কুহেলিকার দেশে হৃদয়ের খোঁজে - ইলমা বেহরোজ - অনু গল্প


          অলন্দপুরের শান্ত, নির্জন গ্রাম নয়াপাড়ায় ইদ্রিস মোল্লার বাড়ির পশ্চিম কোণের ঘরটির পড়ার টেবিলের পাশে বসে আছে হেমলতা। বাবা আদর করে ডাকেন হেমা। হাতে একটি পুরনো রেডিও। রেডিওর ভেতর থেকে ভেসে আসছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা।

'পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জানিয়েছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য।'

সে কিছুটা ঝুঁকে বসে রেডিওর দিকে। সারা দেশের মানুষের মুখে এখন শুধু একটিই কথা, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত। তবে, সেই জয় কি আসলেই নিশ্চিত? পশ্চিম পাকিস্তানিরা কি সহজে তাদের ক্ষমতা ছাড়বে? 

খবর শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় সঙ্গীত অনুষ্ঠান। হেমা রেডিওর ভলিউম আরও একটু বাড়িয়ে দেয়। 

গানের কলি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। বাইরে ঝিঁঝিপোকার একটানা ডাক। হেমা চোখ বন্ধ করে এক নিবিষ্ট মগ্নতায় গান শুনছে। 

সেই নির্জন মুহূর্তে হঠাৎ করেই মৃদু গলা ভেসে আসে, 'হেমা, মাগো...'

সে অবচেতনভাবে চোখ খুলে দরজার দিকে তাকায়। ঘরের আবছা আলোয় কিছুটা বিস্ময়ের সাথে দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা ইদ্রিস মোল্লা। শরীর খানিকটা ভাঙা, অসুস্থতার পীড়ায় কুঁজো হয়ে পড়েছে। হাঁটতে পারে, তবে ধীর গতিতে। কানে কম শোনেন, মাঝে মাঝে কিছু কথা তার কাছে ধোঁয়ার মতো হয়ে যায়। তখন কিছুই শুনতে পান না।

হেমা তার ভাসা ভাসা চোখ দুটি মেলে কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে, তারপর দ্রুত উঠে গিয়ে বাবার হাত ধরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিল।

ইদ্রিস মোল্লার দৃষ্টি পড়ে হেমার পড়ার টেবিলের ওপর। বইগুলো পুরনো, কয়েকটি একেবারে ক্ষয়প্রাপ্ত, অথচ সেগুলোর প্রতি মেয়েটার ভালোবাসা ও যত্ন কোনোভাবেই কমেনি। মলিন, ধূসর হয়ে যাওয়ার পরেও সেগুলোর প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। বছর দুয়েক আগে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাটি হেমার পড়াশোনা থামিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ের পর থেকে, কোনোভাবেই জীবনের রাস্তাটি আবার পুরোনো গতি ফিরে পায়নি। 

কখনো কখনো, জীবনের এমন সময় আসে, যখন মানুষের সমস্ত চেষ্টাই নিষ্ফল হয়ে যায়, নিয়তি তাকে তার পছন্দের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, এবং আর কোনো বিকল্প পথ খোলা রাখে না। হেমার জীবনে ঠিক তেমন একটি মুহূর্তই এসেছিল। সেই মুহূর্তে, শুধু অন্ধকার এবং অবসাদ ছিল, কোন আলো বা আশার রশ্মি ছিল না।

ইদ্রিস মোল্লা বইগুলো থেকে চোখ সরিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু লুকোতে চেষ্টা করলেন। গলার স্বর যতটা সম্ভব শক্ত রেখে বললেন, 'তোর বিয়ে ঠিক করেছি। তিন দিন পরই বিয়ে। ছেলে দেখতে-শুনতে মানানসই, পাশের পাড়ার মোড়ল বাড়ির বড় ছেলে।'

হেমার কাজল মাখা চোখ দুটো একপলকে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। পরনে কলাপাতা রঙের শাড়ি, দুপাশে দুলছে দুটো কালো চুলের বেণী। খবরটা শুনে সে একদণ্ড ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর, ভারী গলায় বলল, 'হঠাৎ... হঠাৎ বিয়ে কেন?'

যেন প্রশ্ন করেনি, বরং আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে এমনভাবে দরজার ওপাশ থেকে মনজুরা চিৎকার করে বেরিয়ে এলেন, 'এইডা কেমন কথা কইলি লতা? তোর কি বিয়ের বয়স হয় নাই? বাপের ঘাড়ে বইয়া আর কত খাবি? কেউ যে তোরে বিয়ে করতে চাইছে, এডাই তো তোগো সাত পুরুষের কপাল! এমনেই শরীলের রং ময়লা, তার উপর কলঙ্কিনী... তোর যে বিয়া হইব, হেইডাই তো ভাবি নাই। বিয়ের প্রস্তাব যখন আইছে, ভালোয় ভালোয় বিয়ে কইরা বাপের ঘাড় থেকে নাম মা। আর জ্বালাইস না। বাপটারে অন্তত শান্তিতে মরতে দে।'

হেমা বাবার দিকে তাকালো জলভরা চোখে। ছুরির মতো তীক্ষ্ণ মায়ের কটুবাক্য আজ নতুন নয়, বছরের পর বছর ধরে শোনা বাক্যগুলো তার কানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মায়ের কথা আর তাকে ব্যথা দেয় না। আজ সে অন্য কারণে আহত, ভেঙে পড়ছে ভেতরে ভেতরে। তার বাবা... যে মানুষটি তাকে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে স্নেহে-ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছিলেন, যে সবসময় তার সমস্যা আর চাওয়া-পাওয়ায় পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেই মানুষটা আজ একেবারে চুপ। নীরবে শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তার এই নীরবতা যেন বলছে, হেমলতা নামের মেয়েটি একটা অভিশাপ, এই অভিশাপ...এই দূর্ভাগ্য তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন বহুকাল ধরে ।

হেমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে শুধুই বোঝা, তার কোনো দাম নেই। কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, এটাই নাকি তার সাত পুরুষের ভাগ্য!

ইদ্রিস মোল্লা মেয়ের মুখে অসহায়ত্বের ছাপ লক্ষ্য করে ধরা গলায় বললেন, 'মাগো, আমি কখনো তোর খারাপ চাইনি।'

হেমা শুধু প্রশ্ন করল, 'ওই বাড়ির লোকেরা আমার সম্বন্ধে সব জানে?'

ইদ্রিস মোল্লা হ্যাঁ সম্মতিসূচক মাথা দোলালেন। হেমাও নীরবে বাবার সিদ্ধান্ত শিরোধার্য করল।

পরদিন গ্রামের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল হেমার বিয়ের সংবাদ। সকাল পেরিয়ে, দুপুর গড়িয়ে, দিনের আলো যখন পাটকাঠির মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল হেমা উঠানে ঝাঁটা দিচ্ছিল। হঠাৎ বাজারের জট পাগলি মাথায় গামছা জড়িয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় সামনে। তার দাঁতে পানের রক্তিম রঙের ছাপ, মুখের কোণে হাসি নিয়ে বলে, 'তোর নাকি বিয়া?'

হেমা উত্তর দেওয়ার আগেই জট পাগলি খিলখিল ধ্বনিতে হেসে ওঠে, মুখে আঁচল চেপে কাকঁড়ার মতো আঙুলে ইঙ্গিত করে বলে, 'তুইতো বাঁজা। তোরে কোন পাগলা বিয়া করতে যাইতাছে? কালা-কুচ্ছিত, মরা বাঁশের খুটির লাহান খাড়া...মোড়লের ছাওয়াল তোরে থুইয়া ভাগবে, বিয়ার পইল্লা রাইত্যাই মাথায় হাত দিয়া কানবে।'

হেমার অন্তরাত্মা যেন অদৃশ্য কোনো পাথরের আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে পড়ে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ঘরে চলে যায়। পাগলের কথা গায়ে নিতে নেই, তারা কত কিছুই বলে! কিন্তু জট পাগলির কথাগুলো তো এই গ্রামের সবারই কথা...এমনকি স্বয়ং তার মায়ের কথা!

সেই দিনই সন্ধ্যা বেলায় হেমা শোনে, যার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তার নাম মোর্শেদ মোড়ল। ডাকনাম মূসা। জনপ্রবাদে সে অত্যন্ত খিটখিটে প্রকৃতির, ক্রোধে অন্ধ হয়ে ঘরের সামগ্রী চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। গায়ের রং কালো। বিদ্যার জ্যোতি তার জীবনে কখনো প্রবেশ করেনি, গণ্ডমূর্খ।

শুনে হেমার কপাল কুঁচকে যায়। আবারও কালো রঙ! এই কালিমার অভিশাপ তার সন্তান-সন্ততিও বহন করবে! মা-বাবা কালো হলে সন্তানরাও তো সেই রঙই পাবে। তার উপর রাগী, অক্ষরজ্ঞানহীন! পুরোপুরি তার বিপরীত মেরুর। হেমার বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসে। এই ধরণী দ্বিখণ্ডিত হোক, সে গোপনে আশ্রয় নিক সেই দ্বিধায়। এই জগতের যাবতীয় অমঙ্গল তারই জন্য নির্দিষ্ট কেন? টানা তিন দিন সে কান্না করে। কান্না করতে করতে কবুল বলে স্বামীরূপে গ্রহণ করে অদৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে। সমগ্র অস্তিত্ব সমর্পণ করে সেই পুরুষের পদতলে।

তারপর এল আয়না দেখার পর্ব। হেমা'র মাথায় ঘোমটা টানা, চোখে নোনা জলের ধারা। চারপাশে গুঞ্জন, কানাঘুষা আর উত্তেজনার রোল। 

দু'জন ঢ্যাঙা চেহারার ভাবি, বরকে চেপে ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এলো। হেমার পাশে বসিয়ে দিল জোর করে। সারাজীবন পুরুষের স্পর্শ থেকে দূরে থাকা হেমা কেমন যেন কাঠ হয়ে গেল বরের দেহের ছোঁয়া পেয়ে।

মোমেনা ভাবির গালের একপাশে পানের রসে রাঙা দাগ৷ সে হাসিমুখে দুজনের সামনে জরির কাজ করা কাঠের আয়না ধরে মূসাকে চোখ টিপে বলল, 'ল মূসা, দেখ্ দেখ্, তোর বউয়ের লাল টুকটুকে মুখটা দেখ্।'

মূসা নড়ল না, তাকালও না। সে পাথরের মূর্তির মত বসে রইল।

পেছন থেকে একজন বয়স্ক মহিলা, কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীর, গায়ের চামড়া কুঁচকানো খেজুর পাতার মত, তামাকের গন্ধ ভরা শ্বাসে বলল, 'ওর বউতো কালা কুলি, লাল টুকটুক কই পাইলি রে মোমেনা? চোক্ষের মাথা খাইছস?'

মোমেনার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। একটু জিরিয়ে নিয়ে বলল, 'কালা-সাদা বউ আবার কি চাচি? লাল শাড়ি পরা সব বউই তো লাল টুকটুকে বউ।'

বুড়ি ছুক করে টিনের দেয়ালে পানের পিক ফেলে বলল, 'বাপরে বাপ, এই নটি'র বিয়াও যে দেখতে হইব হেইডা কি আর ভাবছিলাম! কি ভালো ছেড়া আমগোর। ধানের গোলায় শুকনা খাবিচ্যা! যা কাহিনি করছে ছেড়ি, ছে ছে...!'

হেমার কলঙ্কের কথা অলন্দপুরের সবাই জানে। তারমধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন জ্ঞানীগুণী ছিল, যারা এই তামাশা একদমই বিশ্বাস করেনি, তাদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন মূসার বাবা মিয়াফর মোড়ল। 

মিয়াফর মোড়ল হেমাকে দেখেছেন মাটির পুতুল থেকে কলসি-কাঁখা মেয়ে হয়ে উঠতে। তার চোখে মেয়েটি ভোরের কাঁচা হলুদের মতো খাঁটি মনের। সহানুভূতির গাঙ নিয়ে বয়ে চলে তার হৃদয়, ভদ্রতার বাঁধে ঘেরা। নিষ্ঠায় অন্যন্য, জেদ থাকলেও নম্র। পড়াশোনায় এমন মেধাবী যে, গাঁয়ের সুলেমান মাস্টারের মুখে তার প্রশংসার শেষ নেই। সে যতটুকু পড়েছে তা এই গেরামে আর কোনো মেয়ে তো দূরের কথা, অনেক ছেলেও পড়েনি।

গায়ের রংই কি সব? এমন সোনার টুকরো মেয়ে তার রগচটা, গণ্ডমূর্খ আর রাতভর জুয়া-তাস খেলা ছেলের জন্য কখনোই জোটানো সম্ভব হতো না, যদি না হেমার নামে ওই মিথ্যা অপবাদ রটত। ইদ্রিস মোল্লা খাঁটি রক্তের খোঁজে থাকা মানুষ, কখনোই তার ছেলের সঙ্গে হেমার বিয়ে দিত না। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। একথা মোড়ল সাহেব মূসাকে বারবার বলে দিয়েছেন। 
বাবার সমর্থনের সম্মানে মূসা প্রতিবাদ করে বলল, 'এই ছেড়ি কী এমন করছে যে তার বিয়া হইব না? আপনেরা নিজের চোখে দেখছেন? আল্লাহ পাকের দোহাই দিয়া কন, কেউ কি তারে পরপুরুষের লগে দেখছে? মাইনসের গুজুবে আর কত লাফাইবেন?'

'ওরে হারামজাদা! আমার কথা কাটাস!' বুড়ি রাগে কাঠ হয়ে গেল। গজদাঁত বের করে রাগভরা কণ্ঠে কৃশকায় শরীর কাঁপিয়ে বলল, 'ওর মায়েই তো কইছে। মায় কি আর মিছা কয়?'
বুড়ি তার খয়েরি-রঙিন থুতু ছিটাল কথার শেষে। টিনের দেয়ালে তার থুতুর ছিটেফোঁটা এসে পড়ল। 

মূসা ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার চোখের মণি স্থির, শ্বাস ভারী, রাগের ঝাল নাকের ডগায় জমা। সে রেগে গেলে ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়াবে, একটা কাণ্ড বেঁধে যাবে। এইসব ভেবে মোমেনা ভাবি ব্যাপারটা সামলাতে দ্রুত এগিয়ে এলো। মূসার বাহু চেপে ধরে বলল, 'আচ্ছা আচ্ছা, যথেষ্ট অইছে। পুরনো কথা এখন হাওয়া বাতাসে মিলাইয়া গেছে। এইবার বউয়ের মুখ দেখ মূসা...সময় যাইতেছে।'

হেমার কান্না থেমে গেছে। একটা থমকানো শ্বাস তার বুকে আটকে ছিল, সেটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল সে। এই প্রথম কেউ এভাবে শক্ত গলায় তার হয়ে কথা বলল। কৃতজ্ঞচিত্তে সে চোখ তুলল মানুষটার মুখ দেখতে, আলতো করে আয়নায় তাকাল।

মূসারও তখন চোখ পড়েছে আয়নায়। হালকা গোঁফে ঢাকা কালো বর্ণের সরল একটা মুখ! খিটখিটে স্বভাবের যে রাগী রাগী মুখ কল্পনা করেছিল তার ছিটেফোঁটাও নেই...একেবারে সরল একটা মুখ। গঠন লম্বাটে, নাকটা পাহাড়ি ঢালের মতো তীক্ষ্ণ। দুজনের চোখাচোখি হতেই হেমার বুকের ভেতর ঢেউ খেলল, শিকড় গেঁথে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো মুহূর্তে নিঃশব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এমন ঝিলিক, এমন শিহরণ তার পোড়া জীবনের কোথাও কোনোদিন আসেনি। যেন দগ্ধ মাটিতে প্রথমবারের মতো বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল, আর সেই আর্দ্রতার ছোঁয়ায় রুক্ষ মাটি অলক্ষ্যে কোমল হয়ে উঠল।

একটা উষ্ণতা, একটা সম্ভাবনা, একটা নীরব চঞ্চলতা রক্তের প্রবাহে ছুটে চলল ধমনী ধরে। মুহূর্তে জন্মানো কৃতজ্ঞতা পরিণত হলো এক দুর্বার ভালো-লাগায়। মাথার ভেতর কেমন এক ভনভনানি, লজ্জায় গা-জুড়ানো শিহরণ, আর পেটের গভীরে যেন অসংখ্য অদৃশ্য পাখনা ঝাপটানোর স্পন্দন! যেন সহস্র পাখি একসঙ্গে ডানা মেলছে তার ভেতর।

—————

মূসা দরজার কপাট খুলতেই খটখটে শব্দ উঠে ঘরটির নিস্তব্ধতাকে দ্বিখণ্ডিত করে দিল। কুয়াশার মতো ম্লান হারিকেনের আলোয় তার দীর্ঘদেহী ছায়া টিনের দেয়ালে আঁকা থাকল নিঃশব্দ, দাপুটে উপস্থিতি নিয়ে।

হেমা রক্তিম ঘোমটার আড়ালে নিঃশ্বাস আটকে বসে আছে। তার দৃষ্টি বিভ্রান্ত৷ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, সে কি ভয় পাচ্ছে, লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে, নাকি অজানা কোনো শিহরণে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। 

পুরুষ…! এক জলজ্যান্ত, অচেনা পুরুষের সঙ্গে আজ এক ঘরে, তার পাশে থাকবে, হয়তো স্পর্শ করবে! এই ভাবনাটিই তার স্নায়ুতে শীতল বিদ্যুৎ বইয়ে দিচ্ছে।

দোহারা গড়নের মূসা বন্দিশালায় আটকে পড়া রাজপুত্রের মতো ধীরপায়ে পায়চারি করছে ঘরজুড়ে৷ 

ঘরের কোণে ধূপকাঠির ধোঁয়া, বাতাসে ফুলের গন্ধ। হেমা চোখ নামিয়ে রাখল, আঙুলগুলো শাড়ির পাড় মুঠোয় চেপে ধরল।

মূসা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, 'ঘুমাইয়া পড়ো।'

কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই হারিকেনের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল, বাতাসে শুধু ধূপের স্তব্ধ ঘ্রাণ।

হেমা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে একপাশে কুঁকড়ে শুয়ে রইল। মনের ভেতর এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। আরেকবার যদি চোখাচোখি হতো! সেই প্রথমবার…আয়না দেখায় আচমকা পাশে বসে থাকা পুরুষটির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো। মুহূর্তের সেই চোখাচোখি, সেই বিদ্যুৎরেখার মতো শিহরণে মনে হয়েছিল বুকের গভীরে ছটফট করছে রঙিন ডানাওয়ালা অসংখ্য পাখি।

তারপর পরদিন, তারও পরদিন—যতবার মূসাকে দেখেছে, ততবার আকাশপানে চাওয়া অভাগা পাখির মতো তাকিয়ে থেকেছে, যদি আরেকবার ওই চাহনি মেলে! যদি আবার ওই জাদুকরি আলো তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে! কিন্তু মূসা তাকায় না। তার চোখে এক নিষ্ঠুর বৈরাগ্য। যেন হেমা বেগানা নারী। যেন তার দিকে তাকালে পাপ হবে...ঘোর পাপ!

হেমা জানেও না, এই মানুষটা কখন ঘরে ঢোকে, কখন কোথায় যায়! শুধু জানে, তার বুকের মধ্যে এক গাদা নামহীন অনুভূতি জমা হচ্ছে, যা সে ছুঁতে পারছে না, স্পর্শ করতে পারছে না, শুধু বয়ে চলেছে...

দুজনের মাঝের দূরত্ব টের পেয়ে একদিন মিয়াফর মোড়ল হেমাকে বারান্দায় ডাকলেন। হাতের পানের খিলিটা ঠোঁটে চেপে ধরে বললেন, 'পুরুষ মানুষ হইলো বাগহীন অশ্ব। লাগাম না ধরলে বোঝে না কোন প্রান্তরে ছুটব। আমার বড় পোলাডা হইতাছে দড়িবিহীন গবাদি! উদভ্রান্ত, অস্থির মন। ওরে বন্ধনে রাখার দায়িত্ব তোমার।'

হেমা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মিয়াফর কণ্ঠস্বর নামিয়ে বললেন, 'হে কই যায়, কই না যায় তার তদারকি করবা তুমি। এইটা তোমার অধিকার। স্ত্রী যদি নিজের স্বামীরে জড়ায়া না রাখে, তাইলে কে রাখব কও?'

হেমা বলল, 'উনি আমার সাথে ভালো করে কথাই বলেন না, আব্বা।'

'কথা বলাইবা। তুমি তার সহধর্মিণী। পত্নী যদি জেরা না করে, পুরুষমানুষ তো আরো দূরে পালাইব! বউদের খালি শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাইক্যা চুপ থাকলে অয় না। তুমি তারে নিয়ন্ত্রণে রাখবা। আমি জানি, তুমি ওইডা সাধন করতে পারবা।'

হেমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। 

তখন উঠানের বুক চিরে ঝলসে ওঠা রোদের নিচে দু'জন কামলা শ্রম ঢেলে যাচ্ছে নিঃশব্দে। বেতের ধামা বোঝাই ধান মাথায় করে এনে উঠোনে ছড়াচ্ছে। তামাটে পেশিতে টান পড়ে দম আটকে আসছে, তবুও তাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। মাঝেমধ্যে কাঠের চটা দিয়ে ধান ওলটপালট করছে, যাতে রোদে ভালোভাবে শুকায়। হেমা লম্বা করে ঘোমটা টেনে উঠোনে নেমে পায়ের তালু দিয়ে কায়দা করে বিলি কেটে ধান উল্টে দিতে লাগল।

তখন কোথা থেকে যেন গরম হাওয়ার ঢেউয়ের মতো এসে হাজির হয় মূসা। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে চকচক করছে। কাঁধের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে লোনা জলের ধারা, কপাল আর গলার ঘাম ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে মাটিতে। সে সোজা বাড়ির পেছন দিকে চলে গেল, হিজল গাছের শীতল ছায়ায়। সেখানে রাখা পুরনো কাঠের বেঞ্চে ক্লান্তভাবে বসে পড়ল। গলায় জড়ানো গামছা দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিল। 

হেমা ততক্ষণে রান্নাঘরের কোণে সাজানো নীল রঙের কৌটোগুলোর মধ্যে হাত চালাচ্ছে। একচিমটি লবণ, একচামচ চিনি, টাটকা লেবুর রস। টিনের জগে মিষ্টি ধ্বনি তুলে পানি ঢালল। তারপর, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে হিজল গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো। স্টিলের গ্লাস এগিয়ে দিল মূসার দিকে।

মূসা পা দেখেই চিনে ফেলল কে এসেছে! এমনভাবে হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিল যেন চোখে চোখ না পড়ে। এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলল। যেন হেমা চলে যায়।

গ্লাস ফেরত দেওয়ার সময় হালকা শীতলতা ছুঁয়ে গেল হাতের স্পর্শে—সেই স্পর্শ মাদিনী নদীর জলের মতো শীতল, জুড়িয়ে গেল সারা শরীর। শ্যামবর্ণের হাতে মায়ের দুটি সোনার চুড়ি কী অপূর্ব শোভা পেয়েছে!

মূসা চোখ ফিরিয়ে নিল, কোনো কথা বলল না।

হেমা চলে গেল না। বরং, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাস বইছে আলতো করে, গায়ে লেগে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরের দিগন্তে। মূসাও চুপচাপ। তাকাচ্ছে না, একটি শব্দও উচ্চারণ করছে না।

অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে হেমাই কথা বলল, 'আমাকে আপনার পছন্দ না?'

মূসা দৃষ্টি নত রেখেই প্রত্যুত্তর দিল, 'পছন্দ হইব না ক্যান?'

'তাহলে এমন এড়িয়ে চলেন কেন?'

মূসা এবারও নিস্তব্ধ। লতাপাতার উপরে নত হওয়া সূর্যরশ্মির আলোছায়ার মতো মৌনতা আচ্ছন্ন করে তার অস্তিত্বকে।

'গতকাল থেকে কোথায় ছিলেন?'

'যেইনে মন চায়।'

'বলুন আমাকে।'

'তোমারে কেন কইতে হইব?'
বাক্যটিতে কাঠিন্য ছিল, কিন্তু নিষ্ঠুরতা ছিল না।

হেমা এবার পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসে সাথে বলল, 'কারণ, আমি আপনার বিয়ে করা বউ।'

মূসার চোখ এবার তার দিকে ঘুরল। গভীর, খাঁটি এক জোড়া চাহনি। হেমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল হৃদয়। যেন মিহি হাওয়া কানে কানে কিছু বলে গেল। লজ্জায় ঘেরা পড়ল সারা অস্তিত্ব। নিজেকে অচেনা মনে হল নিজের কাছেই। ঘুরে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে গেল ঘরের দিকে। মূসা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল তার মিলিয়ে যাওয়া পদচিহ্নের দিকে।

সেদিন থেকেই মূসা টের পেতে থাকে হেমার প্রতিটি পদচারণা। হেমা যখনই আড়াল থেকে দেখে, তখন সে কেমন এক অলৌকিক ইশারায় বুঝতে পারে, তাকে একজোড়া জিজ্ঞাসু চোখ লুকিয়ে দেখছে।

যখন সে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, হেমা হারিকেনের কোমল আলোছায়ায় তার মুখের প্রতিটি রেখা খুঁটিয়ে দেখে, চুপিসারে সূরা পড়ে ফুঁ দেয়। টের পেয়েও মূসা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। স্বীয় বধূর আন্তরিক আগ্রহ উপভোগ করে নিঃশব্দে। তাদের দাম্পত্য একসাথে বসবাস করা, খাবারদাবার ভাগাভাগি করা এবং অনুভূতির এক বিশাল খালিপনে ডুবে থাকাতেই সীমাবদ্ধ।

মূসার চলাফেরা, তার প্রতিটি অভ্যেস হেমার মনে গেঁথে গেছে। তার হাঁটার ভঙ্গিও হেমার মুখস্থ। 

মূসা প্রতিদিন নিয়ম করে ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজে, আয়নার সামনে চুল আঁচড়ায়, মাঝেমধ্যে কোথায় যেন চলে যায় দুই-তিন দিন পর ফিরে, আর রেগে গেলে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। যখন ক্রোধের তীব্রতা কমে আসে, সে একটা ছোট বাচ্চার মতো বাবার পাশে চুপচাপ বসে থাকে তবুও মুখ ফুটে মাফ চায় না। এই যে বসে আছে, এটাই তার ক্ষমা চাওয়া। 

অন্যদিকে হেমা, বিয়ের দিন থেকেই যে চোখভরে কাজল পরে সেটা মূসা লক্ষ্য করেছে। হেমার সত্তায় একটা মিষ্টি আবেশ আছে, যা যে কাউকে মুগ্ধ করার মতো। অন্য কেউ হলে হয়তো মোহিত হয়ে তার জন্য নিজের সবকিছু উজাড় করে দিতে রাজি হয়ে যেত।

তার মতো পরিপাটি চালচলন, স্পষ্ট ও সাবলীল ভাষা এই গ্রামে আর কার আছে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সুমধুর কণ্ঠে কোরাআন পড়ে, শ্বশুরের যত্ন নেয়, বাড়ির প্রতিটি কোণা-কানিচা গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখে। সে আসার পর থেকেই বাড়ির চেহারাই পালটে গেছে। যে বাড়ি ছিল নিঃসঙ্গ, একঘেয়ে, সেখানে এখন বিকেলবেলা শোনা যায় শ্বশুরের সঙ্গে হেমার প্রাণবন্ত গল্পগুজব। দুজন মিলে বাগানে নতুন নতুন চারা লাগায়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে। এই বাড়ির প্রতিটি কোণই হেমার আপন হয়ে উঠেছে।

শুধু তার সঙ্গেই দূরত্ব। এমন এক অদৃশ্য বেড়া যা কখনোই পেরোনো হয় না, হওয়ার নয়। তারা একসাথে থেকেও যেন দুটো আলাদা জগতে বাস করে। দুটো ভিন্ন অস্তিত্ব, যারা একে অপরকে দেখে, বোঝে, অনুভব করে, কিন্তু পুরোপুরি ছুঁতে পারে না।

একদিন আষাঢ়ের ঘনঘটায় মূসা তার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে হাজির হয় বাড়িতে। উঠোনের পুরোনো চাতালে সারা রাত চলে তাসের খেলা। দলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বন্ধুটি হঠাৎ দেখতে পায়, হেমা জানালার ফাঁক দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা রাত সে অনড় দৃষ্টিতে তাদের দেখে গেল। এই দৃশ্য নিয়ে তারা মজা করতে শুরু করল। ঠাট্টা-তামাশায় মেতে উঠল।

ঘটনাটি মূসার মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। বন্ধুদের রাগ তাদের উপর না মিটিয়ে ভোরবেলা ঘরে ঢুকে সে হেমাকে হিড়হিড় করে ঘুম থেকে টেনে তুলে বলল, 'লুকাইয়া এত্ত দেহার কী আছে? কারে চোখ পাইত্যা দেখতাছিলা? হারা রাইত ধইরা? আব্বার তোমারে লইয়া কত গরব জানো? তোমারে তো এমন লাজহীন ভাবি নাই।'

বলেই সে বেরিয়ে গেল। কথাগুলো হেমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বিদ্ধ হলো তীক্ষ্ণ শলাকার মতো। মূসা কীভাবে বলল, 'কারে চোখ পাইত্যা দেখতাছিলা?' - সে কি জানে না হেমার চোখ কার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকে!

কত যন্ত্রণা নীরবে বহন করেছে এতদিন... অথচ এই অকিঞ্চিৎকর অভিযোগে তার অন্তর খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে! প্রেমের স্বভাবই বুঝি এমন বিস্ময়কর! যাকে আমরা প্রাণাধিক ভালোবাসি, তার দেওয়া আঁচড়ও গভীর ক্ষত হয়ে যায়।

সেদিন দিনমান সে অভুক্ত রইল। রাতে বাড়ির পিছনের ঘাটে অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইল। জীবনের সমস্ত রং যেন একসাথে মুছে গেছে।

বাবার বাড়ি থেকে এই সংসারে এসে, সে প্রথমবারের মতো জীবনের স্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এখানেও সে একা, অবহেলিত, অপমানিত। তার চরিত্রের ওপর এখানেও সন্দেহ করা হয়, আঙুল তোলা হয়!

সে অন্য কারো দিকে তাকিয়েছিল এমন অবিশ্বাস কী করে জন্ম নিল মূসার মনে? হেমা ধীরে ধীরে আঁচলের কোণা দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল।

মূসা ঘরে ঢুকে থকথকে শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায়। রাত গভীর হচ্ছে অথচ হেমার দেখা নেই। ক্রমশ চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়ল মনের কোণে। ভাবতে লাগল, সকালের কথায় মনে কষ্ট পেয়েছে নাকি? সেই কথায় আবার এমন কী ছিল যে বুকে বিঁধবে? যদিও বা লেগে থাকে, তাতে তার কী আসে যায়?

এই ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেলেও অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিল না। পাশ ফিরে শুলেও চোখে ঘুম এলো না। অধৈর্য শুধু বাড়তেই লাগল। এমন নাজুক-কোমল একটা মেয়ে... বয়সে ছোট হলেও জ্ঞানে গভীর... আর ওই মুখখানা... মায়ার ফাঁদ পাতা... কোথায় গেল সে?

শেষে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মূসা। সাবধানে খুঁজতে লাগল যেন কেউ টের না পায় সে হেমার খোঁজে বেরিয়েছে। 

নদীর ঘাটে পৌঁছে চোখে পড়ল হেমাকে। মেয়েটি মাঝে মাঝে নাক টানছে। কেঁদেছে যে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। মূসা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সামান্য কথায় এমন কান্নাকাটির কী আছে সেটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।

গলা পরিষ্কার করে, স্বর তুলে ডাকল, 'লতা, ঘরে আইয়ো। রাইতের বেলা ঘাডে বইয়া থাওন ভালা না।'

হেমা চুপ। মূসার রাগ চড়ে গেল।

'কী কইতেছি হুনো না? ঘরে আইয়ো। আব্বা দেইখা ফালাইলে কী কইবা?'

হেমা চোখের জল মুছে ত্বরিত গতিতে ঘরে ফিরে এলো। সে চায় না বাড়ির কেউ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অশান্তির আভাস পাক। কিন্তু বিছানায় শুল না, জানালার পাশে মুখ ভার করে বসে রইল। হারিকেনের উদ্ভাসিত আলো কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ছিল ঘরে৷ 

মূসা ঘরে ঢুকে হেমাকে দেখে নিঃশ্বাস ছাড়ল, 'ঘুমাইবা না? আইয়ো ঘুমাও।'

হেমা কঠিন স্বরে জবাব দিল, 'আপনি ঘুমান। আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।'

মূসা সবসময়ই নিজের আধিপত্য জাহির করতে অভ্যস্ত। এবারও সেই একই অভ্যাসে হেমার বাহু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে টেনে তুলে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, 'মুখে মুখে কথা কইবা না। ঘুমাইতে কইছি, ঘুমাও।'

হেমা তাকাল। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় তার চোখের পাতায় অশ্রুকণা ঝিলিক দিচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে মূসা বাহু ছেড়ে দিল। গলার স্বর কোমল করে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কষ্টডা কী নিয়া কও তো? এমন কানতাছো কেরে?'

হেমার চোখ থেকে জলধারা গড়িয়ে পড়ল। মূসা আবার বলল, 'কাইন্দো না। কও আমারে..কোন কথাডায় কষ্ট পাইছ?'

এতক্ষণের সঞ্চিত বেদনা আর আটকে রাখতে পারল না হেমা। কম্পমান কণ্ঠে বলল, 'আপনি কেমন করে বললেন, কারে চোখ পাইত্যা দেখতাছিলা? আপনি ছাড়া আমি কাকে দেখব? এর অর্থ কি আপনি আমাকে চরিত্রহীন ভাবেন? যেভাবে দুই বছর আগে গ্রামের লোকেরা ভেবেছিল। আমি...'

হেমা ধুকপুক করে কাঁদতে লাগল। তার কাঁধ থরথর করে কাঁপছে।

'আমি কি শুধু মিথ্যা কলঙ্কই সইব? আমার জীবনে সুখ হারাম? একটুও আনন্দ পাওয়ার অধিকার আমার নেই? মা মারল, সবাই টিটকারি দিল... নিজের বলতে কাউকে কখনো পেলাম না। বিয়ে করলাম, ভেবেছিলাম এবার আপনি আছেন। আপনিও যদি আমাকে সন্দেহের চোখে দেখেন, তবে আমি কোথায় আশ্রয় নেব? এতই অপছন্দ হলে জীবন নিয়ে নিন। আমার তো যাবার আর কোনো ঠিকানা নেই। আমি তো বন্দিনী। আমার কোনো পথ নেই। এই সংসার, আপনি আমার শেষ আশ্রয়।'

মূসার অন্তরে কিছু একটা নাড়া দিল। হেমাকে তার মনে হলো শিকারীর তাড়া খাওয়া ভীত হরিণশিশু। যাকে সুরক্ষা দিতে হবে। মূসা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল হেমাকে। হেমার মাথা এসে ঠেকল তার বুকে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় হেমার কান্না থমকে গেল। সারা দেহ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।

মূসা হেমার কপালে চুমো দিয়ে বলল, 'কাইন্দো না লতা... কাইন্দো না আর, এতো কিছু ভাইব্যা আমি ওই কথাডা কই নাই।'

মূসার শ্বাসের উষ্ণতা, ঠোঁটের স্পর্শ হেমার কপালে লাগতেই গা শিউরে উঠল। পায়ের তলা শিথিল হয়ে আসছে। সারা দেহে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। কান দিয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। অজানা অনুভূতি ছুটে বেড়াচ্ছে শিরা-উপশিরায়। এত নিকটে কখনো আসেনি মূসা...কখনো না! শক্তি হারিয়ে সে সমর্পিত হলো মূসার বাহুর উপর। চাষাবাদে পোড়া মূসার কালো শক্ত হাত আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল হেমাকে।

হারিকেনের আলো এখন আর কাঁপছে না। স্থির, অটল আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের মেঝে জুড়ে। সেই সোনালি আলোয় হেমার দুই চোখের গভীর মায়াজালে বন্দি হয়ে গেল মূসা। নিজের অতীত, বর্তমান সব কিছু যেন মুছে গেল মুহূর্তের তরে। এক অদ্ভুত মোহে আচ্ছন্ন হলো সে। নাকে ভেসে আসতে লাগল ফুলের মিষ্টি সুবাস। কোমল স্পর্শে সরিয়ে দিল জানালা দিয়ে আসা বাতাসে উড়ে যাওয়া হেমার কপালের রেশমি চুল।

দিশেহারা পথিকের মতো বলল, 'কাইন্দো না, আর কুনুদিন কাইন্দো না। কানলে তোমারে ভাল্লাগে না।' বলতে বলতে বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। দুজনে ডুব গেল এক অতল আবেগের সাগরে। যেখানে অনন্ত গভীরতা, যেখানে সময় স্থির হয়ে যায়। সেখানে তারা প্রকৃত অর্থে স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠল।

ভোররাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎ চমকে জেগে উঠল মূসা। অনুভব করল বুকের উপর আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে হেমা। এমন নির্ভরতা, এমন আকুলতায় শুধু একজনই লেপটে থাকত! সেই স্মৃতি জাগতেই তীব্র আতঙ্কে কেঁপে উঠল মূসার অন্তরাত্মা।

অতি সাবধানে হেমাকে পাশে সরিয়ে দিল সে। হেমার ঘুমন্ত মুখে একটা অদ্ভুত শান্তি। সে শান্তি দেখে মূসার বুকে কে যেন ছুরি বসাল। তবুও দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে পড়ল সদরের উদ্দেশে। রাতেই যাওয়ার কথা ছিল, কাজের ভারে সময় পায়নি। যদিও মনের গহীনে সত্য অন্য কথা বলে, হেমার সান্নিধ্যে কাটানো সময়ই তাকে আটকে রেখেছে, যা স্বীকার করতে নিজের কাছেই লজ্জা বোধ করে সে।

সদরে পৌঁছতে পৌঁছতে দিনের আলো প্রহর পেরিয়ে গেল। গ্রামের ধুলোমাটি ছেড়ে শহরের ইটপাথরের রাজ্যে এলো মূসা। সরু গলিপথ ধরে এগিয়ে গেল উঁচু বহুতল ভবনের দিকে। এটা সাধারণ বাড়ি নয়, এখানে থাকে তারা, যারা সমাজের চোখে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধপল্লীর বারাঙ্গনারা। তবে এই বারাঙ্গনারা স্বাধীন - কারো আদেশে নয়, নিজের ইচ্ছেয় বাঁচে। এদের মধ্যে একজন গোলাপী বানু, পেশাদার বারাঙ্গনা, আর তার মেয়ে বাসন্তী... মূসার জীবনের প্রথম প্রেম।

মামার বাড়ি বেড়াতে এসেই কিশোর মূসা হারিয়ে গিয়েছিল এই পাড়ায়। কিশোরী বাসন্তীর দুরন্ত হাসি আর ভোরের শিশিরের মতো চোখ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সেই প্রেম যখন জোয়ারের মতো ফুলে উঠল, তখন বাধা হয়ে দাঁড়ালো গোলাপী বানু আর মিয়াফর মোড়ল। কিন্তু প্রেমে পাগল মূসা কাউকে না জানিয়ে বাসন্তীকে বিয়ে করল। বাসন্তী তার প্রথম প্রেম, প্রথম স্ত্রী। হেমা? হেমা তো বাধ্যতার সম্পর্ক! পরিস্থিতির চাপে, পরিবারের জিদে!

বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল বাসন্তী। চাঁদের আলো যেন হাতে ধরে রাখা এমন ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, গোলাপের পাপড়ির মতো টুকটুকে গাল, আকাশপানে টানা দীর্ঘ দেহযষ্টি। এমন অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে জন্মানো কোনো নারী সে আর দেখেনি। মূসা বাসন্তীকে দেখে মুখে রোদ ফুটিয়ে হাসল। বাসন্তী কোনো সাড়া দিল না, নির্বাক প্রতিমার মতো চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল।

মূসার হাতে বেলি ফুলের সাদা মালা, বাসন্তীর পছন্দের ফুল। সেটি নিয়ে সে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। গৃহস্থালি থেকে আসা নিজের ভাগের টাকায় সে এখানে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করেছে বাসন্তীর জন্য, সব খরচ দেয়। বাসন্তীর মা থাকে নিচের তলায়।

মূসা ঘরে ঢুকতেই বাসন্তী রুষ্ট কন্ঠে, অভিমানী সুরে বলল, 'এত্তদিন পর আর আর আইতে গেলা ক্যান? ভুইল্যাই গেছো আমারে?'

মূসা বেলি ফুলের মালা বাসন্তীর কোমর অবধি নেমে আসা রেশমি কালো চুলে জড়িয়ে দিতে দিতে বলল, 'কামের মেলা চাপ আছিল গো। দম ফেলাইনের ফুরসত পাই নাই।'

'কামই তো বড়। আমারে কি আর মনে পড়ব? পুরান হইয়া গেছি না তোমার চোখে?'

মূসা বাসন্তীর নাজুক থুতনি আঙুলে তুলে ধরে বলল, 'তুমি কি কুনুদিন পুরান হইতে পারো? তুমি তো আমার চোক্ষের তারা!'

'পারি, পারি। নতুন মানুষ পাইলে পুরুছ একটা ক্যান, দছটা মাইয়ারে ভুইল্যা যাইতে পারে। আমি কি আর জানি না?'

বাসন্তীর কথা ক্ষতবিক্ষত তীরের ফলার মতো বিঁধল মূসার গায়ে। সত্যি... গতরাতে সে বাসন্তীকে ভুলে গিয়েছিল! যে বাসন্তী তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গিনী, সেই বাসন্তীকে ভুলে কীভাবে সে হেমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল? ওই বিশ্বাসঘাতকতা বুকে নিয়ে কীভাবে সে এখন বাসন্তীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে?

তাকে নির্বাক দেখে বাসন্তী চোখে জলের আভাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী ভাবতাছো? কিছু কইবা না?'

মূসা নিজেকে সামলে নিয়ে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল, 'ভাবতাছি, তোমার কাছে কয়ডা দিন বেশি কেমনে থাহন যায়!'

বাসন্তীর চোখমুখ আলোয় ভরে গেল, 'থাকবা? আমার কাছে থাকবা? ছত্যি কইতাছো? আমার বড় একলা লাগে...তুমি থাইক্যা যাও। থাইক্যা যাও...থাইক্যা যাও তুমি। কয়ডা দিন আমার কাছে থাইক্যা যাও। এই কয়দিনে আমার হৃদয়ডা যে ছুকায়া খরা লাইগ্যা গেছে।'

ছিপছিপে নাজুক দেহের অপরূপা বাসন্তীর এই আকুতি মূসার অন্তর গলিয়ে দিল। বলল, 'অনেক কষ্ট অইছে?'

'তুমি ছাড়া আমার একটা বেলাও ভালা যায় না এইডা কী তুমি জানো না?'

বলতে বলতে বাসন্তী মূসার বুকে মাথা রাখল। সেই মুহূর্তে মূসার চোখের তারায় ভেসে উঠল গতরাতের ছবি। হেমাও ঠিক এমনিভাবে বুকে মাথা রেখেছিল, একই ভঙ্গিমায়, একই আশ্রয়ে।

দিনশেষের আলো-ছায়ার খেলা চলছিল তখন। একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে, রাস্তার মাটিতে এখনো ভেজা গন্ধ। হেমা একটা বেলি ফুলের চারা জোগাড় করেছে। শুনেছে, বেলি ফুলের গন্ধ মূসার প্রিয়। অথচ এই বাড়ির কোথাও একটাও বেলি গাছ নেই।

হেমার মুখে লজ্জার রাঙা আভা, চোখে ঝিলিক দিচ্ছে খুশির ঝলকানি। তার হাতের আঙুলগুলো মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে কাঁপছে। ঠিক তাদের ঘরের জানালার নিচে, যেখান থেকে মূসা প্রতিদিন সকালে মুখ বাড়ায়, সেখানে বেলি চারাটা বসাতে বসাতে মন তার উড়ে চলে অন্য জগতে। অজান্তেই ঠোঁটে নেচে ওঠে গুনগুনানি:

আন্ধার রাইতের চাঁন তুমি 
বেলি ফুলের ঘ্রাণ, 
তোমার লাগি জ্বইল্যা দিলাম 
প্রেমের আগুনদান।

তুমি আইয়ো সুজন 
তুমি আইয়ো ঘরে 
গ্রহণ লাগাইও না কভু 
আমার প্রাণের তরে।

তোমার ছোঁয়ায় গন্ধ মাখে 
বেলি ফুলের ডালি, 
তুমি না থাকলে আঁন্ধার নামে 
মনের কানন খালি।

তাই তো কই, তুমি আইয়ো 
সোনার বরণ রাইতে, 
গ্রহণ লাগাইও না কভু 
আমার প্রেমের গাঁথিতে।
·
·
·
সমাপ্তি...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp