রাত বাজে ১টা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। অদ্রি আর অর্পি চোরের মতো গিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকলো। তারপর তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলল সারা ঘর। নাহ, কোথাও নেই ডায়েরিটা। টেবিলে তিনটা ড্রয়ার রয়েছে। নিচেরটা খোলা। আর উপরের দুটো তালা দেয়া। অদ্রি বলল,
“আমার মনে হয় এই দুটো ড্রয়ারের কোনো একটাতে আছে ডায়েরিটা।”
“চাচ্চু যদি ডায়েরিটা নিজের রুমে নিয়ে যায়?”
“তা নেবে না, কারণ ওখানে চাচি দেখে ফেলার একটা চান্স থাকে। যেহেতু এখানে চাচি বা অন্য কেউই আসে না তাই এখানেই থাকার সম্ভাবনা বেশি।”
“তা ঠিক, আর তাছাড়া চাচ্চুকে যখনই কিছু লিখতে দেখেছি, এখানেই দেখেছি।”
“হুম। তুই বরং ওই ডায়েরির কথা ভুলে যা। সারা ঘর তো খুঁজলাম।”
“না আপ্পি, প্লিজ এমন কথা বলিস না।”
“তো কী করব আমি?”
“আচ্ছা, তুই না ক্লিপ দিয়ে লক খুলতে পারিস?”
“গাধা এগুলো কি ওই লক? এগুলো ওভাবে খোলা যায় না।”
“তাও একটু ট্রাই কর না, প্লিজ প্লিজ প্লিজ…”
“আচ্ছা যা একটা ক্লিপ নিয়ে আয়। একবার চেষ্টা করি।”
সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে একটা ক্লিপ নিয়ে এল অর্পি। অদ্রি খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু খুলতে না পেরে হাল ছেড়ে দিল।
তারপর বলল,
“বললাম না এই লক ক্লিপ দিয়ে খোলা যায় না।”
অর্পি মন খারাপ করে বলল,
“তাহলে?”
“তাহলে কী? কিচ্ছু না, ঘুমাতে চল।”
“আচ্ছা শোন না আপ্পি, নিচের ড্রয়ারটা একবার খোল, ডায়েরিটা তো ওখানেও থাকতে পারে।”
“তোর মনে হয় চাচ্চু ডায়েরিটা এভাবে সামনে রেখে দেবে?”
“আহা রাখতেও তো পারে। পুরোনো প্রেম, সবারই থাকে, এত লুকিয়ে রাখার মতো কিছু তো না। তাছাড়া এ ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ কি আসে? আর আসলেও তো বই নিয়ে চলে যাই, চাচ্চুর কোনো কিছুতে হাত দিই না। যেরকম জিনিস সেরকমই থাকে, তো খোলা ড্রয়ারে রাখতেও পারে।”
—————
অদ্রি নিচের ড্রয়ারটা খুলল এবং যথারীতি হতাশ হলো। টর্চ লাইট, ব্যাটারি, মোম, লাইটার, কলম, পেন্সিল, স্কেল, কেঁচি, ছুরি এই টাইপ টুকিটাকি জিনিস। কয়েকটা চাবিও চোখে পড়ল। উজ্জল হয়ে উঠল অর্পির মুখ,
“আপ্পি এই চাবিগুলোর মধ্যে ড্রয়ারের চাবি নেই তো?”
“কী জানি! দাঁড়া দেখি খোলে কিনা।”
কয়েকটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর মাঝখানের ড্রয়ারটা খুলে গেল। বিজয়ের হাসি ফুটল দুজনের মুখে। কিন্তু ড্রয়ারে পাওয়া গেল রবীন্দ্রনাথের একগাদা গানের সিডি। তারপর উপরের ড্রয়ারটা খোলার চেষ্টা চলতে থাকল। একসময় খুলেও গেল এবং পাওয়া গেল ওদের কাঙ্ক্ষিত ডায়েরিটা। সাথে পাওয়া গেল আরো একটি ডায়েরি ও মোটা কাগজের একটি বক্স। সঙ্গে সঙ্গে নীল মলাটের ডায়েরিটা লুফে নিল অর্পি। অদ্রি অন্য ডায়েরিটা খুললো। ডায়েরিটা বড্ড পুরোনো। ১৯৯৬ সালের ডায়েরি। তবে তাতে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। খুলেই বলল,
“অৰ্পি দেখ…”
অর্পি তাকালো। ডায়েরিতে একটা ছবি লাগানো। গায়ের রঙ কালো তবে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, বয়স অর্পির সমান বা তারও ছোট হতে পারে। ছবিটা পেছন থেকে তোলা। মনে হচ্ছে মাত্রই কেউ ওকে পেছন থেকে ডাকল, আর কে ডেকেছে সেটা দেখার জন্যই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছে। দৃষ্টিটা এতটাই মোহময় যে বুকের ভেতর কেমন একটা করে ওঠে। ছবিটার নিচে লেখা…
“সেদিন চৈত্র মাস ছিল কিনা জানি না, তবে তোর এই দৃষ্টিতেই আমার সর্বনাশের শুরু।”
নীরব ইশতিয়াক
১৩ জুন, ১৯৯৬
ছবির নিচে তারিখ দেখে অদ্রি অর্পি একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। ২০ বছর আগের তারিখ! আবার পৃষ্ঠা উলটাতেই ওই মেয়েটারই আরেকটা ছবি দেখতে পেল। স্কুল ড্রেস পরা, দুই বেণি ধরে মাথাটা বাঁকা করে হাসছে। নিচে একটা শব্দ লেখা…. “মিষ্টি”।
আবার পৃষ্ঠা উল্টালো অর্পি। এর পরের ছবিটায় চাচ্চুকে চিনতে কষ্ট হলো না ওদের। চাচ্চু মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছে। চাচ্চুর মুখ গোমড়া আর মেয়েটা হাসছে। ছবির নিচে লেখা…
“কথা ছিল বাজিতে হারলে তোকে কাঁধে নিয়ে যেতে হবে বাকিটা পথ। তাই করছিলাম আর সেই সুযোগে সৌরভ ছবিটা তুলে ফেলল। কী বকাটাই না দিয়েছিলাম এই ছবিটা তোলার জন্য। কিন্তু তুই জানিস না আড়ালে গিয়ে এই ছবিটা তোলার জন্য আমি ওকে দুই প্যাকেট সিগারেট ঘুষ দিয়েছিলাম।”
অর্পি অবাক হয়ে বলল,
“এই ছবিটা বাবা তুলেছে!”
“হুম, তার মানে বাবা সবই জানত।”
“মেয়েটা এই বাসাতেই থাকত বলেছিলাম না তোকে?”
এরকম অসংখ্য ছবি ডায়েরিটায় পাওয়া গেল। কোনোটা সিংগেল, কোনোটা চাচ্চুর সাথে। পরের ছবিগুলোতে মেয়েটাকে একটু বড় মনে হচ্ছিল। অবশ্য প্রত্যেকটা ছবিতেই তারিখ দেওয়া আছে। তা থেকেও বোঝা যাচ্ছে পরের ছবিগুলো যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ১৭ বছর আগের।
একটা ছবিতে দেখা গেল মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে, বুকের ওপর একটা বাচ্চা, দুহাত দিয়ে ধরে রেখেছে। বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে আছে। ছবিটা দেখেই চমকে উঠল অৰ্পি।
“আপ্পি তুই।”
অদ্রি অন্য পাতার ছবিটা দেখছিল। অর্পির কথা শুনে বলল,
“আমি মানে?”
“দেখ ভালো করে, কোলের এই বাচ্চাটা তুই। তোর ছোটবেলার ছবির সাথে পুরো মিলে যাচ্ছে।”
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,
“তাই তো, এটা তো আমি।”
ছবির নিচে লেখা…
“মনে হচ্ছে অদ্রি তোরই মেয়ে। ও আসার পর থেকে আমার ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, তোর এই মা মা রূপটাও বড্ড ভালো লাগে।”
অদ্রি বলল,
“কিন্তু আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। এরকম কেউ আছে তাই তো জানি না। কখনো শুনিনি।”
“হুম, আমাদের বাসায় থাকত, তোকে এত আদর করত অথচ তার কথা আমরা শুনিনি, জানি না। একটা ছবি আমাদের ফ্যামিলি ফটো অ্যালবামে নেই ব্যাপারটা একটু কেমন না? আপ্পি আই থিংক ডায়েরিটা পড়লে অনেক কিছু জানা যাবে।”
“ড্রয়ারে একটা বক্সও আছে। ওটাতে কী আছে দেখি।”
“হ্যাঁ বের কর।”
বক্সে একটা সাদা রঙের টিস্যুপেপার ছাড়া আর কিছু নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে টিস্যুতে কিছু মোড়ানো রয়েছে। অদ্রি টিস্যুটা খুলল। টিস্যুতে একটা নাকফুল পেল। দুজনই প্রচণ্ড অবাক হলো কারণ হুবহু একই ডিজাইনের একটা নাকফুল ওদের দিতিয়া চাচির আছে!
ডায়েরির প্রথম পাতাটা অর্পি সন্ধ্যায় পড়েছে। কিন্তু অদ্রি পড়েনি, তাই ওর পড়া হতেই দ্বিতীয় পাতা পড়া শুরু করল দুজন। অল্প কিছু কথা লেখা…
আজ শুক্রবার, মানসীর সাথে কাটানোর দিন। ওর কথা ভেবে ভেবে কাটানোর দিন। ওর সাথে কাটানো দিনগুলো রিভাইস করতে খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে করে ওর হাতের কোমল ছোঁয়ার ঘুম ভেঙে উঠেও ঘুমের ভান করে থাকতে। এটা খুব করতাম আমি। মানসী এসে ডাকত,
“নীরবদা, ও নীরবদা ওঠো।”
আর আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। ও আবার ডাকত,
“এই তুমি কি সারাদিন ঘুমিয়েই থাকবে?”
আমি সুযোগ বুঝে ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে
বলতাম,
“হ্যাঁ সারাদিন ঘুমাব, সাথে তুইও থাকবি।”
“ইশ, শখ কত! ডাকাত কোথাকার।”
একথা বলেই ও পালাত। এখন সেইসব দিনগুলো হারিয়ে গেছে। আগের মতো ঘুম আর নেই। একা একাই ঘুম ভেঙে যায়।
নীরব ইশতিয়াক
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
পৃষ্ঠা উল্টালো অদ্রি, অর্পি। আবার পড়তে শুরু করল…
একদিন সকালে মানসী চা বানাচ্ছিল। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পেছন থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওকে দেখছিলাম আমি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে ঢুকে পড়লাম রান্নাঘরে, চোরের মতো গিয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরলাম। চমকে লাফিয়ে উঠল ও, হাত থেকে পরে একটা কাপ ভেঙে গেল। শব্দ শুনে মা ছুটে এল,
“কী হয়েছে? কী ভাঙলো?”
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
“মা, ও কাপটা আমার হাতে দিচ্ছিলো, আর আমি টাইমলি নিতে পারিনি, হাত ফসকে পড়ে গেল।”
মা বলল,
“তুই এখানে কী করছিস?”
“আমি চা নিতে এসেছি।”
“চা বানানো হয়ে গেলে তো দেয়াই হবে, রান্নাঘরে আসার দরকার কী? আরেকটু হলেই তো মেয়েটার পায়ে পড়ত। যদি পুড়ে যেত?”
“ওর দেরি হচ্ছিল তো।”
মা বলল,
“তোর মতলব আমার জানা আছে, যা এখান থেকে।”
মায়ের ঝাড়ি খেয়ে সুরসুর করে চলে এলাম। মা কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কথা জানত, সমর্থনও করত বটে তবে ওই মুহূর্তে একটু ইগোতে লেগেছিল আমার। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল মানসীর ওপর। মানসী অসংখ্যবার আমাকে বলেছে ও শুধু আমার, তাই যদি হয় তাহলে ছুঁলেই ওরকম লাফিয়ে উঠবে কেন? আমি যখনই ওকে একটু কাছে টেনে আদর করতে চাই তখনই ও দূরে সরে যায়। তাহলে কি ও আমাকে বিশ্বাস করে না?
বিশ্বাসঘাতকদের আবার বিশ্বাস অবিশ্বাস! যে বিশ্বাসঘাতকতা ও আমার সাথে করেছে তার তো কোনো তুলনাই হয় না। তবুও যে কেন ভুলতে পারি না! শত চেষ্টা করলেও পারি না। কিন্তু মানুষ তো চেষ্টা করলে সব পারে। আমি কি তবে মানুষ নই? অমানুষ আমি?
নীরব ইশতিয়াক
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
·
·
·
চলবে.........................................................................