মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৭২ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"যেখানে ছায়া পড়ে ঢালে,
তপ্ত সূর্য মুখ লুকায় ক্লান্ত বিকেলে।
নিঃশব্দে পড়ে আছে ধূসর প্রহর,
তুমি খুঁজে পাবে তাকে! পেছনের বাঁকে,
যেখানে বাতাস থেমে দাঁড়ায় বড় পাথরের চূড়ায়।"

ধাঁধার প্রতিটি শব্দ কায়েরীথের মনে অনুরণন তুললো। সে ঠান্ডা মাথায় হাঁটতে শুরু করলো। প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেল। সে পা ফেলছে ধীরে ধীরে। চোখ খুঁজছে অন্ধকার সেই স্থান আর নিরবতার পথ। সূর্যের আলো যেখানে পৌঁছায় না ঠিক সেই দিকে কায়েরীথের দৃষ্টি।

চারদিক নিঃশব্দ! পাখির ডাক নেই, পাতার মর্মরও থেমে গেছে। পাহাড়ের এক পাশে দেখা গেলো ঢালু জমি সেখানে দিনের আলো ঠিকঠাক পৌঁছায় না। গাছের নিচে ঢালু জমিটিতে গাঢ় অন্ধকার ছড়িয়ে আছে । দেখে মনে হচ্ছে বিকেলের ক্লান্তি মেটানোর কোনো স্থান। কায়েরীথ নীরবে এগিয়ে গেলো। পাহাড়ের ঢালে লম্বা এক গাছ দাঁড়িয়ে। গাছের নিচে পড়ে আছে একটি বৃহৎ পাথর। চোখে পড়ার মতো সেই বৃহৎ পাথরখণ্ড। ধাঁধার শব্দগুলো আবারও মনের মধ্যে ধ্বনিত করলো কায়েরীথ!

হয়তো এটাই সেই জায়গা। গাছের ডালের নিচে ঢালু জমিতে স্থির হয়ে পড়ে থাকা পাথরটিকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কায়েরীথ। কায়েরীথের দৃষ্টিতে দ্বিধা। ভ্রু কুঞ্চিত করে নিচুতে ঝুকলো সে। ধীরে ধীরে হাত রাখলো সেই পাথরের গায়ে। ঠিক তখনই ঘটে গেলো অদ্ভুত কাণ্ড! পাথরটি সেকেন্ডেই অদৃশ্য হয়ে গেলো। তার পরিবর্তে ধরা দিলো ক্ষুদ্র শ্বেত পাথরের আবরণ। বাতাসে ভাসছে সেই পাথর। কায়েরীথ থমকে গেলো বিস্ময়ে।
সে সেই পাথরের দিকে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল। শ্বেত পাথরটিও আস্তে আস্তে কায়েরীথের কষ্টে জর্জরিত ছিলে যাওয়া, রক্ত জমে যাওয়া হাতের তালুতে অবস্থান করলো। কায়েরীথ শক্ত করে ধরলো সেই শ্বেত পাথরটি। তারপর দেরি করলো না সে। দৌড়ে নামতে লাগলো নিচের পথে। পাহাড়ের ফাঁকে আবার দেখা হয়ে গেলো কয়েকজন প্রতিযোগীর সঙ্গে। কায়েরীথকে নিচে নামতে দেখে চমকে উঠলো তারা। চোখে আগ্রহ নিয়ে তারা বিভিন্ন কিছু জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কায়েরীথ কোনো উত্তর দিলো না। অনমনীয় পায়ে সে নামতে লাগলো নিচের দিকে নিজের গন্তব্যে। নিজের নিয়তির দিকে।

****

সায়েরিন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। তার দৃষ্টি একনাগাড়ে স্থির হয়ে ছিল আরিসার মুখে। কিন্তু আরিসা নিরবতার এক দেয়াল হয়ে বসে আছে। মুখে একরাশ স্থিরতা ঝিলিক মারছে।

শেষমেশ সায়েরিনই নীরবতা ভাঙলো। গলা নিচু রেখে বললো,
“রাজকুমারী আরিসা, কেমন আছো?”

আরিসা ততক্ষণেও চোখ সরায়নি। সামনের দিকেই তার দৃষ্টি! প্রতিযোগীরা ফিরছে একজন একজন করে। মোট পাঁচজন ফিরে এসেছে। কিন্তু কায়েরীথ এখনো নেই। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও আরিসা ঠান্ডা কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“ভালো।”

সায়েরিন হালকা করে হাসলো। নিজের কাপড়ের ব্যাগটা ওপরে তুললো। ব্যাগ থেকে বের করলো দুটো শুভ্র গোলাপ‌। নির্ভেজাল সৌন্দর্যে মোড়ানো সেই গোলাপ দুটো। ফুল দুটি আরিসার মুখের সামনে তুলে ধরে মৃদুস্বরে বললো,
“তোমার জন্য।”

আরিসা চুপচাপ তাকালো গোলাপ দুটোর দিকে। হঠাৎ কিছু পুরোনো স্মৃতি নীরবে ভিড় করছে তার চোখে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে সায়েরিনের চোখে চোখ রাখলো সে।

সায়েরিন নরম কণ্ঠে বললো,
“তুমি শ্বেত গোলাপ পছন্দ করো আমি জানি। তাই এনেছি আমাদের বাগান থেকে। ঘ্রাণ নাও। মন ভালো হয়ে যাবে কথা দিচ্ছি।”

সায়েরিন নিঃশব্দে এগিয়ে ধরেছিল গোলাপ দুটি। আরিসা মুখ তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো কয়েক যুবকের হৈচৈ। মুহূর্তেই বদলে গেলো পরিবেশ। আরিসা দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। আচমকা আরিসার নড়াচড়ায় এবং হাতের ধাক্কায় সায়েরিনের হাত থেকে ফুল দুটি নিচে পড়ে গেলো। স্নিগ্ধ শুভ্র গোলাপদুটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে রঙ হারিয়ে ফেললো নিমিষেই। মাটি ছুঁয়ে ফুল দুটির সৌন্দর্যও ফিকে হয়ে এলো।

সায়েরিন একবার তাকাল আরিসার মুখমন্ডলের দিকে। আবার তাকালো নিচে মাটিতে পড়ে থাকা সেই গোলাপগুলোর দিকে‌ যা আর কখনো আরিসার হাতে দেওয়া সম্ভব হবে না।

আরিসার দৃষ্টি এদিক-সেদিক খুঁজছে। ফিরে আসা চার যুবক উল্লাসে ভরপুর। হাতে রহস্যময় বস্তু নিয়ে হাসতে হাসতে প্রবেশ করছে। কিন্তু কায়েরীথ এখনো ফেরেনি। আরিসা নিজের পোশাকের এক প্রান্ত মুঠো করে চেপে ধরলো। নিজের অস্থিরতা লুকাতে চাইছে সে। আরিসার চোখে অপেক্ষায় ভরপুর। কপালে বড় চিন্তার ভাঁজ। পাশ থেকে বাবার মেজো ভাই এড্রিয়ান কঠোর কণ্ঠে বললেন,
"আরিসা! বসো, সবাই দেখছে।"

আরিসা চোখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকালো। আজকে এখানে বসার অনুমতিও নিতে হয়েছে আভ্রকে ব্যবহার করে। নাহলে এড্রিয়ান ফেইথ যা মানুষ আরিসাকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। তবে আভ্রর কথা সহজেই মেনে চলে। তাছাড়া সেদিন রাজ্যসভায় আরিসাকে একবার দর্শন করে ফেলেছিল সকলে। তাই শুধু শুধু আরিসাকে লুকিয়ে রাখার তাৎপর্য কী? তাই হয়তো সহজেই মেনে নিয়েছিলেন তিনি।

চোখের ইশারায় আবার বসতে ইঙ্গিত করলেন এড্রিয়ান ফেইথ। কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরের ভার সইতে না পেরে ধসে পড়ার মতো চেয়ারে বসে পড়লো আরিসা। সময় বয়ে যাচ্ছে। চারজন ফিরেছে আর এখনো একজন। শুধু একজনের অপেক্ষা।

সায়েরিন আরিসার দিক থেকে চোখ সরালো না। নরম গলায় বললো,
"তুমি কাউকে খুঁজছো, আরিসা?"

আরিসা চোখ না সরিয়েই হালকা স্বরে বললো,
"হুম।"

সায়েরিন কিছুক্ষণ থেমে থেকে নিঃশ্বাস ফেলল,
"তুমি জানো আমাদের বিবাহ ঠিক হয়েছে?"

আরিসার কণ্ঠ কঠিন হলো,
"এখন এসব কথা বলার জন্য উপযুক্ত সময় নয়।"

"কিন্তু আমি বলতে চাই। তাকাও আমার দিকে।"

সায়েরিন আরিসার হাতের উপর ধরা হাতটি রাখতেই মাঠজুড়ে হঠাৎ করে এক উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। দূর থেকে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো কায়েরীথ। তার দৃষ্টিতে বিজয়ের দীপ্তি এবং মুখে এক আভিজাত্যভরা শান্ত হাসি। আকাশি চোখ দুটি ঠিকরে আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে আর হালকা গোলাপী ঠোঁটে খেলে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। এই দৃশ্য দেখে আরিসা এক ঝটকায় সায়েরিনের হাত সরিয়ে দিলো। দাঁড়িয়ে পড়লো সে।

সায়েরিনের ও চোখ গেলো সেই যুবকের দিকে। সে আর চুপ থাকেনি। তার অভিমান আর দ্বিধা মিলেমিশে হয়ে উঠলো প্রশ্ন। সেও দাঁড়িয়ে আবারো আরিসার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে শুধালো,
"আরিসা! কে এই ছেলে?"

আরিসা নিশ্চুপ। মুখে কোনো শব্দ নেই। সে হাত ছাড়িয়ে উত্তর না দিয়ে জোরে হাততালি দিলো। সকলের দৃষ্টি সেই কায়েরীথের দিকে কেন্দ্রীভূত হলো। ওদিকে কায়েরীথের চোখও পড়েছে আরিসার চোখে। এক মুহূর্তে দুজনের দৃষ্টিতে খেলে গেল হাজারো অনুচ্চারিত কথা। রাজকুমারীর চোখে সেই উজ্জ্বলতা দেখে কায়েরীথ থমকে গেলো এবং চমকে ওঠলো।

সায়েরিন সেই দুই চোখের ভাষা পড়তে পড়তে আবারো আসন গ্রহণ করলো।

****

"কী ব্যাপার? আপনি আমার জন্য এতো খুশি হচ্ছেন?"

আরিসা হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। কক্ষের বাইরে পাহারা দিচ্ছে দুইজন দাসী। কায়েরীথ সেদিকে কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থির রাখলো। তারপর চোখ ঘুরিয়ে এই প্রশ্ন করলো।

"কারণ আমি তোমাকে ব্যবহার করবো।"

"এর অর্থ?"
ভ্রু কুঞ্চিত হলো কায়েরীথের। কপালে ভাঁজ পড়লো আলতো করে।

"তুমি আমার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করবে। যেহেতু প্রাসাদে প্রবেশ করেই গেছো, এই দায়িত্ব পালনে কেউ তোমাকে আটকাতে পারবে না।"

কায়েরীথ ঠোঁটে একরাশ তির্যক হাসি মেখে ধীরে ধীরে রাজপ্রাসাদের বিশ্রামাগারের ভেতর হাঁটতে লাগলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো অলঙ্কারপট্টল ঘরটির প্রতিটি কোণ। এরপর নিঃসাড় গলায় বললো,
"আপনি কি মনে করেছেন আপনি চাইলে আমি নিজেকে সঁপে দেবো? এতোই কি সস্তা আমি? আপনি ভুল জানেন রাজকুমারী। আমি বিক্রির জন্য দাঁড়ানো কোনো নামহীন সৈনিক নই।"

বলে সে ঘুরে দাঁড়ালো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই আরিসা কড়া কণ্ঠে বলে উঠলো,
"বের হয়ে যেতে বলিনি আমি। তোমার জন্যই এই প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল। তোমাকে প্রাসাদে আনার কৌশল এটাই। এখন আমি যা বলবো, তাই করতে হবে তোমাকে।"

নীরবতা ঘনিয়ে এলো ঘরে। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। একে অন্যের চোখে ঝলসে উঠছে অভিমান, দ্বন্দ্ব আর একরাশ অমোঘ টান। কায়েরীথ আবারো উল্টো ঘুরে এগিয়ে আসলো। আরিসার তপ্ত এবং শক্ত হয়ে থাকা চোখে চোখ রেখে বললো,
"আপনার হাতের মুঠোয় বন্দি না আমি!"

"আমার দেহরক্ষী হয়ে যাও। তোমার লক্ষ্য পূরণে আমি সাহায্য করবো, ক্রুশ।"

কায়েরীথ থেমে দাঁড়ালো। তার ক্ষীণ চোখজোড়া আরিসার চোখে স্থির হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।

"আপনি জানেন আমার লক্ষ্য কী? কিংবা উদ্দেশ্য?"

"না।" আরিসা নিঃসঙ্কোচে বললো, "তবু আমার তোমাকে দরকার।"

কায়েরীথ হেসে উঠলো, খুব জোরে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"আপনার মতো বিচক্ষণ এবং জ্ঞানী কেউ এতটা আবেগে কথা বলছে? সন্দেহ জাগে বৈকি!"

আরিসার মুখে তখনো কোনও ভাবান্তর নেই। সে বললো,
"সময় হলে সব সন্দেহ কেটে যাবে, ক্রুশ। আপাতত আমার নির্দেশ মেনে চল।"

প্রতিযোগীদের বিজয়ের পর একে একে নাম ঘোষণা করা হলো। প্রত্যেকের কাজ নির্ধারিত হলো ধাপে ধাপে। উৎসুক জনতার ভিড়ের মাঝে যখন কায়েরীথের নাম ডাকা হলো, সকলের দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হলো।

ঠিক তখনই রাজকুমারী আরিসা নিজে মঞ্চে উঠে এলো। আভ্রর হাত থেকে ঘোষণাপত্রটি নিয়ে নিয়ে বললো দৃঢ় কণ্ঠে,
"কায়েরীথ আলেকজান্ডার ক্রুশ! আপনি আমার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করবেন।"

হঠাৎ এমন ঘোষণা শুনে আভ্রসহ পুরো মাঠ হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময়ে সকলের ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। অনেকের মুখে কথা চলছে রাজ্যাভিষেক না হওয়ার আগেই একজন পুরুষকে দেহরক্ষী হিসেবে চাইছে রাজকুমারী? তার না বিবাহ হবে?

আভ্র চোখ বড় করে বললো,
"এসব কী বলছিস, আরিসা? দেহরক্ষী? তোর দেহরক্ষী লাগবে কেনো?"

আরিসা ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত করলো এক মুহূর্ত। তারপর শান্ত এবং কঠোর কণ্ঠে বললো,
"আমি যা বলেছি তাই ই শেষ কথা। আর এ বিষয়ে কোনো আপত্তি শুনতে চাই না।"

এড্রিয়ান ফেইথ এগিয়ে আসলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
"আরিসা সব জায়গাতে নিজের মনমানী করতে পারো না তুমি। দেহরক্ষী হওয়ার জন্য তাকে প্রথমে যোদ্ধা হতে হবে। কিন্তু ছেলেটি সাধারণ এক পুরুষ।"

কায়েরীথ এক কদম এগিয়ে আসলো‌। ঠোঁট খুলে বললো,
"আমি যোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিতে রাজি আছি, মহামান্য।"

"বালক,যোদ্ধা তারাই হতে পারবে যারা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছে। কোনো সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সদস্য যোদ্ধা হতে পারবে না। তাদেরকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া নীতি বিরুদ্ধ।"

আরিসা ধীরে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো এড্রিয়ান ফেইথের দিকে। নিম্ন স্বরে বললো,
"মেজো আরবান ( বাবা)! আপনি চিন্তিত হবেন না আমি কায়েরীথ আলেকজান্ডার ক্রুশকে নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দেবো।"

এড্রিয়ান ফেইথ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্রোধ আটকালেন। গম্ভীর মুখে বললেন,
"আমি এসব কোনোমতে স্বীকৃতি দিতে পারছি না। রাজার সাথে কথা বলো।"

তারপর আর কিছু না বলে পেছন ফিরে সরে গেলেন তিনি। ঘোষণা এখানেই শেষ হলো। ধীরে ধীরে লোকজন খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে যেতে লাগলো। চারদিকে নেমে এলো হালকা স্নিগ্ধতা। আরিসা দূর থেকে চোখে চোখ রাখলো কায়েরীথের সঙ্গে। কায়েরীথকে ইশারা করে শান্ত হতে বললো আরিসা। কায়েরীথ তার দৃষ্টি নামিয়ে মাথা নাড়লো।

*****

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করেছে কায়েরীথ। পেট ভরে গেছে। কিন্তু মন তবুও ফাঁকা ফাঁকা। শেষ কবে এমন গাঢ় স্বাদের খাবার খেয়েছে মনে করতে পারছে না সে। সম্ভবত ছোটবেলায় মায়ের হাতের রান্না। সেই স্মৃতি আজও অমলিন। হৃদয়ের কোনো কোণে আলতো করে বাসা বেঁধে আছে। হ্যাঁ, কায়েরীথ দরিদ্র ছিল না কখনও। সম্ভ্রান্ত পরিবারেই জন্ম তার। ছিল খুব বড় বাড়ি, ছিল সম্মান, ছিল গর্ব। তার বাবা এই রাজপ্রাসাদেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
কিন্তু ওই যে একটা কথা আছে না? কাছের মানুষই সবচেয়ে গভীর ক্ষতটা দেয়।

বিশ্বাস, ক্ষমতা আর কূটনীতি! সবকিছু মিলিয়ে কঠিন খেলায় মেতেছিল সকলে। এ খেলায় টিকে থাকতে গেলে শুধু ভালোবাসা বা সততায় চলে না। প্রয়োজন হয় চালাকি, ত্যাগ, আর কখনও কখনও নিজেকে ভুলে যাওয়ার মত শক্তি। আর কায়েরীথ! সে তো হারিয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু এখন নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। বিশ্বাসঘাতকতার জবাব কীভাবে দিতে হবে তার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। সে এখনো ভুলেনি তার বাবার শেষ বলে যাওয়া কথাগুলো।

কায়েরীথ রাজপ্রাসাদের বামদিকে অবস্থানরত এক উন্মুক্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খুব জোরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। সমগ্র হুডোবাসীকে দূর হতে দেখা সম্ভব। আর রাতের আকাশ তা তো বিশাল। এতো বিশাল লাগে যে চোখ জুড়িয়ে যায়। কায়েরীথ চোখ বন্ধ করে বিরবির করলো,
"আমি তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে প্রাসাদে পৌঁছে গেছি, বাবা!"

হঠাৎ কারো স্পর্শে চমকে উঠলো কায়েরীথ। ভয় পেলো কিছুটা। তার কথাবার্তা কেউ শুনে ফেললো না তো? পেছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়লো অচেনা পুরুষের মুখ। তবে সে পুরোপুরি অচেনা নয়! স্মৃতির খোঁজে কিছুটা ঘাঁটতেই মনে পড়লো এই লোকটিকে সে আগেই দেখেছে। ঠিক রাজকুমারীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল তখন।

পুরুষটি অবজ্ঞার ভঙ্গিতে কায়েরীথের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। তারপর বিরক্ত মুখে নিজের আঙুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
"ছিঃ! কাঁদায় পা রেখে ফেললাম।"

কায়েরীথ ও নিজের কাঁধ ঝেড়ে বললো,
"আভিজাত্য পা কাঁদায় পড়ে কাঁদার সম্মানহানি হয়। তাই ঠিকমতো দেখেশুনে হাঁটবেন, জনাব।"

সায়েরীন ভ্রু কুঁচকে তাকালো কায়েরীথের দিকে। তারপর ঠোঁটে এক চিলতে ব্যঙ্গ মিশ্রিত হাসি টেনে বললো,
"বালক বয়স কম হলেও ভালোই তো কথা বলো। কিন্তু রাজকুমারীর সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কী, জানতে পারি?"

কায়েরীথ নির্ভার গলায় উত্তর দিলো,
"আদান-প্রদানের সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আপনি কে?"

সায়েরীন গলা সোজা করে গর্বের সঙ্গে বললো,
"আমি রাজপ্রাসাদের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পেশায় যোদ্ধা, পরিচয়ে সৈনিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা আমি রাজা মহাশয়ের বন্ধু-পুত্র। আমার পিতা এই রাজ্যের বহু স্থানের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন।"

কায়েরীথ বিস্ময়ের ভান করে কাঁধ ঝাঁকালো। তার কিছু বলার আগেই সায়েরীন আগ বাড়িয়ে বললো,
"আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি আরিসার হবু জামাই! তাই দূরে দূরে থাকবে ওর থেকে।"

কায়েরীথ চোখ বড় করে হাততালি দিয়ে হেসে উঠলো,
"অবশ্যই! অভিনন্দন! অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে আপনি যখন রয়েছেন, তখন রাজকুমারী কেনো একজন দেহরক্ষীর খোঁজ করছেন?"

সায়েরীনের চোয়াল শক্ত হলো। ঠোঁট চেপে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
"তা তো আমারও প্রশ্ন! নিশ্চয়ই তুমি কিছু করেছো?"

কায়েরীথ মাথা নাড়লো। স্বরটাকে নরম করলো, কিন্তু ব্যঙ্গ লুকোল না,
"আমি আর করবোই বা কী? দরিদ্র বলেই না সব দোষ আমার ঘাড়ে! তবে আপনি ভুল মানুষকে দোষ দিচ্ছেন, প্রশ্নের উত্তর কিন্তু রাজকুমারীর কাছেই আছে। তাকে জিজ্ঞেস করুন না। নাকি তিনি আপনার প্রশ্ন এড়িয়ে চলেন? কোনটা বলবেন?"

সায়েরীনের মুখে অসহায় রাগ জমে উঠলো। আর কায়েরীথের ঠোঁটে ঝুলে রইলো হাসি। সে পা দিয়ে জোরে আওয়াজ করে স্থান ত্যাগ করলো। কায়েরীথ চেয়ে রইল তার যাওয়ার পথের দিকে। ভালোই মজা পেয়েছে লোকটার সাথে কথা বলে। এই লোকটাও হতে পারে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মহড়া। কায়েরীথ আবারো ঘুরে দাঁড়ালো শীতল বাতাস তার শরীর ছুঁইয়ে দিলো। শরীরের লোমগুলো আচমকা দাঁড়িয়ে গেলো।কালকে থেকে শুরু হবে নতুন পথচলা। এই জীবনযুদ্ধ কবে শেষ হবে বলা যায় না। তাছাড়া কায়েরীথ এই যুদ্ধ শেষ হতে দিতে চায় না। সে একদিক দিয়ে চায় নিজের কার্য হাসিল করতে, অপরদিকে রাজপ্রাসাদে লুকিয়ে রাখা সেই অমৃত শক্তি গ্রহণ করতে। কায়েরীথের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp