মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ০২ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          মধ্যরাত। ঘরের মধ্যিখানে ঘোর নিস্তব্ধতা চুঁইয়ে পড়ছে। কৌশিক গভীর ঘুমে নিমগ্ন। একটা কোলবালিশে পা তুলে শরীরটাকে হালকা কাত করে শুয়ে আছে। মেহজাবিন বেগম ঘরের সকল কাজ সেরে গুটি গুটি পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার সুন্দর গড়নের চেহারা ছেলের চিন্তা করতে করতে বুড়িয়ে গেছে। কিন্তু শেষমেশ ছেলেটা যে সুস্থ হয়ে উঠেছে এটাই তার জন্য অনেক। আলতো করে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। দরজার সরাসরি সামনে থাকা বিছানায় শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা ছেলের মুখটা দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মন হালকা হলো তার। আস্তে পা ফেলে বিছানার কাছে এগোলেন মেহজাবিন বেগম। একটু নিচুতে ঝুঁকে ছেলের মুখটা দেখলেন ভালো করে। কৌশিকের মাথার চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। ছেলেটা একদম বাবার মতো রং পেয়েছে, চেহারা ও কিছুটা বাবাতেই গেছে।

কৌশিকের মুখ মন্ডল লন্ডনের সেই হিমেল দিনে দেখা হয়ে যাওয়া একুশ বছরের তরুণের কথা মনে করিয়ে দিলো। তখন বয়স মাত্র আঠারো মেহজাবিন বেগমের। বাবার চিকিৎসার জন্য লন্ডনে এসেছিল সে। চিকিৎসার কারণে মা-বাবাকে বেশিরভাগ সময় হাসপাতালেই সময় কাটাতে হতো। ‌বাসায় একা বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল। আর মনের মধ্যে একটা ভয় তো কাজ করতোই যে বাবার যদি কিছু হয়ে যায়! মেহজাবিনরা দুই ভাই দুই বোন ছিল। ভাই বোনের মধ্যে উনি পড়তেন তিন নাম্বারে। আর বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার দরুন তাকে নিয়েই লন্ডনে এসেছিলেন উনার মা বাবা।

একদিন নিজে থেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন মেহজাবিন। হাঁটতে হাঁটতে খুব দূরেই চলে যান তিনি। আশপাশে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে বাসায় ফেরার পথ ধরেন। অনেকখানি হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারেন তিনি ফেরার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। এড্রেসটাও ঠিক মত বুঝিয়ে বলতে পারছিলেন না কাউকে।

সময় পেরিয়ে যেতে থাকে। সকাল থেকে দুপুরে পা দেয় শহর। কিন্তু সঠিক রাস্তা খুঁজে পান না মেহজাবিন। হতাশ হয়ে রাস্তার ধারের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। দীর্ঘ সময় পর কান্নার ধারাও চোখ থেকে নামে। তখনই অন্ধকারের মাঝে আলো ছড়িয়ে দেখা দেয় হলুদ গড়নের এক পুরুষ। অমায়িক তার চক্ষু যুগল। সুন্দর তার মুখমণ্ডল। হাসলে মনটা ধপাস করে জেগে ওঠে‌। এমন একটা মানুষ ছিলেন তার স্বামী ক্রিস্টোফার রেইন। কে জানতো এই মানুষটিই তার মনটা হঠাৎ কেড়ে নেবে।

ক্রিস্টোফার রেইন মেহজাবিন থেকে এড্রেস বোঝার চেষ্টা করে। মেহজাবিন যতটুকু জানতো বুঝিয়ে বলার‌ চেষ্টা করে রেইনকে। রেইন কিছুটা বোঝে বাকিটা নিজের মতো করে ভেবে নেয়। আকাশে সন্ধ্যার রঙ ঢলে পড়েছে চারপাশে মানুষের ভিড়। তাদের দু’জনের চলা শুরু হলো কোলাহলের মাঝেও নীরব হয়ে। শেষমেশ মেহজাবিনের চেনা সেই বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল তারা। চোখের সামনে নিজেদের চেনা বিল্ডিংটি দেখে চোখে আনন্দের আলো ফুটল মেয়েটির। ভরপেট প্রশান্তিতে ভরে গেল তার চেনা মন। কিন্তু এতটাই লজ্জায় গুটিয়ে গিয়েছিল সে, যে "ধন্যবাদ" শব্দটাও মুখ ফসকে বের হলো না। রেইন চলে যাওয়ার পূর্বেই ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে পড়তেই আবারো বাইরে বেরিয়ে ছিল। কিন্তু রেইনকে আর পাওয়া গেলো না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছিল সে বিল্ডিংয়ের দরজার পাশে। এরপর তো বারবার মনে পড়ছিল ছেলেটার মুখ। হেমন্তের ফুলের মতো ছিল রেইনের হাসি! একদম নরম, শান্ত, মন কেড়ে নেওয়ার মতো। নামও জেনে উঠতে পারেনি মেহজাবিন আফসোস হয়েছিল খুব। 

প্রায় এক সপ্তাহ পর আবারও কোনো দরকারে বাইরে বেরিয়েছিল মেহজাবিন। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গেল পরিচিত সেই চেহারাটা। ওদের বিল্ডিংয়ের সামনেই দাঁড়িয়ে রেইন।
মেয়েটিকে দেখে একটু হকচকিয়েই হেসে বলেছিল, “এলাম কিছু কাজ পড়েছিল বলে।” 
কিন্তু সে তো এসেছিল আরেকবার এই বাংলাদেশি মেয়েটার মুখমণ্ডল দর্শনের জন্য।

মেহজাবিন বেগম হেসে উঠলেন। উনাদের বিয়ের ঘটনাও বেশ মজার এবং অপ্রত্যাশিত ছিল। আজ রেইন নেই কিন্তু তার দুই চিহ্ন যে এই পৃথিবীতে আছে এটাই মেহজাবিন বেগমের জন্য খুব শান্তির একটা ব্যাপার । স্বামীর সাথে সাথে কৌশিককেও হারিয়ে ফেলতেন তিনি। কিন্তু ওনার সাত কপালের ভাগ্য কৌশিক সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছে।  

কৌশিকের চুলে হাত বুলিয়ে কপালের ঠিক মাঝখানে আলতো করে চুমু রাখলেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন,
“আমার বাবাটা , তোমাকে সুস্থ রাখতে, সুখে রাখতে আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত। একদম তোমার বাবার মতোই শান্ত, বাবার মতোই নির্ভরযোগ্য তুমি। আমার ছেলে তুমি। জান দিয়ে হলেও তোমাকে ঠিক রাখবো।”

মেহজাবিন বেগম সোজা হয়ে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নিঃশব্দে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

কিন্তু কৌশিকের ঘুমন্ত চোখের অন্তরে চলছে ভয়ানক ঝড়। তার চোখের পাতায় ধরা দিচ্ছে কোনো প্রাচীন দেশ আর সেখানকার মানুষ। ধরা দিচ্ছে একজন নারী এবং তার পরিবার। "কায়েরীথ" ডাকতে ডাকতে একটা বাচ্চার পেছনে ছোটাছুটি করছে সেই ছোট্ট ছেলেটির মা। কায়েরীথের দুষ্টুমি সবটাই স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছে কৌশিক। দেখতে পাচ্ছে সুন্দর একটা পরিবার। হাসতে খেলতে চলতে থাকা একটা জীবন। এরপর! এরপর আচমকাই একদিন চোখের সামনে গুড়িয়ে যেতে দেখলো পুরো পরিবারকে। ভয় পেয়ে উঠে বসলো কৌশিক। খুব হাঁপাতে থাকলো সে। হঠাৎ কেনো এসব স্বপ্ন দেখলো বুঝতে পারছে না। বর্তমান দুনিয়ার ছোটো বেলার কোনো কথায় ই মনে আসে না। মনে আসে না কবে এই পৃথিবীতে তার আগমন হয়েছে। এই বিষয়টা নিয়ে প্রথম দিকে অনেক চিন্তিত ছিল কৌশিক। 

হসপিটালে যখন তার জ্ঞান ফিরলো চোখ খুলে চারপাশে একটা অচেনা দুনিয়া দেখলো সে। এমনকি নিজের মা, ভাইকেও সে চিনতে পারলো না। কাউকে দেখলেই কৌশিক ভয় পেয়ে যেত। কারণ চোখের সামনে সবকিছু একদম অচেনা । বর্তমান সময়ের একটা কিচ্ছু তার মনে নেই। ছোটো বেলার ভিন্ন স্মৃতি চোখে ধরা দেয় যা বর্তমান কাল থেকে ভিন্ন। সে সকলকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার জন্ম এখানে নয়, বহুদূরে এক ভিন্ন সময়, ভিন্ন দেশে তার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু কেউ তার কথা বুঝতে চায় না। ঘুমে চোখ ঢেকে এলেই আরেক জগৎ জেগে ওঠে ওর মনে। প্রায় প্রতি রাতে এক স্বপ্ন ঘুরেফিরে আসে। এখনকার থেকে ভিন্ন অন্য এক শহর, অন্য এক সময়। সেখানে কৌশিক হেঁটে চলে পরিচিত রাস্তায়। দেখে অদ্ভুত মানুষজনের ভিড়, আর দেখে এক অদ্ভুত সুন্দরী মেয়েকে। কিন্তু সেই স্বপ্ন বারবার থেমে যায় এক বিভীষিকায়। সে দেখতে পায় সেই মেয়েটিকেই নিজের হাতে হত্যা করছে কৌশিক। স্বপ্নে ভেসে ওঠা সে দৃশ্য তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিঃশ্বাস আটকে আসে, শরীর কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভেঙে যায়।

কৌশিকের কাছে কোনো প্রশ্নের জবাব থাকে না। সে ধীরে ধীরে বাস্তবতাকে মেনে নেয়। ধীরে ধীরে মেনে নেয় তার জন্ম , তার পৃথিবী যা দেখছে চোখের সামনে তাই সত্যি। এছাড়া তো কোনো উপায় ও নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই সন্দেহ হয় কৌশিকের।এই সবকিছু কি আসলেই সত্যি নাকি শুধু ভ্রম!

কৌশিক বিছানা থেকে নেমে আসে। দরজার অল্প খোলা দেখে বুঝে যায় আজ ও মা এসেছিল। তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেই তবে মনে প্রশান্তি নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। এটা নিত্যদিনের ঘটনা। সে উঠে পর্দা সরিয়ে রাতের আকাশ দেখে। তারায় তারায় ভরে ওঠা সুন্দর আকাশ ঝিলিক মেরে উঠে। কৌশিক সেখানে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মনের সুবাস মেটায়। আকাশ দেখতে বেশ ভালো লাগে তার। মনে হয় একসময় এই আকাশের শক্তির কিছুটা সে ভেতরে বহন করছিল। তাই মনে হয় এই আকাশের সাথে তার অমায়িক সম্পর্ক। সময় কেটে যায়। চোখ ঘুরিয়ে ধীর পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় কৌশিক। টেবিল জুড়ে কিছু বইখাতা রাখা আছে। খুব পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। নিশ্চয় ওর মা সবটা সাজিয়েছে। এতো ভালোবাসে নিজের ছেলেকে যে প্রতিদিন কয়েকবার রুমে এসে দেখে যায় রুম পরিপাটি আছে কিনা। ছেলেটার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? সব দিক খেয়াল রাখেন মেহজাবিন বেগম।

বইগুলোর মধ্যে সিংহভাগই ইংরেজি বুক। আর তার মাঝেই চোখে পড়ে একটি ফিজিক্স বই। অজান্তেই হাত চলে যায় সেদিকে। পাতার পর পাতা উলটে দেখতে থাকে সে। আর বিস্ময়ের সাথে টের পায় সবকিছুই খুব সহজ, খুব পরিচিত কৌশিকের কাছে। এটা নিতান্তই বাচ্চাদের বই মনে হয় ওর। কৌশিক আরো ফিজিক্স সম্পর্কিত বই খুঁজতে থাকে। কিন্তু দুই তিনটাই মেলে যার দরুন হতাশই হয় সে। 

কৌশিক উঠে রান্নাঘরে চলে যায়। নিজে হাতেই সে কফি বানায়। এই প্রথমবার সে রান্নাঘরে প্রবেশ করে কফি বানাচ্ছে। তার জানামতে সে কফি বানাতে পারে না। তাও কীভাবে যেন বানিয়ে নিলো আজ। কফি বানিয়ে সেই তিনটে বই পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কৌশিক।

একসময় মাথায় অন্য এক চিন্তা আসলো। সকালের সেই অপরিচিত মেয়েটার ব্যাপারে সে একটু ভেবেই ফেললো‌। তার মুখ থেকে প্রিন্স শব্দটা শুনে তার ভেতরটা মূহুর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়নি কৌশিক। কিন্তু ভাবনার বিষয় এই শব্দটি সে আগেও অন্য কারো মুখে শুনেছে। কিন্তু এই মেয়েটি কেনোই বা তাকে এরকম নাম ধরে ডাকতে যাবে? 

কৌশিক মাথা ঝাড়া দিলো। বিষয়টা অপ্রয়োজনীয় মনে হলো হঠাৎ। আবারো মনোযোগ দিলো বই পড়াতে।

******

ভোরের নরম আলো চুপিচুপি অনন্যার রুমে ঢুকে পড়েছে। জানলার পাশে রাখা সাদা পর্দায় আলোছায়া খেলে যাচ্ছে তারা। অনন্যার ঘুম এমনিতে তাড়াতাড়ি ভাঙে না। কিন্তু আজকের সকালের শান্তিটা নষ্ট হলো পাশের মানুষটির নড়াচড়ায়। ঘুম ভেঙে হালকা বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলল সে। রাতে হুট করে এই বাড়ি আসে নোহারা। অনন্যার মা মেয়ের কীর্তিকলাপের কথা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু নোহারা তার কোনো কথা শোনার মুডে ছিল না। সে একটাও কথা না শুনেই সোজা ঢুকে পড়েছিল অনন্যার রুমে। আর কোনো কিছু না বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল।

অনন্যা বারকয়েক জিজ্ঞেস করেছিল,
"কি হয়েছে? কিছু বল তো!"

কিন্তু না নোহারার মুখে কোনো উত্তর নেই। সে‌ শুধু চুপচাপ তার দুঃখটা কাটিয়ে উঠতে চাইছিল। তাই অনন্যা সময় দিলো তাকে। সারারাত এভাবেই কেটে গেলো। কে কখন ঘুমিয়ে পড়লো তাও বলতে পারবে না দুজনের একজন।

অনন্যা ধীরে ধীরে উঠে বসল। পাশে শুয়ে থাকা নোহারার চোখও খুলে গেলো সেই শব্দে। দুজনেরই চোখে এখনো ঘুমের কুয়াশা জমে আছে। তবু মনভরা অস্থিরতা যা সহজে কাটবার নয়। দুজনের মাঝখানে কথার পাহাড় জমেছে। ভাঙার অপেক্ষায় বসে আছে তারা।

অনন্যা একটু দম নিয়ে নোহারার দিকে তাকায়। অনন্যার ও অনেক কিছু বলার আছে। তবু সে নিজেকে থামিয়ে প্রথম সুযোগটা নোহারাকেই দিলো ।

নোহারার কাঁধে হাত রাখল অনন্যা। টেনে বসালো মেয়েটাকে। নোহারার কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো নড়ে উঠলো। চোখের সামনে এসে ভিড় করলো সেগুলো। সে মাথাটা নিচু করে রাখলো। এক হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করার অল্প চেষ্টা করলো যদিও।

অনন্যা চোখ কচলে বললো,
"বলবি নাকি কাতুকুতু দিবো? কি হয়েছে বল?"

নোহারা মিনমিনিয়ে বললো কিছু একটা। অনন্যা নোহারার মাথায় আস্তে করে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
"ঠিকমতো বল। কিছু শুনিনি।"

"আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাসার লোকজন। গ্রামের একটা ছেলের সাথে ঠিক হয়েছে।"

অনন্যা খুব জোরেশোরে বলে উঠলো,
"হ্যাঁ? কি বলছিস?"

"হুম কিন্তু আমি না করে দিয়েছি।"

অনন্যা শান্ত হয়ে শ্বাস ছাড়লো,
"ওহ আচ্ছা।"

"কিন্তু বাসায় মানছিলো না তাই আমি সন্ধ্যা ব্রো এর কথা বলে দিয়েছি।"

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"এটা তো খুশির খবর। এতো মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন?"

নোহারা ঠোঁটে কামড় বসালো,
"কিন্তু সন্ধ্যা ব্রোএর ছবি এক দেখাতেই রিজেক্ট করে দিয়েছে বাড়ির লোকজন।"

অনন্যা কপালে হাত চাপড়ে বললো,
"তুই শুধু একটার পর একটা চমক ই শোনাচ্ছিস। এমনিতে যে কোনো পরিবার ই রিজেক্ট করবে এটা স্বাভাবিক। তারপর কী হলো?"

নোহারার মুখ লটকে গেলো। সে মাথা নিচু করে বললো,
"আমার চয়েস কি এতোই খারাপ? আমার কি উচিত হয়নি ওকে ভালোবাসা?"

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"আমি তো এটা বলিনি। ভালোবাসা নিয়ম মানে না। যাকে একবার মন দিয়ে দেওয়া হয় তাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। কিন্তু পরিবার তো সেটা বুঝবে না। পরিবার চাইবে একজন সুশীল, সুন্দর একটা ছেলে যে কিনা সেটেলড এবং তোকে ভালো রাখবে। দেখ, নিক ভাইয়ার মধ্যে সুশীল ব্যাপারটা আছে । উমম! সে তো ভ্যাম্পায়ার ছিল তাই এর শিউরিটি দিতে পারছি না। সে সুন্দর কিন্তু উনার মাথার চুল নীল দেখে কয়েকজন ছাপড়ি আছে না ওদের মতো লাগে। তারপর উনি সেটেলড ও না। তবে শেষেরটা একদম ঠিক আছে। তোকে ভালো রাখবে উনি। কিন্তু ফ্যামিলি দেখবে প্রথমের গুণগুলো।"

নোহারা বিছানায় আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে বললো,
"আমি এতো কিছু জানি না। আমি বলেছিলাম ওকে আমার পছন্দ। ফ্যামিলি রিজেক্ট করে দিয়েছে। এই কথাটা আমি সন্ধ্যা ব্রোকে বলেছি সে আমার উপর রাগারাগি করে ফোন কেটে দিয়েছে। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।"

"তো ফোন করে সব ঠিক কর। বুঝিয়ে বল সবটা আর চাকরি খুঁজতে বল।"

অনন্যা মুখ তুলে জোর গলায় বললো,
"একদমই না। আমার কোনো দোষ ছিল না। তাই আমি প্রথমে ফোন করবো না। ও আমার রাগ ভাঙাবে। ও প্রথমে ফোন করবে। আর ওকে চাকরির কথা বললে বলে যে 'আমি কোনো কাজ পারি না ‌ শুধু পারি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে। এছাড়া অন্য কিছু আমার পক্ষে সম্ভব না'। এই ছেলেকে আর কি বলা যায় বল তুই!"

"তাহলে পরের বার সোজা বলে দিবি তুই অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবি। তারপর দেখ কি বলে এই ছেলে।"

"আমি শিওর ও বলবে করে ফেলো।"

অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"তাহলে ছেড়ে দে। এরকম বয়ফ্রেন্ড থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।"

নোহারার মুখ কাঁদো কাঁদো গেলো। এর ই মাঝে অনন্যা বলে উঠলো,
"কৌশিক স্যারকে পেয়েছি আমি।"

নোহারা প্রথমে অনন্যার কথা বুঝতে পারেনি। সে মনমরা হয়ে মুখ তুলে বললো,
"কী? কৌশিক স্যার?"

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হ্যাঁ কালকে ওনার সাথে দেখা হয়েছে।"

নোহারার চোখ বড় বড় হয়ে উঠলো। চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো সে। লাফিয়ে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"কনগ্র্যাটস, ভাই! কনগ্র্যাটস! আমি বলেছিলাম না স্যার ফিরবে। স্যার তোকে এভাবে রেখে চলে যাবে? জীবনেও না! আমাদের হিরো উনি! এতো সহজে বাতাসে হাওয়া হয়ে যাবে নাকি? ইশশ! দোস্ত আমার তো কান্না করতে ইচ্ছে করছে। তোর জন্য আমি বিশাল খুশি। এখন তাড়াতাড়ি সব ঠিক কর ওনার সাথে। তোদের দুজনকে আবারো একসাথে দেখতে চাই আমি। "

বলতে বলতেই চোখে পানি এসে পড়লো নোহারার। অনন্যা ওকে শান্ত করার জন্য নোহারার হাত চেপে ধরলো। নরম গলায় বললো,
"কিন্তু ওনার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। উনি আমাকে চিনতে পারছেন না। আমি বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। কিন্তু এর শেষ আমি দেখেই ছাড়বো। উনাকে বারবার আমার মুখোমুখি হতে হবে। আর এতো সহজে হাল ছেড়ে দিচ্ছি না আমি। ভালোবেসেছি আর সেটা সারাজীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া এবং নেভানোর দায়িত্ব ও আমার।"

নোহারা মৃদু হাসলো। অনন্যার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"আমাদের পুরাতন স্ট্রং অনন্যা ফিরে এসেছে তাহলে। আমি খুব মিস করছিলাম তোর পুরোনো এই রূপটাকে।"

অনন্যা মাথা নামিয়ে বললো,
"আসলে জানিস আমি যদি আরেক বার এই মানুষটাকে দেখতে না পেতাম সত্যিই আমার মনোবল চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই ধীরে ধীরে মরে যেত। কিন্তু আবার ও সেই পুরোনো মানুষটিকে চোখের সামনে দেখে আশার আলো জেগে উঠেছে। মনে হচ্ছে আমি আবারও ওনাকে কাছে পাবো। সেই আগের রহস্যময় প্রিন্সটাকে আমি ফিরে পেতে চাই।আর তাছাড়া আমার মধ্যে তার অংশ বেড়ে ওঠছে।"

"তার অংশ?"
নোহারা ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো।

"ডাক্তার বলছে আমি নাকি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু আমার কোনো ফিলিংস আসছে না। আমি বুঝে উঠতে পারছি না...."

অনন্যা শেষ করার আগেই নোহারা চিৎকার করে আবারো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অনন্যার পিঠে চাপড় দিয়ে বললো,
"আমি আজ সত্যিই চিৎকার করে কান্না করবো, দোস্ত। এতো খুশির খবর শোনাচ্ছিস। কি হেল্প লাগবে আমাকে বল। তোর জন্য সব করতে আমার এক পা খাঁড়া ।*

অনন্যা হেসে ফেললো। সত্যি নোহারার মতো বান্ধবী পেয়ে সে অতি ভাগ্যবতী নাহলে এই অসময়ে কে তাকে সামলাতো। অনন্যা কি পরিমান খারাপ অবস্থায় ছিল যে কেউ হলে বিরক্ত হয়ে যেত কিন্তু নোহারা কখনোই এমনটা করেনি উল্টো ওর সাথে থেকেছে। কখনো স্বান্তনা দেয়নি। শুধু বলেছে, "আমি তোর সাথে আছি। কখনো নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করবি না।"

অনন্যা সত্যিই ভাগ্যবতী।

******

আরণ্যক টেবিলে নোট খাতা ছড়িয়ে রেখে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। মন তার অন্য জায়গায়। চাকরির প্রস্তুতি নিতে হবে কিন্তু এসব তার একদম ভালো লাগছে না। ওর ভালো লাগে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু সেটা গান হোক অথবা নাচ আর সব কাজে সবার সাহায্য করার চেষ্টা করা। আর ভালো লাগে অনন্যাকে। অনন্যার অবস্থা যে বেশি একটা ভালো নয় তাও সে জানে। নোহারার সাথে একটু আকটু কথা হয় তার। কৌশিক স্যার নাকি হুট করেই উধাও হয়ে গেছে। তারপর থেকে অনন্যা ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এই লোকটা গেলোই বা কোথায় তাও চিন্তার বিষয়। রূপালী ম্যামের কথা শুনেছিল আরণ্যক। সে নাকি পাগল টাগল হয়ে গিয়েছিল। পরে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে এখন। এটা কি কৌশিক স্যারের জন্য ই হলো নাকি অন্য কোন ব্যাপার? আচ্ছা এই কৌশিক স্যার আবার কোনো মেয়ের চক্করে পড়লো না তো?

আরণ্যক এসব চিন্তা করতে করতে নিজের মাথা চেপে ধরলো। টেবিলের উপর মাথা রেখে বিরক্তিকর আওয়াজ করলো। তখনই রুমের দরজা খোলার আওয়াজ হলো।
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp