শেরাজ আর মেহুল পাশাপাশি হাঁটছে। চারপাশে বৈশাখি মেলার আনন্দ। নানা রঙের ফেস্টুনে সাজানো মেলা প্রাঙ্গণ, কাঁচা মাটির ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সারি সারি দোকান বসেছে—মাটির পুতুল, হস্তশিল্প, খাবারের স্টল আর মেয়েদের সাজের জিনিসে ভরপুর।
মেহুলের চোখ আটকে যায় একটা দোকানে। মাটির তৈরি চুড়ি, গলার হার, দুল আর নানা রকম সাজের জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। শেরাজও তার পেছন পেছন যায়।
মেহুল চুড়িগুলোর দিকে ঝুঁকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে, একেকটা তুলে নাড়িয়ে দেখছে। মুখভরা হাসি। ওর সেই হাসিটা দেখে শেরাজের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি খেলে যায়।
হঠাৎ মেহুলের চোখে পড়ে মাটির তৈরি কয়েকটা আংটির দিকে। আগে কখনও দেখেনি এমন কিছু। প্রথম বারের মতো দেখেছে মাটির তৈরি আংটি। মেহুল অবাক হয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল।
“এইটা কি আসলেই মাটির তৈরি?”
দোকানদার হেসে বলল, “জি আপা, একদম দেশি মাটির তৈরি।”
“ভেঙ্গে যাবে না তো আবার।”
”কি কন আপা একেবারে মাটি আগুনে পুড়াইয়া বানানো হয়েছে জীবনেও ভাঙবে না।”
মেহুল আংটিটা নিয়ে নিজের আনামিকা আঙুলে পরানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আংটিটা ঢুকে না। সে মুখে হালকা "চ" শব্দে হতাশা ঝরিয়ে বলল, “লাগে না তো।”
দোকানদার বলল, “আপা, দেন আমি পরিয়ে দিই।”
দোকানদার হাত বাড়াতেই হঠাৎ শেরাজ দ্রুত মেহুলের হাতটা ধরে ফেলে। শেরাজের আচমকা আচরণে মেহুল আর দোকানদার দুজনেই চমকে ওঠে। শেরাজ থমথমে কণ্ঠে বলল, “আমি পরিয়ে দিচ্ছি।”
তারপর দোকানদারের হাত থেকে আংটিটা নিয়ে নেয়। শেরাজের চোখে এক ধরণের গা ছমছমে রাগ। মেহুল শেরাজের চোখে চোখ রাখতেই ভয় পাচ্ছে। শেরাজের চোখ যেন টগবগ করে ফুটছে।
শেরাজ মেহুলের দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলল, “আমি থাকতে, অন্য কেউ কেন তোর আঙুলে আংটি পরাবে মেহুল? আমিই তো যথেষ্ট।”
তারপর মেহুলের বাম হাতটা টেনে ধরে ধীরে ধীরে, যত্ন করে আংটিটা পরিয়ে দেয় মেহুলের আনামিকা আঙুলে। ফর্সা, নরম, মসৃণ হাতের আঙুলে লাল ফুলের ডিজাইনের আংটিটা যেন ঝলমল করে উঠলো। শেরাজ মৃদু গলায় বলল, “ভারী সুন্দর লাগছে।”
মেহুল হাতটা ছটফট করে ছাড়িয়ে নেয়। আংটিটা খুলে ফেলতে গেলে শেরাজ গম্ভীর গলায় বলে, “কি হলো, খুলছিস কেন?”
মেহুল বলল, “নিবো না।”
শেরাজ সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন?”
“এমনি।”
শেরাজ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, রেখে দে তাহলে।”
মেহুল অবাক। এত সহজে মেনে নিলো? সে নেবে না বলল আর ওমনি শেরাজ মেনে নিলো। মুহূর্তেই তার ভেতরে রাগ চেপে বসে। নাক ফুলিয়ে আংটিটা খুলে রেখে ধপধপ পায়ে সামনের দিকে হাঁটা দেয়। পেছন থেকে শেরাজও হাঁটে, প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে নিঃশব্দে মেহুলের পেছন পেছন।
মেহুলের পদচারণ থেমে যায় হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজে শুনে। পাশ ফিরে দেখে—নাগরদোলার দিক থেকে আসছে শব্দগুলো। চাকা ঘুরছে দ্রুত, উঠতি-পড়তি মানুষগুলো মজা করে চিৎকার করছে তো কেউ আবার ভয়ে আতঙ্কে।
সেই দৃশ্য দেখে মেহুলের মনে ভেসে ওঠে পুরোনো একটা স্মৃতি। কয়েক বছর আগের বৈশাখি মেলার ঘটনা। সাথে ছিলো ইফা। ইফা বায়না ধরেছিলো নাগরদোলায় উঠার জন্য। তখন মেহুল রাজি হয় নি—কারণ ওর ভয় লাগে নাগরদোলায় উঠতে। সেই সময় সাথে ছিলো শেরাজও, শেরাজও ভয় পায় নাগরদোলায় উঠতে।
আজ মেহুল শেরাজকে নাগরদোলাতে তুলবে। নিজের ভয়কে জয় করে শেরাজকে মজা দেখাবে। শেরাজ মেহুলকে এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি রে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
মেহুল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “নাগরদোলায় উঠব।”
শেরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “তুই না ভয় পাস নাগরদোলায় উঠতে?”
মেহুল দৃঢ় গলায় বলল, “এখন আর ভয় পাই না।”
শেরাজ হাসিমুখে বলল, “ঠিক আছে, দেখি তাহলে কতটা সাহসী হয়েছিস তুই।”
শেরাজ পা বাড়াতে যাবেই, তখন মেহুল বলে উঠে, “আমার সাথে তুমিও উঠবে।”
শেরাজ থেমে গিয়ে চোখ সরু করে তাকায়, “আমি?”
“হুম, তুমি উঠবে। সমস্যা কোথায়?”
শেরাজ একটু মন খারাপের ভঙ্গিতে বলল, “তুই জানিস আমি নাগরদোলায় উঠতে ভয় পাই।”
মেহুল এবার একেবারে সিরিয়াস, “ভয় পেলেও উঠতে হবে। এটা আমার ইচ্ছে। তুমি তো বলেছিলে, আজ আমার সব ইচ্ছা পূরণ করবে আজ।”
শেরাজ মুখ বাঁকিয়ে হালকা বিরক্তির সুরে বলল, “বলেছিলাম বুঝি?”
মেহুল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, বলেছিলে। এখন দোনামনা করছো কেন?”
শেরাজ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে ওঠে, “ঠিক আছে, চল।”
শেরাজ সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ভাবলেশহীন চেহারার আড়ালে খেলা করে এক অন্যরকম অভিব্যক্তি। মেয়েটা তাকে জব্দ করতে চাইছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কে কাকে জব্দ করে?
শেরাজ আর মেহুল ষাট টাকা দিয়ে টিকিট কেটে নাগরদোলায় উঠে বসে। মেহুল মাঝখানে বসেছে, এক পাশে শেরাজ আর অন্য পাশে একটা মেয়ে। মেহুলের মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। ও ফিসফিস করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “আপু, আপনি কি ভয় পান না নাগরদোলায় উঠতে?”
মেয়েটা এক গাল হেসে বলল, “না আপু, ভয় লাগে না, আমার তো সেই মজা লাগে।”
মেহুল কপাল কুঁচকে বলল, “মজা লাগে বুঝি!”
ঠিক তখনই নাগরদোলার খাঁচাটা ওপর দিকে উঠতে শুরু করে। মেহুল আতঙ্কে শেরাজের বাহু খামচে ধরে। শেরাজ ঠোঁট কামড়ে হাসে—মেয়েটা তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল, এখন নিজেই ভয় পাচ্ছে। ভেবেছে সে নাগরদোলায় উঠতে ভয় পায়। এর থেকে কত উচু উচু স্থান থেকে সে স্কাই ড্রাইভিং করেছে তার হিসাব নেই আর এই নাগরদোলা তো কিছুই না! শেরাজ মুচকি হেসে মেহুলকে খোঁচা মেরে বলল।
“কি হলো, ভয় পাচ্ছিস নাকি?”
মেহুল সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “কই, ভয় পাচ্ছি?”
শেরাজ নাটক করে বলল, “কিন্তু আমার তো ভয় লাগছে, মেহুল। এত উঁচুতে কখনও উঠি নি।”
মেহুলের হঠাৎ মস্তিষ্ক নড়ে উঠে শেরাজ এতো উচুতে উঠে নি মানে প্লেন তো আরও হাজার হাজার ফিট উপরে ওঠে তাহলে? মেহুল একটু থমকে গিয়ে বলল, “তাহলে প্লেনে উঠো কিভাবে?”
“প্লেনে উঠলে তো আর নিচের দিকে তাকানো যায় না। সব কিছু বন্ধ থাকে কিন্তু এখানে সব খোলামেলা আর কই প্লেন আর কই নাগরদোলা। নাগরদোলা তো নিচের দিকে গেলেই পেট পাক দিয়ে উঠে।”
মেহুল শেরাজের কথা শুনে ঢোক গিলে। মুখটা আরও শুকিয়ে গেল। না নাগরদোলা থেকে নেমে যাওয়া মঙ্গল হবে কেন যে শুধু শুধু নিজের পায়ে কুড়াল মারতে গেলো। মেহুল বুঝানোর স্বরে শেরাজকে বলল।
“শেরাজ ভাই চলো নাগরদোলা থেকে নেমে পড়ি। নাগরদোলায় চড়তে ইচ্ছে করছে না এখন আমার।”
ঠিক তখনই নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করে। মেহুল চোখ বন্ধ করে ঝাপটে ধরে শেরাজের বাহু। শেরাজ হেসে ফেলে। নাগরদোলা পূর্ণ গতিতে ঘুরছে আর মেহুল চিৎকার করে বলছে, “শেরাজ ভাই! থামাও ওদের! আমার ভয় করছে!”
মেহুল ভয়ে শেরাজকে একদম জড়িয়ে ধরে। কয়েক পাক ঘুরে নাগরদোলা থামে, মেহুল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। শেরাজ মেহুলের গালে হাত রেখে বলল, “মেহুল ঠিক আছিস?"
মেহুল মাথা নাড়ায়। মেহুল নাগরদোলা থেকে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আর কখনও উঠব না এই নাগরদোলায়!”
শেরাজ শরীর টানটান করে কণ্ঠে ঠাট্টা মিশিয়ে বলল, “আমার তো দারুণ মজা লেগেছে!”
মেহুল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “তুমি না বলছিলে ভয় পাও?”
শেরাজ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তুই যেভাবে জাপটে ধরেছিলি তাতে ভয় সব উড়ে গেছে!”
মেহুল রাগে নাক ফুলিয়ে বলল, “তুমি একটা মিথ্যাবাদী!”
বলেই গাল ফুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। শেরাজ পকেটে হাত গুঁজে মেহুলের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে।
—————
মেহুল মেলা থেকে বেরিয়ে পড়ল। শেরাজ ঠিক তার দুই হাত পেছনে। মেয়েটাকে এভাবে হেঁটে চলে যেতে দেখে শেরাজ দৌড়ে এসে মেহুলের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, “কি হলো? আর মেলায় ঘুরবি না?”
মেহুল থমথমে গলায় বলল, “না।”
শেরাজ একটু চুপ করে থেকে হালকা গলায় বলল, “আচ্ছা, তোর ইচ্ছে। চল তাহলে বাড়ি ফিরে যাই।”
মেহুল মাথা নাড়ল, “হুঁ।”
শেরাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “শুনেছি মেয়েরা নাকি ফুচকা খেতে খুব পছন্দ করে। তুই করিস না?”
মেহুল সংক্ষেপে বলল, “না, পছন্দ করি না।”
“আচ্ছা, তাহলে কী পছন্দ করিস?”
“কিছুই না।”
আর কথা বাড়ায় না শেরাজ। দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে, নীরবতায়। হেঁটে হেঁটে গাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। ঠিক তখনই মেহুল থেমে যায়। তার চোখ আটকে যায় রাস্তার ধারে একটা আম গাছের উপর। সরকারি আম গাছ। ডালে ডালে ঝুলে আছে কাঁচা আম। মেহুলের চোখে-মুখে অদ্ভুত এক হাসি খেলে যায়। শেরাজ ওর দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে বলল।
“কি হলো, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল।”
মেহুল শেরাজের দিকে তাকিয়ে বলে, “শেরাজ ভাই তুমি তো বলেছিলে আজ আমার সব ইচ্ছা পূরণ করবে, তাই তো?”
শেরাজ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, বলেছিলাম।”
মেহুল সরাসরি বলল, “তাহলে গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়া আমাকে।”
শেরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “মানে।”
মেহুল তর্জনী উঁচিয়ে বলল, “ওই যে গাছটা দেখছো। ওখান থেকে আমার জন্য দুটো কাঁচা আম পেড়ে আনো।”
শেরাজ অবাক হয়ে বলল, “আর ইউ ক্রেজি? আমি এখন গাছে উঠব?”
“হ্যাঁ, উঠবে। কারণ এটা আমার ইচ্ছা।”
শেরাজ চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মেহুলের দিকে। তারপর গলায় একটু নরম সুর এনে বলল, “আমি যদি গাছ থেকে আম পেড়ে দেই তোকে, তাহলে তুই খুশি হবি?”
মেহুল হেসে বলল, “হুঁ।”
শেরাজ মাথা নিচু করে হালকা হাসল, “ঠিক আছে, শেরাজ মির্জা তোর জন্য আম পেড়ে আনবে তোর খুশির জন্য।”
শেরাজ এগিয়ে গেল গাছটার দিকে, জুতো খুলে রাখল পাশে। গাছে উঠার আগে মেহুলের দিকে ফিরে বলল, “তুই চাইলে তোর জন্য আমি আকাশ থেকেও চাঁদ পেড়ে আনার চেষ্টা করব… কিন্তু চাঁদ তার নিজের জায়গাতেই সবচেয়ে সুন্দর। খোলা আকাশই তার আসল ঠিকানা।”
মেহুল কিছু বলে না, শুধু অপলক তাকিয়ে থাকে শেরাজের দিকে। গাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে ছেলেটা।
শেরাজ গাছ থেকে ডালসহ দুটো কাঁচা আম পেড়ে এনে মেহুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে তোর আম।”
কিন্তু মেহুল পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। শেরাজের ভ্রু কুঁচকে গেল, “কি রে? কি হয়েছে?”
জবাব না পেয়ে নিজেই গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় মেহুলের সামনে। মেহুলকে দেখেই শেরাজ চমকে ওঠে। মেহুলের দু’গাল টকটকে লাল রঙে ভরা। শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। চোখ দুটো ধীরে ধীরে লালচে হয়ে উঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কে দিয়েছে রঙ? কে হাত দিয়েছে তোর গায়ে?”
মেহুল নিচু গলায় বলল, “একটা ছেলে হঠাৎ কোথা থেকে এসে রঙ দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।”
শেরাজের কপালে নীল রগটা ফুটে ওঠে। হাতের আম মাটিতে ছিটকে পড়ে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড, “কোন দিকে গেছে?”
মেহুল ইশারা করে বলে, "এই দিকে।”
শেরাজ তাকায় সে দিকটায় কিন্তু কেউ নেই। শেরাজ গম্ভীর গলায় বলে, “মুখ দেখেছিস?”
শেরাজের চোখ দেখে মেহুলের বুকের ভিতর কেঁপে উঠে কাঁপা কাঁপ কণ্ঠে বলল, “না... মুখে মাস্ক ছিলো।”
শেরাজ চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে। অন্যর প্রতি উঠা রাগটা আর যাই হোক নিজের ভালোবাসার উপরে প্রকাশ করবে। মেহুল ওর প্রাণ আর নিজের প্রাণের উপর কখন আঘাত করবে না। যার উপরে রাগটা প্রকাশ করার প্রয়োজন তার উপর সেটা ঠিক করবে। মেহুলকে যে ছুঁয়েছে দরকার পড়লে তার হাত দুটো শরীর থেকে আলাদা করে দিবে। শেরাজ ভেতরের রাগটা আটকে রেখে বলল।
“সমস্যা নেই। গাড়িতে পানি আছে, মুখ ধুয়ে নিলে রঙ উঠে যাবে।”
তারপর নিচু হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা আম দুটো তুলে নরম গলায় বলল, “এই যে, তোর জন্য গাছ থেকে আম পেড়ে এনেছি চল।”
দুজন একসাথে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ওরা একটু দূরে যেতেই গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে একজন। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে মুচকি হাসে। নিজের দু হাতে লেগে থাকা লাল রঙ দু’গালে লাগিয়ে বলে।
“এবার তো রঙ দিয়ে রাঙালাম তোমায়, পরের বার রাঙাবো আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমায় মেহুপাখি… তৈরি থেকো।”
—————
গাড়ি এসে থামে মির্জা বাড়ির সামনে। মেহুলের গালে এখন আর কোনো রঙ নেই—ধুয়ে মুছে সব সাফ করে ফেলেছে। মেহুল গাড়ি থেকে নামতে নিবে ঠিক তখনই শেরাজ ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “মেহুল।”
মেহুল ফিরে তাকায় শেরাজের দিকে। শেরাজ মেহুলের বা হাতটা টেনে নিজের কাছে আনে। মেহুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
শেরাজ পকেট থেকে মাটির তৈরি ওই আংটিটা বের করে মেহুলের অনামিকায় পরিয়ে দেয়। তারপর মেহুলের চোখে চোখ রেখে নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে।
“পছন্দের জিনিস কখন হাত ছাড়া করতে নেই তাকে নিজের করে নিতে হয়।”
মেহুল শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে ঢোক গিলে আংটিটার দিকে এক পলক তাকায়। তারপর গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হতেই আবারও শেরাজ ডাকে, “মেহু।”
মেহুলের বুকের ভেতর কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠল। কত বছর পর শেরাজ ভাই তাকে এই নামে ডাকল—তাও এতটা স্নিগ্ধ, আদর মাখা কণ্ঠে। মেহুল ফিরে তাকাতেই তড়িৎ গতিতে শেরাজ তার ঘাড়ে পুরুষালী হাত রেখে কাছে টেনে আনে। তারপর কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই মেহুলের নরম, ভেজা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। আকস্মিক এমন আক্রমণে চমকে ওঠে মেহুল। চোখ বড় হয়ে যায় বিস্ময়ে। সারা শরীর জুড়ে যেন এক ঝটকায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মেহুল শেরাজের বুকে হাত জোড়া রেখে শেরাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলে শেরাজ এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মেহুলের মেদহীন কোমরে বা হাতটা রেখে টেনে আনে নিজের কাছে। সময়ের ব্যবধানে মেহুলও আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। অনুভব করে এক নাম না জানা অনুভূতি। অতল সাগরে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে মেহুল। অজান্তেই শেরাজের শার্ট মুঠো করে ধরে। সময় কেটে যায়, দুজেনের কেউ গোনে না তার হিসেব।
অবশেষে, শেরাজ নিজে থেকেই মেহুলের ঠোঁট জোড়া ছাড়িয়ে নেয়। তাকায় মেহুলের দিকে। মেহুলের চোখ জোড়া বন্ধ। শেরাজ মেহুলের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। দুজনে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শেরাজের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মেহুলের মুখের উপর। শেরাজ মেহুলের ঠোঁট নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দেয়। মেহুল কেঁপে উঠে। তল পেট অদ্ভুত ভাবে পাক দিয়ে উঠে। বুকের উঠানামা গতিহীন ভাবে চলছে। শেরাজ পুনরায় মেহুলের লালচে ঠোঁটের দিকে এগুতে নিবে তখনই তড়িৎ বেগে সরে আসে মেহুলের কাছ থেকে। মেহুল হতভম্ব চোখে তাকায় শেরাজের দিকে। শেরাজ চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে।
“বাড়ি যা।”
মেহুল চুপচাপ বসে থাকে। সে যেন একটা ঘোরের ভেতরে চলে গেছে। শেরাজ আবার বলল, “কি হলো যা?”
মেহুল শুকনো ঢোক গিলে আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। শেরাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, মাথা ঠেকিয়ে দেয় স্টিয়ারিংয়ের উপর। কি করলো এটা? এমনটা তো করতে চায় নি সে তাহলে কি করে হয়ে গেলো?
·
·
·
চলবে...................................................................................