নাজমা বেগমের লাশ সেই রাতেই দাফন করতে হয়। ক্ষতবিক্ষত লাশ বাহিরে বেশিক্ষণ রাখা কোনভাবেই সম্ভব ছিলোনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেবল ওনার এক ছেলেই ওনার দাফনকার্যে উপস্থিত ছিলেন। অপর ছেলে দেশের বাইরে এখন। তারপক্ষে সম্ভব ছিলো না সময়মতো আসা। সারারাত জেগে ছিল সকলেই। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে রুদ্র, প্রিয়তা আর জ্যোতি ছিল নাজিফাদের বাড়ি। নীরবকে দাফনের পরপরই পাঠিয়েও দিয়েছে রুদ্র। আমের ভিলায় কুহু একা থাকবে নাহলে। সারাটারাতই কেমন অদ্ভুত বিষাদে কেটে গেছে ওদের। গুমোট, থমথমে অস্থিরতা।
সকাল তখন ছ'টা বাজে। চারপাশে ঘন কুয়াশা। ধূসর দৃশ্যপট যেন বিষাদময় পরিবেশটার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে। নাজিফাদের বিল্ডিংয়ের ছাদটাতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে উচ্ছ্বাস। সদা হাস্যজ্জ্বল ছেলেটা চোখে এক আকাশ বিষাদ নিয়ে তাকিয়ে আছে অদূর শূণ্যে। বারবার নাজিফার সেই চিৎকার কানে বাজছে ওর। মেয়েটার অসহায়ত্ত্বের কথা চিন্তা করলেই সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে ওর। এতো দুঃখ, যন্ত্রণা কেন পাবে মেয়েটা? কোন অপরাধে? আজন্ম পাপিতো ও নিজে। ঐ মেয়েটাতো নিষ্পাপ। একদম ফুলের মতো। অথচ ওর সকল পাপের ভার যেন সৃষ্টিকর্তা ঐ মেয়েটার ঘাড়েই দিয়ে দিচ্ছে। কেন? ওকে ভালোবেসেছে বলে? এক পাপিকে ভালোবাসার শাস্তি! অপরাধবোধে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল উচ্ছ্বাসের। সজোরে একটা ঘুষি বসালো ছাদের শক্ত দেয়ালে। কী দরকার ছিল মেয়েটার কাছাকাছি যাওয়ার? দূর থেকে দেখেইতো জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেতো। তাহলে হয়তো এতটা কষ্ট পেতে হতোনা ওকে জীবনে।
উচ্ছ্বাসের এসব চিন্তার মাঝেই কখন যেন পাশে এসে বসেছে রুদ্র আমের। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল না সে। হতে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে দুটো সিগারেট বের করে একসঙ্গে ধরল দু আঙ্গুলের মাঝে। ধীরেসুস্থে একসঙ্গেই দুটো জ্বালিয়ে নিয়ে এগিয়ে দিল উচ্ছ্বাসের দিকে। নিচে তাকাল উচ্ছ্বাস। দুটো সিগারেটের থেকে একটা নিয়ে নিল নিজ হাতে। রুদ্র সিগারেটটা ঠোঁটে গুঁজে বলল, 'নাজিফা কোথায়?'
' ভেতরের ঘরে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বউমণি আর জ্যোতি আছে ওর কাছে।'
খানিকক্ষণ চুপ থাকল দুজন। শরীরে কাটা দেওয়ার মতো শীতল হাওয়া আসছে। খানিকক্ষণের নীরবতার পর রুদ্র বলল, 'গিল্ট ট্রিপে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। নাজিফার জীবনে যা যা বিপর্যয় ঘটেছে তাতে লতায়পাতায়ও তোর কোন সম্পর্ক ছিল না।'
উচ্ছ্বাস সিগারেটের জ্বলন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, 'প্রত্যক্ষভাবে হয়তো নেই। কিন্তু ওর জীবনের সব বিপর্যয়তো আমার সঙ্গে জড়ানোর পরেই শুরু হয়েছে। আমি মাঝরাস্তায় ওকে ছেড়ে দেওয়ার পর।'
ভ্রু কোঁচকালো রুদ্র, 'তোর ওকে ছেড়ে দেওয়ার সেই সিদ্ধান্তটা আমি আজও সমর্থন করি না। কিন্তু তারপরে যেসব হয়েছে তাতে তোর কী দোষ?'
উচ্ছ্বাস মলিন একটু হেসে বলল, ' দোষ আমার সঙ্গের। আমি মানুষটাই অপয়া। ছোটবেলায় সবাই তাই-ই বলতো। আমি আমার বাপ-মাকে খেয়েছি। সত্যিই বলতো। তাইতো দেখ, নাজিফার জীবনটাও কেমন দুর্বিষহ করে দিচ্ছি। ভাবছি ওকে আমি আর বিয়ে করবনা বুঝলি। ওর ভাইদের কাছেই ও ভালো থাকবে। আমার সঙ্গে থাকলে ও বাঁচতে পারবেনা।'
রুদ্র রেগে গেল। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে থমথমে গলায় বলল, ' একধাক্কায় ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব, ফারদার এসব ই'লজিক্যাল ইডিয়টিক কথা বললে। এই মুহূর্তে তোকে ওর সবচেয়ে বেশি দরকার। এবার যদি ওর হাত ছাড়ার কথা ভেবেছিসতো নিশ্চিত আমার হাতে খু*ন হবি তুই।'
উচ্ছ্বাস হতাশ চোখে রুদ্রর দিকে তাকাল, ' এখনকার অবস্থা তোর জানা।'
' এমুহূর্তে তোকে কিছু করতে হবেনা আর। আমি আর কাকা মিলে দেখে নেব সবটা।'
' তোর সেই কথা আমি শুনব, এটা কেন মনে হচ্ছে তোর? শোনার হলে সেই বছরখানেক আগেই শুনতাম। নাজিফাকে নিয়ে সুখের একটা সংসার করতাম। ঝামেলাহীন, যন্ত্রণাহীন, সহজ জীবন।'
কথাটা বলে সিগারেটে জমা ছাইটা ঝাড়ল। বেশ বিরক্ত হচ্ছে রুদ্র। অসহ্য লাগছে ছেলেটাকে এখন ওর। তিক্ত গলায় বলল, ' আজেবাজে কথা ছাড়। সিগারেটটা শুধু পোড়ানোর জন্যে দেইনি। টানার জন্যে দিয়েছি। একেকটা বিশ টাকা। নষ্ট করবিনা।'
সিগারেটের শোলাটা চোখের সামনে ধরে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল উচ্ছ্বাস, ' শালা বিজনেস ডুবছে কী ডোবেনাই, তুইতো হাড় কিপটা হয়ে গেছিস। বিশ টাকার একটা সিগারেট দিয়া আবার কথাও শোনাস। ছ্যাহ্!'
রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ' দে, ফেরত দে।'
সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটটা মুখে গুঁজে ফেলল উচ্ছ্বাস। মুখে সেটা রেখেই দাঁত বের করে হেসে বলল, ' ছ্যাপ লেগে গেছে। নিয়ে দিবি মুখে?'
হতাশ হয়ে হাত ফিরিয়ে নিল রুদ্র। উচ্ছ্বাস সিগারেটটা নামিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল। রুদ্র কিছু বলল না আর। ঘন কুয়াশাময় দৃশ্যপটে তাকিয়ে সিগারেট টানা শুরু করল। এই ছেলে এখন হেসেই যাবে! ঠিক তখনই নিচের থেকে চিকিৎসার করে উঠল এক মহিলা। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস দুজনেই তাকাল। ময়লা শাড়ি, ছেড়া ব্লাউজ, এলোমেলো রুক্ষ চুল। নার্গিস। সে ওদের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করে বলল, ' বিষ ঢুকছে ছোট বাবা! তোমার ঘরেই ঢুকছে! সাবধান! তোমার ঘরে বিষ! বিষ!'
উচ্ছ্বাস বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বলল, ' শা-লার! মাথার তার কাটছে তবুও বিষ ঢালার স্বভাব যায়নি। আগেও ঢালতো, এখনো ঢালে। মহিলার নাম নার্গিস না, আর্সেনিক হওয়া উচিত ছিল। মন্থরা বুড়ি একটা!'
মনে মনে হাসল রুদ্র। এর আগেও একথা বলেছিল নার্গিস ওকে। সেদিন পুরোপুরি ধরতে পারেনি। কিন্তু আজ সে জানে, কে এই বিষ!
•••••••••••
' প্রিয়তা?'
জ্যোতির আচমকা ডাকে চমকে উঠল প্রিয়তা। বিভ্রান্ত চোখে একবার জ্যোতি একবার নাজিফার দিকে তাকাল। বিছানায় বেঘোরে পরে আছে নাজিফা। কাঁদতে কাঁদতে ভীষণ ক্লান্ত সে এখন। একটা হাত দিয়ে রেখেছে নিজের ভরা পেটটার ওপরে। পাশের ঘরে নাজিফার ভাবি কোরআন তেলোয়াত করছে। প্রিয়তা ঠিক পাশেই বসে ছিল নাজিফার। জ্যোতিও দু মগ কফি হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। একটা মগ প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ' সারারাত জেগে আছো। কফিটা খাও, ভালো লাগবে।'
প্রিয়তা কফিটা নিয়ে বলল, ' থ্যাংকস্ আপু। রুদ্র আর ভাইকে দেখেছো?'
' ছাদে আছে। নিচে এলে খেতে দেব। সারারাত খায়নি কিছু।'
প্রিয়তা আলতো করে হাত বোলালো নাজিফার মাথায়, 'কাল সন্ধ্যা থেকেই কিছু খাওয়া হয়নি মেয়েটার। ডেকে কিছু খাওয়ানো উচিত না?'
জ্যোতিও তাকাল নাজিফার দিকে, ' হ্যাঁ। কিন্তু বেশিক্ষণ হয়নি ঘুমিয়েছে। আরেকটু ঘুমোক। পরে উঠিয়ে খাইয়ে দেব কিছু।'
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি, ' হাতেগোণা কদিন পর ডেলিভারি মেয়েটার। এই প্রেগনেন্ট অবস্থায় কী কী সহ্য করতে হলো বলোতো? স্বামী, তারপর বাবা, এখন মা। সবকিছুই শেষ হয়ে গেল।'
আশেপাশে কেউ আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে বলল, 'ওর ভাইয়া ভাবিদের কথাতো জানোই। এখন শুধু উচ্ছ্বাসটাই ওর জীবনের শেষ ভরসা।'
প্রিয়তা কিছু বলল না। চুপচাপ চুমক দিল কফির মগে।জ্যোতি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। অতঃপর বলল, 'একটা কথা বলব?'
চোখ তুলে তাকাল প্রিয়তা, ' বলো?'
' রুদ্রর সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে তোমার তাইনা? বোঝা যাচ্ছে দেখে। আর এভাবে হুটহাট কোথায় চলে যাচ্ছো আজকাল? তোমার সেই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে? আশ্চর্যের বিষয় রুদ্র দেখেও না দেখার ভান করছে! তোমার নিরাপত্তা নিয়ে সব চিন্তা উবে গেল! কী এমন ঝগড়া হয়েছে বলোতো?'
' ছাড়োতো আপু। ভালো লাগেনা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে এখন আর।'
জ্যোতি মলিন একটু হাসল। বলল, ' রুদ্র এমুহূর্তে কঠিন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তা। ওর চোখমুখ বলে দেয় কী অসম্ভব মানসিক চাপের মধ্যে থাকে ও। এই মুহূর্তে খুব কাছের একজনকে দরকার ওর। যে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। সারাদিন পর যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরবে, তখন মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দেবে। মাথা টিপে দেবে, ঘাড় ম্যাসাজ করে দেবে। মাঝরাতে কড়া করে গরম এককাপ কফি এনে দেবে। এই দুটো জিনিস ওকে অনেক রিলিফ দেয়। আশা করি এই দু'বছরে তুমি সেটা জেনেছো। আগেতো আমিই_'
বলতে গিয়েও থেমে গেল জ্যোতি। রুদ্রর প্রতি অতিরিক্ত চিন্তায় অযাচিত কথা বলে ফেলছিল। ঠোঁটে হাসি ফোঁটাল প্রিয়তা। কিন্তু হাতটা চেপে ধরল গরম কফির মগে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ রাগ হল ওর। ইচ্ছে হল এখনই জ্যোতিকে মেরে ফেলতে। একদম মেরে ফেলতে। জ্যোতি নরম গলায় বলল, 'কিছু মনে করোনিতো?'
মুখে মিষ্টি হাসি ধরে রেখেই মাথা নাড়াল প্রিয়তা। বলল, 'তোমার শেষ অবলম্বন কী আপু?'
' মানে?' ভ্রুকুটি করে ফেলল জ্যোতি।
' তুমি যা ভাবছো সত্যিই কী তা হয়? এভাবে সারাজীবন একা কাটানো যায়? আজাদ ভাইতো ভীষণ ভালো মানুষ। ওনাকে নিয়ে একটাবার ভেবে দেখা যায়না?'
জ্যোতি নিজের কফি মগটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল, ' জীবনসঙ্গী কাছ থেকে সবাই ভালোবাসা ডিজার্ভ করে প্রিয়তা। আমার সবটুকু ভালোবাসা একমানবেই ফুরিয়ে গেছে।'
•••••••••••
সেদিন সন্ধ্যার পরপরই আমের ভিলার সকলে ফিরে এলো নাজিফাদের বাড়ি থেকে। নাজিফার ভাই-ভাবি এখনো সে বাড়িতে। তাই ওকে এখনো সেখানেই ছেড়ে এসেছে ওরা। আগামীকাল আবার যাবে জ্যোতি। প্রিয়তাও মাঝেমাঝে যাওয়া আসা করবে। সেসঙ্গে উচ্ছ্বাসতো আছেই ওখানে নিয়মিত যাতায়াত করার জন্যে।
নিচে জ্যোতির সঙ্গে বাড়ির সব কাজটাজ গুছিয়ে রুমে এলো প্রিয়তা। এসে দেখল রুমের কাউচটাতে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে রুদ্র। দরজা লক করে আবার পেছন ঘুরল ও। কিন্তু রুদ্রর মধ্যে কোনরকম কোন ভাবান্তর নেই। প্রিয়তা আসছে কী যাচ্ছে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর আর। সেটাই যেন প্রমাণ করতে চাইছে রুদ্র। প্রিয়তা চুপচাপ গিয়ে গিজার অন করল। অতঃপর কাবার্ড থেকে নিজের একটা পোষাক বের ওয়াশরুমে চলে গেল। শাওয়ার নেওয়া হয়নি আজ এখনো। এমনিতেই পৌষ মাস শুরু হয়েছে। বেশি রাত করলে শীত বাড়বে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেশ অবাকই হল প্রিয়তা। রুদ্র তখন ভীষণ মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে ল্যাপটপে। সাধারণত এতো দীর্ঘসময় ল্যাপটপে কাজ করেনা রুদ্র। যদিনা কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকে। আর রুদ্রর গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ মানেইতো সেটা প্রিয়তা অর্থাৎ ওদের দলের বিরুদ্ধে কিছু। এমুহুর্তে তেমন কী করছে রুদ্র? আগামীকাল রাতে আবার মাল আসবে ওদের। তাও বার্মা-নাইন থেকে। এই ডেলিভারিটা সম্পর্কেও রুদ্র আগে থেকে জেনে যায়নিতো সবকিছু? কিন্তু তাতো অসম্ভব! গতকালের ঐ মিটিংটাতে কোথাও কোন ডিভাইস ছিলোনা। আর লোক যারা উপস্থিত ছিল তাদের দ্বারা কোন নিউজ লিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দুশ্চিন্তায় কপাল কুঁচকে উঠল প্রিয়তার। এবারের এই ডেলিভারিটা সাক্সেসফুল হতেই হবে। লক্ষের খুব কাছে আছে ও। জীবনের এতোগুলো বছর বিসর্জন দিয়েছে শুধুমাত্র সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে। শেষমুহূর্তে এসে তা নষ্ট হতে দেবেনা ও। কোনকিছুর বিনিময়েই না। তারজন্যে যদি ওকে খারাপের তলানিতে গিয়েও নামনে হয়তো, নামবে। এসব চিন্তা করতে করতেই প্রিয়তা খেয়াল করল খানিক বাদে বাঁ হাতে নিজের ঘাড়টা হালকা করে চেপে নিচ্ছে রুদ্র। এমনটা রুদ্র তখনই করে যখন ওর ঘাড় ব্যথা করে। ভীষণ স্ট্রেস যায়। কয়েকদিন আগে হলে আনমনেই রুদ্র বলতো, 'প্রিয় এককাপ কফি আনোতো।' কিন্তু এখন! এখন রুদ্র ভুলেও এমন কোন আবদার করবেনা। মাথায় পেঁচানো তোয়ালেটা খুলে ফেলল প্রিয়তা। রুদ্র চাইছেনা তো কী হয়েছে? ও নিজেই কফি করে আনবে। যদিও নিশ্চিত নয়যে ওর হাতের কফি রুদ্র আদোও খাবে কি-না। কিন্তু রুদ্রর মাথায় কী চলছে তা জানার একটা চেষ্টা করা ভীষণ প্রয়োজন এখন।
দরজাটা খুলতে না খুলতেই দেখল জ্যোতি এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। নক করতেই যাচ্ছিল। ট্রেতে দু মগ কফি নিয়ে এসেছে জ্যোতি। প্রিয়তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার দিকে। জ্যোতি মলিন একটু হেসে বলল, ' দেখলাম, সেই আসার পর থেকে রুদ্র আর বের হলোনা ঘর থেকে। বুঝতে পারছিলাম কাজ করছে। আর একটানা এতক্ষণ কাজ করলে রুদ্রর মাথা ধরে, ঘাড় ব্যথা করে। এক কাপ স্ট্রং কফি খাওয়ার আগে ঠিক হয়না তা। তাই...। তাছাড়া তুমিওতো টায়ার্ড হয়ে ওপরে এসেছো।'
মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হল প্রিয়তার। রুদ্রর প্রয়োজন এতোদূর থেকেও কীকরে উপলব্ধি করে মেয়েটা? কেন করে? রুদ্র অন্যকারো জেনেও একতরফা এতো প্রেম আসে কীকরে? কিন্তু ঠোঁটে মিছে এক হাসি ঝুলিয়ে বলল, 'ধন্যবাদ আপু। ভীষণ দরকার ছিল। ভেতর এসো?'
জ্যোতি দৃষ্টি প্রসারিত করে একবার দেখল রুদ্রকে। শ্যামবরণ ক্লান্ত মুখে হালকা ঘাম। সুদৃঢ় বাঁ হাত দিয়ে ঘাড় টিপতে টিপতে কাজ করছে। যেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জ্যোতি বলল, ' এখানে আমার কাজ শেষ। নিচে আরও কাজ আছে। আমি যাচ্ছি।'
বলে আর দাঁড়ালনা জ্যোতি। প্রস্থান করল। সেদিকে দাঁতে দাঁত পিষে তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। লম্বা শ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল। কফি নিয়ে ভেতরে এসে দরজা লক করে দিল আবার। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। প্রিয়তা জানে, রুদ্রর নিয়ন্ত্রণশক্তি প্রখর। বেখেয়ালে কিছু বলে বসবেনা। এই মুহূর্তে বোধহয় প্রিয়তার সঙ্গে কোনরকম কথা বলতেও রাজি হবেনা। কিন্তু প্লাস পয়েন্ট একটাই। প্রিয়তা রুদ্রকে পড়তে পারে। ওর ভাবভঙ্গি, শরিরীভাষা ইত্যাদি দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে রুদ্রর মনে কী চলে। ট্রেটা টি-টেবিলের ওপর রাখল প্রিয়তা। পাশের কাউচটার হ্যান্ডেলের ওপর বসে বলল, 'কফিটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।'
রুদ্র কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। যেন প্রিয়তা নামের কারো অস্তিত্বই নেই এই রুমে। রুদ্রর জীবনেও কী নেই আর? প্রশ্নটা মনে এলেও নিজেকে সামলে নিল। নিজের মগটা হাতে নিয়ে বলল, ' আমি বানাইনি। নিয়েও আসিনি। দেখেছেনইতো রুমে ছিলাম। আপনার জ্যোতি বানিয়ে এনেছে।'
হাত থেমে গেল রুদ্রর। দু সেকেন্ড বসে রইল ওভাবেই। তবে প্রিয়তার দিকে তাকাল না। হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল কফির মগটা। একটা চুমুক দিয়ে পুনরায় কাজে মন দিল। প্রিয়তা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। খানিকটা সময় কেটে গেল এভাবেই। অতঃপর কফির মগের দিকে তাকি মৃদু হেসে প্রিয়তা বলল, ' আপনার জ্যোতি বললাম। রেগে গেলেন না যে?'
এবার কাজ করা থামাল রুদ্র। কফির মগে শেষ চুমুক দিল। ল্যাপটপটা বন্ধ করে বলল, 'রেগে যাওয়ার কিছু নেই। জ্যোতি আমারই। আমার ভীষণ স্নেহের একজন হিসেবে হোক, খুব কাছের বন্ধু হিসেবে হোক, অসময়ের সঙ্গী হিসেবে হোক কিংবা একতরফাভাবে ভালোবেসে যাওয়া একজন হিসেবে হোক; জ্যোতি শুধুই রুদ্র আমেরের। এটা চিরন্তন সত্য।'
বলেই উঠে চলে যাচ্ছিল রুদ্র। হাত ধরে থামিয়ে দিল প্রিয়তা। কফির মগটা রেখে নিজেও নেমে দাঁড়াল হ্যান্ডেল থেকে। রুদ্রকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, 'আর আমি?'
রুদ্র সরাসরি তাকাল প্রিয়তার চোখে। যে চোখ সবসময়ই ওকে দুর্বল করে দিয়েছে। এখনো দিতে চাইছে। ভেতরে ভেতরে কেমন অদ্ভুত কম্পন হচ্ছে ওর। কিন্তু বাহিরে তা বিন্দুমাত্র প্রকাশ পেলোনা। শক্ত গলায় বলল, 'একটা সময় ছিল যখন তোমার মাঝে আমি কেবলমাত্র আমার প্রিয়কে দেখতে পেতাম। যাকে আমি ভালোবেসেছি। যে আমায় ভালোবেসেছিল, আমার পরিবারকে ভালোবেসেছিল। আমার ছন্দহীন, এলোমেলো, প্রেমহীন জীবনে নতুন ছন্দ আর প্রেম নিয়ে এসেছিল। আমের ভিলাকে নিজহাতে ঝলমল করে সাজিয়েছিল। আমার প্রিয়। যে শুধুমাত্র আমার ছিল।'
এইটুকু বলে থামল রুদ্র। নিজের দুর্বল হতে থাকা কন্ঠস্বর জোরপূর্বক দৃঢ় করে বলল, ' কিন্তু এখন তোমার দিকে তাকালে আমি কোথাও আমার প্রিয়কে দেখতে পাইনা। দেখতে পাই রাণী মীর্জাকে, শওকত মীর্জার মেয়েকে, সম্রাট তাজওয়ারের প্রেমিকাকে। এন্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, আমার বাবা আর সন্তানের খুনিকে।'
প্রিয়তা চোখ নামাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'আফসোস হয়? জ্যোতি আপুর বদলে আমায় ভালোবেসেছিলেন বলে?'
'রুদ্র আমের নিজের কোন কাজের জন্যে কখনও আফসোস করেনা। আগেও বলেছি, ভুল আর ব্লান্ডার ছাড়া মানুষের জীবন অসম্পূর্ণ। তুমি আমার জীবনের সেই একমাত্র ভুল, একমাত্র ব্লান্ডার। সেভাবে দেখতে গেলে সত্যিই আমার জীবন পূর্ণ করেছো তুমি।'
শেষ কথাটা বেশ তাচ্ছিল্য করে বলল রুদ্র। ঠোঁটের হাসিটুকু প্রসারিত হল প্রিয়তার, 'ভুলতো শুধরে নেওয়া যায়।'
' সব ভুল শোধরানো যায়না।'
বলে প্রিয়তার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল রুদ্র। প্রিয়তা বলে উঠল, ' যদি আমি মারা যাই?'
থেমে গেল রুদ্র। ভেতরে ভেতরে অজান্তেই এক ধাক্কা লাগল প্রিয়তার বলা ছোট্ট ঐ বাক্যটায়। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নিজের স্ত্রীর দিকে। প্রিয়তা আবার বলল, 'যদি আমি মারা যাই? বিয়ে করবেন জ্যোতি আপুকে?'
' তুমি মারা যাওয়ার পর কী ঘটবে, সেটা জেনে আদোও তোমার কোন লাভ আছে?'
' সবকিছু কী লাভ-লোকসানের হিসেব কষে হয়?'
রুদ্র মৃদু হেসে এক আঙ্গুলে নিজের নাক চুলকে বলল, 'ওয়েল, আমি যতটা জানি তোমার ক্ষেত্রে সবকিছু লাভ-লকসানের হিসেব কষেই হয়। এই যেমন এখন আমার সঙ্গে এতো মিষ্টি-মধুর আলাপ করছো। তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য হল, আদোও আমি কিছু প্লান করছি কিনা জেনে নেওয়া। এম আই রাইট, মিসেস অর্ধাঙ্গিনী?'
বলতে বলতে প্রিয়তার হাতের কবজি ধরে ওর পিঠের মাঝে নিয়ে গেল রুদ্র। মুচড়ে ধরল খুবই ব্যথাতুরভাবে। প্রিয়তা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর চোখে। রুদ্র চোখমুখ শক্ত করে বলল, ' আর বাকি থাকল জ্যোতিকে বিয়ে করার কথা। তারজন্যে তোমার মরার দরকার নেই। তুমি বেঁচে থাকা অবস্থায়, তোমার নাকের ডগা দিয়ে ওকে বিয়ে করতে পারি আমি। বাট এজ আই সেইড বিফর, আমি তুমি নই। তাই প্রতিশোধের জন্যে কারো অনুভূতিকে ব্যবহার করবনা আমি।'
বলতে বলতে ধাক্কা দিয়ে প্রিয়তাকে ছেড়ে দিল রুদ্র, 'আপাতত চোখের সামনে থেকে সরো। আই ডোন অন্না সি ইওর ফেইস।'
প্রিয়তা কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। নিজের মতো আবার কাউচটাতে বসে পড়েছে রুদ্র। হ্যান্ডেলে কুনুইয়ের ভর দিয়ে দু আঙ্গুল চেপে ধরেছে কপালে। চোখ বন্ধ। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ইচ্ছে হলোনা প্রিয়তার। চুপচাপ বেরিয়ে গেল। প্রিয়তা বেরিয়ে যেতেই চোখ খুলল রুদ্র। ধীরে ধীরে ঠোঁটে বক্র হাসি ফুটে উঠল ওর। কাউচে হেলান দিয়ে বলল, 'মাইন্ড গেইম খেলার ভীষণ সখ তোমার তাইনা রাণী মীর্জা? ওকে দেন। লেটস্ প্লেই দ্য গেইম। দেখা যাক মস্তিষ্কের এই খেলায় কে সেরা? তুমি? নাকি, আমি।'
•••••••••••
রুদ্রর ঘর থেকে সোজা ছাদে এসেছে প্রিয়তা। ছাদে আসামাত্র কল করল শওকত মীর্জাকে। শওকত মীর্জা তখন নিজের অফিসরুমে আগামীকালের ডেলিভারির ছকটাকে খুঁটিয়ে দেখছে, কোন লূপহোল আছে কিনা খোঁজার চেষ্টা করছে। ফোনের রিংটোনে মনোযোগ ছিন্ন হলো তার। প্রিয়তার কল দেখে কুঁচকে উঠল ভ্রুজোড়া। মেয়ে তার সহজে কল করেনা। গুরতর কিছু ঘটল নাকি! কালকের ডেলিভারির কোনকিছু মিস হয়ে যায়নিতো! চিন্তিত হয়ে দ্রুত কল রিসিভ করল শওকত। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ' কী হয়েছে? কোন বিপদ?'
একহাতে নাকে নিচটা মুছে নিল প্রিয়তা। চারপাশে অস্থিরভাবে চোখ বুলিয়ে বলল, 'জানি না। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।'
কপালের রেখাগুলো গাঢ় হল শওকতের, 'এমন কেন মনে হচ্ছে?'
' সেটাইতো বুঝতে পারছিনা বাল।'
চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস ফেলল শওকত, ' রাণী! বাবা হই তোমার। বিহেইভ!'
চোখ উল্টে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল প্রিয়তা। নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ' সন্ধ্যা থেকেই খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে রুদ্র। শুধু আজ নয়, কয়েকদিন যাবতই দেখছি। তবে আজকে একটু বেশিই ব্যস্ত আর মানসিকভাবে উত্তেজিত দেখাচ্ছে ওকে। ওর চোখমুখ দেখেই আমি বুঝে গেছি শীঘ্রই বড় কিছু করতে চলেছে। কাল ডেলিভারি আছে। কোনভাবে কিছু জেনে যায়নিতো?'
' কীকরে জানবে? কালকে আমাদের মাঝে হওয়া মিটিংটা সম্পর্কে বাইরের একটা পক্ষীর ও জানা সম্ভব নয় কোনভাবে। ইটস্ ইম্পসিবল।'
মুখ দিয়ে চ বর্গীয় ধ্বনি করল প্রিয়তা, ' ইম্পসিবল শব্দটা রুদ্র আমেরের জন্যে নয় বাবা। ইউ নো দ্যাট। আমার মনে হয় আমাদের লোকেশন আর পাসকোডটা চেঞ্জ করা দরকার।'
শওকত মাথা নেড়ে বলল, ' এইমুহূর্তে সেটা সম্ভব না রাণী। তুমি তা জানো।'
প্রিয়তা রেলিংয়ে হাতের ভর দিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, 'ফাইন! বাট কাল যা করবে খুব সতর্ক হয়ে বাবা। কালকের মালগুলো কোনভাবেই যাতে হাতছাড়া না হয়। এমনিতেই কোন একটা কারণে ওদের বিশ্বাস নড়ে গেছে আমাদের ওপর থেকে। কালও যদি একই ঘটনা ঘটেতো সব শেষ হয়ে যাবে। আর হোমমিনিস্টারের সঙ্গে পার্সোনাল সেই মিটিং ডিপেন্ড করছে এই ডিলটার ওপর। ঐ মিটিংটা করা ভীষণ প্রয়োজন আমার। যেকোন মূল্যে।'
শেষ শব্দদুটো বেশ ভয়ংকর ঠান্ডা গলায় বলল প্রিয়তা। জবাবের অপেক্ষা না করেই কল কেটে দিল। ছোট ছোট তারায় ঝলমল করা বিশাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইল ঠিক সেদিনকার মতো। মনে করতে লাগল রুমে বলা রুদ্রর একেকটা কথা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আনমনেই বলে উঠল, 'এই খেলায় জিততে হলে অনুভূতিকে ব্যবহার আপনাকে করতেই হবে রুদ্র আমের। একবার আমি আপনার সঙ্গে ছলনা করেছি, একবার আপনি আমার সঙ্গে করবেন। আপনি প্রতারিত হয়ে আমায় বন্দি করেছিলেন। কিন্তু যেদিন আমি প্রতারিত হব, সেদিন মুক্তি দেব আপনাকে। চিরমুক্তি!'
•••••••••••
রাত আটটায় মিটিং বসল আমের ফাউন্ডেশনে। সেই পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী চেইক করে নেওয়া হল রুমের প্রতিটা কোণ। অতঃপর প্রত্যেকের শরীর ডিটেক্টর দিয়ে চেইক করে দেখা হল কোন ডিভাইস আদোও আছে কিনা। পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই শুরু হল মিটিং। মিটিংয়ে রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর তিন দলপ্রধানসহ উপস্থিত আছে জয়সহ আরও কয়েকজন সোলার সিস্টেমের সেই বিশ্বস্ত লোক। যারা এতোকিছুর পরেও সোলার সিস্টেম ছাড়েনি। আর আজ পুনরায় সরাসরি আবার সোলার সিস্টেম জয়েন করেছে রঞ্জু। রঞ্জু দেখামাত্র জাফর এবং উচ্ছ্বাস দুজনেই ভীষণ অবাক হল। যদিও রুদ্র বলেছিল, নিজের ব্যক্তিগত কাজে পাঠিয়েছে রঞ্জুকে। উচ্ছ্বাস হেসে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রঞ্জুকে। পেটে মাঝারি গোছের একটা ঘুষি মেরে বলল, 'কীরে শালা! আমিতো ভাবছিলাম তুই মনে হয় টপকাইয়া গেছস। কোন গর্তের থেকে উঠলি?'
রঞ্জু কেবল দাঁত বের করে হেসে বলল, ' ভাই অর্ডার করলে টপকাই যাইতেও আমার আপত্তি নাই উচ্ছ্বাস ভাই।'
গম্ভীর গলায় জাফর জানতে চাইল, 'তা ছিলি কোথায়?'
রুদ্র সাজিয়ে দিয়েছিল উত্তর। তোতাপাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া বুলিটাই আওড়ালো রঞ্জু, ' চিটাগাং।'
সবাই যখন মিটিংয়ের জন্যে প্রস্তুত। তখন মিটিংরুমে প্রবেশ করল রুদ্র। নিজের বরাদ্দ চেয়ারে বসে বলতে শুরু করল, 'রিপন চৌধুরীর কম্পানিটা এফএল গ্রুপ আর মল্লিক ইন্ডাস্ট্রি কিনে চাইছিল। ডিলটা কার সাথে হয়েছে?'
উচ্ছ্বাস বলল, ' এসএল এর সঙ্গে। মল্লিক ব্যাটা বংশগত কিপ্টা। দামে মেলেনি। শালা টাকাই বের করতে চায়না। কী ভয়ংকর পরিশ্রম করেইনা উশুল করেছি কম্পানিটা। শালা পানির দামে কিনতে চায়। এসএল কেই দিয়েছি।'
' টাকা এসেছে?'
' সঙ্গে সঙ্গে একাউন্টে ট্রান্সফার করে ফেলেছি।'
এবার জাফর আমেরের দিকে তাকাল রুদ্র। বলল, 'মিলস্ দুটো বিক্রির টাকাতো চলে এসেছে একাউন্টে। তাইনা?'
জাফর বলল, ' হ্যাঁ।'
হাত বাড়িয়ে রুদ্র বলল, ' ফাইলগুলো দাও। হিসেবগুলো দেখব আমি।'
ফাইলটা এগিয়ে দিল জাফর। ঠোঁটে সদ্য জ্বালানো একটা সিগারেট গুজে ফাইলটা খুলে নিজের চোখের সামনে মেলে ধরল রুদ্র। জাফর একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল রুদ্রর দিকে। মনে হল যেন নিজের ভাইজানকে দেখছে সে। রাশেদ আমের! লোকটাতো একই ভঙ্গিতে, একই দৃষ্টিতে একাজ করতো। একই ভঙ্গিতে ধীরেসুস্থে সিগারেট ছোঁয়াতো পরু ঠোঁটে। ধোঁয়া ছাড়ার ভঙ্গিটাও কতটা এক। দীর্ঘশ্বাস চাপল জাফর। রুদ্র ফাইলের একদম শেষ মাথায় চোখ রেখে বলল, ' লাস্ট সমস্ত মাল বিক্রি, ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, কয়েকজনের কম্পানি সিজিং, মিল বিক্রি এবং লাস্টলি রিপন চৌধুরীর কম্পানি সেইল করার পর আমাদের কাছে এখন আছে চৌদ্দ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।'
উচ্ছ্বাস দাঁত কেলিয়ে বলল, ' মানে বাংলাদেশী টাকায় একশ সত্তর কোটি ছয় লাখ তেতাল্লিশ হাজার নশো টাকা। এই টাকা নিয়া বিদেশ-টিদেশ ভেগে গেলে সারাজীবন বাদশার মতো ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং উঠিয়ে চলতাম। কে খায় ডাইল মাইরি!'
রুদ্র কটমট চোখে তাকাতেই এক ঝটকায় দাঁতগুলো বন্ধ করে ফেলল উচ্ছ্বাস। চোখেমুখে সিরিয়াসনেস নিয়ে এসে বলল, 'তাহলে কোন কোন দলের টাকা শোধ করার কথা ভাবছিস এগুলো দিয়ে?'
রুদ্র সিগারেট ধরা হাতটা একপাশে সরিয়ে নিয়ে বলল, 'ইনড্রা লাইন, বারমা নাইন এবং ব্লাক ডিউন লিমিটেড। এই তিন দলের পাওনা টাকা শোধ করে দাও। আজই। আজ রাত বারোটায় ডেডলাইন ছিল ওদের।' অতঃপর জাফরের দিকে ফাইলটা ফেরত দিতে দিতে বলল, 'ইভেন ওদের শোধ করার পরে আমাদের কাছে অবশিষ্ট থাকে, 1.3 মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ পনেরো কোটি উনআশি লাখ তেতাল্লিশ হাজার সাতশ।'
জাফর স্তম্ভিত হয়ে একবার চোখ বুলাল ফাইলটায়। বাংলাদেশী টাকায় ইনড্রা লাইন পাবে বিয়াল্লিশ কোটি বায়ান্ন লাখ তেত্রিশ হাজার দুইশ। বারমা নাইন পাচ্ছে ছত্রিশ কোটি চুয়াল্লিশ লাখ পঁচাশি হাজার ছয়শো। পঁচাত্তর কোটি একত্রিশ লাখ বিয়াল্লিশ হাজার তিনশ পাবে ব্লাক ডিউন লিমিটেড। এবং অবশিষ্ট টাকার পরিমাণটাও একদম ঠিকঠাক বলেছে রুদ্র। তারমানে সবকিছু গোছানোই ছিল রুদ্রর। গোড়া থেকে পরিকল্পনা করা!
আমের ফাউন্ডেশনে উপস্থিত সকলে হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। মাসখানেক আগেও সোলার সিস্টেমের যে ভয়ংকর অবস্থা ছিল তাতে একটা কম্পানিরও টাকাও যে শোধ করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল ওদের মধ্যে। সেখানে তিন তিনটে কম্পানির টাকা শোধ হয়ে যাচ্ছে! কীকরে! একা কী জাদু করল রুদ্র! হ্যাঁ এটা ঠিক রুদ্র একা কিছুই করেনি। রুদ্রর আদেশ অনুযায়ী সকলেই হাড় কাঁপা খাটুনি খেটেছে এই কদিন। কিন্তু ওরা কেউই জানতোনা কীকারণে কোন কাজটা করছে। শুধু করে গেছে রুদ্রর কথা মতো। আর আজ যখন রুদ্র কনক্লিউশন হাতে ধরিয়ে দিল। রীতিমতো জাদু দেখল ওরা।
ডেডলাইন যত ফুরিয়ে আসছিল কলিজা শুকিয়ে আসছিল ওদের, প্যানিক করছিল, অবশিষ্ট সদস্যদের মধ্যেওতো দুএকজন পালালো বিদেশি উগ্র দলগুলোর হাতে প্রাণ দেওয়ার ভয়ে। যেকজন আছে, কেবল আর কেবলই রুদ্রর ভরসায়। সেখানে এই লোকটা, সব চেয়ে বড় বিপদের খাড়া যার গলাতে ঝুলে ছিল; ঠিক কতটা ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ঘটিয়েছে, একটার পর একটা ধাপ সাজিয়েছে চিন্তা করেও ভেতরটা শিরশির করে উঠল সকলের। একটা মানুষ এতোটাও শান্ত ভয়ংকর হতে পারে তা রুদ্র আমেরকে না দেখলে বোঝা সম্ভব না।
ঘরের স্তব্ধ নীরবতা ভেঙ্গে উচ্ছ্বাস বলল, 'ওদের লোককী আসছে? পেমেন্ট হবে কীভাবে?'
রুদ্র সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুজতে গুজতে জবাব দিল, 'ইনড্রা আর বার্মাকে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে পাঠিয়ে দে। বিশমিনিট এর মতো লাগবে ব্লকচেইন আনলক হতে। ব্রাক ডিউন লিমিটেডের লোক আসছে অলরেডি। দশটায় লোকেশন জানাব আমি তোকে। সঙ্গে রজ্ঞুসহ কিছু লোক আর প্রপার আর্মড প্রটেকশন নিয়ে যাবি। কোড আমি কলে জানিয়ে দেব।'
উচ্ছ্বাস একপলক তাকাল রঞ্জুর দিকে। মাথা ঝাঁকিয়ে শায় দিল রঞ্জু। কিন্তু জাফর তখনও চিন্তিত। মুখে হতাশ ভাব করে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ' কিন্তু ইনড্রা, বার্মার আগে বল্ক আর্মেক্স আর গোল্ডেন কস্ট আর্মসের টাকাগুলো শোধ করে দিলে ভালো হতো না? ওরা ডেডলাইন একটু বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ডেডলাইন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাবা বসাবে। একবারে গোড়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে আমাদের।'
গম্ভীর হয়ে উঠল উচ্ছ্বাসের চোখমুখও, 'ভুল বলেনি কাকা। ভুলে যাসনা রুশ আর আফ্রিকান ওরা। ভয়ংকর! একজন একজন করে ছিড়ে ফেলবে।'
অথচ চিন্তার লেশমাত্র দেখা গেলোনা রুদ্রর মুখমন্ডলে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হেলান দিয়ে দিল চেয়ায়ে। আঙ্গুলে ধরা কলমটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ' জাস্ট কিপ ডুইং এজ আই সে। ভুলে যেওনা বড়সর একটা হোঁচট খেয়ে গেলেও মানুষটা আমি রুদ্র আমেরই আছি।'
কিছুক্ষণের জন্যে স্তব্ধতা নেমে এলো ঘরটাতে। অতঃপর বাকি সদস্যদের ছোটখাটো আরও কিছু কাজের নির্দেশনা দিয়ে বিদায় দিল রুদ্র। রয়ে গেল কেবল উচ্ছ্বাস, জাফর। দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু আর জয়ও। জাফর গলা ঝেড়ে বলল, 'সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু ব্লাক ডিউন লিমিটেড এর টাকাটা শোধ হয়ে গেলেতো মানি লন্ড্রিংটা প্রপারলি শুরু করা যায় আবার। এন্ড ইকোনোমিকালি এটা খুবই দরকার। আমাদের দলটাকে সাজানোর জন্যে। দুবাইতো গিয়েছিলি তুই। কথা হয়েছিল নিশ্চয়ই ওদের সাথে?
জবাব দিলোনা রুদ্র। গম্ভীর মুখ করে আরেকটা সিগারেট জ্বালালো। জয় আর রঞ্জু বেরিয়ে গেল। বাইরে অপেক্ষা করবে উচ্ছ্বাসের। উচ্ছ্বাস একপলক তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র পূর্বের পরিকল্পনা ছিল এইসব ঝামেলা শেষ করে তুলে ফেলবে সোলার সিস্টেম। নিজের স্ত্রী পরিবার নিয়ে আলাদা কোথাও চলে যাবে। বাকি জীবনটা শুধু পরিবার নিয়ে কাটাবে। ঝামেলাহীন, বাঁধাহীন, সুখী জীবন। কিন্তু বর্তমানে রুদ্রর মাথায় ঠিক কী চলছে জানা নেই উচ্ছ্বাসের। বোধহয় এক আল্লাহ আর রুদ্র ছাড়া কারোরই জানা নেই।
••••••••••
চট্টগ্রাম। পৌষের রাত, জানুয়ারির তিন তারিখ। ভোর তখন চারটা। কনকনে শীত, আর ঘন কুয়াশায় ঘেরা। শরীরে কাঁটা দেওয়া শীতল বাতাস। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি, দক্ষিণ দিক ঘেষে পরিত্যক্ত একটা কন্টেইনার ইয়ার্ড। জায়াগাটা আক্ষরিক অর্থেই পরিত্যক্ত। এখানে মানুষের যাতায়াত নেই, কেউ সেভাবে নামও নেয়না, আর না আছে কোন পরিচয়। সেখানে এসে পৌঁছেছে ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোলের লোকেরা। আজকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করে এসেছে ওরা। তারসবচেয়ে বড় প্রমাণ, দলপ্রধানদের সকলেই আজ উপস্থিত হয়েছে এখানে। ভারী অস্ত্র, ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ আর হঠাৎ আক্রমণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আজ মাঠে নেমেছে ওরা। আজ কোনভাবেই মাল হাতছাড়া করবেনা। সেবিষয় বদ্ধপরিকর প্রতিটা সদস্য। তবে শওকত মীর্জা এবং করিম তাজওয়ার স্পটে নেই। কিন্তু কাছাকাছিই একটা ঘাটিতে বসে আছে দুজন। এমনকি চট্টগ্রাম আছে স্বয়ং রাণী মীর্জাও। আজ সকালেই নিজের মতো ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিল ও। এখন আশেপাশেই আছে কোথাও একটা। তবে কোথায় আছে, সেটা জানেনা কেউ।
অনেক বড় দল নিয়ে আসলেও ইয়ার্ডের ভেতরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল মাত্র চারজন। সম্রাট, শান, সাজ্জাদ আর সজল। তবে বাকিদের চারপাশে দৃঢ় পাহাড়ায় বসিয়ে দেওয়া হল। ভেতর থেকে যদি অ্যাটাক করে কেউ মাল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করে। বের হওয়ার কোন রাস্তা খুঁজে পাবে। সে বিষয়টা নিশ্চিত করতে দুপাশে দুজন স্নাইপারও বসিয়ে রেখে ওরা।
সবকিছু সেটআপ করে ইয়ার্ডের ভেতরে প্রবেশ করল চারজন। সবার গায়ের ভারী গরম কাপড়। হুডি দিয়ে মাথা ঢাকা। প্রায় চার-পাঁচ একর জমি নিয়ে তৈরী হয়ে ইয়ার্ডটা। ভেতরে প্রায় ভূতের মতো পর আছে মরিচা ধরা কয়েকশ কন্টেইনার। সবগুলোই রঙচটা, অনেক জায়গায় ইংরেজি আর বার্মিজে লেখা ছেড়া স্টিকার। মাটি ভীষণ কর্দমাক্ত। তার ওপর কোন কোন জায়গা রাবার বুটের ছাপ আছে। কোথাও কোথাও টানা রক্তের শুকিয়ে যাওয়া দাগ। আশেপাশে ধ্বসা দেয়াল। দূর থেকে ভেসে আসছে ক্রেন আর ট্রলারের শব্দ। কোথাও কোথাও দুএকটা লাইট জ্বলছে টিমটিম করে। ভেতরে ঢুকলেই কেমন অস্থির লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে। সেসব পেরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পৌঁছল ওরা চারজন। দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখে নিল একবার। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাঁপছে ওরা। একটু পরপর ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া বের করছে মুখ দিয়ে। হাতের তালু ঘষে ঘষে উষ্ণ রাখছে নিজেদের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন কুয়াশা ভেদ ইয়ার্ডে ঢুকল ধূসর রাঙা ট্রেইলার। যার সঙ্গে সংযুক্ত আছে প্রায় চল্লিশ ফুটের একটা কন্টেইনার। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সম্রাট এবং শানের। সেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করে একে অপরের দিকে তাকাল ওরা। ট্রাক থেমে ইঞ্জিন বন্ধ হল। দুজনেই প্রায় দ্রুতকদমে গিয়ে পৌছলো কন্টেইনারের কাছে। শান ওয়াকিটকিতে ভ্যারিভাই করে নিল কন্টেনার, ' ট্রান্সফার ভেরিফায়েড। 40-B9 কন্টেইনার, পাসকোড, *****। উই আর গোয়িং টু ওপেন দিস্।'
সম্রাট ভারী লকটা একবার চেক করে নিল। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছে ও। কী-প্যাডে কোড বসাল দ্রুতহাতে। কিন্তু ওকে চমকে দিয়ে স্ক্রিনে ইংরেজি বর্ণে লেখা উঠল, ' ACCESS DENIED- Code Already Redeemed.'
হতবাক চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে সম্রাট আর শান। সম্রাট বলল, ' মাদারচোদ ইয়ার্কি হচ্ছে!'
পেছন থেকে সজল বলল, ' ভাই মনে হয় কোড ভুল হইছে।'
ধমকে উঠল শান, ' চুপ কর বাস্টার্ড। ভুল হইলে রং দেখাইতো। পাসকোড অলরেডি কেউ ব্যবহার করে ফেলেছে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? পাসকোডটাতো লিক হওয়া কোনভাবেই_'
ঠিক তখনই স্ক্রিনে ভেসে উঠল, 'CODE** Redeemed 3:40AM — Verified by Priority Clearance.'
পায়ের তলা থেকে মাটি সর গেলো ওদের। দু'কদম পিছিয়ে গেল শান। অস্ফুট স্বরে নিল রুদ্রর নাম।
' বাইনচোদের বাচ্চা!' রুদ্রকে গালিটা দিতে দিতেই সম্রাট প্রায় দৌড়ে গেল পেছনের দরজায়। দ্রুত হাতে খুলে দেখল। ফাঁকা! কিচ্ছু নেই সেখানে। দম আটকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল সম্রাট। শানও এলো। এই দৃশ্য দেখে শরীর খারাপ লাগতে শুরু করল ওর। কী হয়ে গেলো এটা! সাজ্জাদ আর সজল প্রায় জমে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে সাদা একটা কাগজ দেখতে পেল শান। কম্পমান হাতে তুলে নিল সেটা। আস্তে আস্তে খুলল। কিন্তু অতো ধৈর্য্য হলোনা সম্রাটের। হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিল সেটা। চোখ বোলানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখ ভয়ঙ্কর লাল হয়ে উঠল ওর। প্রচণ্ড আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠল। পরপর দুটো লাথি বসাল কন্টেনারে। শান বিরক্ত হয়ে টেনে নিল কাগজটা। ভেতরে চকচকে কালো অক্ষরে লেখা আছে,
' কনগ্রাচুলেশনস্ । দ্বিতীয়বারের মতো সফলতার সঙ্গে মাল হাতছাড়া হল তোমাদের। তৃতীয় বারের জন্যে শুভকামনা রইল। কারণ তারপর আমার লক্ষ্য তোমাদের অস্ত্র নয় প্রাণ হবে।
- রুদ্র আমের'
••••••••••••
ইয়ার্ডটার থেকে এক কিলোমিটারের মতো দূরে তাবু গেড়েছে শওকত মীর্জা আর করিম তাজওয়ার। ভেতরে কয়েকটা মশাল জ্বালিয়ে হলদেটে আলো করে নিয়েছে। সেখানেই অল্প, অল্প মদ খেতে খেতে এতক্ষণ সময় কাটাচ্ছিল তারা। ভেতরে ভেতরে মারাত্মক টেনশন। এইমুহূর্তে প্রিয়তার সঙ্গে লাইনে আছেন শওকত মীর্জা। ফোনের ওপাশে একটা আপডেটের জন্যে অস্থির হয়ে আছে প্রিয়তা। শওকত বললেন, 'তুমি চিন্তা করোনা এতো। ঠিকই আছে সব। এখন আছো কোথায়?'
প্রিয়তা কিছু বলার আগেই বেজে উঠল করিমের ফোন। সম্রাটের কল! দেখার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে নিল করিম, 'হ্যাঁ বল।'
কিন্তু ওপাশ থেকে সম্রাট যা জানাল তাকে রক্তশূন্য হয়ে গেল করিমের চেহারা। কেঁপে উঠল সারা শরীর। ফোনটা হাত থেকে খসে পড়তে পড়তে পড়ল না। করিম স্তম্ভিত অবস্থায় তাকিয়ে বলল, ' মালগুলো নেওয়াতো দূর। চোখেও দেখতে পায়নি ওরা। তার আগেই নিয়ে গেছে রুদ্র আমের।'
চমকে তাকাল শওকত মীর্জা। ফোনের ওপাশ থেকে সবটাই শুনতে গেল প্রিয়তা। আফসোসে চোখ বুজে ফেলল ও। রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ' আমি বলেছিলাম কিছু একটা ঘটবে। শোননি আমার কথা।'
থতমত খেয়ে গেল শওকত। এমুহূর্তে ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। বস্তুতপক্ষেই যেন বোকা বনে গেছে সে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠল প্রিয়তা। দৃঢ় কন্ঠে বলল, 'ড্রাইভার! ট্রেইলারের ড্রাইভারকে ধরতে বলো। ফাস্ট!'
কিছুক্ষণের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে যেন শওকত। মেয়ের নির্দেশ শুনে অদ্ভুতভাবে তাকাল করিমের দিকে। করিম শুনেছে সবটাই। সময় নষ্ট করল না সে। সম্রাটকে চিৎকার করে বলল, ' ড্রাইভারটাকে ধরে আন এখানে। দ্রুত!'
•••••••••••••
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেশ খানিকটা দূরের রাস্তা। এ মুহূর্তে নির্জন। একটা মানুষ বা কিংবা গাড়ির নামগন্ধ নেই এদিকে। দুপাশে ঘন জঙ্গল। ঘন কুয়াশা আর জমিয়ে দেওয়া ঠান্ডা। তারমধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে রুদ্রর সেই জীপ। মাঝারি গতি। নেই কোন তাড়া, কোন উত্তেজনা। কালো জ্যাকেটের ওপর দিকে গলায় পড়ে থাকা লকেটটা বেরিয়ে আছে। যেটা ওর মা ওকে দিয়েছিল। সেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু একটু হাসল রুদ্র। পুনরায় মনোযোগ দিল গাড়ি চালানোতে। তখনই ভাইব্রেট করে উঠল পকেটে থাকা ফোনটা। ব্লুটুথ কানেক্ট করল রুদ্র। গম্ভীর গলায় বলল, 'হ্যালো?'
' বাইকের ওপর হেলেই আছি। আর হেলতে পারতাম না। কই আছিস তুই? কথা নেই, বার্তা নেই চট্টগ্রাম তুলে নিয়ে আসলি। ভাবলাম আগেরবারের মতো মিশন আছে। কী সুন্দর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। শালার, এইখানে বইসা মশা মারতেছি। কাহিনী কী বলবি?' একটানে কথাগুলো বলল উচ্ছ্বাস। ভীষণ বিরক্ত সে।
রুদ্র বলল, ' মিশনেই ছিলাম। কাজ শেষ। তোকে এনেছিলাম ব্যাকআপ হিসেবে। লাগেনি। এখন যেখানে আছিস ওখানেই থাক চুপচাপ। আমি আসছি।'
' তুই কোথায় সেটা বল।'
নিজের লোকেশন বলল রুদ্র। কল কাটার আগে বলল, ' টেনশনের কিছু নেই। আসছি।'
•••••••••••
তাবুর মধ্যে ড্রাইভারের গগনবিদারী আর্তনাদ আর আশপাশ থেকে ভেসে পশু-পাখির হুংকারের কারণে আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। এতক্ষণ অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে ড্রাইভারের ওপর। কাজটা করেছে শওকত আর সম্রাট। করিম তাজওয়ার ছিল দর্শক। শান বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ওসব দেখার ইচ্ছে তার নেই। এতক্ষণের টর্চারে জানতে পারা গেছে ড্রাইভারটা আসলে রুদ্রর এজেন্ট। রুদ্রর কথাতেই সে সময়ের আগের রুদ্রকে কন্টেইনারের কাছে আসতে সাহায্য করেছে। তবে পাসকোডটা রুদ্র কীকরে জানে সেটা কোনভাবেই বের করা যাচ্ছেনা। একটা একটা করে হাতে পায়ের সবগুলো নখ তুলে ফেলা হল, হাতে পেরেক বসিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু লাভ হচ্ছে না কোন। প্রিয়তা ফোনের ওপাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, 'হয়েছে! ওসব জানেনা ও। জিজ্ঞেস করো রুদ্র কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এখন। ফাস্ট!'
এবার শওকত এসে বসল ড্রাইভারের সামনে। চুলের মুঠি ধরে বলল, 'কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে?'
লোকটা কাতরাতে কাতরাতে বলল, ' জানি না!'
হঠাৎই ব্যাটরি চালিত ড্রিলারটা অন করে লোকটার পায়ে বসিয়ে দিল শওকত। চারপাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করল লোকটা। জীবনে এমন যন্ত্রণার কথা কল্পনাও করেনি ও। চোখ দিয়ে যেন রক্ত উঠে আসবে। রক্তের ছিটা এসে লাগছে শওকতের চোখেমুখে। করিম বলল, 'বল শুয়োরের বাচ্চা! কোনদিক দিয়া যাচ্ছে? বল?'
ড্রাইভার জানে একথা। রুদ্র বলেছিল সব গুছিয়ে বলার সময়। এই ভয়ংকরের চেয়েও বেশি ভয়ংকর যন্ত্রণা সইতে পারল না সে আর। বলে ফেলল কোনদিক দিয়ে যাচ্ছে রুদ্র। প্রিয়তাকে জানাতেই যাচ্ছিল শওকত। তার আগেই প্রিয়তা বলল, ' শুনেছি। তোমরা এখন রওনা দিলেও কিছু করতে পারবেনা। আমি দেখছি।'
প্রিয়তা এতক্ষণ নিজের ইয়ামাহা এমটি-১৫ বাইকের ওপর বসেই কথা বলছিল শওকতের সঙ্গে। এক মুহূর্তও দেরী করল না ও আর। সঙ্গে সঙ্গে নিজের হেলমেটটা পড়ে নিল মাথায়। চালু করল ইঞ্জিন। চোখেমুখে অদ্ভুত এক রাগ, জেদ, আক্রোশ দেখা যাচ্ছে ওর। শরীর কাঁপছে সেই জেদে। থ্রটল ঘুরিয়ে নিজের সেই জেদের বহিপ্রকাশ ঘটাল ও।
•••••••••••••
এদিকে প্রিয়তা কল কাটার সঙ্গে সঙ্গেই চলমান ড্রিলারটা সোজা ড্রাইভার গলায় বসিয়ে দিল শওকত। কিছুক্ষণ গোঁ গোঁ আওয়াজ করে স্থির হয়ে লোকটা। থকথকে একগাদা রক্ত ছিটকে এলো শওকতের মুখে। করিম অনেকটা থ মেরে গিয়ে দেখল এই দৃশ্য। একি বিভৎস মানুষ! কিছুটা ভড়কে গেছে সম্রাটও। তবে সামলে নিলো নিজেকে। শওকত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পানির ঝাপটা দিল মুখে। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে তার। এইমুহূর্তে আর খুন আরও রক্ত ঝড়াতে পারলে শান্তি পেতো। ঐ রুদ্র আমেরকে কুঁচিকুঁচি করে কাটার জন্যে সমগ্র সত্তা যেন ছটফট করে উঠল শওকত মীর্জার।
কিন্তু সম্রাট এদিকে চিন্তিত অন্যবিষয়ে। রাণী কোথায় গেছে? রুদ্রকে আটকাতে? ও একা কীকরে আটকাবে? রুদ্র যদি রাণীর কোন ক্ষতি করে দেয় তবে?
••••••••••
বেশ অনেকটা সময় যাবত জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে কুয়াশা ভেদ করে যাচ্ছে রুদ্রর জীপটা। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মেইনরোডে পৌঁছনোর কথা। এদিকে আকাশে অর্ধ চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। তাতেও খানিকটা আলোকিত হয়েছে রাস্তা। আরেকটু এগোতেই তিন রাস্তার একটা মোড় দেখতে পেল রুদ্র। সোজা যাবে ও। কিন্তু ঠিক তখনই প্রচণ্ড স্পিডে একটা ম্যাট কালো রঙের বাইক চলে এলো রুদ্রর জীপটার সামনে। খুবই নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘুরে পথ আগলে দাঁড়াল রুদ্রর। বাধ্য হয়েই জীপটা থামাতে হল রুদ্রকে। ভ্রু কুঁচকে ঠিক করে একবার দেখল সামনে। দেখামাত্র কোঁচকানো ভ্রু সোজা হয়ে উঠল ওর। মৃদু হাসি ফুটল ঠোঁটে। এটাযে তার তথাকথিত অর্ধাঙ্গিনী তা বুঝতে সময় লাগল না।
পা উঁচু করে ঘুরিয়ে বাইক থেকে নামল প্রিয়তা। হেলমেটটা খুলতেই পিঠের নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল চুলগুলো। বাক্যব্যয় করল না ও। হোলস্টার থেকে নিজের বেরেটা বের করে সোজা তাক করল রুদ্রর দিকে। অনেক চেঁচিয়ে বলল, ' নেমে আসুন।'
রুদ্রর ঠোঁটের হাসিটুকু সরল না। অনেকটা আলসেভাবেই বেরিয়ে এলো জীপ থেকে। এগিয়ে জীপের সঙ্গে হেলান দিয়ে দেখল প্রিয়তাকে। সেই পরিচিত পোশাক। কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স, কালো টিশার্ট। রুদ্র বলল, ' হঠাৎ মাঝরাস্তায় তোমার বন্দুক যুদ্ধ করার ইচ্ছা হল কেন?'
' মালগুলো কোথায় আছে রুদ্র?'
রুদ্র অবাক হওয়ার ভান করে বলল, 'মাল? কীসের মাল?'
দাঁতে দাঁত পিষল প্রিয়তা। সেইফটি ক্যাচ অফ করে দিয়ে বলল, ' নাটক করবেন না। এখন আপনার কোন নাটক দেখার সময় আমার হাতে নেই। ঐ মালগুলো লাগবে আমার। কোথায় আছে? কোন রুট দিয়ে যাচ্ছে বলুন।'
হেসে ফেলল রুদ্র। বুকের ওপর হাত ভাজ করে বলল, 'যদি না বলি?'
জোরে চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়তা। অদ্ভুতরকম হিংস্র হয়ে উঠছে ওর চোখমুখ। যেন অন্যকোন ব্যক্তিত্ব পুরোপুরি গিলে ফেলছে ওর আরেক ব্যক্তিত্বকে। চোখে আগুন নিয়ে প্রিয়তা বলল, ' আমায় বাধ্য করবেন না রুদ্র। আমি চাইনা আপনাকে আঘাত করতে। ডোন্ট মেইক মি টু ডু দিস। এই মালগুলো আমার চাই! সেটা যদি আপনার প্রাণের বিনিময়েও হয়, তবে তাই। আই নিড দ্যট ব্লাডি আর্মস ড্যাম ইট!'
রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল প্রিয়তার বদলাতে থাকা মুখভঙ্গি। এই সেই মেয়ে যার সঙ্গে ও দু'বছর সংসার করেছে। প্রতিটা রাত বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছে! এই মেয়েটার গর্ভে ওর বাচ্চা ছিল!
প্রিয়তা আবার চেঁচিয়ে উঠল। প্রচণ্ড রাগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরেকটা বাইক এসে উপস্থিত হল ওখানে। রুদ্র-প্রিয়তা দুজনেই চমকে তাকাল সেদিকে। বাইকটা রুদ্রর জীপের সামনেই থামল। প্রায় ঝড়ের গতিতে খুলল হেলমেটটা। উচ্ছ্বাস! এইমুহূর্তে উচ্ছ্বাসকে এখানে দেখে রুদ্র আর প্রিয়তা দুজনেই অবাক হয়েছে। থ হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছে উচ্ছ্বাস নিজে। প্রায় হা করে তাকিয়ে আছে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়তার দিকে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ও রুদ্রর পাশে এসে দাঁড়াল। রাগে এখন গা জ্বলছে রুদ্রর। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্ছ্বাসকে বলল, ' তোকে বলেছিলাম না ওখানেই ওয়েট করতে?'
উচ্ছ্বাস তখনও বিস্ময়ে প্রিয়তার দিকে চেয়ে থেকেই বলল, 'মিশনে আছিস। দেরী হচ্ছে এতো। স্বস্তি নিয়ে বসে থাকা যায়?'
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলর রুদ্র। উচ্ছ্বাসের এখানে আসাটা অনেক বড় বিপদ নিয়ে এলো। এরকম ভয়ংকর মুহূর্তে মজা করা কেবল বেমানান নয়, উদ্ভটও বটে। কিন্তু নিজের চিরকালীন স্বভাব ত্যাগ করতে পারল না উচ্ছ্বাস। চোখ ঝাঁপটা দিয়ে বলে উঠল, 'এ ভাই, তোর বউয়ের মতো ক্যাডা জানি কালো জ্যাকেট গায়ে দাঁড়াইয়া আছে। হাতে আবার পিস্তল। এই দুইটা জিনিস না থাকলে পুরাই তোর বউ।'
রুদ্র গম্ভীর গলায় জানাল, ' ওটা আমারই বউ।'
গা শিরশির করে উঠল উচ্ছ্বাসের। এতক্ষণ মজা করলেও এবার চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। বিস্ময় পা থেকে মাথা অবধি একবার দেখল মেয়েটাকে। অস্পষ্ট করে বলল, 'বউমণি!'
এবার নিজের পিস্তলটা সোজা উচ্ছ্বাসের মাথা বরাবর ধরল প্রিয়তা। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, 'মালগুলো আমায় দিয়ে দিন রুদ্র। নয়তো আমের পরিবারের আরেকটা মৃত্যুর জন্যে দায়ী হবেন আপনি।'
রুদ্র চোখমুখ শক্ত করে ফেলল। তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। উচ্ছ্বাস চোখে তখনও বিভ্রম, অবিশ্বাস, বিস্ময় নিয়ে রুদ্রকে বলল, 'এটা সত্যিই বউমণি?'
'হুঁ।' ছোট্ট করে জবাব দিল রুদ্র।
' সত্যি সত্যিই গুলি চালাবে?'
' এতক্ষণ নিশ্চিত ছিলাম চালাবেনা। কিন্তু এখন জানি না।'
প্রিয়তা হুংকার দিয়ে বলল, ' রুদ্র! ভুলে যাবেন না আমি প্রিয়তা নই, রাণী মীর্জা। আপনার বাবাকে খুন করতে পেরেছি, উচ্ছ্বাসকে খুন করতে অসুবিধা হবে না আমার। আপনি আপনার পিস্তল বের করার আগেই ওকে আমি শেষ করে দিতে পারব।'
রুদ্র তখনও কেবল তীক্ষ্ম চোখেই তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। কিছু বলছে না, নড়ছেও না। শুধু ডান হাতটা ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছে পেছন দিকে। প্রচন্ড উত্তেজিত থাকায় এবং দুজনের ওপর চোখ থাকায় তা খেয়াল করছে না প্রিয়তা। রুদ্রকে চুপ থাকতে দেখে প্রিয়তা বলল, 'বাধ্য করলেন আমাকে।'
গুলির বিভৎস এক আওয়াজে কেঁপে উঠল চারপাশটা। ঝাঁকি খেয়ে উঠল উচ্ছ্বাসের শরীর। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নড়তেও পারল না বিস্ময়ে। কেমন অদ্ভুত স্তব্ধতা আর ঝিঁঝিঁ আওয়াজ চারপাশে। অতঃপর ধীরে ধীরে তাকাল বাঁপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রর দিকে। বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখমুখ শক্ত, নির্বিকার। হাতে ধরা বন্দুকের নলের মুখ দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঝট করে সামনে তাকাল উচ্ছ্বাস। প্রিয়তার বেরেটাটা খসে পড়ে গেছে হাত থেকে। জগত সুন্দর চোখ দুটো বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে স্বামী রুদ্র আমেরের দিকে। ধীরে ধীরে সেই চোখ ভারসাম্য হারাতে শুরু করল, তারপর শরীর। একবার হতবাক হয়ে নিজের শরীর থেকে ঝড়তে থাকা রক্ত দেখল প্রিয়তা। পুনরায় বিস্ময়ে তাকাল শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকা নিষ্ঠুর পুরুষটার দিকে। অতঃপর আস্তে করে ঢলে পড়ল রাস্তার ওপর। বন্ধ করে ফেলল চোখজোড়া।
উচ্ছ্বাস চিৎকার করে উঠল, 'বউমণি!'
.
.
.
চলবে.......................................................................