বজ্রমেঘ - পর্ব ১৫ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


          অবাক বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকল সেগুফতা! মুখে কথা জুটল না, শব্দ ফুটল না, বিস্ময় কাটল না। ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছে না! কী ঘটছে এটা? কী দেখছে? এ কেমন অলীক দুঃস্বপ্ন? গলার কাছে আঁটকে পড়া ঢোক নিচে নামল না ওর! বিরাট বড়ো হাঁ করার মতো মুখটা বানিয়ে ফেলেছে সেগুফতা! ওই মুখের ভেতরে যেন আস্ত এক পৃথিবীই ঢুকে যাবে! যাকে চাইলেও কাছে ভিড়ানো যায় না, ওভাবে পাশে বসানো যায় না, ওরকম একটা সেবা পাবার কথা ভাবাও অকল্পনীয়, সেই লোক কিনা বসে আছে ওই জঘণ্য মেয়েটার জন্য? ওই ইতর, নিচু, অসভ্য মেয়েটার সামনে? কেন অমন উদারতা দেখাতে হবে তাকে? কী প্রয়োজন এটার! কী অদ্ভুত, কী উদ্ভট, কী হিজিবিজি লাগল ব্যাপারটা। অজান্তেই পা পিছিয়ে সরে যেতে নিলে হঠাৎ কে যেন বাজখাঁই কণ্ঠে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, 

  - আপনি স্যারের ঘরের সামনে কী করছেন! 

আচমকা বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো শিউরে উঠল সেগুফতা! ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে চাইতেই রাজ্যের আতঙ্ক যেন খামচা দিয়ে ধরল! কী সর্বনাশ! ও এখানে কী করছে! রাফান এখানে কখন এসে দাঁড়িয়েছে? ও কী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই লক্ষ করেছে নাকি? কী ভয়াবহ ব্যাপার! মনে মনে এসব নিয়ে ভাবতেই জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁটটাকে আলতো ভেজাল সেগুফতা। কণ্ঠে একটা খরখরে গাম্ভীর্য তুলে তোপ দেখিয়ে বলল, 

  - এটা আমার দেবরের ঘর। আমার দেবর ফারশাদ মির্জার। দেবরের ঘরের সামনে কী করব না-করব তোমাকে জিজ্ঞেস করতে যাব নাকি? তুমি কে? তুমি আমার পেছনে পেছনে কী করছিলে! কী উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে ফটকামি করছ শুনি? 

সেগুফতা ভ্রুঁদুটো কুঁচকে তির্যকসুরে শোনাতেই রাফান তখন আর থামল না। নিজের পুরুষালি ভ্রুঁদুটো আরো দ্বিগুণ খিঁচে চোখমুখ কঠোর করে বলল,  

  - উনার নামের পাশে মির্জা লাগাবেন না সেগুফতা ভাবী। এই নামের কোনো অস্তিত্বই নেই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আপনাদের মতো মির্জা ট্যাগ উনার লাগাতে হয় না। ওই ট্যাগ ছাড়াই মানুষজন উনাকে চিনে, এক নামে পুরো পরিচয়টাই জানে। বংশের দাপট উনার অন্তত লাগে না। 

  - তুমি সিলি ম্যাটারের জন্য তর্ক করছ কেন! এরকম বাজে ব্যবহার কী জন্য? আমি কী এখন তোমার থেকে পারমিশন নিব রাফান? তুমি এরকম ফালতু অসভ্যমি কেন করছ? তর্ক বাদ দিয়ে বিদেয় হও। আমি এমন কিছু করিনি যেখানে এখানে আসাটা কোনো সমস্যা! যাও। 

  - দেবরের ঘরের সামনে বাঙালি বধূরা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে? চোরের মতো ছোঁক ছোঁক করে? আপনি আমাকে দুই বোঝালেন, আর আমিও আপনার কথামতো দুই দুই বুঝে গেলাম? দুইয়ে দুইয়ে যে চার হয়, সেটা আমি বুঝব না? 

কী পরিমাণ খারাপের খারাপ! এই রাগী, অভদ্র, শয়তান ছেলেটা কীভাবে কথা বলছে? কথা শুনে গা জ্বলে উঠছে সেগুফতা! কত বড় সাহস! শয়তানটা মুখে মুখে আবার তর্ক জড়াচ্ছে! ডান গালে চটাশ করে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে সেগুফতার। কিন্তু পরিস্থিতির কথা ভেবে নিজেকে শান্তভাবে দমাল ও। ভারি একটা শ্বাস ফেলে দাম্ভিক কণ্ঠে বলে উঠল , 

  - তুমি আমাকে কোন সাহসে হুমকি দেবার চেষ্টা করছ? কার সামনে দাঁড়িয়ে জবান চালাচ্ছ? আমার সাথে ফালতু স্পর্ধা দেখাবে না বলছি! আমি কেন এসেছি সেটার কৈফিয়ত তোমাকে দেব না। আমার সামনে দুই টাকার পশ অ্যাটিচিউট দেখাবে না। তোমার মতো অশ্লীল চিন্তা করা লোকদের জন্য বলছি, আমি ওই মেয়েটার অবস্থা জানতে এসেছি। মেয়েটা কী করছে, কেমন আছে এটা দেখার জন্যই আসা। ভেতরে এজন্য ঢুকিনি, কারণ সেগুফতা কারো প্রাইভেসি ম্যাটারে ইন্টারাপ করে না। এখন নিজে একজন পুরুষ মানুষ হয়ে এখানে কেন এসেছ? এই ঘরে তো তোমার স্যার ঘুমাননি। কালরাতের ওই আহত মেয়েটা ঘুমিয়েছে। এখন নিজে কীসের জন্য এসেছ? ওই সুন্দরী, ঘুমন্ত মেয়েটার লোভে লোভে এসেছ না? ফাজিল ভণ্ড কোথাকার! নিজের নেই শিক্ষা, অন্যকে দেয় দীক্ষা! 

দুহাত বজ্রমুষ্টি করে তাকিয়ে থাকে রাফান। চোখে ধিক ধিক করে জ্বলছে আগুন। ইচ্ছে করছে এই বজ্জাত মহিলাকে কঠিন ক'দফা শিক্ষা দিতে, কিন্তু আশু পরিস্থিতির কথা ভেবে কিছুই বলল না সে। একটা মুখ ভাঙা জবাব পর্যন্ত দিল না। যদি স্যার একবার এই অবস্থাটা দেখতেন, এই মহিলার অহংকার মাটির মধ্যে পিষে দিতেন তিনি। ভাগ্যিস, রাফান এই মুহুর্তে বচসা করতে আসেনি। রাগের হলকাটা নাক ফুলিয়ে ছাড়তেই আধ ভেজানো দরজায় ঠক্ ঠক্ করাঘাত করল সে। গলায় বিনীত ভঙ্গিটা রেখে সরলকণ্ঠে বলে উঠে, 

  - স্যার, রাফান বলছিলাম। ক্যান আই কাম ইনসাইড?

ভেতর থেকে সেই হিমধরা শীতল, ভরাট, শাণিত গলাটা ছুটে এল। ছোট্ট করে বলল,  

  - কাম ফরোয়ার্ড। 

ওই দুই শব্দের অনুমতিতে স্থির হল রাফান। চোখদুটো তখনো সেগুফতার দিকে বিদ্ধ। ডানহাতে দরজাটা ঠেলে পা বাড়িয়ে ভেতর ঢুকল রাফান। কিন্তু শেষ ঝলক পর্যন্ত সেগুফতার দিকেই ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে রইল সে। এরপর যখন ভেতরে প্রবেশ করে, ঘরের নির্দিষ্ট দিকে চোখ পড়ে, তখনই আচমকা কপাল কুঁচকে উঠল! তৎক্ষণাৎ মাথাটা ডানে বাঁয়ে দুবার ঝাড়া দিয়ে ফের চোখ মেলে তাকাল। চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার। এরপর যা বুঝতে পারল, তাতে পিলে চমকে উঠার জোগাড়! সাদা শার্ট পড়া ওই পেশিধারী শান্ত মানুষটা মাথা নিচু ঝুঁকিয়ে ক্ষত মুছে দিচ্ছে। মেয়েটার কনুইয়ে লাগা আঘাতে তুলো দিয়ে ধীরে ধীরে স্যাভনল লিকুইড লাগাচ্ছে। স্যাভলনের ঝাঁঝালো জ্বলুনিতে মেয়েটার দুচোখ বন্ধ, মুখটা বাঁদিকে ঘুরানো, বাঁদিকের খোলা জানালাটা দিয়ে হুঁ হুঁ করে সতেজ বাতাস উদ্যম উল্লাসে ঢুকছে। সেই হাওয়াতে মেয়েটার এলোমেলো বেণীর চুল, স্যারের ঈষৎ নরম চুল দুরুদুরু উড়ছে। দৃশ্যটা এমন জান্তব, এমন সুন্দর, এমন অকল্পনীয় ছিল যে রাফান দুই মিনিট কথাই বলতে পারল না। পরক্ষণে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিটা ফুটে উঠলে দ্রুত সেটা লোপাট করল রাফান। হাসিটা দেখে ফেলল বিপদ! এখন এই ঘরে ওই ঈগলচক্ষুর সামনে হাসা যাবে না। হাসলেই গ্লক-১৭ পিস্তলটার মতো চোখদুটো তাক করে ফেলবে। 

  - এখানে কেন এসেছ রাফান? দরকারটা বয়ান করো। 

কথার ধরণ শুনে শাওলিন চোখ খুলে চাইল। এভাবে কেউ কথা বলে? কেমন যেন খড়খড়ে ভঙ্গির না? আজ্ঞাসূচকের মতো লাগল না ওটা, বরং ফাঁসির আসামীর কাছে যেভাবে কর্তৃত্ব বজায় রেখে বলা হয় ' বয়ান করো! ', ঠিক সেরকম কিছু মনে হল ওর। গলার স্বরটা এমনিই কিছুটা বজ্র গম্ভীর লাগে। কানে ভারি গমগম প্রতিধ্বনির মতো অনুভূত হয়। গতকাল রাতে যখন স্ট্র দিয়ে পানি পান করাল, ওই মুহুর্তের দৃশ্যটা আবারও মনে মনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। ওই মোমজ্বলা আঁধারে, সাদা পর্দার ওপাশে, কেমন বিরাট দেখাচ্ছিল ওই পৌরুষ দেহকায়! কেমন সম্ভ্রম ব্যক্তিত্বের আভাস ছিল ওটা! এমন সময় শাওলিন শুনতে পেল রাফানের শক্ত গলা, 

  - কালরাতের হামলাটা নিয়ে আর্মির কিছু তথ্য এসেছে স্যার। ওরা যা জানিয়েছে, তাতে প্রচণ্ড আশ্চর্য হতে হয়েছে। আপনি যদি ফ্রি থাকেন, আমি আপনাকে তথ্যগুলো পাঠিয়ে দিব। ওদের নন অফিশিয়াল কিছু আপডেটের পাশাপাশি একটু আগের ভাইটাল তথ্যটাও এসেছে। আমি কী আপনার অফিস রুমে পৌঁছে দেব স্যার? 

মাথাটা অল্প নোয়ানো থেকে এবার একটু তাকাল শোয়েব। বাঁয়ে মুখ ফিরিয়ে রাফানের মুখটায় তাকাল। এক মুহুর্তের জন্য রাফান এই চশমাধারী চোখদুটোর কাছে অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণে সেই বিশেষ কথাটা স্মরণ করে নিজেকে শক্ত বানাল ও। শোয়েব নিজের নীলবর্ণ চোখদুটো পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন সে মনোযোগের সহিত সাদা গজ কাপড়ে নতুন ব্যাণ্ডেজটা বাঁধতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মনে মনে কিছু ভাবনা কষল শোয়েব ফারশাদ। দুহাতের দক্ষ চালনায় কনুইয়ের ব্যাণ্ডেজটা পুরোপুরি বেঁধে দিতেই বলল, 

  - রাফান শোনো। 

বলেই ডানহাতে সার্জিকাল কাঁচিটা তুলে নিল। ক্ষণিকের ওই অল্প বাক্যে রাফান ও শাওলিন দুজনই সপ্রতিভ। দুজনই শোয়েবের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা নিজেও আড়চোখে লক্ষ করে প্রসঙ্গটা ব্যক্ত করল শোয়েব, 

  - আগামী সাতদিন কড়া পাহারার একটা ব্যবস্থা করো। এমন ব্যবস্থা করো, যেন নিরাপত্তার ফাঁদ গলে একটা পাখিও ঢুকতে না পারে। গতকাল এদের উপর সাধারণ কিছু হয়নি। একটা অস্বাভাবিক মুভমেন্ট প্রসিডিউর হয়েছে। এটা আগে থেকেই কোথাও না কোথাও রেডি করা ছিল। আর এখানেই ছিল, এই খাগড়াছড়িতে। এখানে বন জঙ্গলের পরিমাণ এতো বেশি, রাতের আঁধারে কেউ পালিয়ে গেলে আর্মিরা ধরতে পারবে না। কেন পারবে না জানো। তাই যেভাবে যেভাবে বললাম, সেভাবে করো। কোথাও এপিডেমিক কণ্ডিশন দেখলে সবার আগে কার্যালয়ে যোগাযোগ করবে, এরপর বাকি জায়গায়। পরিষ্কার? 

সবগুলো কথা অখণ্ড মনোযোগে শুনল শাওলিন। শুনতে পেল রাফান সিদ্দিকীও। কিন্তু কথার মাঝে এমন একটা তির্যক ইঙ্গিত ছিল যেটা শুধু বুঝতে পেরেছে রাফান। আর্মিরাও ধরতে পারবে না! এই একটা কথার কাছে সম্পূর্ণ উত্তর বুঝে মাথাটা হ্যাঁ সূচকে দোলাল রাফান। পকেট থেকে একটা খামের মতো জিনিস বের করে সেটা সে সামনে বাড়িয়ে ধরল। শাওলিন চকিতে মুখটা ডানে ফিরালে সেই বাড়ানো হাতটাকে দেখতে পেল। একটা খাম সদৃশ বস্তু দেখে চোখ উপরে তুলল ও, 

  - এটা কী? 

  - এটা আপনার জিনিস মিস। কালরাতে এই কটা জিনিসই আপনার কুটির থেকে নিয়ে আসা গিয়েছে। বাকি সব জিনিস এখন কাস্টেডিতে আছে। ওগুলো এখান থেকে পরে নিতে পারবেন। কিছু প্রমাণ দেখিয়ে পারমিট ইস্যু লাগবে। স্যারই ওসব এনে দিবেন। চিন্তা নেই। কিন্তু এখন এটা বুঝে নিন।  

শাওলিন নিজের বাঁহাত দিয়ে খামটা বুঝে নিল। কাগজে খসখস খামটা ধরতেই বুঝল, এটার ভেতরে মোবাইল ফোন! ওর ফোনটা বোধহয় উদ্ধার করা গেছে! শাওলিন খামটার মুখ বিছানায় উপুড় করে ধরতেই টুপ করে নিজের ফোনটা বিছানায় পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একরত্মি স্বস্তির বায়ু চোখ বন্ধ করে ছাড়ল শাওলিন। অবশেষে বাঁচা গেছে! এই মুহুর্তে ফোন হারানো মানে বিপদ! বাসায় ফিরে গেলে একশো একটা অজুহাত, কৈফিয়ত, বিপদের পয়গাম হতো। এদিকে শোয়েব কাজ সম্পণ্ণ করে চেয়ার থেকে নিজের কালো স্যূটটা তুলে নিয়েছে। ওদিকে রাফান ঘরের বাইরে প্রস্থান। নিজের বাঁহাতে ভারি স্যূটটা ঝুলিয়ে নিতেই হিম-স্থির কণ্ঠে ডেকে উঠল শোয়েব,  

  - শাওলিন, 

এমন করে ডাকল, যাতে চকিতে চোখ তুলল শাওলিন। দুচোখে কৌতুহল মিশ্রিত চাহনি ফুটিয়ে বলল, 

  - জ্বী? 

  - তুমি কী নিচে ডাইনিং এরিয়ায় ব্রেকফাস্ট করতে পারবে? এখন? 

প্রশ্নটা শুনে নিজের পায়ের দিকে তাকাল ও। একপলক পাদুটো মৃদু নাড়াচাড়া করে দেখল। পরক্ষণে চোখ ফিরিয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতিতে বলল, 

  - আমার কোনো সমস্যা হবে না অফিসার। পায়ের ব্যথা কিছুটা কমেছে। হাঁটা যাবে আশাকরি। 

  - বেশ, নিচে চলো। 

কথামতো পা দুটো ফ্লোরে নামিয়ে খুব সাবধানে দাঁড়াল ও। পায়ের গোড়ালি দিকটায় বেশি ভর রেখে সামনের দিকটা হালকা করে রাখল। পায়ের তলায় এখনো মোটা সাদা ব্যাণ্ডেজ। এই ব্যাণ্ডেজটা এখনো খোলা হয়নি। এটা নাশতার পর খোলা হবে। সিঁড়ি দিয়ে খুব আস্তে আস্তে নামলেও ওর পেছনে ততটাই আস্তে ধীরে নামছিল শোয়েব। তার চোখ সমান সতর্ক, বাঁহাতে ঝুলছে কালো স্যূট, ডানহাতে মোবাইল চেপে কথা বলছে সে। কিন্তু নজরটা ঘুরাফেরা করছে সামনে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পাদুটোর দিকে। না, মেয়েটা অন্যান্য মেয়েদের মতো করছে না। তার অভিজ্ঞ চোখ এই জীবনে যত মেয়ে দেখেছে, তন্মধ্যে এই হিসাব স্পষ্ট, যারা মার্জিত, সভ্য, নিজেকে সব পরিস্থিতিতে সমানভাবে খাপ খাওয়ায়, তারা কখনো ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সিমপ্যাথি আশা করে না। তারা অধরা ভাবী এবং এই মেয়েটার মতোই চমৎকার। 

ডাইনিং টেবিলের সামনে পৌঁছুতেই সবগুলো চেয়ার প্রায় ভরাট দেখল। ডিম্বাকৃতি লম্বা টেবিল, টেবিলের দুপাশে দশটি চেয়ার, টেবিলের এ-মাথা ও-মাথা দুটি চেয়ার। শাওলিনের ছয় বন্ধু এবং শোয়েবের চার ভাবী মিলে বসে পড়াতে এখন অবশিষ্ট রয়েছে এ মাথার সিংহাসন সদৃশ্য চেয়ার, এবং ওটার বাঁদিকের চেয়ারটাই। সবাই ততক্ষণে খাওয়া শুরু করেছে বলে কাউকেই জায়গা বদল করতে দিল না সে। শাওলিন যখন চেয়ারে বসে নাশতায় হাত দিল, তখনই টের পেল এই খাবার ওর জন্য বিস্বাদ! এক বাটি প্লেইন স্যূপ, দুটো সিদ্ধ ডিম, যা মাঝ বরাবর কাটা, এক গ্লাস দুধ সামনে রাখা। খাবারটা দেখেই নাড়িভুঁড়ি উলটে আসতে চাইল ওর! এই ডিম আর দুধ ওকে উনিশ বছরেও খাওয়াতে পারেননি মণি। এই দুটো বস্তু দেখলেই ওর বমি বমি পায়, জিভটা বমির জন্য উলটে আসে। অসহ্য লাগে! শাওলিনের চোখমুখ বিতৃষ্ণায় থমথম করলে হঠাৎ চোখ পড়ল আরেকদিকে। ঠিক মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে নাযীফ। মাথায় টুপির মতো সাদা ব্যাণ্ডেজ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। চোখে কাতর কাতর চাহনি, পারলে এই খাবার দেখে এখুনি কেঁদে ফেলে। সুস্বাদু বাঙালি খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে ভেবেছিল, তাকেও বোধহয় কষা মাংস দিয়ে পরোটা খেতে দিবে। কিন্তু শাওলিন আর ওকে এ কী গু জাতীয় খাবার দিয়েছে! হ্যাঁ এগুলোই গু-ই। মুরগীর গু, গরুর গু এবং এক গামলা সবজি ধোয়া পানি। এগুলো কিনা আবার আহত রোগীর জন্য নাশতা! আরে, এসব খাবার খেলে আহত রোগীটা নিহত হয়ে যাবে! এর চেয়ে হসপিটালে থাকাটাই ঠিক ছিল না? মামা-চাচাদের পকেটে দু-চারটা নোট ঢুকিয়ে দিলে হরেক পদের সুস্বাদু খাদ্য এনে দিতো। এরপর কেবিনের বাইরে যথাযথ পাহারাও দিতো, যেন নার্স বা ডিউটিরত ইন্টার্ণ না আসে। ধ্যাত! এমন সময় চোখে চোখে শাওলিনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল নাযীফ, অর্থটা ঠিক এমন, 

  - কীরে, খেতে পারবি এগুলো? বমি চলে আসছে না? কী করি বল তো! এরকম অত্যাচার তো নেয়া যায় না। আয়! অজ্ঞান হওয়ার নাটকটা ধরি। 

শাওলিন দুটো ভ্রুঁই যথাসম্ভব কুঞ্চন করল। ওসব নাটুকে ভঙচঙে একদম নেই ও। আড়চোখে ওর ডানদিকে বসা লোকটার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাল, 

  - তুমি উনাকে সরাসরি বলো এসব খাবার তুমি খাবে না। এগুলো তোমার পছন্দ না। তুমি একটা পরোটা দিয়ে ঝাল কষা মাংস খেতে চাও। 

  - তুই খাবি? তুই খেলে এক্ষুণি ব্যাটাকে বলব! 

  - আমি কখন বললাম খাব? 

  - দাঁড়া, এক্ষুণি বলছি। আমি বুঝতে পেরেছি তুই দুটা পরোটা খাবি, আর সাথে এক বাটি গরম কষা মাংস। ঘ্রাণটা সুন্দর আসছে রে। আমার তো ঘ্রাণ শুঁকেই এপিটাইট বেড়ে গেছে। 

  - তুমি আমার নাম --- 

শাওলিন আর কথা শেষ করতে পারল না। মাথায় মিশরের মমির মতো ব্যাণ্ডেজ নিয়ে ছোটখাটো একটা হুঙ্কার ছাড়ল নাযীফ, 

  - স্যার! 

স্যূপের চামচে ঠোঁট রাখতে গিয়ে থামল শোয়েব। চোখটা এমনভাবে তাক করল, যা তার চশমার উপর দিয়ে ফুটে উঠেছে। নাযীফের অমন 'স্যার' বলে উঠাতে বাকিরাও তখন হতভম্ব। ও হঠাৎ হঙ্কার দিল কেন? এই খাওয়ার মধ্য কী হল? শোয়েব স্যূপের চামচটা নিচে নামিয়ে মুখ সোজা করে বলল, 

  - জ্বী, নাযীফ। 

  - স্যার, জানা এই খাবারটা খাবে না। ওর বমি বমি পাচ্ছে। এসব দেখলে ও অসুস্থ ফিল করে। ওর জন্য এনাদার অপশন দেয়া যায়? এই যেমন, বাকিদের মতো মাংস-পরোটা?  

হতবাক শাওলিন বিস্ফোরিত চোখে চাইল! কী খারাপের খারাপ! এভাবে কেন ফাঁসানো হচ্ছে? ও কখন বলল ও এসব দেখে অসুস্থ ফিল করছে? কী বাজে মিথ্যাটা বলে দিল! অন্যদিকে শ্রেষ্ঠার চোখ অনুসন্ধিৎসু চোখে দুই বন্ধুর দিকে ঘুরছে। একবার বড় হারামিটার দিকে, আরেকবার ছোট পাথরটার দিকে। দুটোই বসেছে মুখোমুখি, দুটোই পেয়েছে মশলাহীন নাশতা। তার মানে এই ভণ্ডামির গুলটা পাকিয়েছে নাযীফ! নিজে খেতে চায় না বলে জানার ঘাড়ে চাপাচ্ছে! কী আশ্চর্য! শ্রেষ্ঠা টেবিলের নিচ দিয়ে সোহানার পায়ে লাত্থি দিল। সোহানা তখন মাংসের ঝোলে পরোটা চুবিয়ে সবে মুখে ঢুকাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পায়ে বারিটা খেয়ে হাতটা ওর নাক-মুখ মাখিয়ে দিল। পরোটার টুকরোটা ধপ করে পড়ল প্লেটে। ওদিকে শ্রেষ্ঠা নাযীফের দিকে চোখ ফেলে ফিসফিস করে বলছে, 

  - ওর খাই খাইপণা বন্ধ করতে বল। ইশারা দে। এই চোরটা মাংস দেখে হুঁশ রাখতে পারছে না। 

এদিকে সোহানা বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, 

  - তুই আগে আমার দিকে তাকা! 

  - তোর দিকে কী তাকাব? তুই ওইদিকে তাকা। ইশারা কর। তোরটা আগে দেখবে। 

  - তুই আমার দিকে তাকা শ্রেষ্ঠা! 

এবারের ফিসফিসানিটা দৃঢ় শুনতে পেল শ্রেষ্ঠা। তৎক্ষণাৎ চোখটা ডানদিকে ফেরাতে ফেরাতে বলছিল, 

  - আচ্ছা কী তাকা--- 

আর বলতে পারল না শ্রেষ্ঠা! ঠোঁট হাঁ করে জুলজুল দৃষ্টিতে সোহানার চেহারাটা দেখল ও। এরপরই ফিক করে হেসে দিতেই বহুকষ্টে হাসি আঁটকে ফিসফিসিয়ে বলল, 

  - ওমা! তোর মুখ দেখি হনুমানের লাল প--- মানে পশ্চাৎদেশ হয়ে আছে। আচ্ছা স্যরি, স্যরি। তুই প্লিজ ন্যাপকিনটা দিয়ে মুছে ফ্যাল। আর ওই বান্দরটাকে বল ফকিরিপণা না করতে। নাহলে আজ বিকেলের চিকেনে কাবাবে ওকেই আমি চিকেনের কিমা বানাব। সাবধান কর। 

  - করছি। কিন্তু . . এক মিনিট, কীভাবে করব? ও তো --- 

বলতে বলতেই শোয়েব তখন শাওলিনের মুখে তাকাল। ওই মুখ দেখে কী বুঝল কে জানে পুনরায় নাযীফের দিকে চোখ ফেলে বলল, 

  - তুমি শিয়োর তোমার বন্ধু সিক ফিল করছে? অনলি ফর দিস বয়েল্ড এগ অ্যাণ্ড সাম ভেজিটেবল স্টক প্লেইন স্যূপ? 

  - ইয়েস স্যার। আই অ্যাম ওয়ান থাউজেণ্ড পার্শেন্ট শিয়োর। প্লিজ ডোন্ট টর্চার উইদ হার ফর দিস প্লেইন ফুড। 

  - সাউন্ডস ইক্যুয়েল। আচ্ছা, এক কাজ করো। তুমি ওখান থেকে প্লেটে তিনটা পরোটা নাও, যতখানি তরকারি দরকার তুলে নাও। 

এরকম আত্মতুষ্টির কথা শুনে মনটা বাকবাকুম করে উঠল নাযীফের। এই তো সেরেছে কাজ! জানাকে এভাবে মধ্য অবস্থায় রেখে খাপে খাপ কাজ হয়েছে। পুরুষদের সবসময়ই মেয়েদের উপর একটুখানি কোমল ইন্দ্রিয় কাজ করে। তারা কখনো ডেম্পারেট ভঙ্গিটা ওদের উপর না। নাহলে আর্মিরা কেন পেছনে ছেলেদের মারে, আর মেয়েদের বেলায় শুধু মুখ দিয়ে বলে? তার উপর পার্বত্য অঞ্চলের এই ফরেস্টার অতিমাত্রায় ভদ্রলোক। খুশিতে ঠোঁট-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে প্লেটে মনের ইচ্ছেমতো সব তুলে নিল। এরপর আরেকটা প্লেটে শাওলিনের জন্য একই খাদ্য তুলে নিতে গেলে এবার পারমাণবিক মিসাইলটা ছুঁড়ল শোয়েব, 

  - তুমি আরেকটা প্লেট নষ্ট করছ কেন? ওটা কার জন্য? প্লেট তো তোমাকে একটা সাজাতে বলেছি। দুটা না। ওটা সাজানো হয়ে গেছে, যে সিক ফিল করছে তাকে দেয়া হয়েছে। এবার তুমি ওরটা সহ দুটো প্লেটের খাবার শেষ করো। খাবার যেন একটুও ওয়েস্ট না হয়। খাও। 

মুখে অমাবস্যার আঁধার নিয়ে চুপসে গেল নাযীফ। অসহায়, বুভুক্ষু নজরে শাওলিনের দিকে চাইল। শাওলিনের সামনে তখন দ্বিগুণ বাঁশ। নাযীফ নিজের প্লেট ভেবে যেভাবে খাদকের মতো খাবার নিয়েছে, মাংসের টুকরোয় বাটি উঁচু উঁচু, এগুলো ওর মতো স্বল্পভুক্তের গলা দিয়ে নামবে? এই নরক যন্ত্রণাটা নাযীফ ডেকে আনল না? কী দরকার ছিল ওর নাম নিয়ে কাজটা করা? নাযীফ মিশরের আসল মমির মতোই শুকনো মুখে বলল, 

  - আপনি ওকে দেখেছেন? ও এতগুলো খাবার খেতে পারবে? 

স্যূপের চামচে নিঃশব্দে একটা চুমুক দিয়ে শোয়েব বলল, 

  - নিশ্চয়ই। তুমি যেহেতু শিয়োর তোমার বন্ধু প্লেইন ফুডের জন্য সাফার করছে, তাই এটাও তোমার ধারণা থাকার কথা, সে কতটুকু খাবে। তাই তোমাকে বলেছি একটা প্লেট সাজাও, আর সেটা ওকে পাস করো। 

  - স্যার, ও তো ছোট মানুষ। ছোটখাট একটা পিঁপড়াও ওর চেয়ে বেশি খায়। ও তো অতোগুলো খাবার খেতে পারবে না। নষ্ট করে ওয়েস্ট বিনটাই ভরিয়ে ফেলবে। 

মেজাজটা আর সামলাতে না পেরে কঠিন গলায় ধমকে উঠল শ্রেষ্ঠা, 

  - অ্যাই ছাগল, তুই ওকে পিঁপড়ার সঙ্গে তুলনা দিয়ে কী বোঝাচ্ছিস? চড় দিয়ে এখন খাবারের স্বাদ ভুলিয়ে দেব। তুই মাংস খেতে চাচ্ছিস এটা মুখ দিয়ে বললেই হয়। অতো জিলাপির প্যাঁচে প্যাঁচাচ্ছিস কেন? 

এবার চোখটা স্বাভাবিক করে শোয়েবের দিকে চাইল শ্রেষ্ঠা। কণ্ঠের উত্তাপটা নীচের দিকে ঠেলে ধাতস্থ গলায় বলল, 

  - স্যার, অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার জন্য আমি স্যরি বলে নিচ্ছি। গরুর যেমন ঘাস দেখলে হুঁশ থাকে না, ওরও মাংস দেখলে হুঁশ থাকে না। আপনি যে হেলথ কনসাস চিন্তা থেকে খাবারগুলো দিয়েছেন, এটা ওর মতো ষাঁড়ের বুদ্ধিতে ধরেনি। আপনি প্লিজ কন্টিনিউ করুন স্যার। অ্যাই জানা, তুইও খা প্লিজ। ওখানে দুই পিস আপেল দিয়ে শুরু কর। খেতে পারলে ভারি কিছু ওখান থেকে নিয়ে নিস। 

শ্রেষ্ঠার উপস্থিত ধমকে পরিস্থিতি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে গেল। এদিকে শ্রেষ্ঠা আর শাওলিন বাদে প্রায় প্রত্যেকেই ফিসফিস হাসছে। মিথিলা ঠোঁটের সামনে হাত রেখে হাসি আড়াল করছে, তাহিয়া মাথাটা প্লেটের দিকে ঝুঁকিয়ে রেখেছে, অধরা বহু কষ্টে ঘর কাঁপিয়ে হাসা থেকে বিরত থাকছে। অন্যদিকে সেগুফতার চোখ-মুখ গম্ভীর। মুখে যেন কালি পড়েছে। অধরা হাসির দমকটা আঁটকানোর জন্যই সবে ডানপাশে তাকিয়েছিল, কিন্তু সেগুফতার ওই গম্ভীর মুখ দেখে আর নিজেকে আঁটকাতে পারল না। হো হো করে হেসে উঠতেই এদিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সেগুফতা। মুখে পরোটা নিয়ে চিবোতে চিবোতে হঠাৎ থেমে ভাবল, আচ্ছা মুখে কী কিছু লেগেছে? এই অধরা চোখ খিঁচিয়ে হাসছে কেন? অন্যদিকে থেমে নেই বাকিরা! হাসির জীবানু ছড়িয়ে যেতেই পুরো ডাইনিং ঘর হাসিতে ফেটে পড়ল। এবার আর বাঁধ মানল না কেউ। সেই হাস্য কলরবে চমকে উঠলেন বৃদ্ধা ফাতিমা। এ কী! চোখে বয়সের ভারে ন্যূব্জ চশমা, হাতে সুন্দর একটা কাঠের ডায়েরি। তিনি দুই ভ্রুঁর মাঝে চমকের ভাঁজ ফেলে বললেন, নিচে হাসির রোল নাকি? কারা হাসছে? এই মরা বাড়িতে উল্লাসপূর্ণ আবহাওয়া কী করে এল? কীভাবে কী? 

—————

দুপুরটা ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যায়। চারিদিকে ভয়াল কালো মেঘ। মেঘের গোগ্রাসে ঢেকে গেছে সমস্ত আলোকিত বনাঞ্চল। ঢেকে গেছে সমস্ত নির্মলতা। পার্বত্য এলাকায় যখন-তখন ঝড়বৃষ্টি নামে, যখন-তখনই আছড়ে পড়ে তুফান। এখানে আবহাওয়ার আন্দাজটা খাটে না। সারাটা বাংলো ভয়ানক নির্জীব। কোথাও কেউ নেই। ওরা পাঁচজন দূরের একটা টিলার কাছে গিয়েছে। হেঁটে গেলে চল্লিশ মিনিট। নাযীফ গিয়েছে হসপিটালে। ওর মাথার ব্যাণ্ডেজটা পালটানো বাকি। শাওলিন দুপুরের ঔষুধগুলো খেয়ে চুপচাপ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর দুটো নির্মল চোখে বজ্র সরব প্রকৃতি। কেমন গুমোট যন্ত্রণায় মোচড়ে উঠে বুকটা। একটা বোবা অস্ফুট কান্নায় হু হু করে মন। যেন এখুনি আকাশের চোখ ফেটে অশ্রু ঝরবে। আর পৃথিবীর মাটিতে ছড়িয়ে দিবে আলোড়ন। পড়ণের হালকা গোলাপি জামাটা বাতাসে খুব দুলছে। ঢোলা হবার ফলে দস্যুর মতো ছোবল দিচ্ছে শীত। ঠাণ্ডা শীতালু পরশে কেঁপে উঠে শাওলিন, হাতদুটো চেষ্টা করে বুকের কাছটায় আড়াআড়ি জড়িয়ে নিতে। কিন্তু ডানহাতের কনুইয়ে বীভৎস ব্যথাটা জন্য পারে না। এমন সময় ঘরের পেছন থেকে ডেকে উঠল অধরা, 

  - তুমি ঘুমোওনি? 

মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে তাকায় শাওলিন। ডান কাঁধ বরাবর পিছু তাকিয়ে মাথাটা ডানে-বামে নাড়ায় ও। সমস্ত মুখ চুলের দুরন্ত ঝাপটায় লুটোপুটি খাচ্ছে, বাগানের সতেজ গোলাপ ফুলটার মতো রঙ ফিরে পেয়েছে ওর পাতলা ঠোঁট। গোলাপি নরম মিঠে রঙ, ঠোঁটের চর্তুদিকে এক অদ্ভুত কোমলত্ব। অধরা মিষ্টি হেসে মেয়েটার কাছে ভিড়তে ভিড়তে বলল, 

  - তোমার তো গোসল করা হয়নি। বেলা যে প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে। তুমি কী গোসল করতে চাও? 

সামনে দাঁড়ানো অল্পবয়সী মানুষটাকে দেখল শাওলিন। সুডৌল হাসিমুখ মুখ, চোখে হাসির উচ্ছ্বাস, গায়ে সোনালি পাড়যুক্ত কালো রঙের শাড়ি, ছোট হাতায় ম্যাচিং কালো ব্লাউজ। চুলগুলো সদ্য গোসলের দরুন ভিজে আছে। টুপ টুপ করে পানি ঝরছে চুল গড়িয়ে। শাওলিন নিজেও এক টুকরো হাসি ফিরিয়ে বলল, 

  - আমার জন্য তো গোসল করলে ভালো হয়। গতকাল দুপুরের পর থেকে এই সুযোগটা পাইনি। আমার জামাকাপড়গুলো ছোট ট্রাভেল ব্যাগটায় ছিল। ওগুলো ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। 

অধরা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল। শোয়েব এতোকিছুর খেয়াল রেখেছে, টাইম টু টাইম ঔষুধের বিষয়টাও দেখে দিয়েছে, সে কেন এতো বড়ো দায়িত্বটা ভুলে গেল? নাকি ওর পুরুষোচিত মস্তিষ্কে এটা আসেইনি যে, একটা মেয়ে গোসল ছাড়া থাকতে পারবে না। তার জন্য পোশাকটা অপরিহার্য। অধরা ভাবতে ভাবতে চকিতে চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকাল। শাওলিনের দিকে আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলিয়ে ভাবুক গলায় বলল, 

  - আচ্ছা, তোমার জন্য একটা ভালো বুদ্ধি আছে। বুদ্ধিটা খুব সুন্দর। তুমি চাইলে এক্ষুণি উপায়টা বাতলে দিতে পারি। তবে একটা শর্ত হচ্ছে, তোমার জামাকাপড়ের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার বুদ্ধিটায় 'না' করবে না। কোনো সংকোচ করবে না।

  - কী বুদ্ধি অধরা? একা একা কী উপায় ঠাওরাচ্ছ তুমি? 

হঠাৎ দুজনই সেই প্রশ্নকণ্ঠে চোখ পিছু ফেলল। শাওলিন তাকাল অধরার ঠিক পেছনে, আর অধরা নিজের মাথাটা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। দেখতে পেল, সেজো নাতবউ তাহিয়া হারুন ভ্রুঁ নাচাতে নাচাতে অধরাকে প্রশ্ন শুধাচ্ছে। অধরা একটা ফিচেল হাসিতে সম্পূর্ণ পেছনে ঘুরতেই তাহিয়াকে সব বলল। তাহিয়া ব্যাপারটায় তৎক্ষণাৎ সম্মতি দিলে আর দেরি করল না অধরা। ঝটপট সব দক্ষহাতে, ত্রস্তভাবে বন্দোবস্ত করল সে। বিস্ময় বিমূঢ় শাওলিনের হাতে একস্তুপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, 

  - যাও, এবার গোসলটা সেরে আসো। বাকিটা আমি দেখে দিচ্ছি কেমন? এরপর ছাদে গিয়ে বসলে তোমার চুল দশ মিনিটের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। যাও যাও, দেরি করো না। একটু পর বেলা হয়ে যাবে। 

নিজের হাতের দিকে থমকানো চোখে তাকাল শাওলিন। ঘোর বিস্ময়ে কপাল কোঁচকানো। বাইরে গুড়ুম গুড়ুম করে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামতে বোধহয় দেরি নেই। 

—————

লোহার প্রকাণ্ড ভারি গেটদুটো গুঁড় গুঁড় মেঘের মতো গর্জন তুলেছে। মাঝখানে ফাঁক হয়ে দুদিক বরাবর খুলে যাচ্ছে গেটদুটো। গেট ডিঙিয়ে ভেতর ঢুকছে একটি অফ রুটের জীপ। জীপের পুরো দেহ কালচে সবুজ বর্ণের। ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গমগম স্বরগুলো থেমে যেতেই দরজা খুলে বেরুলো বন কর্মকর্তা। মুষলধারে আছড়ে পড়েছে বন পাহাড়ের বৃষ্টি। একেকটি ফোঁটা যেন মার্বেল আকৃতির। তার পোশাকে, তার চলনে, তার দৃষ্টিতে, তার ভাবভঙ্গিতে বৃষ্টির নিপাট স্পর্শ ছুঁয়ে দিচ্ছে। আবছা হয়ে আছে চোখের একহাত দূরত্বও। জীপের চাবিটা পকেটে পুড়তে পুড়তে কাঁকর বিছানো লম্বা পথটা ধরে বাংলোর সীমানায় উঠল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কোথা থেকে যেন মতিন একটা গামছা হাতে ছুটে এল। গলায় অস্থির চিন্তার ভাব ফুটিয়ে বলল, 

  - ভাইজান, আপনে ভিইজা ভিইজা ক্যান আইলেন? আমারে একটাবার ডাক ছাড়তেন! ছাতাখানাডা লইয়া ছুট দিতাম! এই আকাইম্মা বিষ্টির লিগ্যা আপনেরে যদি সর্দি ধরে! 

  - না, এই বৃষ্টিতে আমার জ্বর আসে না।রোকেয়াকে বল এক মগ কফি লাগবে। আমি উপরে গেলাম। 

  - আইচ্ছা ভাইজান। আমি পাডায়ে দিবার ব্যবস্থা করতিছি।

মতিনের প্রস্থানের পর পাদুটো সিঁড়িপথে চলমান করে শোয়েব। সমস্ত শরীর বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে থাকলেও আজ বাড়িভরা অতিথি বাৎসল্য। একঝাঁক তরুণ-তরুণী দল। অন্যদিকে গুলজার আজিজ তার দুজন চেনা লোক নিয়ে এখানে আসছেন। আসার কোনো শক্ত উদ্দেশ্য নেই। তবে শোয়েব অনুমান করছে, এরা নিশ্চয়ই গুলজার আজিজের স্বজন কেউ। এখন ব্যাপারটা যেন কোনো আঙ্গিকে বিয়ে-প্রসঙ্গে না যায়। দাদীর কানে পাত্রী সংক্রান্ত কথা না উঠায়। সে এই মুহুর্তে এসব ভয়াবহ চিন্তা করছে না। সে বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনে আগ্রহী না। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ ভেঙে ভেঙে দোতলায় উঠছিল শোয়েব, অন্যমনষ্ক মস্তিষ্ক আজ বড়োই অশান্ত। মেজাজটা তিলে তিলে খতারনকের দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তার মুখায়ব যথেষ্ট শান্ত। বাঁদিকে না যেয়ে ভুলবশত ডানদিকে পা ঘুরায় ও। খেয়াল নেই নিজের ঘরটা যে রাতারাতি অন্য কারোর। সে পায়ে পায়ে হাঁটতে থাকলে বন্ধ দরজার সমুখে থামে। আরেক পা বাড়িয়ে যেই দরজাটায় ধাক্কা দিতে নিবে, ঠিক তখনই আচমকা থমকে যায় শোয়েব! স্থির হয়ে যায় চোখ! থমকে তাকায় ও! 
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp