আমার একটা বাচ্চা হয়েছে। ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা। ওকে কোলে নিলে মনে হয় একদলা মেঘ কাঁথায় পেঁচিয়ে নিয়েছি। এজন্য ওর নাম রেখেছি মেঘ। কিন্তু ওর বাবার কোনো খোঁজ নেই। বিয়ের পর সেই যে আদনান ডেনমার্ক গেল এরপর থেকে আর যোগাযোগ করেনি। ওর ফোন নাম্বার থেকে শুরু করে সোস্যাল একাউন্ট সব বন্ধ। আমি কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারিনি। বাবার কাছে আদনানের অফিস বাড়ি সবকিছুর ঠিকানা আছে। পরিচয়পত্র আছে। কিন্তু আমার বাবার অত টাকা নেই যে, আদনানকে খুঁজতে ডেনমার্ক যাব। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় পেট বড় হল। মেয়ে চলেও এলো কিন্তু অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। এইটুকু দেখার পর আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ভয়াবহ ভাবে ঘামছি। শরীর কাঁপছে। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিলাম। আল্লাহ বাঁচিয়েছে যে এটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এমন ভয়াবহ স্বপ্ন দেখার অর্থ কী? সারাটাদিন আমার ভীষণ দুশ্চিন্তায় কাটলো। আমি জানি আদনান এরকম নয়৷ তবু দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না। আমার বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই। কিন্তু এমন একটা বিষয় আলোচনা করার মত এত কাছের বন্ধু কেউ নেই। আমার সব সমস্যা চাচ্চুর সাথে শেয়ার করি। তিনি একটা সমাধান বের করে দেন কিন্তু এই স্বপ্নটা শেয়ার করতে কেন যেন লজ্জা লাগছে।
অবশেষে বিয়ের আগেরদিন মাকে গিয়ে বললাম,
"মা বিয়ের পর আমাকে কি ওরা নিয়ে যাবে? নাকি যে কদিন দেশে আছে আদনান এখানে থাকবে ?"
মা রান্না করছিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
"এমন কোনো কথা তো হয়নি এখনো। আর আদনান তো আছেই আর ৬-৭ দিন। তবে কাল কাবিনের পর আমরা আদনানকে রেখে দেব। কাবিন বা আকদ হলে এটাই নিয়ম।"
"না মা। ওদেরকে বলে দিও তোমরা চাও এখন বাসর হবে না। যেহেতু আদনান এখন চলে যাবে তাই কাবিনের পর ও ওর বাসায় আমি আমার বাসায় থাকব।"
"কী বলছিস তুই? বিয়ের পর আলাদা থাকতে চাস কেন? তোর পছন্দেই তো বিয়ে হচ্ছে। তাছাড়া কদিন পর তো তুই ওর কাছেই যাবি।"
"সবই ঠিক আছে মা। তবুও আমি ওর কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একসাথে থাকতে চাই না। যদি গিয়ে আর যোগাযোগ না করে? আমি সবসময় মানুষ চিনতে ভুল করি তাই ভয় হচ্ছে।"
মা হেসে বললেন,
"তোকে যতটা বোকা ভাবি ততটা বোকা আসলে তুই না রে তিন্নি।"
মা কে বলতে পারলাম না এটা আমার নিজের ভাবনা না। গায়েবি ভাবনা। স্বপ্নে পেয়েছি! শুক্রবার আমার আর আদনানের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর খাওয়াদাওয়া করে আদনান ও তার পরিবারের লোকেরা চলে গেলেন। আদনানের বড়বোন খুব চাইছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে কিংবা তার ভাইকে রেখে যেতে। কিন্তু আমার মা কোনোটাতেই রাজী হলেন না। এবং বাবা তার পক্ষ নিলেন। রাতে আদনান ফোনে জিজ্ঞেস করল,
"ঘটনা কী বলো তো?"
"কোন ঘটনা?"
"আমাদের বাসর হলো না কেন?"
আমি ঢোক গিলে বললাম,
"আমি জানি না।"
"বড় আপা তার বাসায় বাসর ঘর সাজানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি খুব চাইছিলাম সেখানে যেন না যেতে হয়। আকদ হলে তো মেয়ের বাড়িতেই বাসর হয়। তেমন কিছু হবে ভেবেছিলাম। যাই হোক আপার বাসায় যেতে হয়নি বলে আমি আনন্দিত।"
"আমি সত্যিই জানি না আদনান। তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?"
"কষ্টটা ঠিক বাসর হয়নি বলে নয়। কষ্টটা.."
"কী বলো?"
আদনান দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"তোমারা সম্ভবত এখনো আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারোনি।"
এবার আমারও ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। তবে বলে ফেলা কথা ফিরিয়ে নেয়া যায় না। আমি বললাম,
"তোমরা বললে যে? এটা তো আর আমার সিদ্ধান্ত না।"
"এমনি তিন্নি। এত সিরিয়াসলি নিও না। তোমাকে পাব কি পাব না সে ব্যাপারে নিশ্চিত না থেকেও তোমার কাছে আসার জন্য ৬ মাস অপেক্ষা করতে পেরেছি। আর এখন তোমাকে পেয়েও তোমার যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না ভাবলে কী করে?"
"সরি।"
"বাদ দাও। একটা কথা বলো তো। আমি আর যে কদিন আছি, তুমি প্রতিদিন একবার আমার সাথে দেখা করবে?"
"তুমি চাইলে অবশ্যই করব।"
"আমি চাই। আমি তো হানিমুনে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেখানে বাসরই হচ্ছে না, সেখানে হানিমুন তো দুঃস্বপ্ন।"
আমার মন আরও খারাপ হতে লাগলো। আদনান বলল,
"তারচেয়ে বরং প্রতিদিন দেখা করি। আমি অনেকগুলো স্মৃতি সাথে করে নিয়ে যেতে চাই তিন্নি। যাতে তুমি না যাওয়া পর্যন্ত স্মৃতিচারণ করে যেতে পারি।"
.
.
.
চলবে......................................................................