মেহুল নিজের ঘরের বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। তাকিয়ে রয় মির্জা বাড়ির গেটের সামনের রাস্তার দিকে। শেরাজের গাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে কালো রঙের গাড়িটা চলতে শুরু করে। মেহুলের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায় শেরাজের গাড়ি।
মেহুল দুর্বল পায়ে হেঁটে নিজের রুমে ফিরে আসে। রুমে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। অবাক হয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে, এই ড্রা গ অ্যাডিক্টেড শেরাজ ভাই তার সাথে কী করলো এটা? মেহুল থমকে গিয়ে ঠোঁটের ওপর হাত রাখে। এখনও জীবন্ত মনে হচ্ছে শেরাজের ছোঁয়া। মেহুল উঠে দাঁড়ায়। সোজা চলে যায় ওয়াশরুমে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। ঠোঁটের এক পাশে লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে। মেহুল টেপ ছেড়ে দেয়। পানির ছলছল শব্দে মুখর হয়ে ওঠে পুরো ওয়াশরুম। মেহুল দু হাতের তালুতে পানি নিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। ঠোঁটের চারপাশ হাত দিয়ে ঘষে, যেন মুছে ফেলতে চাইছে সেই অনুভূতি, সেই স্মৃতি।
মেহুল থেমে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে আসে, পেছনে থাকা কলের সাথে ধাক্কা লাগে আর তখনই ঝর্ণা থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করে। পানির ধারা ভিজিয়ে দিতে শুরু করে মেহুলের পুরো শরীর। মেহুল ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়ে।
পিঠ ঠেকিয়ে দেয় দেয়ালে। মনের ভেতরটায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে—একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মনে, শেরাজ ভাই এমন করলো কেন? সে কি তাকে ভালোবাসে? যদি ভালোবাসে তবে কেন কিছু বলে না? কেন এভাবে তার পুরো পৃথিবীটাকে ওলটপালট করে দিয়ে চলে যায় বার বার? মেহুল চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে মাথাটা হেলিয়ে দেয় দেয়ালে। তার উত্তর চাই। উত্তর চাই মানে চাই।
—————
কেটে গেছে দু'সপ্তাহ। এই ক'টা দিন মেহুল অনেকবার চেষ্টা করেছে শেরাজের সাথে কথা বলতে, কিন্তু প্রতিবারই শেরাজ তাকে এড়িয়ে গেছে। একবারও ফিরেও তাকায় নি পর্যন্ত মেহুলের দিকে।
শেরাজের এই অবহেলাগুলো মেহুলের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় গলা ফাটিয়ে কান্না করতে। কেন সকলে তাকে এতো অবহেলা করে?
এই চিন্তায়, এই যন্ত্রণায়, মেহুল ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছে না। মেহুল যেন একটা কাঠের পুতুলে পরিণত হয়েছে—
ঠিক পাঁচ বছর আগের সেই নিঃস্ব, ভাঙা মেহুলের মতো। নাতনির এই করুণ অবস্থা আতাউর মির্জার চোখে এড়ায় নি, নাতনিকে এর জন্য নিজের ঘরে ডেকে পাঠান।
মেহুল নানা ভাইয়ের ঘরে ঢোকে আস্তে করে বলল, "নানা ভাই ডেকেছো?"
আতাউর মির্জা, শুয়ে ছিলেন, নাতনির কণ্ঠ শুনে উঠে বসলেন।
স্নেহভরা গলায় বলেন, "এসো, আমার পাশে এসে বসো।"
মেহুল ধীর পায়ে গিয়ে নানাভাইয়ের পাশে বসে। আতাউর মির্জা মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "কয়েকদিন ধরে দেখছি তোমায়... কিছু কি হয়েছে তোমার?"
মেহুল ভেঙে পড়ে না বরং নরম গলায় উত্তর দেয়, "না নানাভাই, কিছু হয় নি। তুমি অযথা টেনশন করছো। শুধু শুধু টেনশন করে শরীর খারাপ করো না নিজের আমি একদম ঠিক আছি।"
আতাউর মির্জা নাতনির মাথাটা টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলেন, "যতদিন তুমি সুস্থ আছো, ততদিন আমার কিছু হবে না। তোমার সুস্থতাই আমার সুখ। তাই নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে মনে থাকবে আমার কথা।"
মেহুল মাথা তুলে চুপচাপ মাথা নেড়ে সায় দিলো। আতাউর মির্জা স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে বলেন, "আচ্ছা যাও, রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।"
মেহুল কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে এসে থমকে দাঁড়ায়। সামনেই শেরাজ। সবে বাড়িতে ঢোকেছে সে। দুজনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললেও কেউ কিছু বলে না। নিঃশব্দে, ঠাণ্ডা বাতাসের মতো মেহুলের দিক থেকে শেরাজ মুখ ফিরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঘরে চলে যায়।
আর মেহুল...চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু গিলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায়।
—————
সকাল সকাল মির্জা বাড়িতে এসে হাজির হন আমিনুল মর্তুজা।
ওনার হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত আগমন আতাউর মির্জাকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দেয়।
দুজনে মুখোমুখি বসে আছে। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু ঘরে ছড়িয়ে আছে চাপা উত্তেজনা। আমিনুল মর্তুজা সৌজন্য ভরা কণ্ঠে বলেন, "কেমন আছেন, চাচামশাই?"
আতাউর মির্জা ঠান্ডা গলায় জবাব দেন, "ভালোই আছি। হঠাৎ তোমার এখানে আসার কারণ কি?"
আমিনুল মর্তুজা মুচকি হাসলেন বললেন, "আমার এখানে আসার কারণটা তো আপনি আমার থেকেও বেশি ভালো জানেন।"
আতাউর মির্জা নিরব। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকেন সামনের মানুষটার দিকে। আমিনুল মর্তুজা আবার বলেন, "আমার ভাতিজি কই? বাড়িতে আছে না কি ভার্সিটিতে গেছে?"
আতাউর মির্জা হালকা স্বরে বলেন, "আছে, বাড়িতেই আছে।"
আমিনুল মর্তুজা কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলেন, "তাহলে একবার ডাকুন তাকে দেখি একবার, প্রায় দু বছর হতে চলল দেখি না তাকে। তবে তার আগে বিয়ের বিষয়ে একটু কথা হোক আমাদের মাঝে।"
আতাউর মির্জা চমকে তাকান ওনার দিকে। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার বলেন, "বিয়েটা কি এখনই হওয়া খুব জরুরি মেয়েটা পড়ছে?"
আমিনুল মর্তুজা একটু কপট অবাক হয়ে হেসে বলেন, "এ কী বলছেন চাচামশাই! আপনার কথাতেই তো বিয়েটা দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আর না। এবার আর পেছানো যাবে না।
আমাদের জিনিস, আমাদের কাছে নিয়ে যাবো। আর পড়াশোনা বিয়ের পরেও করতে পারবে।"
আতাউর মির্জা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলেন। ওনার হাত-পা বাঁধা। এই সম্পর্কটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই সম্পর্কটা নাকি ঠিক করে গেছে স্বয়ং মনিরুল মর্তুজা, মেহুলের বাবা। কিন্তু আতাউর মির্জা নিজ কানে কখনো এমন কথা শুনে নি। মনিরুল মর্তুজার মৃত্যুর পরপরেই এই কথাটা আমিনুল মুর্তজা আতাউর মির্জাকে বলেন। আর নিশ্চয়ই মনিরুল মর্তুজা এই কথাটা বলে গেছে ভাইয়ের সাথে। মৃত ভাইয়ের নামে আমিনুল মর্তুজা আর যাই হোক মিথ্যা কথা বলবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে ওনার সন্দেহ হয় আদৌ কি এই কথাটা ওনার মেয়ের জামাই বলে গেছে নাকি শুধুই ভাইয়ের সম্পত্তি হাতানোর জন্য এই কথা বলেছে আমিনুল মর্তুজা।
আমিনুল মর্তুজা বলেন, "তাহলে বলুন চাচামশাই, বিয়ের তারিখ কবে দিলে ভালো হয়? আমার ছেলের তো আর তর সইছে না মেহুলকে বিয়ে করার জন্য।"
আতাউর মির্জা কণ্ঠ নরম করে প্রশ্ন করেন, "তোমার ছেলের চাকরি হয়েছে তো?"
আমিনুল মর্তুজা হেসে হেসে তুচ্ছ ভঙ্গিতে বলেন, "চাকরি করার কি দরকার চাচামশাই। চাচার এতো বড় বিজনেস কে সামলাবে বলুন? মেহুলকে বিয়ে করার পর ওকেই তো সব দেখভাল করতে হবে তাই না।"
আতাউর মির্জা কথাগুলো শুনে নিরুত্তর থাকেন। আমিনুল মর্তুজা আবার শুরু করেন, "যবে থেকে শুনেছে ওর চাচা মেহুলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে রেখে গেছে তবে থেকে মেহুলকে বিয়ে করার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে আমার ছেলেটা। আর আপনি তো জানেন মৃত ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।"
আতাউর মির্জা মৃদু হেসে মাথা নাড়েন, "তা তো ঠিকই। তবে একটা কথা, বিয়ের পর আমার নাতনির যেন কোনো অযত্ন না হয়। ও আমার চোখের মণি। ওর কষ্ট আমি কোনোভাবেই মেনে নেব না।"
আমিনুল মর্তুজা গলা নামিয়ে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেন, "কি যে বলেন চাচামশাই! ও তো আমাদের বংশের মেয়ে, আমার রক্ত। আপনি আর চাচিজান তো জোর করেই ওকে আমাদের কাছে থেকে নিয়ে এসেছেন মনিরুল আর সুহানার মৃত্যুর পর। আপনাদের সন্দেহ ছিল আমরা আদর-যত্নে রাখতে পারব না আপনাদের নাতনিকে। আর মেহুলের সাথে সাথে মনিরুলের ভঙ্গুর বিজনেসটাও নিজের হাতে তুলে নিয়ে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন। এখন তো আপনারও বয়স হয়েছে। এবার তো এর ভার অন্য কাউকে কাঁধে তুলে নিতে হবে তাই না?"
আতাউর মির্জা চুপচাপ শুনে যান ওনার প্রতিটি কথা। মনিরুল মর্তুজা আবারও হাসিমুখে প্রশ্ন আসে, "তা চাচামশাই, মেহুল আর আসিফের বিয়েটা কবে হলে ভালো হয়? শুভ কাজ দ্রুত সেরে ফেলাই ভালো তাই না।"
এক জোড়া পা কথাটা শোনা মাত্রই থেমে যায়। হাত থেকে কালো রঙের ফাইলটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে যায়। আচমকা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে আমিনুল মর্তুজা আর আতাউর মির্জা দরজার দিকে তাকান। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেরাজ।
চোখে মুখে অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।
আমিনুল মর্তুজা শেরাজকে দেখার সাথে সাথে বলে উঠেন, "আরে শেরাজ বাবা যে! তুমি কবে এলে দেশে?"
শেরাজ কাঠের পুতুলের মতো স্থির গলায় বলে, "এই তো, পাঁচ মাস আগে। কার বিয়ের কথা বলছিলেন আপনারা?"
আমিনুল মর্তুজা হাসি মুখে বলেন, "এসো! বসো এখানে এসে। তোমরাও তো জানা দরকার বড় ভাই হিসেবে সবটা।"
শেরাজ দাদাভাইয়ের দিকে তাকায়। আতাউর মির্জা চোখ সরিয়ে নেন চুপচাপ। শেরাজ মেঝে থেকে ফাইলটা তুলে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ সোফায় বসে। আমিনুল মর্তুজা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "মেহুল আর আসিফের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছিল।"
শেরাজ কথাটা শোনা মাত্র নাকের পাটা ফুলিয়ে নেয়। দাঁত চেপে ধরে রাগে, চোখে জ্বলন্ত রাগ ফুটে উঠে। মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতটা নীরবে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে সামনে থাকা লোকটা যেই মুখ দিয়ে এই কথাটা উচ্চারণ করেছে সেই মুখটা ভেঙে দিতে কিন্তু শেরাজ ঠান্ডা রইল। এই ব্যাপারটা সে অন্য ভাবে হ্যান্ডেল করবে যেখানে বিষধর সাপটাও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না।
শেরাজ নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, "তাই নাকি? কবে বিয়ে?"
আতাউর মির্জা অবাক হোন নাতির উচ্ছ্বাস দেখে। আমিনুল মর্তুজা গলায় আনন্দের স্বর এনে বলল, "খুব শীঘ্রই। কি বলো তো মনিরুলের ইচ্ছে ছিলো তার মেয়ে মেহুলের সাথে আমার ছেলে আসিফের বিয়ে দিতে। এই ইচ্ছাটা পূরণ করার জন্যই বিয়েটা দিতে হচ্ছে। ভাইটা যদি আমার বেঁচে থাকতো তাহলে কত খুশি হতো।"
শেষ কথাটা আফসোসের স্বরে বললেন। শেরাজ চুপচাপ দাদাভাইয়ের দিকে তাকায়। আতাউর মির্জাও নাতির দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো বা এটাই বোঝার চেষ্টা করছে নাতি এতটা শান্ত কিভাবে আছে মেহুলের বিয়ের খবর শুনে।
শেরাজ ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে আমিনুল মর্তুজার দিকে ফিরে বলল, "তা ফুফা, এই কথাটা আপনাকে কবে বলেছিলেন? মানে মেহুল আর আসিফের বিয়ের কথাটা?"
আমিনুল মুর্তজা সামান্য ভেবে বলেন, "উমম... এই তো, দুর্ঘটনাটা হওয়ার কয়েক মাস আগেই।"
শেরাজ মাথা নেড়ে বলে, "ও আচ্ছা। আমরা তো জানতামই না এই ব্যাপারে।"
আমিনুল মুর্তজা মুচকি হেসে বলেন, "তোমার দাদাভাই জানতেন।"
শেরাজ উপরের দাঁতের পাটি জিভ দিয়ে কষে ঠোঁটের ভেতর শব্দ তোলে বলল, "হুম, তা তো বুঝতেই পারছি।"
আমিনুল মুর্তজার চোখ পড়ে শেরাজের হাতে ধরা ফাইলে। তিনি
জিজ্ঞেস করেন, "হাতে কী?"
শেরাজ ফাইলের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে, "ও এটা? ‘মনিরুল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর একটা ফাইল। দাদাভাইয়ের একটা সাইন লাগবে। জানেন এটা কত কোটি টাকার প্রজেক্ট?"
আমিনুল মর্তুজা নড়েচড়ে বসে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "কত কোটি?"
শেরাজ কণ্ঠে রস লাগিয়ে বলল, "চল্লিশ কোটি টাকা। এখন সব কিছুই দাদাই সামলাচ্ছেন। আমি দেশে আসার পর থেকে টুকটাক কিছু দেখে দিচ্ছি।"
শেরাজ একটু থেমে মজা নিয়ে আবার বলে, "মেহুলের যখন আপনার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে, তখন তো সবই আপনাদের হয়ে যাবে? মেহুল তো মেয়ে মানুষ এসব বোঝে না। ও তো জানেই না এখন পর্যন্ত ও যে কত কোটি টাকার মালিক!"
আমিনুল মর্তুজার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো টাকার লোভে। শেরাজ সেটা ঠিকই ধরতে পেরেছে। সে বাঁকা হেসে আরও এক ধাক্কা মারে আমিনুল মর্তুজার মনে, "দরকার হলে কোম্পানির নামটা চেঞ্জ করে আপনার নামটা বসিয়ে দিবেন। আপনার ভাইয়ের কোম্পানি মানেই তো আপনার কোম্পানি তাই না?"
আতাউর মির্জা এবার কণ্ঠ শক্ত করে নাতিকে বলেন, "দাও ফাইলটা। সাইন করে দিচ্ছি।"
শেরাজ চুপচাপ ফাইলটা এগিয়ে দেয়। আতাউর মির্জা সাইন করে ফাইলটা শেরাজকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, "এবার যাও।"
শেরাজের চোখ-মুখ কিছুটা শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি এনে বলে, "আপনি চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। মেহুল আর আসিফের বিয়ের সব দায়িত্ব আমার। ধুমধাম করে হবে বিয়ে ওদের।"
এই কথা বলে শেরাজ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আতাউর মির্জা হতবাক হয়ে নাতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নাতির মুখে যতটুকু হাসি ছিল, ঠিক ততটাই চোখে ছিল আগুন। শেরাজ এতো সহজে মেনে নিলো মেহুলের বিয়েটা ওনার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছু তো একটা করবে এই ছেলে আর সেটাও খুব ঠান্ডা মাথায়।
শেরাজ দাদাভাইয়ের ঘর থেকে বের হতেই মুখোমুখি হয় মেহুলের। চোখে-মুখে এক ব্যঙ্গ হাসি ফুটিয়ে বলে, "তোর চাচা এসেছে, দেখা করে আয়।"
মেহুল কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে নানাভাইয়ের ঘরের দিকে চলে যায়। শেরাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেহুলের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে নিজ মনে বলে উঠে, "তুই যদি একান্ত ভাবে আমার না হোস তাহলে অন্য কারোর হতে দিবো না তোকে। প্রয়োজন পড়লে তোকে নিজ হাতে এই নোংরা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে তোকে চির নিদ্রায় শায়িত করব। তারপর নিজেও তোর সাথে চির নিদ্রায় শায়িত হবো।"
শেরাজ থেমে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, "তুই শুধু আমার হবি। তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন হবে এই শেরাজ মির্জা সব করবে সব। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।"
—————
মেহুলের বিয়ের কথা চলছে অথচ মেহুল কিচ্ছু জানে না। চাচার সাথে দেখা হলেও, বিয়ের বিষয়ে একটি কথাও বলে নি তিনি। মূলত আতাউর মির্জাই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন—এই বিষয়ে এখনই নাতনিকে কিছু জানানোর দরকার নেই।
দিন পেরিয়ে রাত নেমেছে ধরনীতে। ঘড়ির কাঁটা এখন রাত আটটা ছুঁয়েছে। ইফা নিচে নামে। তার মাথা ব্যথা করছে তার জন্য কফি বানাতে এসেছে কিচেনে। কিচেনে এসে দেখে মাকে কেমন জানি উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে! ইফা প্রশ্ন করে।
"কি মা, তোমায় এত হাসি-খুশি লাগছে কেন? কিছু কি হয়েছে?"
শাহানা বেগম বিড়বিড় করে উত্তর দেন, "আপদ বিদায় হচ্ছে, খুশি তো হবই।"
ইফার ভ্রু কুঁচকে যায়, "মানে? কে বিদায় হচ্ছে?"
শাহানা বেগম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন, "আরে আমাদের মেহুলের বিয়ে জানিস না?"
ইফা হতভম্ব হয়ে পড়ে। বলে কি এসব? মনে হচ্ছে যেন একটা বড়োসড়ো বাজ এসে পড়েছে তার কান। ইফা অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, "কি? মানে সত্যি বলছো?"
শাহানা বেগম বলেন, "হ্যাঁ রে সত্যি।"
"কার সঙ্গে?"
"আসিফের সঙ্গে।"
"আসিফ! মানে মেহুলের চাচাতো ভাই আসিফ?"
"হুম আর বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নাকি রাজ নিয়েছে।"
ইফা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, "ভাইয়া বিয়ের সব দায়িত্ব নিয়েছে।"
"হুম।"
ইফার মাথা ব্যথা হাওয়া হয়ে গেছে। এমন এক সংবাদ শুনে আর মাথা ব্যথা থাকার সুযোগ পায় নি। এবার ইফার মাথা ঘুরছে। মাথাটা কেমন জানি ভনভন করছে। ইফা দিশেহারা হয়ে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে। শাহানা বেগম ভীষণ খুশি ভীষণ। এই বাড়ি থেকে শেষমেষ মেহুলের বিদায়ের ঘন্টা বাজতে চলেছে তাহলে।
—————
মেহুল বসে অ্যাসাইনমেন্ট গুছাচ্ছে। দু’দিন পরেই জমা দিতে হবে অ্যাসাইনমেন্ট । ইফা হাপাতে হাপাতে তার রুমে ঢুকে। মেহুল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, "কি হয়েছে ইফা আপু এভাবে পাগলের মতো ছুটছো কেন? কিছু হয়েছে?"
ইফা কাঁপা কণ্ঠে বলে, "তুই কিছু জানিস না, মেহুল।"
মেহুল মাথা নিচু করে কাগজে স্টেপলার মেরে বলল, "কি জানবো?"
ইফা এক নিঃশ্বাসে বলে, "তোর বিয়ে মেহুল।"
“বিয়ে” শব্দটা শোনা মাত্রই মেহুলের হাত জোড়া থেমে যায়। সে স্তব্ধ, বিমূর্ত। ইফার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, "মানে।"
"মানে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাও তোর চাচাতো ভাই আসিফ ভাইয়ার সাথে।"
এক মুহূর্ত স্তব্ধ থাকে মেহুল। তারপর ইফার কথাটা হেসে উঁড়িয়ে দিয়ে বলল, "যাহ বাজে কথা! তুমি মজা করছো আমার সাথে, তাই না? তুমি পারোও বটে মজা করতে।"
ইফা এবার মেহুলের দু বাহু চেপে ধরে বলল, "আমি মজা করছি না, মেহুল। সত্যি বলছি। তোর বিয়ের কথা বলার জন্যই তোর চাচ্চু আজ এখানে এসেছিলো। আর সবচেয়ে বড় কথা, তোর বিয়ের পুরো দায়িত্ব নিয়েছে ভাইয়া।"
মেহুল যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। চোখের কোণে জমে উঠেছে নোনাজল। কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গালের ওপর। শেরাজ ভাই তার বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছে, কথাটা যে বিশ্বাস করতে চাইছে না। মেহুল ভাঙা কণ্ঠে বলল, "এটার জন্য চাচ্চু নানা ভাইয়ের কাছে এসেছিলো আজ।"
ইফা মেহুলের চোখের জল মুছে বলল, "শান্ত হো মেহুল।"
মেহুল ইফার হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল, "আমি বিয়ে করতে চাই না আপু বিয়ে করতে চাই না।"
"দাদাভাইকে গিয়ে বল কথাটা। তোর কথা নিশ্চয়ই মানবে দাদাভাই।"
মেহুল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দু চোখের জল মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে উদ্দেশ্য নানা ভাইয়ের ঘর। কিন্তু নানা ভাইয়ের ঘরে ঢোকে দেখে নানাভাই ঘুমাচ্ছে। মেহুল কি করবে এবার? বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ঠিক তখনই শেরাজের চিৎকার ভেসে এলো ছাদের সিঁড়ির ঘরের দিক থেকে। শেরাজ ভাই বাড়িতে? মেহুল কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যেন কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।মেহুল ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। শেরাজকে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব কেন নিলো সে? কি চায় এই শেরাজ মির্জা?
মেহুল ছাদে উঠে। আকাশ ঝমকাচ্ছে নিরবে। হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে অথবা ঝড়। শেরাজ ফোনে কথা বলছে। অত্যন্ত রাগী কন্ঠে কারো সঙ্গে ফোনে চেঁচিয়ে কথা বলছে। হঠাৎ মেহুলের উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকায়। মেহুলকে দেখে চমকে ওঠে শেরাজ। একি অবস্থা মেয়েটার? চোখে মুখের নাজেহাল অবস্থা। শেরাজের হৃদয় পুড়ে। বুকের ভেতর ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু তাকে শক্ত থাকতে হবে। মেহুলকে সারাটা জীবনের জন্য নিজের করে পেতে হলে একটু কঠোর হতে হবে। শেরাজ কল কেটে দিয়ে মেহুলের দিকে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, "এখানে কি করছিস তুই? ঘরে যা।"
মেহুল সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, "তুমি নাকি আমার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছো?"
শেরাজ উত্তর দেয় না শুধু বলে, "ঘরে যা, মেহুল।"
মেহুল এবার আর সহ্য করতে পারে না। চিৎকার করে বলে উঠে, "তোমার কথায় আর এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। তুমি কেন আমার সাথে এমন করছো? কী করেছি আমি? কিসের শাস্তি দিছো তুমি আমায়? যখন মন চায় কাছে টেনে নাও যখন মন চায় দূরে সরিয়ে দাও। আমাকে কি কাঠের পুতুল পেয়েছো তুমি যেভাবে মন চাইবে সেভাবে নাচাবে আর আমি নাচব। কি চাও তুমি আমার কাছ থেকে?"
শেরাজ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ঢোক গিলে বলল, "বিয়েটা করে নে মেহুল?"
মেহুল নির্বিকার হয়ে বলল, "মানে।"
"মানে বিয়ে করে নে আসিফকে।"
"তুমি বলছো বিয়েটা করে নিতে?"
"হ্যাঁ বলছি।"
মেহুল শুকনো ঢোক গিলে বলল, "তাহলে ওই দিন পহেলা বৈশাখের দিন গাড়িতে যেটা হলো ওইটা কি!"
শেরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, "যা হয়েছিলো ভুলে যায়। ওটা জাস্ট একটা ভুল আর কিছুই না।"
মেহুল নিচু গলায় বিড়বিড় করে, যেন নিজের মনকে বোঝায়, "ভুল... ওটা শুধুই ভুল ছিলো... আর কিছুই ছিলো না এতে..."
শেরাজ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। চোখের কোনায় জমে উঠা কষ্টকে চেপে রেখে ছাদ থেকে নেমে যায়। মেহুলের কষ্টগুলো তার বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে। এতো দিন এতটুকু সে বুঝে গেছে এই মেয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে আর আর সেটা খুব গভীরভাবে। যাকে বলে ভয়ানক রকমের ভালোবাসা।
·
·
·
চলবে...................................................................................