কালো চাদরে আব্রুত মেয়েলী কায়া তাঁর দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে পুরনো আমলের মহলে ঢুকে যায়। উজ্জ্বল ঝাড়বাতির আলো গায়ে লাগতেই চাদর খানা ছুঁড়ে ফেলে। ব্যতিব্যস্ত গলায় ডাকে কাউকে। সরাই খানা হতে বেড়িয়ে আসে মাঝবয়সী মহিলা শুপ্রা দত্ত। দামিনী স্মিত হেসে শুধায়,
" আমার সুভা ঘুমিয়ে পড়েছে মনি?"
শুপ্রা থমথমে গলায় বলে, " কাঁদতে কাঁদতে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমারে কত্ত করে বললুম যেও না ।তুমি শুনলেই না। আমার পেয়ারি দামু? তুমি কেন ওপথে পা বাড়াচ্ছো? ওখানে পদে পদে বিপদ ওৎ পেতে আছে! কেউ কারো আপন নয়। মুসলমানরা তো আরো নয়। ওরা জাত শত্রু মানে আমাদের! একবার দগ্ধ হয়ে শখ মিটে নি? ভুলে গেছো সব?"
দামিনী হাতের লন্ঠণ শুপ্রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
" কিচ্ছু ভুলি নি মাসিমনি! সব পুষিয়ে রেখেছি। সময় হলে পাই টু পাই ফিরিয়ে দিবো। আমার জীবনটা তছনছ করে তারা ভদ্রসমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওদিকে আমার বৃদ্ধা বাবা মা মাথা নত করে কুকুরের মতো সবার লাথি গুঁতো খাচ্ছে। আমি তো এমনি এমনি ছেড়ে দিবো না? কল্লা না কাটতে পারি আঘাত আমি হানবোই দুগ্গা মায়ের দিব্বি!"
শুপ্রার মনটা কু ডাকে। ভীতিকর গলায় বলে, " দামু কি সব বলছো? কি দরকার পুরনো কাসুন্দি টেনে বর্তমানটাকে বিপদে ফেলার? আর ভুল তোমারো ছিলো কিন্তু? ভুলে যেওনা। ওরা খুবই ভয়ানক। শকুনীর থেকেও বেশি তীক্ষ্ম বুদ্ধি তাদের। তুমি একা পারবে ওদের সাথে? ওরা তোমাকে পিষে ফেলবে পায়ের নিচে। ওরা ভদ্রলোক সেজে সমাজে ঘুরে ফিরে। গ্রামবাসীর চোখে তাঁরা সাধু সন্ন্যাসী আর তুমি যাত্রাপালার মঞ্চে নাচানাচি করা নর্তকী যাকে ভদ্রসমাজ নষ্টা ছাড়া কিছুই ভাবে না।"
"জবান সামালকে বাত করো মাসিমনি। তোমার বস্তাপচা জ্ঞান আমাকে দিতে আসবা না। যাও মালছামানা গোছাও আমার! কাল থেকেই যাত্রাপালা শুরু, সকাল থেকেই চর্চা শুরু হবে।"
দামিনীর ক্ষুর ধারালো বাক্য ও আদেশ বানীতে শুপ্রা মাথা নত করে নেয়।
" ভুল ত্রুটি মার্জনা করো দামু লেকিন তোমার কিছু হলে সুভার কি হবে?"
দামিনী দাঁত কিড়মিড় করে বলে, " মানহুস কথা বলবে না। সুভাকে তাঁর আসল ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে তবেই ঠাকুরের কাছে যাবো। তার আগে না।"
শুপ্রা নত মাথায় দাঁড়িয়ে রয়। দামিনী বিরক্ত মুখে অগ্রসর হয় কামরার দিকে। রসাই খানা থেকে চপর চপর আওয়াজ শুনে দামিনীর কান খাঁড়া হয়। সন্দেহভাজন মন নিয়ে উঁকি দেয় সেখানে। ময়লা কাপড়ে আচ্ছাদিত এক মাঝ বয়সী লোক গ্রোসারে খাবার গিলছে যেন ক'দিনের অনাহারী! গোঁফে ঢাকা মুখটা দেখে চিনতে অসুবিধে হয় না তাঁর। শুপ্রাকে হুকুম তামিল করে,
" এটা এখনো খাচ্ছে? হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করো জলদি। আমার সুভার ধারের কাছেও যেন না ঘেঁষতে পারে।"
আকরাম নামক পাগলটা ভীতিকর চাহনিতে দামিনীর দিকে তাকায়। ময়লা দাঁত কেলিয়ে বলে, " পেয়ারি দামু শফিল ভাই তোমারে শুভেচ্ছা দিছে। তাঁর হয়ে কাজ করলে অনেক মুনাফা পাইবা। আর তোমার লগে দেখাও করবার চাইছে।"
দামিনী শুপ্রাকে ইশারায় পাগলটাকে বের করতে বলে নিজ কামরায় চলে যায়। শব্দহীন পা ফেলে নরম পালঙ্কে উঠে বসে। দেবী মা তাঁর সুভাকে রূপ লাবণ্যতা ঢেলে দিয়েছে। সুভাকে দেখলেই চোক্ষু শীতলতার আবেশে ভরে যায়। এতো সুন্দর স্নিগ্ধা মানবী খুব কমই দেখা যায়। দামিনী সুভার মাথাটা নিজ কোলে তুলে নেয়। রঙিন ফিতেয় বাঁধা বিনুনি খুলে চুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে দেয়। সুভার লাস্যময়ী সুশ্রী চেহারার দিকে তাকিয়ে বাকী নিশীথ নিশাচর হয়ে অন্ধকার বুনে যায় সুঁই সুতোয়।
°°°°°°°°°°°
সাত সকালে খোপে ধরা মোরগের ডাকে না, মায়ের বকবকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে সুরেলা বিছানায় দুই তিনবার গড়াগড়ি খেয়ে উঠে বসে। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। শান্তি বেগম থেমে নেই। এতো বড় মেয়ে হয়েছে কামকাজ নাই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবে আর তিনি খেটে মরবেন।আরো অনেক কথা। সুরেলা কানে নেয় না। উনুন পারের বেড়ার ফাঁকে রশি দিয়ে বোতলের গলা বেঁধে রাখা হয়েছে। সুরেলা সেটা টেনে বা হাতের তালুতে মাজন নেয়। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে মাজন দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে চলে যায় বাড়ির পেছনের দিকে। শান্তি বেগম মেয়ের ভাবলেশহীনতায় যেন জ্বলে ওঠেন। গোয়ালপাড়ে গরুর কাছে দন্ডায়মান ছেলেকে দেখিয়ে বলে,
" দেখলি নবাবজাদির ভাব? কামকাজ নাই টই টই কইরা ঘুইরা বেড়াইবো। এদিকে মায়ে যে কামের তলে পইড়া মরতে নেয় সেদিকে ধ্যান নাই। সেলাই মেশিনে বসমু নাকি রান্ধমু!"
" তোরে কাজ করতে কইছে কেডায়? মেশিন বেইচা পায়ের উপর পা তুইল্যা খা। আব্বায় তো ওহন টাকা দিতাছেই ঝোল্লা ভইরা। তারপরও লোভ যায় না?"
ছেলের ভর্ৎসনায় খারাপ লাগে শান্তি বেগমের। ভোঁতা মুখে ঝাটা রেখে ঘরে চলে যায় ধচং বচং দেখিয়ে। সিনানের এসবে কিচ্ছু যায় আসে না। উচিত কথা বলতে পারলেই সে শান্তি পায়। গোয়ালঘরের পাশে কাঁঠাল গাছ থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে তাঁর বিউটিকে খাওয়ায়।
সাত সকালে শাপলা সখিদের টেনে এনেছে। সুরেলাকে টেনে এনে মাটিতে দাগ কেটে কুতকুত খেলার ঘর আঁকে। মধ্যে শির দাঁড়া, শিরকে কেন্দ্র করে তরঙ্গের মতো এঁকে বেঁকে এঁকেছে। খোলা ফেলে এক পা তুলে কুতকুত বুলি আওড়িয়ে খেলছে। সিনান এগিয়ে এসে খোলাটা পায়ের নিচে আটকে খ্যাক করে বলে ওঠে,
" সাত সকালে আল্লাহর নাম নেওয়া বাদ দিয়া কি ফ্যাক ফ্যাক শুরু করছোস? স্কুল নাই তোদের?"
ধমকে কিশোরী মেয়েগুলোর মুখ পানসুটে দেখায়। সুরেলার পেছনে লুকিয়ে পড়ে। সিনান সালেহের খিটখিটে মেজাজের গাঁথা যে পুরো গাঁওয়ে রপ্ত। শাপলা কোমড়ে হাত রেখে ঝগরুটে ভঙ্গিতে বলে,
" সিন ভাই? ভালা হইতাছে না কিন্তু? খোলা দাও? আমরা আমাদের উঠানে খেলতেছি। আর আজ ইস্কুল ছুটি বুঝলা?"
" কেন? আজ তোর শ্বশুরের বিয়া নাকি?"
শাপলা ঠোঁট চোখা করে বলে, " উন্না। কোন রাজ্যে বাস করো সিন ভাই? জানো না আজক্যার থাইক্যা মেলা শুরু? মেলার প্রথম তিন দিন ইস্কুল ছুটি দিছে। বিশ্বাস না হইলে হেডমাস্টারের কাছে যাইয়া শুইনা আহো। যাও যাও? আমগোরে খেলায় ডিশটার্ব কইরো না। গো গো?"
মট মট শব্দ হয়। শাপলার চোখের আকার বর্ধিত হয়। সিনান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে পা সরায়। খোলা টুকরো টুকরো করে দিয়েছে পায়ে পিষে। শাপলা আহাজারিতে ফেটে পরে যেন মাটির খোলা নয় বেচারির শখের হৃদয় চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে। সিনান বেশ উপভোগ করে। তাঁর হাসিতে শাপলার দুঃখ বেড়ে যায়। বাঁচালী মেয়েটা পারে না পুরো গাঁ মাথায় তুলে নাচে। শাপলার মা এসে শাপলাকেই বকাঝকা করে যায়। মেয়ে মানুষ কেন গদা ফাড়বে? আশ্চর্য লোকে ছিঃ ছিঃ করবে না? শফি আড়াল থেকে দেখে যায়। বের হওয়ার সাহস করে না। ক্ষ্যাপাটে হাতের কাছে পেলে তাঁকে কাঁচা গিলে খাবে। সুরেলা ভাইকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়। সিনান হেসে চলে যাবে শাপলার মায়ের ডাকে থেমে যায়।
"বাপ, বিকালে মেলায় যাইবা না?"
সিনান স্মিত হেসে বলে, " চাচি আম্মা উৎসব বাজলে পকেট ফাঁকা হয়। তবুও যাইয়া ঘুইরা ফিরা আসুম নে।"
ভদ্রমহিলা ঘর থেকে ঘুরে এসে শ'তিনেক টাকা দিয়ে বলে,
" শফি ছোট মানুষ। হাঁট বাজারের কি বোঝে। ওরে মেলায় থাইকা ঘুইরা আইনো। কিছু সদাই পাতি কিইনা তোমরা নিও কয়টা আমাগোরে দিও!"
সিনান টাকাটা নেয় না। ভদ্রমহিলার মহানুভবতায় হাসে। মন বড় করতে টাকার খনির দরকার পরে না।
" কি যে বলেন না চাচি! এতোটাও অধঃপতন হয় নাই। বাপ ডাকছেন আবার টাকাও দিতেছেন? কষ্ট পাইলাম। শফি কই? পাঠাই দেন।"
সিনানের কথায় ভদ্রমহিলা বিস্ময় প্রকাশ করৈ টাকাটা জোর করে দিতে নেয়। সিনান নেয় না। চলে আসে উঠোন থেকে। নিজ বাড়ির উঠোনে আসতেই শান্তি বেগমের সম্মুখীন হয়। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সব শুনে নিয়েছে। বিড়বিড় করে বলেন,
" অভাবে পেটে ভাত যায় আসছে দয়া ধর্ম পালন করতে!"
অতি নিম্ন আওয়াজে বললেও সিনান ঠিকই শুনতে পায়। কিছু বলতে উদ্যত হয়েও চুপ করে যায়। পাশের উঠোনে চাচি শুনলে কী ভাববেন? সিনান কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধোয়। শফি পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে সিন ভাইয়ের পিন্ডি চটকে চটকে। সিনান চোখ তুলে তাকালে শফি পিছু ছোটে। সিনান হেসে মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে বলে,
" গাধা, আয় মারবো না।"
" মাও এই কথা কয়। গেলে পাছার ছাল তুলে নেয়। মায়েরেই বিশ্বাস করি না তুমি কনকার পাড়াতো ভাই।"
শফি ভেংচি কেটে বলে। সিনান রশিতে টানা গামছা টেনে হাত মুখ মুছতে মুছতে আদেশ ছোড়ে,
" আসা লাগতো না। তোর ভাবী'রে লইয়া ঘাটপারে যা। গোসল করাই দিমু!"
সিনান ঘরে গেলেই শফি এগিয়ে আসে। গোয়ালপাড়ে বাঁধা লালচে রাঙা বকন গরুর সামনে দাঁড়ায়। হাসি পায় তাঁর। এই গরু নাকি তাঁর ভাবী। তার ছেঁড়া পাগলের কান্ড শুনলে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে ইচ্ছে করে। সে গরু টার গালে ঠাস করে একটা লাগিয়ে বলে,
" ভাবী জান? ভালা আছেন? গোসল করবেন ক্যান সাত সকালে?"
প্রশ্ন করেই শফি মিটমিট করে হাসে। গরুটা মুখ এগিয়ে আনে। শফি একটু আদর করে দেয়। বকন গরু জিভ বের করে চেটে দেয় হাত। শফি হেসে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
" ও ভাবী জান কতা কন না ক্যা? আমি আপনের দেওরা লা.."
বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অপ্রত্যাশিত আঘাতে ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। সিনান চোখ পাকিয়ে চায়।
" ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জা শরমের মাথা খাইছোস? বড় ভাইয়ের বউরে চুমা দেস? তোর মুখ আজ আমি শিল পাটায় ছেঁচমু!"
শফি পারে না ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। সিনান তেড়ে গেলে দৌড়ে গোয়াল ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বলে,
" আমার ভুল হইছে সিন ভাই। তোমার পায়ে পড়ি মাফ কইরা দেও। আর জীবনে কাউরে চুমা খাইতাম না। তোমার বউরে তো আরো না। দরকার পড়লে আমার বউ হইলে তুমি একখান চুমা দিয়া সোধবোধ কইরো। তাও মাইরো না?"
" আস্তাগফিরুল্লাহ! সিনান সালেহরে কি তোর লুইচ্চা লাগে নাকি? যে অন্যের বউরে চুমা দিবো? তাঁর কি বউয়ের অভাব? আল্লাহ পাকে রহম করলে চার পাঁচটা বউ আনমু। সকাল বিকাল একেক বউরে চুমা দিমু!"
শফি দাঁতে দাঁত চেপে অশ্রাব্য গালি দেয় মনে মনে। লুইচ্চার বাপ! চার পাঁচটা বউ আনবো! শখ কত? বউ কি গাছে ফলে নাকি? যে হাবভাব একটা জুটলেই সে পুরো গাঁ প্যান্ট ছাড়া চক্কর দিয়ে আসবে। শফি চুপসানো মুখে বলে,
" ও সিন ভাই? তুমি না আমার দুলাভাই? শালা ভাইবা মাফ কইরা দাও?"
সিনান হেসে বলে, " কাল না কইলি বোন দিবি না? আজ আবার দুলাভাই কস? তোর ভাঙা রেডিও মার্কা বোন আমি নিতাম না। আমার তো আসমানের চাঁদ চাই।"
পাইল্লার কালিও জুটতো না তোর কপালে। শালা তার ছেঁড়া! বিড়বিড় করে গোয়ালঘরের কাঠের দরজা খুলে উঁকি দেয়। সিনান গরুর কপাল ঘঁষে দিচ্ছে যেখানে শফি চুমু দিয়েছিল। শফি ভেংচি কাটে। কি দরদ! দেখলেই গা জ্বলে যায়।
" এবারের মতো মাফ কইরা দিলাম। ভবিষ্যতে আমার বউয়ের আগেপিছে দেখলে মেশিন কাইটা হাতে ধরাই দিমু! সাবান ক্ষ্যার নিয়ে পেছনে আয়।"
সিনান সালেহের হুকুমে শফি ভোঁতা মুখে ৫৭০ সাবানটা হাতে নেয়। খরের গোদা হতে এক মুঠো খর নিয়ে পিছু পিছু যায়।সিনান গরুর রশি টেনে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটে। পিছনে শফির অবস্থান খেয়াল করে বলে,
" মেলায় নাকি সার্কাস আইবো হুনছোস?"
"সার্কাস কি সিন ভাই?"
শফির নাদান গলায় সিনান পিছনে ফিরে। ব্যাঙ্গ করে বলে, "ওলে কচি খোকাটা! সার্কাস বুঝে না। বগলে, নিচ তলা বাল চাইয়া থাহে উনি সার্কাস চিনে না। গতবারের থাপ্পড়ের কথা ভুইল্যা গেছোস?"
শফির এক হাত গালে উঠে আসে। গতবার সিন ভাইয়ের সাথে মেলায় গিয়েছিলো। তার ছেঁড়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে সার্কাসের পেছনের দিকটার টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটু উঁকি ঝুঁকি মারছিলো। হালার পুত চুলের মুঠি টেনে রাম থাপ্পড় দিয়েছিলো। সে থাপ্পড়ে সে সাত দিন জ্বরের কোলে বসে ছিলো।
" যাবি সার্কাস দেখবার?"
সিনানের প্রশ্নে শফির ভাবনাচ্ছেদ ঘটে। সে জানে তাকে পরীক্ষা করার জন্য বলছে তাই ভেংচি কেটে বলে,
" জীব্বনেও না। আম্মা মারবো! আর তুমি তো আছোই আমার জীবনের শনি!"
শেষোক্ত বাক্য ধীমান গলায় বলে। সিনান হেসে বলে, "আজ রাতে যাবো নে দু'জন তাও ফ্রি ফ্রি!"
শফি বিশ্বাস করে না এই তার ছেঁড়া কে। তাই জবাব দেয় না। সিনান পুকুর পারে গরু টেনে নামাবে চেনা পরিচিত মেয়েলী কায়া নজরে বিঁধে। সিনানের স্বাভাবিক মুখটা গম্ভীর আকার হয়ে আসেই। শফির দিকে তাকিয়ে বলে,
" দুলালি কি করে এইখানে?"
" কোনে দুলালি?"
শফি মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দুলালিকে খোঁজে। পড়ে ভাবে এই দুলালি টা আবার কেডা? তাদের গাঁওয়ে দুলালি নামের কেউ নাই তো। তয় দুলাল নামের একখান বুড়া আছে। সিনান সালেহ ওঁর মাথায় ঠাস করে একটা লাগিয়ে গরু সহ পুকুরের পানিতে নামায়। মাঝ পুকুর থেকে ঘুরিয়ে এনে হাঁটু সমান পানিতে এনে খর ঘষে গরুর গায়ে।
এক উচ্ছ্বসিত কিশোরী দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে পুকুর ঘাটে। ঝি বউয়েরা কাপড় কাঁচা বাদ রেখে বাঁকা নজরে তাকিয়ে। হাঁটুর উপর কামিজ, পা চেপে সালোয়ার। গলায় ছোট্ট ওড়না ঝুলছে। পিঠ ছড়িয়ে চুল গুলো দুলছে হাঁটার তালে তালে। গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে এমন বেশ ভূষায় বেরোয় না ভুলক্রমেও। ময় মুরুব্বি দেখলে সিধা নালিশ যাবে বাড়ির কর্তার কাছে। চেয়ারম্যানের ভাতিজি হওয়ার দরুন রূপসা উক্ত নালিশ থেকে বেঁচে। সে ঘাটপারে শফির পাশে দাঁড়িয়ে ডাকে,
" ও সিন ভাই? কি করছো?"
অন্য কেউ হলে সিনান সালেহে খিটখিটে মেজাজে ত্যারা কথা শুনিয়ে দিতো। আলালের ঘরের দুলালিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাঁর বউকে আদরে ভাসিয়ে সাবান লাগিয়ে দেয়। রূপসার চঞ্চলা মনটা নুইয়ে পড়ে। নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড। সে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ক্ষুব্ধ চাহনি নিক্ষেপ করে লোকটার পানে।শফি যেন আকাশে উড়ে বেড়ায় রূপসাকে তাঁর পাশে দেখে। লাজুক হেসে মাথা চুলকায়। রূপসা আপার লগে দেখা হইবো জানলে ভালা জামাপ্যান্ট পইড়া আসতো। ধ্যাত্তেরিকি!
°°°°°°°°°°°°°
" তুই দে না শয়তান?"
" তুই কাটছোস তুই দিবি। আমি পারমু না।"
" কেন পারবি না। অর্ধেক কাম আমি করছি বাকি অর্ধেক তুই করবি। নে ধর টিকিট?"
" না না না। এক কাজ কর জামাল আসুক। ওর হাত দিয়াই দে। শা/লার মধ্যে অনুভূতি নাই। আমার আবার নইজ্জ্যা করে!"
" সার্কাসে বেডি গোরে নাচন দেখতে নইজ্জ্যা করবোনি না হুহ!"
ভেংচি কেটে বাবু টিকিট গুলো নিয়ে এক কদম এগিয়ে আসে তো দু কদম পেছায়। ভাই কাল বলেছিলো তো যাত্রাপালার টিকিট কাটতে। কেটেও এনেছে তবে তাঁরা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে ডুবে আছে। রিজ ভাই কি তখন মজার ছলে বলেছে নাকি? এখন টিকিট দেখে যদি রেগে যায়? ভাই আর ওই ভিড়ভাট্টার যাত্রাপালা দুই মেরুর বাসিন্দা। বাবু এগিয়ে যায় বাগানের দিকটায়।
বেতের চেয়ার গা এলিয়ে দেয় নওরিজ মাহবুব। কানে হেডফোন লাগিয়ে নীলচে খামে কিছু টুকে রাখে। ঢাকনায় ঢাকা কফির মগে ঠোঁট ভিজিয়ে ভাবনায় বুঁদ হয়। একটু সতেজ অনুভব করে নির্জন পরিবেশে। অন্দর মহলের পরিবেশটা বেশ থমথমে। আম্মা আর রওশনের মুখের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। চাচির চোখ মুখ অবশ্য উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জ্বল জ্বল করছে। আব্বা তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। কিভাবে ভাতিজার উপকার করতে পারে। বোন নওরিন আর বোন জামাই তো কানের কাছে প্যান প্যান শুরু করে দিয়েছে। সবচেয়ে স্বস্তির মানব সাদমান ভাই। ভদ্রলোক টু শব্দটি করে নি। শুধু কাঁধ উঁচিয়ে অল্প হেসে বুঝিয়েছে এক মেয়ের পেছনে দুই ভাই? মেয়ের অভাব পড়েছিল বুঝি? নওরিজ নিজেও অবাক হয়। রওশন, যার ছোট ভাই সুরকে পছন্দ করে আর সে ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি? আসলে সে সেভাবে খেয়াল করে নি হয়তোবা। এখন আগে কি হবে? কি আর হবে তাঁর ভাইটার মন ভাঙবে। কেননা সে এ ব্যাপারে বড্ড স্বার্থপর। যা তাঁর তা শুধু তারই। ত্যাগের কোনো প্রশ্নই আসে না। সে মনে করে এটা তাঁর ভাইয়ের দূর্ভাগ্য! সে মনে প্রাণে প্রার্থনা করে রওশনের জীবনে এক সতেজ পদ্মর আগমন ঘটুক। তাঁর ভাঙা হৃদয় জুড়ে যাক পূর্বের চেয়েও দৃঢ়তার সাথে।
" রিজ ভাই? যাত্রাপালার টিকিট! আপনে কাটতে কইছিলেন যে!"
নওরিজ মাহবুব বাবুর কথায় হেডফোন খুলে রাখে। বাড়িয়ে দেওয়া টিকিটের দিকে তাকালেও আগে চোখে বিঁধে বাবুর নখে থাকা ময়লা। তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে বিরক্ত মুখে বলে,
" নখে ময়লা জমে আছে। পরিষ্কার করতে পারিস না?"
বাবু নখের দিকে তাকায়। পরপর আঙুল মুখে পুরে দাঁত দিয়ে নখ কাটে। নওরিজ যেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
" চোখের সামনে থেকে দূর হ গাধার দল। টিকিট তোর কাছেই রাখ। ক'টা কেটেছিস?"
বাবু ভোঁতা মুখে জবাব দেয়, " আপনিই তো কইলেন আটটার কথা।"
" ওহ্। আজ রাতেই না শো?"
বাবুর ভোঁতা মুখ উজ্জ্বল হয়। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। নওরিজ বাঁকা চোখে তাকিয়ে শুধায়, " ক'টার দিকে শুরু হবে?"
" প্রথমদিন তো তাই একটু দেরি হবে। এই ধরেন এগারোটা বারোটার দিকে। ফজরের আগ অবদি চলবো!"
বাবুকে বলতে না দিয়ে হারুণ চটজলদি জবাব দেয়। নওরিজ কফির মগে আবারও ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, " ওহ্, এখন আমার আপডেট দে চটজলদি।"
বাবু এবার শুরু করে দেয়। গলা পরিষ্কার করে হড়গড়িয়ে বলে, " সেলিম রেজারে ঢাকায় নিয়ে গেছে ওর বাপে অবস্থা নাজুক তাই শুনলাম। ওর বাপে তাফালিং দেখাইলো খুব। চেয়ারম্যান চাচার কাছে বিচার চাইছে না পাইলে পুলিশে মামলা করবো কইলো!"
" সে দেখা যাবে। মন্টু মিয়া আর আকরামের কি খবর?"
নওরিজের ভাবলেশহীন গলায় হারুণ হেসে বলে,"মন্টু মিয়া তো কথাতেই চিড়া ভিজায় ভাই। ভদ্রলোকের মুখে বহুত মধু। সবার লগেই মিষ্টি মিষ্টি কিরা কথা কয়। তাই বুঝি না কার লগে চলে সব। তয় স্কুলের ছোকরা গোর লগে বেশ ভাব। আর সন্দেহের বিষয় এই ভাই কাল ভাবীগোরে স্কুলের এক পোলা ফিট খাইছিলো। সবাই বলাবলি করলো কোন মাইয়ার জন্য বিষ খাইছে। ডাক্তারও তাই কইলো। কিন্তু পোলার বাপে মায়ে মানবার চায় না। থানা পুলিশ করার হুমকি দেয়। হেড মাস্টার স্কুলের বদনাম হইবো দেইখা টাকা পয়সা আর ভয় দেখাইয়া ধামাচাপা দিছে বিকেলে।"
নওরিজ মাহবুব ভাবনায় পড়ে।
" ছেলেটার ব্যাপারে ভালো রে খোঁজ-খবর নে। আর ওর বাস মায়ের সাথে কথা বল ভালো করে। হেড মাষ্টারের উপর নজর রাখ।"
বাবু, হারুণ, তমাল একসাথে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। তমাল বলে,
" সে খোঁজখবর পেয়ে যাবো ভাই। আরেকটা কথা মিন্টু মিয়া মেলায় জিলাপির দোকান দিবো। আর কয়েকদিন হলো যাত্রাপালার শুক্কুর মিয়ার সাথে তাঁরে বেশ কয়েকবার দেখা যায়।"
" আকরামের খোঁজ খবর?"
" কাল পেয়ারি দামুর বাড়িতে গেছিলো। কেন গেছিলো এখনো ক্লিয়ার না।"
" আচ্ছা ঠিক আছে। জামাল কোথায়? ওরে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।"
.
.
.
চলবে.....................................................................