নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ১৯ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


দু বোনের আলাপে কাঁচুমাচু মুখে বসে আরিফা। মা রাহেলা বানু একপ্রকার ক্ষোভ ঝাড়ছে খালা রেবেকা বানুর উপর। ভদ্রমহিলা থমথমে মুখে বসে আছেন। আরিফা আড়চোখে তাকায় খালার পানে। ভদ্রমহিলা দেখতে বেশ। হাতে মুখে গলায় সর্বত্রই আভিজাত্যের ছোঁয়ায় যেন কোনো রানী মা। রেবেকা খালাকে মনে নেই খুব একটা। সেই ছোটবেলায় দেখেছিল একবার। বাবা মারা যাবার পর আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়ার সাথে সাথে আত্নীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক গুলো কেমন ভাটা পড়েছে। কারো সাথে দেখা হলেই কেমন পালাই পালাই করে। ভাবটা এমন ওদের কাছে হাত পাততে গেছে।

" রিফা চল? এখনি বাড়ি ফিরবো। ঝড় বৃষ্টি কিছুই না। রানীর হাল থাইক্যা মুখ থুবড়ে পড়ছি তয় এভাবে কেউ অপমান করে নাই। মায়ের পেটের বোন হইয়া এমন অপমান করতে পারলো? আমি কি ওর হাতে পায়ে ধরছিলাম? নিজেই ফোন দিয়া অনুনয় বিনয় করলো। ওহন ত্যাজ দেখাই তেছে।"

মায়ের কর্কশ গলায় আরিফা কেঁপে ওঠে। সাথে লজ্জায়ও পড়ে। মা এভাবে বলছে কেন? রেবেকা বানু বোনের হাত ধরে করুন গলায় বলে,

" বুবু তুমি কষ্ট পাইও না। আমি কি জানতাম কও পেটের পোলা ওমন ধারার হইবো? কোনকার ফকিন্নীর ঝিয়ের জন্যে মায়ের সাথে দূর্ব্যবহার করবো? আমি সত্যিই লজ্জিত বুবু। তুমি আইছো ক'টা দিন থেকে তারপর না হয় যেও?"

রাহেলা বানু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। ভাব এমন যেন অভিমান করেছে। তবে মনে মনে ভাবনা উদয় হয় আরেকটু জোর করলে থেকে যাবে ক'দিন। রেবেকা বানু বড় বোনকে নিরাশ করে না। মানিয়ে নেয় কথার জালে। রাহেলা বানু হেসে ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে। দরজার দিকে একপল তাকিয়ে বলে,

"তুই কি সত্যিই মাইনা নিবি রিজ যারে বিয়া করবো?"

" কক্ষনো না বুবু।"

"তাইলে কি করবি?ওই মাইয়ারে যাইয়া হুমকি ধামকি দিবি?"

"কিছুই না। যেখানে নিজের ছেলেই বেঁকে গেছে অন্যেরে ধমকে কি হবে? আমি কিছুই করবো না। করুক যার যা ইচ্ছা। আজকালকার ছেলেদের বউ পেলে মা'কে দরকার পরে না।"

কন্ঠে আক্রোশ অভিমান দুটোরই মেলা বন্ধন। রাহেলা বানু আলাপকাল চালিয়ে যায়। রেবেকা বানুও বোনের কাছে সংসারের সুখ দুঃখের মাদুর পেতে দেয়। রাহেলা বানুর ওতশত মনোযোগ নেই। নিজেই দুঃখের অতলে ডুবে সেখানে অন্যের দুঃখে ভরা কাহিনী বড্ড পানসে লাগে। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

" দুই ভাই এক মাইয়ার জন্য পাগল হইলো ভাবা যায়! রিজ বাবা না হয় ওই মাইয়ারে বিয়া কইরা নিলো। রশুনের কি হইবো?"

পূর্বের আলাপে অনিহা দেখালেও এ যাত্রায় আরিফা যেন কৌতুহল খুঁজে পেলো। আম্মা রশুন বলতে রওশন ভাই নামক লোকটাকে বুঝিয়েছে যা না বোঝার অবকাশ নেই। সে কান খাঁড়া করে। খালার জবাব যুৎসই না হলেও মায়ের পাল্টা প্রশ্নে আরিফা লজ্জায় মিশে যায়।

"বলি কি ওই রশুনের লগে আমার রিফার বিয়ার কথা কওন যায় না? আমার রিফা কিন্তু রূপে গুনে কম না! তোর ছোট জায়ের চাওয়া পাওয়া থাকলেও পূরণ করবার পারুম। রিফার আব্বায় দুই লাখ ব্যাংকে রাইখা গেছে। আরিফ বা কেউ জানে না এ সম্বন্ধে শুধু তোরেই কইলাম!"

রাহেলা বানু রয়ে সয়ে কথা পাড়ে। মেয়েটাকে একটা ভালো শিক্ষিত ঘরে দিতে পারলে তিনি হাঁফ ছাড়বেন। লজ্জায় আরিফার চোখের কোণায় পানি জমে। নজর লুকিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। আম্মা এতোটা ছ্যাবলামি কবে শিখলো? ছোটবেলায় একবার পাশের বাড়ির কাকির তেলে পিঠা ভাজা দেখে এসে মা'কে বলেছিলো, 'ওই পিঠা খাবে'। মা সেদিন কাঁচা কুঞ্চি ভেঙেছিল পিঠে। কারণ টা এই, ' তেলে পিঠা খাবো বানিয়ে দিও!' না বলে, ' ওই কাকির পিঠা খাবো' কেন বলেছে? আর সেই মা কি না! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। মাটিতে মিশে যেতে না পারলেও মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে আরিফা। হালকা ব্যাথা পায় কনুইয়ে। কনুই ডলে ব্যাথাতুর চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে চায় মানুষটার পানে।

রওশন হাত বাড়িয়ে দেয়। স্বল্প পরিচিত মেয়েটার চোখে অশ্রু কণার আবির্ভাব দেখে কোমল গলায় শুধায়,

" ঠিকাছো তুমি?বেশি চোট লাগে নি তো?"

আরিফা, রওশনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকায়। পরপুরুষের হাত ধরার মানেই হয় না। সে নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালো। 

" না না। লাগে নি চোট। ঠিকাছি আমি! স্যরি ভাইয়া।"

বলতে বলতেই যেন লজ্জায় নুইয়ে যায়। মাথা হতে পড়ে যাওয়া লম্বা ঘোমটা টেনে নেয়। রওশন ভ্রু কুঁচকে চায়। মেয়েটা একটু বেশিই লাজুক। তার উপস্থিতিতে কেমন হাঁসফাঁস করছে। আরিফা রওশনের হাতে ব্যাগ পত্র দেখে মিনমিনে গলায় বলে,

"এই বৃষ্টির মধ্যে কোথাও বেরোবেন? না মানে লাগেজ হাতে তাই মানে.."

প্রশ্ন করে বড্ড ফ্যাঁসাদে পড়ে আরিফা। অচেনা মানুষকে এভাবে প্রশ্ন করা কেমন সাজে? বলদ রিফা! নিজেই নিজেকে শাসায়। 

"সিলেট যাবো। ছবি আর সাদমান ভাইয়ের সাথে বেরোবো। ওদের চেনো নিশ্চয়ই? আমার ছোট বোন আর বোন জামাই।"

আলগোছে জবাব দিয়ে রওশন ভদ্রসুলভ হাসে। পাশ কাটিয়ে চলে যায় লাগেজ টেনে। আরিফা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে তাঁর প্রস্তান। লোকটা হাসলে বেশ লাগেতো! একদম দাদির হাতের মিঠা পান! 

দূরে শুকনো মরিচের কুলো হাতে দাঁড়িয়ে ছামিনা বেগম। কপাল কুঁচকে সবটাই লক্ষ্য করে।

°°°°°°°°°°

 কামরার এক কর্ণধারে বুকশেলফ। তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা শখের বইগুলো আড্ডায় মেতে। বুকশেলফের সমকোণে জানালা হতে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসে সঙ্গে আনে বৃষ্টির রুম ঝুম তান। বুক শেলফের সম্মুখে মোড়ায় বসে নওরিজ মাহবুব। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা আর হাতে 'মৃত্যুক্ষুধা'। পাশে সোফার হাতলে ঢাকনায় ঢাকা উষ্ণ কফি। কফিটা রূপসা দিয়ে গেছে বেশ সময় হলো। সে ছুঁয়ে দেখে নি। মেয়েটার ভরসা নেই। কে জানে মুখ লাগিয়েছে কি না ছোট বেলার মতো! নওরিজ মাহবুব বইটা রেখে স্যানিটাইজারের শিশিটায় আঙুল ভিজিয়ে মুখে ঘঁষে। আবার আতরের সুগন্ধ শুঁকে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। মন মস্তিষ্ক জুড়ে যেন গোবর আর গোবর। ভাবনাতেই গা ঝাড়া দেয় নওরিজ। সুরকে হাতের কাছে পেলে দু'টো চটকানা লাগাবে। কত বড় সাহস তার মুখে গোবর ছুঁড়ে! ছিঃ! কি বিশ্রী গন্ধ! নওরিজ মাহবুব মুখটা এমন বানালো যেন আবারও মুখ বরাবর গোবর ছোঁড়া হয়েছে। দরজা খটখটানোর আওয়াজ ভেসে আসে। নওরিজ অনুমতি দিলে ভেতরে প্রবেশ করে দোসত্ত্বা। বাড়ন্ত পেট চাদরে ঢেকে এগিয়ে আসে রূপালী। নওরিজ বইটা শেলফে রেখে ঘুরে বসে।

"কিছু বলবি? তোর জামাই টাকে অনেক দিন চাপে ফেলে আটকে রাখলাম। আর সম্ভব না রে। তোর শাশুড়ি বাড়িতে মেইড দের নির্ভরে আছে। সাবধানে যা, কিছু দিন পেরোলে নিয়ে আসবো।"

রূপালী মলিন হাসে। এগিয়ে এসে সোফায় বসে। ঢেকে রাখা কফির মগটা তুলে গলা ভিজিয়ে বলে,

" তোমার কাপ থেকে ছোটবেলায় একবার চা খেয়েছিল মানে এই না এখনো খাবে। তুমিও না রিজ ভাই! তোমার শুচি বায়ু স্বভাবটা খুব খুব বিরক্তিকর।"

নওরিজ চশমাটা খুলে সামান্য হাসে। রূপালী সুক্ষ্ম চোখে তাকায়। শুকনো ঢোক গিলে হেসে বলে,

" আম ভাবছি এতটুক নোংরা সহ্য করতে পারো না সেখানে সুরেলা... তোমার কাছে কেমন লাগে জানি না কিন্তু ও অসহ্য রকমের বিরক্তিকর। ঝগরুটে ছ্যাঁচড়া মেয়ে।"

নওরিজ উঠে দাঁড়ালো। বুক শেলফের উপরের তাকে এক বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে কিছু খুঁজে বেড়ায়। রূপালীর বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে।সে শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলবে নওরিজ কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা বের করতে সক্ষম হয়। নীল রাঙা খাম! রূপালীর মুখটা পানসুটে হয়ে আসে। অপমানে থমথমে মুখ! 

" আমি তখন অবুঝ ছিলাম রিজ ভাই!"

" তুই এখনও অবুঝ আছিস। যাইহোক সুর তোর রিজ ভাইয়ের বউ। সম্পর্কে তোর বড় ভাবী হবে। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।"

নওরিজ খামটা পুনরায় বইয়ের ভাঁজে রেখে দেয়। রূপালী উঠে দাঁড়ালো। অধর বাঁকিয়ে হেসে বলে,

"রওশন ভাইকে নিয়ে যাচ্ছি সাথে। আমি না তোমার এই স্বার্থান্বেষী স্বভাবে খুব খুশি। আমার ভাইয়ের জীবনে যেই আসুক ওই ফালতু মেয়েটা আসবে না এটাই অনেক।"

 বিরক্তে মুখটা তিতে হয়ে আসে নওরিজের। সব পাগলের কান্ডারি তার সামনেই!

°°°°°°°°°°°°°°°

"মাতে আমি বিপলু দা'র মতো অ আ কবে শিখতে যাবো?"

"তুই তো ছোট। আরেকটু বড় হ তারপর যাবি।"

সুভাকে রঙিন ফিতেয় চুল বেঁধে দেয় দামিনী। সুভা হেসে উঠে দাঁড়ালো পিঁড়িতে। কাঁধ উঁচিয়ে বলে,

" আমি তো এতো এতো বড় মাতে। তাও কেন যেতে পারবো না? আমার এখানে ভালো লাগে না। বিপলুদা দের সাথেই থাকবো। এখানে কোনো সখা সখি নেই আমার। মনি মা তো বুড়ো । আমার বুড়োদের সাথে খেলতে ভালো লাগে না।"

 বুকে হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সুভা। তার মানে এই সুভা গাল ফুলিয়েছে। দামিনী খিলখিল করে হেসে সুভার টোল পড়া গালে আঙ্গুল দিয়ে টোকা দেয়। শুপ্রা সারা বাড়িতে মঙ্গল ধোঁয়া দিচ্ছিলো। সুভার কথায় মুখ ভেংগে বলে,

" ও মা! এখন আমি বুড়ো হয়ে গেছি? আবার খেলতে এসো? এই আমি আড়ি কাটলাম আর ভাব করবো না!"

সুভা জিভ দেখিয়ে হাসে। শুপ্রা এগিয়ে এলে সুভা পুরো বাড়ির চক্কর কাটে। এক পায়ের ছোট্ট ঘুঙুর রিমঝিম সুর তুলেছে সেই সুরে গেয়ে ওঠে সুভার কলকল হাসি। দেহরক্ষীর আওয়াজে সজাগ হয় দামিনী। শুপ্রাকে ইশারা করে সুভাকে সরিয়ে নিতে। শুপ্রা সুভাকে বলে,

" সুভা? আমার কাছে ছোট্ট কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাঁধা আছে। তাদের জন্য জামা সেলাই করবো তুমি আমাকে সাহায্য করবো?"

"খুউব করবো। কৃষ্ণ ঠাকুরকে কিন্তু আমি জামা পড়াবো?"

শুপ্রা হেসে সম্মতি দেয়। সুভা নিজেই তার মনি মা'কে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। দামিনী দেহরক্ষীকে ইশারা করে। কালো গোঁফ মুচড়ে দেহরক্ষী বেরিয়ে যায়। ক্ষণপল পরেই হে হে সুরে হাসতে হাসতে ভেতরে আসে আকরাম নামক পাগল লোকটা। দামিনীকে দেখে মাথা চুলকে ময়লা দাঁত কেলিয়ে বলে,

"ও আমার পেয়ারি দামু? তোমার জন্যে সন্দেশ আনছি খাইবা?"

দামিনী বিরক্ত মুখে চায়। 

"রাম দা? যা বলতে এসেছো জলদি দাও আর কেটে পড়ো।"

আকরাম এগিয়ে এসে দামিনীর হাতে একটা থলে ধরিয়ে দেয়। গাল মুখে দাঁড়িতে চুলকে বলে,

"ক্ষিধা লাগছে পেয়ারি দামু কয়ডা খাইতে দিবা?"

"শুকনা চিড়া গুঁড় আছে শুধু খাইলে খাও নইলে রাস্তা মাপো।"

দামিনীর রসকষহীন গলায় আকরামের মুখ ছোট হয়ে আসে। শুকনো চিড়ে গুঁড় তাঁর পোষাবে না। দামিনী থলেটা খুলে দেখে। কতকগুলো সিরিঞ্জ দেখে অবাক সুরে বলে,

"রাম দা? এগুলো কি এনেছো? ভুল টুল হয় নি তো? এতো ডাক্তার বাবুদের সিরিঞ্জ!"

আকরাম দাঁত ভেটকিয়ে বলে, "হে হে পেয়ারি দামু। শফিল ভাই কইছে এগুলা হইলো দুঃখ ভোলানের যন্তর। নতুন মাল আইসে। রগে পুশ করলেই দুঃকু ভুইল্যা অন্য দুনিয়ায় চইলা যাইবা। বুঝলা? আমিও নিছিলাম এই যে এমনে কইরা!"

বলেই থলে থেকে একটা সুঁই সিরিঞ্জ বের করে। ছোট্ট কাগজে মোড়ানো শিশি যাতে প্যাথেডিন লেখা। সিরিঞ্জে ভরে হাতের রগে পুশ করে মুখ বাঁকায়। সম্পুর্ন তরল ভেতরে পুশ করতেই আকরামের মুখ জুড়ে খেলা করে প্রশান্তির হাসি। আকরাম তারিফে তারিফে দামিনীকে উশকে দেয়। দামিনী অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। সত্যিই এতে শান্তি পাওয়া যায়? দুঃখ ভুলে থাকা যায়? আকরাম সাদা কাগজে মোড়ানো খামটা দামিনীর দিকে বাড়িয়ে বলে,

"পেয়ারি দামু তুমি মেলা সুন্দর। পরীর লাহান মুখ। ওই সেদিনের বাচ্চাটা তোমার মাইয়া?"

দামিনী খামটা খোলে। কিছু কড়কড়ে টাকা আর একটা চিরকুটে নির্দেশনা দেওয়া আছে। কে আসবে কাকে কোনটা দিতে হবে। দামিনী টাকা গুলো গুনতে গুনতে বলে,

"রাম দা, কিসের বাচ্চা? কোথায় বাচ্চা পেলে? চোখে ছানি পড়ে নি তো? যাও যাও বাড়ি যাও জলদি করে।"

আকরাম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বেরিয়ে যায়। দামিনী সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। নতুন নোটের ঘ্রাণ শুঁকে। আহ্! কি নেশালু ঘ্রাণ! এ নেশালু ঘ্রাণ নেশাকেও হার মানায়। তবে তাঁর কৌতুহলী মন সুই সিরিঞ্জ আর কাঁচের শিশির উপর। এসব তো আগে কখনো দেখে নি! কারো আগমন বার্তা টের পেয়ে দামিনী থলেটা কিচেনে রেখে ফিরে আসে। তুলসী গাছের কাছে দন্ডায়মান মানবকে দেখে হাসি প্রসারিত হয় দামিনীর। মৃদু কেঁশে বলে,

" রিজ বাবু যে! হায় কৃষ্ণ! কি সৌভাগ্য আমার!"

দামিনীর দিকে ফিরে নওরিজ। তাঁর দাম্ভিক ধারালো সন্দেহভাজন চাহনিতে দামিনী স্মিত হাসে। ছেলেটা একদম বদলায় নি। সেই যেন পূর্বের রিজ। শুধু বয়সটা বাড়ার সাথে সাথে পরিপক্বতা এসেছে হাবভাবে। আগে একটু হ্যাংলা পাতলা থাকলেও এখন সপুরুষ! চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতোই।

"হঠাৎ দামুর দোর গড়ায়? কিছু প্রয়োজন?"

নওরিজ মাহবুব এগিয়ে আসে দু কদম। আশেপাশে নজর বুলিয়ে রাশভারী স্বরে বলে,

"আমার এক পুরনো বন্ধুর খোঁজে এসেছিলাম। মিনী তাঁর নাম। পেয়ারি দামু আপনি তাকে দেখেছেন?"

দামিনী খিলখিল করে হেসে ওঠে। যেন কোনো কিশোরীর উচ্ছ্বাস। খোলা হাঁটু ছুঁই ছুঁই চুল খোঁপায় বেঁধে বলে,

"রিজ বাবু আমি তো শুনেছি এক লাড়কা ওর লাড়কি কাভি দোস্ত হতে পারে না।"

পকেটে হাত পুরে ভ্রু কুঁচকে চায় নওরিজ। দামিনী আবারও হেসে ওঠে শব্দ করে। এগিয়ে এসে নওরিজের বাহুতে চাপড় মেরে কিছু বলতে উদ্যত হয় এমন মুহূর্তে সুভা দৌড়ে বেরিয়ে আসে। হাতে ছোট্ট কৃষ্ণ ঠাকুর। দামিনীকে দেখিয়ে বলে,

"মাতে, দেখো আমার কৃষ্ণকে আমি সাজালাম। সুন্দর না বলো?"

দামিনী সুভাকে কাছে টানে। চোখ টিপে বোঝায় অনেক সুন্দর হয়েছে। সুভা খুশি হয় তবে অপরিচিত লোককে দেখে দামিনীর আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলে,

" মাতে ইনি কে?"

নওরিজ সুক্ষ্ম চোখের পরখ করে বাচ্চা মেয়েটাকে। সাত আট বছরের হবে। দেখতে মায়ের মতোই রূপবতী। সে দামিনীর দিকে প্রশ্নভাজন চোখে চায়।

"ওর বাপ কে?"

" তুই ছাড়া আর কে?"

নওরিজ ছোট ছোট চোখে চায়। দামিনী আবারও হেসে চোখে পানি আনে। হাসতে হাসতেই বলে,

"ভয় পাচ্ছিস কেন রিজ! ওর বাপ নেই। আমিই ওর বাপ আমিই ওর মা।"

সুভা চোখ উল্টিয়ে দেখে অপরিচিত লোকটাকে। নওরিজ মাহবুব গম্ভীর গলায় বলে, "সেই যে হারিয়ে গেলি তারপর আর খোঁজখবর নেই। কোন লম্পটের সাথে হাওয়া হয়েছিলি?"

"বলবো রিজ। তোকে না বললে কাকে বলবো? আয় বসে কথা বলি?"

"আগে বল আকরাম নামক পাগলটা এখানে কি করছিলো? ওর সাথে কিসের সখ্যতা তোর?"

সন্দেহ বাণে জর্জরিত দামিনী অতি ধুর্ততার সাথে হেসে জবাব দেয়,

"ওর নাম তো রাম। রাম দা বলে ডাকি। পাগল মানুষ ক্ষিধে পেলে মাঝেমাঝেই এসে দুমুঠো ভাত খেয়ে যায়।"

নওরিজ মাহবুব বিশ্বাস করলো কি-না বোঝা গেল না। তবে পাল্টা প্রশ্নে দামিনী একটু হচকচিয়ে বলে,

"মা নাকি লাড্ডু পাঠিয়েছিল আমার জন্য। তুই জানিসই তো মনে হয়। মা বাবুকে একঘরে করে দিয়েছে সমাজ। আমার সাথে যোগাযোগ রাখলে আরও কি না কি করে তাই.. এই তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস নাকি কিছু নিয়ে?"

নওরিজ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসে। হাত নাড়িয়ে সুভাকে ডাকে। সুভা দামিনীর দিকে তাকায় অনুমতির আশায়। নওরিজ ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

"ওর দিকে তাকাচ্ছিস কেন? আমি বাঘ নাকি যে তোকে হালুম করে খেয়ে ফেলবো?"

নওরিজের সহজ গলায় সুভা হেসে মাথা নেড়ে এগিয়ে আসে। নওরিজ গোটাকয়েক লজেন্স বাড়িয়ে দেয়। দামিনীর চোখে মুখে অবাকতা। রিজ কি সুভা সম্বন্ধে জানতো? কিন্তু কিভাবে সম্ভব?

°°°°°°°°°°

লুডুর শক্ত কাগজটা ঘুরে ফিরে দেখছে শফি। কাগজে থাকা সুন্দর সুন্দর মেয়েদের ছবি। শাবনূর, পূর্ণিমা, ঈশ্বর্য আর সুচিত্রা সেন। শফি চেনে তাদের। সবার সিনেমা দেখা হয়েছে। হিন্দি ভাষা মাথায় না ঢুকলেও হা করে গিলে গেছে। শফি আরও মনোযোগ দিয়ে দেখে ছবিগুলো। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। কি মনে করে চুমু খায় টুপ করে। লাজে লাল হয়ে আসে। হঠাৎ রূপসা আপার কথা স্মরণে আসে। রূপসা আপাও তো মেলা সুন্দর আসমানের পরীর লাহান। একদম মাখন। ইশ্ ইশ্ ইশ্!

পাশের গ্রামের সুরুজ মিয়ার সাথে কথা বলছে সিনান। তবে মনোযোগ ওর শফির উদ্ভট কার্যকলাপে। কি সব বিড়বিড় করছে? সিনান সুরুজ মিয়াকে বিদায় দিয়ে এগিয়ে আসে। ধরাম করে কিল বসিয়ে বলে,

"কিরে শফি কোন দুনিয়ায় ঘুরোস ফিরোস? স্বপ্নে সুচিত্রা সেন এলো নাকি?"

শফি বিরক্ত হয় তবে ভাবান্তর না দেখিয়ে চুপটি মেরে রয়। সিনান হেসে লুডুর কাগজের উপর গুটি ঢেলে বলে,

"লুডু খেলবি?"

শফি যেন ঈদের চাঁদ হাতে পায়। সিনান গুটি সাজিয়ে বলে,

" চল খেলি। তবে এমনি এমনি না। তুই রাখ পঞ্চাশ আমি পঞ্চাশ। একশতে গরম জিলেপি কিনে বাড়ি ফিরবো। ডিল?"

" উন্না। আমি জানি সুর আপা জিলাপি ভালোবাসে তাই টোপলা তোমার ঘরেই ঢুকতো। তারচেয়ে ভালো এইডা, আমি জিতলে রূপসা আপার লগে আমার বিয়া দিবা!"

সিনান বাঁকা চোখে তাকিয়ে ছক্কা ঝাঁকিয়ে চাল দেয় । পিঁপড়ের শখ রসের হাঁড়িতে ডুবে মরবে! অথচ রসের হাঁড়ি সিঁকায় বাঁধা।

"মাথায় সবসময় দুলালি ঘুরে ফিরে তাই না? হারলে কি তারে আমার গলায় ঝুলাই দিতি?"

শফি দাঁত কেলিয়ে হেসে জবাব দেয়, "জীব্বনেও না। হে জিতলেও আমার হারলেও আমার।"

ঠাস করে চর পড়ে বা গালে। শফি দু গালে হাত রেখে চোখ উল্টিয়ে চায়। মারার কারণ বোধগম্য হয় না। সিনান খ্যাক করে ওঠে,

"পা/ছায় কাপড় নাই উনি আলালের ঘরে দুলালির শখ পুষে। তোর চোপায় আরেকবার ওই দুলালির নাম শুনলে জুবান কাইটা ফালামু।"

দু গালে হাত রক্ষাকবচ বসিয়ে শফি থমথমে মুখে বসে থাকে। সে দুলালির শখ পুষুক আর দুলালির মায়ের তারছেঁড়ার এতো জ্বলে ক্যান? সিন শফির নীরব যুদ্ধের মাঝে সাইরেন বাজায় এক টমটম। সিনান সালেহ কৌতুহল নজরে তাকায় বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িটির দিকে। উঠে যাবে এমতাবস্থায় রওশনকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে কপালে সুক্ষ্ম রেখার দেখা মেলে।

রওশন এগিয়ে এসে ভনিতা হীন গলায় সরাসরি বলে,

"সিন তোর পুতুল সোনাকে দিবি? হারিয়ে যাবো অজানা শহরে। তাকে ছায়া বানিয়ে ঘুরে বেড়াবো ওলিগলি। দিবি বল?"

সিনানের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হয়। ঘার বাঁকিয়ে গাড়ির দিকে তাকায়। জানালার গ্লাস খুলে রূপালী চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

"ভাই পাগল হয়ে গেছিস? আপদকে ঘরে তুলার জন্য.."

আর বলতে পারে না। সাদমান মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। ধমকায় না তবে তাঁর শান্ত চাহনিতে রূপালী মিইয়ে যায়।

 সিনানের বুঝতে বাকি থাকে না আপদটা কাকে বলা হয়েছে। রূপালীর সাথে সুরেলার দা কুমড়ার সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই। কারণ অজানা! সিনান স্মিত হেসে বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলে,

 "আপদ থেকে দূরে থাকাই উত্তম আমি মনে করি।"

রওশন হুট করে জড়িয়ে ধরে বন্ধুকে। কম্পমান করুন গলায় আওড়ায়, "সিন তুই না আমার নেং/টা কালে বন্ধু? সে-ই ছোট্ট বেলা থেকেই কাঁধে কাঁধ জড়িয়ে হেঁটে এসেছি। আমার অনুভূতি গুলোকেও আড়াল করি নি। তাকে দিয়ে দে। সব কিছু থেকে দূরে রাখবো। ফুলের টোকাও পড়তে দিবো না।"

অনুভূতির চাপা কলে পিষ্ট সিনান সালেহ থমকায়। বন্ধুর করুণ সুর কোথাও একটা বিঁধে। অস্থির হয় মন বাগিচা। পিঠে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে,

"আমি কখনো মানা করেছিলাম? সুর তোর নসীবে থাকলে তোর হতো। রিজ ভাই.."

রওশন ছিটকে সরে আসে। মলিন হেসে বলে, "জানিস তাহলে সব। আসছি ভালো থাকিস।"

গাড়ির দিকে পা বাড়ায় রওশন। গতদিন সুরেলা তাদের আঙিনায় উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিলো সে খেয়াল করেছে। এগিয়ে আসবে তাঁর আগেই যার আসার সে এসে যায়। তাঁর দেওয়া উপহারের মতো সেও ডুবে গেলো ডোবায়। 

°°°°°°°°°°°

"এসেছিস তবে?"

"আসি নি হুমকি ধামকি দিয়ে আনা হয়েছে!"

"আমার হুমকিতে ভয় পাস?"

" কক্ষনো না।"

"তাহলে কেন এসেছিস?"

শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সুরেলা। প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। ঘনঘটা অন্ধকার আবছায়া দেখে প্রাণ জুড়োয় না। হাতের লন্ঠণ জ্বালিয়ে উঁচুতে তুলে। সোনা রাঙা টিমটিমে আলোয় আলোকিত হয় শ্যামবরণ। সোনা রাঙা আলোয় মুখটা জ্বল জ্বল করছে। কপালে দু ভ্রুয়ে মাঝ বরাবর ছোট্ট তিলটা চৌম্বকের মতো আকর্ষণ। দ্বিপ্তীমান ডাগর ডাগর আঁখি যুগ্ম যেন আফিম। তাতে কাজলের রেখা খুন করবে নিশ্চিত। কাজল লেপ্টে যায় নি মানে বেহায়া কাজল খুব সময় হয় নি কান্তিমন আঁখিতে ঘাঁটি গেড়েছে। নওরিজ মুক্ত হাত বাড়িয়ে মাথা হতে ঘোমটা ফেলে দেয়। সুরেলা যেন ফুঁসে ওঠে। ঝটকায় হাত সরিয়ে আক্রোশে ফেটে পড়বে নওরিজ মুখ বন্ধ করে দেয়। বৃদ্ধাঙ্গুল নরম ওষ্ঠাপুটে চেপে ধরে মুখ এগিয়ে আনে। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে ফিসফিস শব্দে বলে,

"কতটা ছটফট করছি বুঝতে পারছিস? খাওয়া ঘুম সব নাইওর খেতে গেছে। আমার সফেদ বিছানা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। পছন্দের জিনিস, শখ গুলোও ইদানিং ভাও দিচ্ছে না। কি হয়েছে বল তো সুর? কেন কিশোর ছেলেদের মতো ছুটে আসছি বারবার?"

পরণের কামিজ খাঁমচে ধরে সুরেলা। বৃষ্টির শেষে ঠান্ডা পরিবেশেও উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে তনুমনে। নিজ আবেগের গলা চেপে বৃদ্ধাঙ্গুলে দাঁত বসিয়ে দেয়। তবে অপর পক্ষের মানবের মাঝে ভাবান্তর দেখা যায় না। সুরেলা ছেড়ে দেয়। সোনালী রাঙা আলোয় খেয়াল করে লোকটা হাসছে। গোমড়া মুখে হাসিটা মন্দ নয়।

"ধরতো হ্যারিকেনটা?"

সন্দিহান চোখে চায় সুরেলা। মতলব খানা কি? উল্টোপাল্টা কিছু করলে জায়গা মতো লাগিয়ে দিবে! সুরেলার কোনো ভাবান্তর না দেখে নওরিজ নিজ দায়িত্বে লণ্ঠনটা সুরেলা হাতে ধরিয়ে দেয়। বাতাসে এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দেয়। মৃদু মন্দ বাতাসে কপালে গালে বারংবার ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে দেয়। দু গাল আঁজলায় ভরে। মুখ নামিয়ে ছোট্ট করে চুমু বসায় দু ভ্রুয়ের মাঝে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,

"বাড়ি যাও সুরেলা সালেহ। আমার খাঁচায় বন্দী হলে বেরোনোর নিশ্চয়তা শূন্যের কোঠায়। শিঘ্রই তোমাকে তোমার নীড়ে স্বাগত জানাবো। অপেক্ষায় থেকো।"

আবারও তুমি সম্বোধন। প্রথমবার তিক্ত স্বাদের হলেও এ যেন মিঠা গুঁড়। ঢিপ ঢিপ ঢিপ শব্দ যেন পর্দা ভেদ করে বেরিয়ে আসবে। ভারী কিছু পড়ার শব্দে হুঁশে ফেরে সুরেলা। হাত থেকে লণ্ঠনটা ছুটে গেছে। আটকে রাখা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে,

"লুইচ্চ্যা লোক। রাত বিরেতে এক অবলাকে ডেকে এনে চুম্মা খাওয়া হচ্ছে? আপনার মুখে আমি বিচুটি পাতা ঘষে দিবো।"

নওরিজ মাহবুব অতিশয় শান্ত। হাত বাড়ায় ঘোমটা টেনে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। সুরেলা তিন কদম পিছিয়ে কর্কশ গলায় বলে,

"দুপুর বেলার ফেরেন লাভলীর কথা মনে নাই? নিজেকে কি ভাবেন হুঁ?"

"ভাবাভাবির কিছুই নেই ডার্লিং। ইয়ু আর মাইন। এখন কথা বাড়ালে তোর লস প্রজেক্ট আর আমি লাভে লাভবান।"

সুরেলা দু'টো শুদ্ধ গঞ্জের গালি দিয়ে উল্টো পথে পা চালায়। নওরিজ লণ্ঠনটা উঁচুতে তুলে ধরে। সোনা রাঙা আলোয় জ্বলে ওঠে স্বীয় সুশ্রী মুখ। ধীমান ভারী গলায় বিড়বিড় করে,

"আমি ঘুম রাজ্যের সওদাগর তুমি খোয়াব নামক প্রহেলিকা।ধুম্রজালে বুনানো কুন্ডুলি পাকিয়ে উড়তে উড়তে উবে যাবো ওই নীলাম্বরে। তারপর একদিন বৃষ্টির শেষে রৌদ্দুরের হাতছানিতে রামধনু হয়ে তুমি আমি রং ছড়াবো এক কোণে।"

পা টিপে টিপে চাপিয়ে রাখা দরজা খুলে সুরেলা। কাঠের দরজার ক্যাড় ক্যাড় আওয়াজ বুকে শঙ্কা জাগায়। ভেতরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে ঘুরতেই কুপির আলোয় ভাইয়ের থমথমে মুখ দৃশ্যমান হয়। সুরেলা যেন পাথর বনে যায়। ভয়ে পা থেকে মাথা অবদি শিউরে শিউরে ওঠে। সিনান সালেহ তাচ্ছিল্যভাবে হেসে বলে,

"আমার পিঠ পিছনে কতো কিছুই না ঘটে সুর। তোরা ভাবিস সব আমার অগোচরেই থাকে। তোদের নাড়ি নক্ষত্রের সব খবরই আমার কাছে আসে। শা/লার শখ ইচ্ছারে গলা টিইপ্যা খালি দিয়াই গেছি। বিনিময়ে কি পাইছি?"

°°°°°°°°°°

বিরক্ত মুখে স্কুল ব্যাগ কাঁধে ঘর থেকে বের হয় এক যুবক। পেছন পেছন দরদিনী মা এসে ছেলের গা দুইয়ে কান্না ভেজা গলায় বলে,

" আমার আব্বার উপর থাইক্যা বেক্কের বদ নজর দূর কইরা দেও ইয়া রহমান।"

" কানের কাছে কি প্যান প্যান শুরু করছোস মা? সর তো?"

ছেলের দুঃছাই আচরণে ব্যথিত হয় মাতৃমন। আঁচলে চোখ মুছে বলে,

"সোহাগ? আব্বা আমার? ইস্কুল থাইক্যা জলদি ফিরিস। কবিরাজের কাছে নিয়া গা বন্ধ কইরা দিমু নে। আমার সোনা ছেলের উপর কোন ডাইনির নজর পড়লো আল্লাহ পাক জানেন।"

সোহাগ বিরক্ত মুখে সায় জানালো। সোহাগের হতভাগা বাবা দূর হতে দেখে মা ছেলের কান্ড। তাঁর সোনার টুকরা ছেলে তো এমন ছিলো না! তাদের গরীবের ঘরে যেন রাজপুত্তুর। মা বাবাকে চোখের মণিতে বসিয়ে রাখা ছেলেটা আজ বাবা মায়ের প্রতিই বিরক্ত হচ্ছে? তিনি এগিয়ে আসেন। বকেন না আদরের ছেলেকে। লুঙ্গির গিঁটের ভাঁজ থেকে বিশ টাকা বের করে ছেলেকে দেয়। বোঝানোর গলায় বলে,

"তুই ছাড়া আমাগোরে আর কেডা আছে? একটা মাত্র পোলা তুই। আমাগোরে সবই তো তোর। যা চাস তাই দেই কহনো মানা করি নাই। দু'দিনের মাইয়ার জন্যে আমাগোরে ভুইল্যা যাবি? ওই সব আমরা কেউ না?"

সোহাগ টাকা নেয়। কপাল কুঁচকে বলে, "ভালোবাসার কি বুঝো তোমরা? আমি ভালোবাসতাম ওকে। সত্যিকারের ভালবাসা আমাদের।ওর জোচ্চর বাপে জোর করে বিয়ে দিছে। আমার বুকটা খান খান করে তোমরা তো বুঝবা না?"

বলতে বলতে সোহাগের চোখ ভিজে ওঠে। সোহাগের মা আঁচল মুখে গুঁজে কাঁদে। সত্যিই ভালাবাসা কি বুঝে না তারা? যাকে পেটে ধরেছে। নাড়ি ছেঁড়া ধন, আঠারো বছর হলো আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। নিজে না খেয়ে খোকার মুখে নিবালা দিলো। নিজে খালি পায়ে হেঁটে ছেলেকে স্কুলে পড়ার জন্য বুট জুতো কিনে দিলো। নিজ ছেঁড়া শার্ট সুই ধাগায় জুড়ে ছেলের গায়ে নতুন শার্ট তুলে দিলো। যার পড়াশোনার খরচ চালাতে মায়ের নাক ফুলটাও বেঁচে দিলো হতভাগা বাবা। এগুলো কি ভালোবাসা ছিলো না? নিজেদের মনে উঁকি দেওয়া অভিমান পিষে ফেলে তৎক্ষণাৎ। ছেলের অকল্যাণ না হয়। সোহাগ নাক ঝেড়ে বলে,

"পাঁচশোর মতো টাকা লাগতো।"

কৃষক বাবার চোখমুখ শুকনো দেখায়। শঙ্কিত হয়ে বলে, "কেন বাজান? ওতো টাকা দিয়া কি করবা?"

"সাজেশন গাইড কেনা লাগতো। সামনে পরীক্ষা না?"

সোড়াগের বাবা খুশি হয়। ছেলের পড়াশোনার কথা মাথায় আছে তাহলে! ছেলে তাঁর পড়াশোনায় প্রথম শ্রেণীর । প্রথম থেকে দ্বিতীয় হয় নাই কোনোদিন। সে খুশি মনে পাঁচশো টাকার মলিন এক খানা নোট বের করে দেয়। সোহাগ পকেটে পুরে বেরিয়ে যায় বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। 

বিদ্যালয়ের পেছনে পোস্ট অফিসের সম্মুখে খোলা বারান্দায় বখাটে ছেলেদের আড্ডা বসেছে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মানুষজনের আনাগোনা কম। বেচাকেনা না থাকায় পাশের দোকানটাও বন্ধ। এতেই যেন সুবিধা হয়েছে। সোহাগ আড্ডায় যোগ দেয়। স্বল্প পরিচিত বন্ধুদের দেখে হেসে বলে,

"বুকের ভেতর আনচান আনচান করে। কিছু দে ভুইল্যা যাই সব।"

এক ছেলে আধখাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে বলে, "কচি খোকাটা। তুমি এইডাই টানো। ওসব দিয়া কেস খাওনের ধান্দা? বসের ঝাড়ি খাইতে খাইতে কান শ্যাষ।"

সোহাগ মাথা চুলকে বলে, "প্রথমবার তো তাই। তাছাড়াও ওটা শুইক্যা বেশ আরাম পাইছিলাম তাই লিমিট ক্রস কইরা ফেলছি। দে না? আর হইবো না! আর তো সহ্য হয় না"

পাশ থেকে এক ছেলে সোহাগের পিঠ চাপড়ে বলে, "বন্ধু, একখানা খাসা মা/ল আইছে। পুশ করলেই এমন সুখ পাবি যা বৃআর মতো না। নিবি? টাকা লাগবো কিন্তু?"

সোহাগ হেসে পকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোটটা বের করে।

°°°°°°°°°°°°

বড় বড় দু'টো রুই, খাসির মাংস,গরুর মাংস, মুরগি, দই মিষ্টি সহ আরো নানান ধরনের বাজার এনে হাজির সালেহউদ্দিন। আনন্দ চোখে মুখে উপচেপড়া। শান্তি বেগমকে হেসে হেসে নানান পদ রান্নার কথা বলছে। শান্তি বেগমও দ্বিরুক্তি না করে হাসিমুখে রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন উনুন পারে। সিনান গোয়ালঘর হতে সবটাই লক্ষ্য করে। ব্যাপারখানা কি? এতো এতো বাজার! আবার ঘরদোরও কেমন ঝকঝক করছে! কেউ আসবে নাকি? সিনান গুরুর চারিতে খরকুটো দিয়ে এগিয়ে আসে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

"বাব্বাহ ঘরে ঈদ লাগছে দেখতেছি! কেউ আসবো নাকি?"

শান্তি বেগম মুচকি হাসেন। কিছু বলতে নিবেন সালেহউদ্দিন থামিয়ে দিয়ে বলে,

"সে আইলেই দেখবার পারবি বাপ। তুই আজ গ্যারেজে যাইস না। গেলেও যোহরের আগে ফিরবি কইলাম?"

সিনান কোনোমতে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। বাড়তি কথা না বলে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়। খেয়েদেয়ে সাইকেল নিয়ে বের হয়। উঠোনের এক কোণে বসে পাটায় মশলা পিষতে থাকা বোনের মলিন মুখচোপা দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে পরে তাঁর ভাঙাচোরা এফাছি নিয়ে। সুরেলা হা করে শ্বাস টানে।

গ্যারেজে এসে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সিনান। শ্বাস ফেলার জো নেই। সাথে তার বিশ্ববিখ্যাত মেজাজ যেন তুঙ্গস্পর্শী। কথা বলাই যায় না ছ্যাৎ করে ওঠে। এই শুরু বেলাতেই শফি ঝাড়ি সহ চার পাঁচ চটকানা খেয়ে হজমও করে নিয়েছে। এসব তাঁর কাছে নিতান্তই ডালভাত। ডালভাত ছেড়ে শফি সিনানের হুকুমে ধোঁয়া ওড়ানো দু কাপ গরম চা আনে। এক কাপ সিনানকে দিয়ে সামনের টায়ারের উপর আয়েশ করে বসে। সিনান তাড়া দিয়ে চায়ে ফুঁ দিবে এমন সময় কেউ হাত থেকে চায়ের কাপ ছিনিয়ে নেয়। গরম চা ছিটকে পড়ে হাতের উল্টো পিঠে। সিনান গর্জে উঠবে শফির কথায় থেমে যায়।

"রূপসা আপা তুমি.. আপনি এখানে?"

রূপসা নেকাবটা তুলে শফির পাশের টায়ারে বসে। চায়ের কাপে ফু দিয়ে চুমুক বসায়। তীক্ষ্ম নজর নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড লোকটার উপর নিবদ্ধ।

"তুমি করেই বলো। তোমার নাম শফি তাই না?"

শফি উপর নিচ মাথা নাড়ে। মাথা চুলকে হাসে। মনে হয় যেন স্বর্গে ভাসছে। রূপসা আপা তাঁর পাশে বসেছে। খুশিতে তাঁর নাচতে মন চায়। সিনান ভ্রু কুঁচকে শফির দিকে তাকিয়ে। শফি তাকানোতে চোখাচোখি হয়। খানিকটা লজ্জা পায় শফি। পিট পিট করে তাকিয়ে লাজুক হেসে বলে,

"রূপসা আপা তুমি এইখানে? আমার না বিশ্বাস হইতেছে না। মনে হইতেছে স্বপ্ন দেখতেছি। একটা চিমটি কাটবা?"

বলে হাত বাড়িয়ে দেয়। রূপসা চিমটি কাটবে তাঁর আগেই চর পড়ে গালে। রূপসা গালে হাত রেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়ে। শফি রাগে দুঃখে চায়ের কাপ উবু করে ফেলে দেয়। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,

"তার ছেঁড়া কুনকার! আমার লগে তোমার কোন জন্মের শত্রুতা কও দেহিন?"

সিনান ভাবলেশহীন ভাবে বলে, "তুই তো বিশ্বাস করতে পারছিলি না এটা স্বপ্ন, নাকি বাস্তব! তাই বিশ্বাস করিয়ে দিলাম যে এটা বাস্তব।"

শফি গাল ডলে। খুব বেশি জোরে না লাগলেও গাল যেন ব্যাথায় টনটন করছে। আর এর কারণ রূপসা আপা। সিন ভাই কেমতে পারলো রূপসা আপার সামনে তারে মারতে? রূপসা এখনো ঘোরে ডুবে। গালে হাত রেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে যেন চরটা তাঁর নরম গালেই পড়েছে। সে তড়িঘড়ি চায়ের কাপ ফেরত দেয়‌ ঢোক গিলে মিনমিনে গলায় বলে,

"আমার ভুল হয়েছে সিন ভাই! মাফ করে দাও?"

সিনান সালেহ আলগোছে উঠে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রূপসা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। এই উপেক্ষা সহ্য হয় না তাঁর! ভদ্রতার খাতিরেও কি একটু কথা বলা যায় না? সে কি খেয়ে ফেলবে লোকটাকে? অভিমানে তাঁর চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। শফির দিকে তাকিয়ে ফ্যাচ ফ্যাচ গলায় বলে,

" ভাব কি জনাবের? নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড লোক। বাড়িতে কেউ নেই। আপুরা তো চলেই গেছে। রওশন ভাই টাও নেই। রিজ ভাইয়ের তো খোঁজই পাওয়া যায় না। আব্বা, চাচাজান, খালা মিলে সুর আপাকে দেখতে গেছে। বাড়িতে চাচি আম্মা আর আমি একা। আরেকজন আছে তবে সে তো লজ্জায় মুখই তোলে না। তার উপর চাচি এমন ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন যেন আমি সাপ উনি সাপুড়ে। তাই আলমারি খুলে মায়ের বোরকা পড়ে চলে এলাম।"

চালচুলো বিহীন গল্প শোনায় রূপসা। যার আগা গোড়া মাথা কিছুই নেই। অহেতুক খুচরো আলাপ। শফি সেগুলোই অমৃতের মতো গিলে যায়। দু'জন খেয়ালে এতো ডুবে যে ভরা চায়ের কাপ খালি হয়ে যথাস্থানে রেখে দেওয়া হয় তাঁরা টের অবদি পায় না।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp