"চুমকি চলেছে একা পথে। সঙ্গী হতে দোষ কি তাতে! রাগ করে না লক্ষী সোনা রাগলে লাগে তোমায় আরো ভালো!"
" আরে আরে ভয় পাচ্ছো কেন সোনামনিরা! পাঠক্ষেতে চলো সব ভয় দূর করিয়ে দিবো। সাথে স্বর্গীয় সুখ আহ্ আহ্!
বিশ্রী ইঙ্গিত ও বিশ্রী গানের গলা কানে ভাসতেই সুরেলা কাঁধে ব্যাগের ফিতা শক্ত করে চেপে ধরে দ্রুত পা চালায়। মেম্বরের ছেলে সেলিম রেজা দলবল নিয়ে পিছু নেয়। সুরেলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অশ্লীল কথা বলে। অঙ্গ ভঙ্গিতে এটা ওটা ইশারা করে। সুরেলা ভুল ক্রমেও তাদের দিকে তাকায় না। আশেপাশে আরো ক'জন মেয়েরা নত মুখে হেঁটে যাচ্ছে সে তাদের সঙ্গে পা মেলায়। ওদিকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ বেড়েই চলেছে অনেকটা অসহনীয় পর্যায়ে। সুরেলার ইচ্ছে করে পায়ের চটি জুতো মুখ বরাবর ছুঁড়ে মারতে। নিজ ইচ্ছে কে দমিয়ে এগিয়ে যায়। সামনে মজিদের বাড়ির পুকুরের পাশে আমগাছের গোড়ায় শান বাঁধানো বসার জায়গায় চেনা পরিচিত লোক দেখে সুরেলার মনে সাহস সঞ্চয় হয়। আরে এতো খুঁতখুঁতে লাট সাহেবের চ্যালাপ্যালা! সুরেলা ঘার ঘুরিয়ে সেলিম রেজা ও তাঁর দলবলের দিকে তাকায়। সেলিম রেজা চুমুর ভঙ্গিমা করে ঠোঁট কামড়ে মিটমিটে হাসে। সুরেলার মেজাজ বিগড়ে যায়। বা পায়ের জুতো খুলে করে ছুঁড়ে মারে মুখ বরাবর। আকস্মিক ঘটনায় সেলিম ও তার দলবল ভড়কায়। জুতোর ঢিল এসে সেলিমের গায়ে লাগে। উপস্থিত মেয়েরা চাপা স্বরে হেসে ওঠে। সেলিম রেজার চিত্ত বরাবর আগুন লাগলো যেন। তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে আসে। সুরেলা ডান পায়ের জুতোটাও খুলে জোর খাটিয়ে ঢিল ছুঁড়ে ভাইয়ের মতো খেঁকিয়ে ওঠে,
" জাউরা কোথাকার। ঘরে মা বোন নাই? তাদের নিয়া যা পাঠক্ষেতে। আরেকবার আমার পিছু নিলে আবারও খৎনা করিয়ে দিবো বাইঞ্চত।"
এবার জুতো চোয়াল বরাবর আঘাত হানে। আশেপাশের মেয়েরা খিলখিলিয়ে হেসে দেয় সুরেলার কথায়। সুরেলাও হাসে ক্ষীণ। এখন একটু শান্তি শান্তি লাগছে। কিছু দিন হলো হালার পুতেরা তাঁর পেছনে পড়েছে। আজ শিক্ষা দিলো, এরপর লাগতে আসলে ভাইকে বলে নেংটো করিয়ে গ্রাম ঘুরাবে। সেলিম রেজার মুখাবয়ব থমথমে। অপমানে সারা অঙ্গ জ্বলে ওঠে। ওর দলবল মুহূর্তেই হৈ হৈ করে তেড়ে আসে। সুরেলা কে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করা শুরু করে দেয়।
হারুণ, তমাল, জামাল দূরে আমগাছ তলা থেকে গন্ডগোলের আভাস পেয়ে ছুটে আসে। সেলিম রেজার মেয়েবাজ চরিত্রের কথা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে। কয়েকদফা শালিশিও বসেছে। হাত, পা ধরে মাফ চেয়েছে কতবার তাঁর গণনা নেই। কিন্তু কুত্তার লেজ যে সোজা হবার নয়। ও কি সুর ভাবীরে কিছু বলেছে? বলে থাকলে ওর কেচ্ছা চির সমাপ্ত হতে খুব বেশি সময় নেবে না। ওদের আগমনে সেলিমের দলবল চুপ করে যায়। হারুণ সবার আগে এসে সুরেলার দিকে তাকিয়ে শুধায়,
" ভাবী কুনো সমস্যা? ও আপনেরে কিছু কইছে?"
সুরেলা কাঁধের ব্যাগ ঠিক করে দু কদম এগিয়ে আসে। আঙুল তুলে কর্কশ গলায় বলে,
" কে ভাবী? কোথাকার ভাবী? আমি আপনের কোন জন্মের ভাবী লাগি? আরেকবার কইলে চোপায় দাঁত থাকবো না।"
হারুণ ভোঁতা মুখে বিড়বিড় করে। ভাইয়ের কোনো অংশে কম না। সেলিম সুরেলার দিকে ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে আছে। চাহনি সুবিধার লাগে না। জামাল থমথমে মুখে এগিয়ে যায় সেলিমের দিকে। কাঁধ চাপড়ে গম্ভীর গলায় বলে,
" উল্টোপাল্টা কিছু করলে সেলিম ভাই পালানোর রাস্তা খুঁজে পাবেন না।"
সেলিম ঝটকায় হাত সরিয়ে কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে যায়। তবে তাঁর হিংস্র চাহনি অনেক কিছুই যেন বলে গেলো। তাঁর পিছু পিছু তার দলবল চলে যায়। সুরেলাও বাকি মেয়েদের সাথে পা বাড়ায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। জমাল, হারুণ, তমাল সেখানেই দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে আলাপ আলোচনা করতে থাকে।
সুরেলা একটু আগের ঘটনার বিষয়ে কথা বলতে বলতে সাথে কার মেয়েদের সাথে হাসতে হাসতে হাঁটতে থাকে। তাদের স্কুলেরই মেয়ে সবগুলো। কেউ অষ্টম শ্রেণীতে তো কেউ কেউ ষষ্ঠ সপ্তমে। তন্মধ্যে একজন মেয়ে বলে,
" আপা জুতা মাইরা তো ঠিকই করছেন তয় ডর লাইগলো না? অহন ওরা যদি কোনো ক্ষতি করে আপনের? পিছনে যদি লাগে? আমার মা কয় কেউ উল্টাপাল্টা কিছু কইলে চুপ থাকবি। লাগতে যাবি না। লাগলে তাগোর চোখে পড়বি। সর্বনাশ করতে উঠেপড়ে লাইগবো।"
সুরেলা ভাবে কথা মন্দ বলে নি। তাঁর মায়েও তাকে বারণ করে ঝামেলায় না জড়াতে।
" কতদিন এমনভাবে চুপ থাকতাম? আমার চুপ থাকায় ওরা লায় পাইতো। তাছাড়া ভয় পাই নাকি ওই বেজন্মারে? আমার ভাইয়ের কানে গেলে ওরে পিসপিস কইরা কাটবো। আর তোমরাও চুপ থাকবা না, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করবা। মনে রাইখো শক্তরে কেউ ভাঙতে যায় না। যে দূর্বল তাঁর পেছনেই দা ছোরা নিয়া দৌড়ানি দেয়।"
সুরেলার কথায় সবাই সায় জানালো। মোটর বাইকের হর্ণের আওয়াজে সবাই রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটে। বাইকের মালিককে দেখে সুরেলা হাসে। বাইকের মালিকও মৃদু হেসে বাইক থামায়।
" এই সুরেলা কি হয়েছে? কি সব গুসুর ফুসুর শুনলাম। সেলিমকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছো? উত্যক্ত করেছে নিশ্চয়ই জানোয়ারটা? দাঁড়াও ওর একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করছি।"
রওশনের কথায় সুরেলা প্রসারিত হেসে বলে, " হ্যাঁ রওশন ভাই জলদি করেন। ওটা কুত্তার লেজ কখনো সোজা হওয়ার না। স্কুলের পেছনে দলবল নিয়ে থাকবে। ছোট থেকে বড় সবাইকেই অশ্লীল ইঙ্গিতে করবো। ওর জ্বালায় অতিষ্ঠ গ্রামবাসী। মেম্বরের ছেলে তাই অনেকেই ভয় পায়।"
" আমি দেখছি। ভয় পেও না। অনেক সাহসীতার পরিচয় দিয়েছো। বাইকে ওঠো পৌঁছে দিচ্ছি। আসো?"
সুরেলা ভদ্রতার সাথে নাকচ করে প্রস্তাব খানা। রওশনের কাঁধে হাত রেখে পেছনে বসা রূপসা অভিমানী স্বরে বলে,
" সুর আপা আসো। আমার ভাই তোমার ভাইয়ের মতো খারুস না। সকালে একটু লিফট চাইলাম ভাব দেখিয়ে চলে গেলো।"
সুরেলা সুক্ষ্ম চোখে চায়। মেয়েটা সকালের বিষয় নিয়ে খোঁচা দিলো? রওশন আবারও বাইকে উঠতে বলে। সুরেলা দোনামোনা মনে উঠে বসে। চেয়ারম্যান বাড়ির এই একমাত্র ব্যাক্তি যার কথা বা আচরণে সুরেলা কখনো হিন্যমন্যতায় ভোগে নি। সবসময় হাসিমুখে বিনয়ী ভঙ্গিতে কথা বলবে। রওশন বাইক টেনে নিয়ে যায় সাবধানে। রূপসা সুরেলাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
" সুর আপা আমি রেডি হয়ে দৌড়ে এসেছি ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু তোমরা কেউ ছিলে না। রিজ ভাই বললো চলে গেছো। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। একটু সাইকেলেই তো চড়তে চেয়েছি তোমার তাঁর ছেঁড়া ভাইয়ের মাথায় উঠে তো নাচতে চাই নি, তাই না?"
" হ্যাঁ সুরেলা সিন কিন্তু কাজটা মোটেই ঠিক করে নি? রূপ তো কেঁদেই দিয়েছিলো। সে আমি এটা ওটা বলে মানালাম। তোমার ভাইটা একেবারে কাঠখোট্টা শালার কপালে বউ নাই।"
রওশনও বোনের সাথে যোগ দেয়। সুরেলা হেসে বলে,
" বললেই হলো? আমার ভাইয়ের জন্য সুন্দর নরম শোভা শান্ত শিষ্ঠ মেয়ে খুঁজে আনবো। একদম মিষ্টি পুতুল।"
" হ্যাঁ এনো দু'দিন না যেতেই বউ ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। তোমার ভাইয়ের যা মেজাজ। বাপ রে!"
রূপসার ভর্ৎসনায় হাসে সুরেলা। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
" ধারনাটা ভুল। মেজাজি মানুষ কিন্তু বউরে বেশিই ভালোবাসে। আমার ভাইও বাসবো। একেবারে আদরে সোহাগে ভরাই রাখবো। ভাইয়ের মেজাজের ঠিকঠিকানা না থাকুক তাঁর প্রত্যেকটা শাসনে অসীম স্নেহ আর ভালোবাসা লুকায় থাকে। যেটা দেখবার জন্য ভাইকে বুঝতে হইবো জানতে হইবো।"
সুরেলা থেমে যায় না। ভাইয়ের গুন কির্তনে সুরেলা এককোণাও বাকি রাখে না। রওশন মাঝে মাঝে মজার ছলে বিরোধীতা করে। সুরেলা তর্কে দমিয়ে দেয় তাকে। রূপসা চুপচাপ শুনে যায় সব কথা। সত্যিই লোকটা এমন? নাকি সুর আপার মুখের চাপা। ওই লোককে নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
চেয়ারম্যান বাড়ির গেইটে রূপসাকে নামিয়ে দিয়ে সুরেলাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়। সুরেলা হেঁটে যাবে বললেও রওশন যেতে দেয় না। অগত্যা রূপসা একটু এগিয়ে বসে। রওশন ঠেস দিয়ে বলে,
" আমাকে কি সেলিম মনে হয়? কাঁধে হাত রাখতেই পারো। কাঁচা মাটির উঁচু নিচু রাস্তা পড়ে যাবে।"
ভুল বলে নি। প্রথমবার বাইকে উঠেছে সে। তখন রূপসাকে প্রায় জাপটে ধরলেও কেমন ভয় হচ্ছিল, এই ঘষটে পড়ে না যায় বাইক থেকে। এখন তো রূপসাও নেই। সে যথেষ্ঠ দূরত্ব মেপে বসে কাঁধে একহাত রেখে বলে,
" আস্তে চালাবেন রওশন ভাই। পড়ে হাত পা ভাঙলে বিপদ!"
" আমায় ভরসা করতে পারো সুরেলা।"
বাইক চলতে শুরু করে আপন গতিতে। নওরিজ মাহবুব স্টেয়ারিং হাতে জিপ গাড়ি নিয়ে বের হয় চেয়ারম্যান বাড়ির গেইট পেরিয়ে। বিপরীত রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে পেছন ফিরে চায় একবার।
সুরেলার হঠাৎ অদ্ভুত অনুভূতি হয়। মনে হয় কেউ দেখছে তাকে। তৎক্ষণাৎ বাঁকিয়ে তাকায়। দূর হতে বলিষ্ঠ পিঠখানা নজর কাড়ে। দ্রুত বেগে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে বলিষ্ঠ পিঠের মালিক। সুরেলা চোখ উল্টিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে সামনে ফেরে।
" আপনে কত্ত ভালো। রিজ ভাই পুরোই উল্টা। খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব। বিরক্তিকর। এতো ভাব নিয়া ঘুরে যেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। "
বাইকের হাতলে থাকা রওশনের শক্ত হাত দৃঢ় হয়। ভেতরটা যেন হারানো সুর গেয়ে বেড়ায় ছন্দহীন। বিষাদে ভরপুর সেই সুরেলা তান বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
" পাহাড় পছন্দ নাকি সমুদ্র সৈকত?"
" একটাও দেখি নি তাই কিভাবে বলবো?"
" আমার পাহাড় ভালো লাগে। বড় পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আশেপাশে তাকালে পরিবেশ এতোটা আকর্ষণীয় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলি সবুজের সমারোহে। প্রকৃতির প্রেমে দেওয়ানা হয়ে বিলীন হয়ে যাই চিরতরে।"
" আপনিই নিশ্চয়ই পাহাড় দেখেছেন?"
সুরেলার প্রশ্নে রওশন হাসে। বাইকের আয়নায় ওই এবরো থেবড়ো কাজলের ভিড়ে ধ্বংসময়ী চাহনি বুকে ধারালো তীর ছুঁড়ে। সে হেসে বলে,
" দেশের প্রায় সব পাহাড় দেখা শেষ। বিয়ের পর বউকে নিয়ে সাজেক দেখতে যাবো বিধায় সেখানে যাই নি।"
সুরেলা হেসে ওঠে শব্দ করে।
" সোজাসাপ্টা কইলেই হয় হানিমুনে যাইবেন। ইশ্ কি সুন্দর! দোয়া করি জলদি বউ আসুক তারপর তাকে বগলদাবা কইরা সাজেক ট্যুর দিয়েন। আপনার ক্যামেরা আছে না? ছবি উইঠেন আমরা দেখবো নে।"
রওশন হাসে প্রতিত্তরে। যাকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তাকে পাওয়ার রাস্তাটা যে কাঁটায় কাঁটায় ছেয়ে আছে।সুরেলাদের বাড়ির রাস্তায় সুরেলাকে নামিয়ে দিয়ে শুধায়,
" সিন গ্যারেজে না? দরকার ছিলো খুব!"
" দোকানেই তো থাকার কথা। ফোন দিয়া আগে জাইনা নেন।"
" হুম। তুমি ভেতরে যাও। কোথাও বেড়িও না আর এ বেলা। সেলিম সুবিধার লোক না।"
সুরেলা সায় জানিয়ে বাড়ির ভেতরে যায়। রওশন বাইক নিয়ে সিনান সালেহের গ্যারেজের উদ্দেশ্য ছোটে।
°°°°°°°°°°°°°
অন্দর মহলের ভেতরে ছোট্ট উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসে রেবেকা বানু। চোখ মুখ শুকনো দেখাচ্ছে। নিত্যদিনের সাজসজ্জার তুলনায় আজকের সাজসজ্জায় বেশ বিষন্ন ভাব খুঁজে পাওয়া যায়। কানে, হাতে কিংবা গলায় নেই আভিজাত্যের সেই স্বর্ণালংকার। গালের মেছতাও কৃত্রিম রঙে ঢেকে রাখা হয় নি। আটপৌরে শাড়িটাও কেমন ফিকে রঙের। অথচ ভদ্রমহিলাকে রঙিন সাজে বেশি দেখা যায়। ছামিনা বেগম পিতলের বাটিতে তেল ঢেলে জায়ের মাথায় চুলে তেল মালিশ করে দেয়।
" আপা আপনার মন খারাপ? অসুস্থ লাগছে নাকি? কাল রাত থেকেই দেখছি কেমন গুমরিয়ে আছেন। কোনো সমস্যা?"
ছামিনা বেগমের কথায় রেবেকা বানু নড়েচড়ে বসল। দাঁত কপাটি পিষ্ট করে বলে,
" সমস্যা তো বিশাল ছামিনা।"
আসল ঘটনা বলতে নিয়েও বলে না রেবেকা বানু। কি বলবে? ওই ফকিন্নীর ঝিয়ের জন্য প্রাণপ্রিয় একমাত্র ছেলেটা তাকে অপমান করেছে? লজ্জায় তিনি বলতে পারেন না। রাগে শরীর তাঁর রি রি করে ওঠে। ওই ঝি'রে হাতের সামনে পেলে চুল ধরে থেকনাতো। ছামিনা বেগম ঠোঁট চেপে হাসেন। জায়ের লুকনো কথা কিছুটা হলেও জানা তাঁর। আদরের ছেলে মা'কে কথা শুনিয়েছে তাও ওই সুরেলার জন্য। আপা তো মনে হয় ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই আগুনে ঘি ঢালতে তিনি বলেন,
" আপা আপনি কি জানেন?"
" কি জানবো?"
বিরক্তের সাথে বলেন রেবেকা বানু। ছামিনা কিছু মনে নেন না। কেঁশে গলা পরিষ্কার করে বলেন,
" আমরা যেটা সবচেয়ে অপছন্দ করি ঘুরে ফিরে সেটাই আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। এই দেখুন না? আমার গ্রাম বাংলা পছন্দ না। নাক সিঁটকাতাম সেই আমিই শহরের সাচ্ছন্দ্যতা ফেলে এতো বছর ধরে গ্রামে কাটাচ্ছি।"
" ঝেড়ে কাঁশো ছামিনা!"
" আসলে আপনি ভাববেন না আপনাকে লজ্জায় ফেলছি আমি সাদাসিধা মানুষ সাদাসিধে ভাবেই বলছি!"
" স্পষ্ট কথা বলো! নইলে চোখের সামনে থেকে দূর হও?"
কর্কশ গলায় বলে রেবেকা বানু। ছামিনা বেগম মনে মনে জা'য়ের গুষ্টির ষষ্ঠী বাজিয়ে বলেন,
" আপনি সুরেলা মানে ওই ফকিন্নীর ঝি'কে দু'চোক্ষে সহ্য করতে পারেন না, তাই না? কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে আপনার পালেই না পড়ে মেয়েটা। আমাদের রিজ মেয়েটাকে ভালোবাসে। একেবারে মজনু তাঁর প্রেমে। আমি বুঝি না বাপু মেয়েটাতে কি এমন আছে? যে সবাই তাতেই মরিয়া হয়ে উঠছে!"
রেবেকা বানু কিছু মুহূর্তের জন্য যেন বোধগম্য হারিয়ে ফেলেন। কি বললো ছামিনা? এও বিশ্বাস করতে হবে? কক্ষোনোই না। রওশনের নজর ওই পঁচা ডোবায় বলে কি তাঁর ছেলেরও অধঃপতন হবে? অসম্ভব। তাঁর ছেলের নজর ওই নীলাম্বরে। তিনি উঠে দাঁড়ান। চুল গুলো খোঁপায় বেঁধে আক্রোশে ফেটে পড়েন,
" কি যা তা বলছো ছামিনা? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? আমার রিজ ফকিন্নীদের জন্য সহানুভূতি দেখায় তাঁর মানে এই না ফকিন্নীর বাচ্চাকে ঘরে তুলে আনবে!"
তাঁর উঁচু গলায় ছবি, সাদমান, নওরিন ছুটে আসে। গৃহকর্মীরাও কান পেতে রয়। ছামিনা বেগম গায়ে মাখেন না। চোখে মুখে তাঁর এক অন্যরকম দ্যুতি। তেলের কৌটা আঁটকে বলে,
" আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না আপা? আপনার ছেলে এলেই জিজ্ঞাসা করবেন তাহলে। বড় ভাই তো অনেক আগে থেকেই জানেন। তাকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন?"
"একদম চুপ। আমি আমার ছেলেকে চিনি। ও এমনটা করতেই পারে না। আরে যে ছেলের নোংরাতে এলার্জি সে নোংরায় জড়াবে এও সম্ভব?"
রেবেকা বানুর গলা বেশ চড়ে যায়। নওরিন এগিয়ে আসে মায়ের কাছে। শান্ত হতে বলে শুধায়, কাহিনী কি? রেবেকা বানুর মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। রূষ্ট মেজাজে বলেন,
" কি হবে? কিছুই না। রিজের জন্য রূপসাকে নিতে চেয়েছি। ছামিনার মত নেই প্রস্তাবে। তাই সরাসরি না বলতে পেরে কীর্তন গাইছে। ছামিনা? তোমার মেয়েকে তোমার কোলেই রাখো করবো না টানাটানি। সুন্দর সুশীল মেয়েদের অভাব পড়েছে বুঝি?"
ছামিনা বেগম রেগে যান।
" আপা কি উল্টোপাল্টা বলছেন আপনি? কোথাকার কথা কোথায় টানছেন। আপনার আমার কথায় বিশ্বাস না হলে নিজের ছেলের কাছ থেকেই শুনবেন। আমি তো ভালোর জন্য বললাম আপনাকে। আপনি আমাকেই যা তা বলছেন।"
রেবেকা বানু থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। আসুক রিজ। ও নিজেই সব অস্বীকার করবে। দক্ষিণা দুয়ারে দাঁড়িয়ে রূপসা। কিশোরী মনে লজ্জারা হাতছানি দেয়। রিজ ভাইয়ের সাথে তাঁর বিয়ের কথা? অসম্ভব। চাচি আম্মা কি সব বলছে!
নওরিন মা'কে শান্ত করে। ছামিনা বেগম থমথমে মুখে প্রস্থান নেন সেখান হতে। রেবেকা বানু বারান্দার সিঁড়িতে বসেন। নওরিন গৃহকর্মীকে পানি আনতে বলে। রেবেকা বানু অস্থির গলায় বলেন,
" রিজকে ফোন কর রিন। এখুনি আসতে বল। রাগে আমার মাথার তালুতে জ্বলছে। তোর আব্বা কোথায়?"
" আব্বা কতক্ষণ আগেই না জেলা কার্যালয়ে যাবে বলে বেরিয়ে গেলো? ভুলে গেছো? আর রিজকে ফোন করছি এখনি চলে আসবে। তুমি চাপ নিও না তো।"
নওরিনের কথায় রেবেকা বানু শান্ত হয়। মাথা গরম করলে চলবে না। ছামিনার কথা গুলো ফেলে দেওয়ার মতো না। তবে তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শেষে কী না ওই ফকিন্নীর ঝি?
" রিন? তোর রিফাকে মনে আছে?"
মায়ের কথায় নওরিনের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। সন্দিহান গলায় বলে,
" হ্যাঁ থাকবে না কেন? তোমার বোনের মেয়ে। আমাদের খালাতো বোন। কেন বলোতো?"
রেবেকা বানু প্রত্যুত্তরে অধর বাঁকিয়ে হেসে বলেন,
" মেয়েটা কিন্তু নরম শোভা ভদ্র গোছের। যদিও রূপসার মতো সুন্দর না তবে কম না। রিজের সাথে মানাবে না বল?"
নওরিন অবুঝ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। মায়ের মাথায় কি চলছে?
.
.
.
চলবে..................................................................