে আমাকে আমার আপনি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলেন। আমার বিশ্বাস, আমার ভালোবাসার মূল্য রাখলেন? তারপর যখন বিয়ে ভেঙ্গে দিলাম, আমি নিজেকে কড়া শাসনে রেখেছিলাম। আর কখনো কাউকে বিশ্বাস করবো না প্রতীজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু তখনও আপনি এসে হাজির হলেন ভালোবাসার কথা বলে। আমি কি করে তৃতীয়বারের মতো আপনাকে বিশ্বাস করবো বলুন? কি করে আবার ভালোবাসবো? এতো সোজা? কি ভরসা আপনি আবার কোনো স্বপ্ন দেখছেন না। কি ভরসা আপনি আমাকে আবার ব্যবহার করছেন না”
“আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি, চিংকি আমি কোনো স্বপ্নের ভয়ে তোমার কাছে আসি নি। আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই তোমার কাছে এসেছিলাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার মন থেকে সেই সব জঘন্য স্মৃতি গুলো মুছিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যেগুলো তোমাকে কাঁদিয়েছিলো। ইনফ্যাক্ট আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, আমি কলেজের ফেয়ারওয়েলের দিনটাকেও পুনরাবৃত্তি করাতাম। আমি সেদিন তোমাকে কখনোই ফিরিয়ে দিতাম না। আমাকে শেষবারের মতো বিশ্বাস করো”
 “প্রমাণ দিতে পারবেন আপনি?”
 “তুমি কি প্রমাণ চাও? বল। তুমি যা চাইবে তাই হবে। শুধু বল”
 “আমাকে বিয়ে করতে পারবেন? এখন এই মুহূর্তে?”

জাওয়াদ থমকালো। সে নিস্তব্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো চিংকির দিয়ে। শান্ত সরোবরের মতো অনুত্তাল চিংকির এমন কথা তাকে স্তব্ধ করে ফেললো। মেয়েটি কখনো না বুঝে জিদ করে না। চিংকি শ্লেষাত্মক স্বরে বললো,
 “কি হলো সব সাহস উবে গেলো? ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলো?”
 “আমি তোমাকে বিয়ে করবো”
 “জানতাম আপনার দ্বারা কিছু সম্ভব না। আপনি আসলে আমাকে ভালোবাসেনই না। আমাদের পরিবার কখনো আমাদের মেনে নিবে না। আমি শুধু শুধু ট্রেন থেকে নামলাম”
 
দীপশিখা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কান্না বাঁধ ভাঙ্গছে না। জাওয়াদ তার বাহু শক্ত করে ধরে ঝাঁকালো। স্পষ্ট স্বরে বললো,
 “আমি তোমাকে বিয়ে করবো। এখনই করবো”
 “হ্যা?”

বিমূঢ় চেয়ে রইলো দীপশিখা। কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। হতভম্ব হয়ে বললো, 
 “এই অবস্থায়?”

জাওয়াদ অশ্রুমিশ্রিত স্বরে বললো,
 “হ্যা, এই অবস্থায়?”
 “পড়ে পস্তাবেন না তো?”
 “নাহ”
 “স্বপ্নে আমাকে দেখে আপনার অবস্থা বেহালাল, বিয়ের পরও যদি তাই হয়”
 “তুমি আমার সৌভাগ্য চিংকি। তোমার স্বপ্ন দেখার জন্য আমি কাতর হয়ে থাকি। বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো। বুকের মধ্যে আগলে রাখবো। আমার বউ হবে?”
 “বাবা না মানলে?”
 “একটু বিশ্বাস কর, এই পৃথিবী সাক্ষী থাকবে আমার ভালোবাসার। আজন্ম আমি তোমার হাত ছাড়বো না। এবার একটু বিশ্বাস কর”

দীপশিখার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকনাগুলো সযত্নে মুছে দিলো জাওয়াদ। দীপশিখা কাঁদছে। হৃদয়ে চেপে থাকা দুঃখ গুলো আজ মুক্তি পেয়েছে যেন, অভিমান গুলো গলে অশ্রুরুপে বয়ে যাচ্ছে। এক চাঁপা আনন্দে তার চোখ ভিজে আসছে। এতোটা আনন্দিত শেষ কবে হয়েছিলো সে? মনে পড়ছে না। তবে সত্যি যেন সৃষ্টিকর্তা তার ঝুলিতে সুখের জ্যোৎস্না এনে দিয়েছেন। নির্মল এই প্রাপ্তি। 

******

কমলাপুরের পাশেই এক কাজী অফিসে বিয়ে করলো জাওয়াদ এবং চিংকি। সাক্ষী হিসেবে থাকলো পাভেল এবং জ্যোতি। চিংকির বিয়ে এতোটা সাদামাটা হবে কখনো ভাবে নি। অথচ ঠোঁটে হাসির রেষ কমছে না। আইনত, ধর্মীয় রুপে এখন সে দীপশিখা কবির থেকে দীপশিখা হামিদ হয়ে গেলো। না না দীপশিখা জাওয়াদ হামিদ। বাবাকে না জানিয়ে কাজ করার মেয়ে নয় দীপশিখা। তাই বিয়ে পূর্বে সে প্রথমে বাবাকে জানালো। মোস্তফা গম্ভীর স্বরে বললেন,
 “এতো বড় সিদ্ধান্ত একা একা নিচ্ছো?”
 “হ্যা বাবা”
 “কোনো সংশয় অনুভব করছো?”
 “আশ্চর্যের ব্যপার আমার একটুও সংশয় লাগছে না বাবা। খুতখুত করছে না মন। আমার মনে হচ্ছে বিয়েটা কোনো খারাপ কোনো সিদ্ধান্ত না”
 “তাহলে আমাকে ফোন করলে যে?”
 “তুমি আমার বাবা, আমার বন্ধু। তোমাকে না জানিয়ে কি করে বিয়ে করবো বাবা? তুমি কি রাগ করেছো?”
 “একদম না। আমি শুধু ভাবছি তোমার মা কে সামলাবো কি করে?”
 
দীপশিখা চুপ করে রইলো। মা যে খুব বড় ঝামেলা করবেন তাতে সন্দেহ নেই। তিনি ঠিক এগারোটায় নয়া ফুপুকে ফোন দিবেন। দীপশিখার খোঁজ করবেন। দীপশিখা নিষ্প্রভ স্বরে শুধালো,
 “তাহলে কি করবো বাবা?”
 “এক কাজ কর, বিয়েটা করে আজ তুমি জাওয়াদের সাথেই থাকো। কাল সকাল হতেই আমাদের বাসায় চলে এসো। নীরু নারকেলজাত মহিলা। পা ধরলেই গলে যাবে। আর শোনো চিংকি মা?”
 “কি বাবা?”
 “তোমার বাবার দোয়া তোমার সাথে আছে। আমি এখন আসতে পারছি না। তবে তোমার বিয়েটা আমি ধুমধাম করেই দিব”

বাবার সাথে কথা বলে মনটা শান্ত হয়ে গেলো। নিঃসংশয় মনে সে বিয়েটা করলো। বিয়ের পর জাওয়াদ মৃদু স্বরে বলল,
 “চলো”
 “কোথায়?”
 “তোমার বাড়িতে”

******

জাওয়াদের হাত ধরে আব্দুল হামিদের মুখোমুখি হলো চিংকি। আব্দুল হামিদের মুখখানা শক্ত। রাগ ঠিকরে উঠছে চোখে মুখে। জাওয়াদ ঘরে ঢুকতে নিলেই তিনি কঠিন স্বরে বললেন,
 “তুমি এই মেয়েকে বিয়ে করে আমার সামনে আসার স্পর্ধা দেখালে কিভাবে? মনে নেই এই মেয়ের জন্য আমার কত অপমান সইতে হয়েছে?”
 “আমরা একে অপরকে ভালোবাসি বাবা”
 
আব্দুল হামিদ রাগে কাঁপছেন। নিজের ছেলের এমন অবাধ্যতায় তিনি নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে। চোখ থেকে আগুন বের হচ্ছে যেন তার। কঠিন, বজ্রকণ্ঠে বললেন,
 “বেয়াদ্দব, বের হ। বের হ আমার সামনে থেকে। তোর মুখ দেখতে চাই না”
 “বেশ। আমি শুধু আপনার দোয়া নিতে এসেছিলাম। আমার স্ত্রীর এখানে জায়গা না হলে আমিও এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না”

 বলেই নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো জাওয়াদ। চিংকি তাকে বোঝাতে চাইলো। কিন্তু জাওয়াদ শুনলো না। চিংকির হাত ধরেই ঘর আব্দুল হামিদের ঘর ছাড়লো সে। 

******

বন্ধু হিসেবে বন্ধুর পাশে থাকা পাভেলের দায়িত্ব। তাই জাওয়াদ এবং চিংকির বাসস্থানের ব্যবস্থা সেই করলো। তার বোনের বাসায় একটা ফ্লাট খালি ছিলো। ছোট ফ্লাট। কিন্তু নব্য দম্পত্তির জন্য যথেষ্ট। জাওয়াদ যখন তাকে ধন্যবাদ দিতে চাইলো, সে নির্বিকার স্বরে বলল,
 “ঋণ যথা সময়ে পরিশোধ করবি। আমিও যখন জ্যোতিকে নিয়ে পালাবো তখন আমাকে সাহায্য করবি”

ছোট দুটো ঘর, একটা রান্নাঘর। ঘরে কোনো আসবাব নেই। পাভেল এবং জাওয়াদ একটা তোশক আর দুটো বালিশ কিনে এনেছে আজ রাতের জন্য। চিংকি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চট করে সিদ্ধান্তটা কি ভুল ছিলো? তাদের কি একটু ধৈর্য্য ধরা উচিত ছিলো? ঠিক সেই সময় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো জাওয়াদ। নাক ডোবালো কাঁধে। ধীর স্বরে বললো,
 “ম্যাডাম আজ কিন্তু বিশেষ রাত, আজ কোনো বারণ আমি শুনবো না।”
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp