মিষ্টি নারী কণ্ঠ কানে আসতেই চকচক করে উঠলো প্রহরীর চোখ। বনিককে নিচুস্বরে শুধালো,
“ভেতরে কি সুলতানের জন্য খাস উপহার?”
“একেবারে খাস উপহার হুজুর। আমি দরিদ্র বনিক, আমার কাছে এর থেকে মূল্যবান কোনো জিনিস উপহার দেবার মত নেই”
প্রহরী বাক্সটার একেবারে কোনায় শ্বাস নেবার জন্য যে ছোট খুপড়ি তৈরি করা হয়েছে তাতে উঁকি দিলো। সাথে সাথে নজরে পড়লো সাগরের ঢেউয়ের ন্যায় গভীর একজোড়া চোখ। চোখজোড়ায় কি যেন ছিলো। সামান্য প্রহরী চোখ সরাতে পারলো না। অদ্ভুত শিহরণ অনুভূত হলো যেন। লোভ জাগলো মুখখানা দেখার। কিন্তু সুলতানের উপহারে লোভ নেওয়া ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। মেহমুদ সাম্রাজ্যের এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে জানে না সুলতান মালেক শাহর নারী মোহ। চরিত্রের দিক থেকে তিনি এই দিক থেকে নিকৃষ্ট ধরা যায়। ফলে তার হারেমে উপপত্নীর সংখ্যা প্রায় ছয়শ পার হয়েছে। মোট তিনজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার নারীর দেহর প্রতি লোভ সীমাহীন। এখনো সুলতানকে খুশি করতে তার উজির, দেওয়ান, পাশারা তাকে নিজের ঘরের নারীদের উপঢৌকনরুপে সাজিয়ে পাঠান। হারেমের এই নারীদের উপস্থিতি কেবলই তাকে যৌনসুখ দেবার জন্য। কেবল সুলতানা তাবিয়া ব্যতিক্রম। প্রধান উজিরের কন্যা তাবিয়া বর্তমানে বেগম সুলতানা উপাধিতে আছেন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সুলতানকে রাজ্যবৃদ্ধিতে প্রচুর সাহায্য করেছে। শোনা যায় একবার তাবিয়া সুলতানের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। সেই থেকে সে সুলতানের প্রিয় পত্নী তাবিয়া। এতে অনেকেই ভাবতে পারে সুলতান নারীর সৌন্দর্য্যে মোহিত হন না। কথাটা ভুল। প্রতি বছর তার বিনোদনের জন্য বিভিন্ন দেশ, রাজ্য থেকে দাসী আনা হয়। প্রহরী বিদ্রুপ টেনে বললো,
“উপহার দেবার নামে বড়লোক হবার ইচ্ছে”
বনিক আমতা আমতা করে বলে,
“কি যে বলেন হুজুর। আমি দরিদ্র বনিক। রাজ্যে রাজ্যে ব্যবসা তাগিদে ঘুরি। এই দাসকে কিনেছিলাম মাত্র ২ মোহরে। কি রুপ! কি চাহনী! এই দাসকে মরুর বালিতে নয়, মানায় সুলতানের সেবায়। তাই তো নিয়ে এসেছি। এবার আমাদের প্রবেশে অনুমতি দিন”
“ঠিক আছে যাও”
প্রহরী নগরীতে প্রবেশের অনুমতি দিল বনিককে। বনিকের সাথে আরোও তিন-চারজন ছিলো তারাও নগরীতে প্রবেশ করলো। তাদের সকলের দৃষ্টি চকচক করছে। ঠোঁটে হাসি। অবশেষে তাবরেজে তারা প্রবেশ করতে পেরেছে। বনিক তার সাহায্যকারীকে বললো,
“একটা থাকার বন্দোবস্ত কর”
—————
নগরীর বাজারের সারাইখানায় বনিক এবং তার লোকেদের থাকার ব্যবস্থা হলো। ছোট দুটো কামরাতে থাকবে তারা। সারাইখানার লোকেরা তাদের কামরা দেখিয়ে চলে গেলো। বনিকের ইশারায় সহকারীরা দরজা আটকে দিলো। তারপর বনিক তার সহকারীকে বললো,
“বেয়াদবটাকে বের কর বাক্স থেকে”
মখমলের কাপড়ে ঢাকা বাক্সের ঢাকনা খুলতেই দেখা গেলো গুটিসুটি মেরে একটি মেয়ে বসে আছে। পরণে নিতান্ত ময়লা জামা। হাতজোড়া দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে সে। চোখে তীব্র ভয়। যেন সে বুঝতে পারছে তার সাথে কি হবে এখন। বনিক তার চামড়ার চাবুকটা দিয়ে জোরে শব্দ করলো মাটিতে। ফলে ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। বণিক তার কোমল শুভ্র মুখের ভয়কে একেবারেই উপেক্ষা করে নিষ্ঠুর হাতে চালালো সেই চাবুক। চাবুকের প্রহারে চামড়া চিরে ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগলো রক্তকণা। মেয়েটি দাঁত কামড়ে যেন ব্যথাটা সহ্য করলো। চোখ টলমল করছে অশ্রুতে। কিন্তু সে দাসী, এটাই তার নিয়তি। বণিক রোষ মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,
“কতবার বলেছি, মুখ বন্ধ রাখবি। ধৃষ্টতা দেখাবি না। পুরুষ দেখলেই তোর খই ফোঁটে ঠোঁটে? বেয়াদব কোথাকার। তুই সুলতানের সেবক হবি। তোর সাত জন্মের ভাগ্য আমি তোকে এতো সুন্দর জায়গায় পৌছে দিচ্ছি। কিন্তু তুই আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিবি দেখছি। তোর জন্য যদি আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায় আমি তোকে জানে মেরে ফেলবো”
হঠাৎ বনিকের সাথে আসা একটি মেয়ে বলে উঠলো,
“হুজুর নাফিসাকে আর মারবেন না। দেখুন কেমন রক্তাক্ত হয়ে গেছে। কাল উৎসব। সুলতান মালেক শাহর দাগহীন জিনিস পছন্দ। সুলতানের উপহার এমন কদর্য হলে আমাদের প্রাণ যাবে। সেই সাথে আমাদের পরিকল্পনা সব নষ্ট হয়ে যাবে”
মেয়েটিও একটি দাসী। বণিকের হাত প্রহার করতে করতে ক্লান্ত। তাই সে থামে। আর কঠিন স্বরে বলে,
“বেয়াদবটাকে মিশরীয় পাতার মিশ্রণটা লাগিয়ে দিও। আর শিখিয়ে দিও কি করে আচারণ করবে। কাল থেকে সে সুলতানের রমনী হবে। মনে থাকে যেন”
নাফিসা নামক মেয়েটি চাবুকের প্রহারে ক্ষত বিক্ষত। উবু হয়ে শুধু গোঙ্গাচ্ছে সে। কাঁদার অনুমতি নেই তার। তার মালিক তাকে প্রাণে রেহায় দিয়েছে এটা অনেক। বণিকের সহচারী মেয়েটি তার কাছে যায়। আগলে ধরে। নাফিসা ভয়ে কাঁপছে। থরথর করছে শরীর। রক্তে তার জামা ভিজে গেছে। অশ্রুতে ভিজে আছে গাল। খুব অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আমাকে মেরো না আর, আমি আর ভুল করবো না”
!!৪!!
সুলতান তাবিয়ার চুল শুকাচ্ছে তার খাস দাসী রোকসানা। ধূপের কটু গন্ধে ঘর ভরে গেছে। জানালা সব বন্ধ। তাবিয়ার লম্বা চুল একটু একটু করে শুকিয়ে তা অলংকার দিয়ে সাজিয়ে দিল রোকসানা। তাবিয়াকে শুধালো,
“বেগম সুলতানা আর কোনো অলংকার পড়বেন? উৎসব উপলক্ষে স্বর্ণকারকে ডাকা হয়েছে। আপনি কি তার সাথে এখন দেখা করবেন?”
তাবিয়া উত্তর দিল না। তার নির্নিমেষ দৃষ্টি আবদ্ধ ইরহানের পাঠানো বাক্সে। বাক্সটা যখন সে পেয়েছিলো তখন ভয়ে শিউরে উঠেছিলো। সেই স্মৃতি এখন মাথা থেকে খসছে না। রোকসানা তাবিয়াকে অন্যমনস্ক দেখে শুধায়,
“বেগম সুলতানা কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
রোকসানার প্রশ্নে এবার উত্তর দিলো তাবিয়া। চিন্তিত স্বরে বললো,
“আমার পরিকল্পনা আবার ভেস্তে গেলো। ইরহান আবার বেঁচে গেলো”
রোকসানা খুব রয়ে সয়ে বলে,
“গোস্তাখি মাফ করবেন সুলতানা, তবে আমি একটা বিষয় বুঝতেই পারছি না। আপনি কেন ঐ দাসীপুত্রকে নিয়ে চিন্তিত। শেহজাদা ইরহানকে না জনগণ পছন্দ করেন না দরবারের কেউ। সত্যি বলতে যুদ্ধ আর খুন ছাড়া সে কিছুই জানে না। আমাদের শেহজাদার কাছে সে কিছুই নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা সুলতানের প্রিয় আপনি। তাই শেহজাদা আবু সাঈদের কদর সবথেকে বেশি। যদি কাউকে নিয়ে চিন্তা করতেই হয় তবে আমাদের শেহজাদা উমারকে নিয়ে চিন্তা করা উচিত। মামলুকদের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে সে। জনগণ তাকে খুব ভালোবাসে। শেহজাদা আবু-সাঈদকে যদি কেউ টক্কর দেয় তবে…”
কথাটা শেষ করার পূর্বেই তাবিয়ার অগ্নিদৃষ্টির মুখোমুখি হলো রোকসানা। মাথা নত করে ফেললো সাথে সাথেই। মিনমিনিয়ে বললো,
“ক্ষমা করবেন সুলতানা। তবে দাসীর পুত্র কখনো সুলতান হতে পারে না”
“রোকসানা, তুমি হয়তো জানো না সুলতান মেহমুদও দাসী পুত্রই ছিলো। সে ছিলো সামান্য সৈনিক। সেখান থেকে সে এই মেহমুদ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তোমার মনে হয় ইরহানকে ছাড়া উমার কখনো মামলুকদের সাথে শান্তি চুক্তি করতে পারতো? শুধু তাই নয়, সেনাপতি মীর বখসি তার সাথে রয়েছে। তখ্ত্ কখনো জনপ্রিয়তা বুঝে না, বুঝে রক্ত। সে রক্ত ঝরাতে পারে তখ্ত্ তার। মেহমুদ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী সব ইরহানের মুঠোয়। তাকে সুলতান পছন্দ করেন না, কিন্তু সে তার পালা সাপ। বিষাক্ত সাপ। সেই সাপের ছোবলে সুলতানের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হবে। তাই সুলতান তাকে সরাচ্ছেও না। আর আমার প্রতিটি চাল বৃথা হচ্ছে। এখন তো ইরহান নিজেও জানে সেটা। নাহ, রোকসানা। এভাবে করলে হবে না। আমার ছেলের সুলতান হওয়ার বাঁধাকে আমি দুনিয়াতে রাখবো না”
“কিন্তু সুলতানা, যদি সুলতান শেহজাদা উমারকে তখ্ত্ দিয়ে দেন। আপনার চিন্তা হচ্ছে না?”
তাবিয়া হাসলো। তার বুদ্ধিদীপ্ততা উজ্জ্বল চোখ জ্বলজ্বল করছে। সামনে রাখা শরবত ভরা পেয়ালা হাতে নিয়ে বললো,
“যার আয়ু ক্ষীণ তাকে নিয়ে আমি চিন্তা করিও না”
—————
শেহজাদা উমার নিজের মা নীলুফার খাতুনের কামরায় উপস্থিত হলো। নীলুফার খাতুন সুলতান মালেক শাহর দ্বিতীয় পত্নী। নীলুফারের বিয়েটা সুলতান মেহমুদ বেঁচে থাকার সময় হয়েছিলো। নীলুফার খাতুন ছিলো আরব শেহজাদী। আরবদের সাথে শান্তি চুক্তি করার জন্য নীলুফারকে নিজ পুত্রের সাথে বিবাহ দেন মেহমুদ। উমার ঘরে প্রবেশ করে দেখলো নীলুফার নামাজ পড়ছে। সে অপেক্ষা করলো মার জন্য। নীলুফার সালাম ফিরিয়ে দেখলো তার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। নীলুফার মনে হল সে তার ছোট ছেলেটিকে দেখছে যে চোখের পলক ফেলতেই এতোটা বড় হয়ে গেলো যেন। নীলুফার উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে শোধালো,
“কেমন আছো উমার?”
“আলহামদুলিল্লাহ আম্মী, আপনি কেমন আছেন?”
“যেমন আল্লাহ রেখেছেন। তুমি বড্ড শুকিয়ে গেছো বাবা, খাওয়া দাওয়া করছো না তাই না?”
“আপনার সবসময় আমাকে শুকনো মনে হয় আম্মী। অথচ আপনার ছেলে যে এখন কত বড় হয়ে গেছে!”
“কিছুদিন বাদে আমার ছেলে সুলতান হবে”
নীলুফার কণ্ঠ কাঁপছে। আনন্দ ঠিকরে উঠছে কণ্ঠে। বুকে জমা সুখ যেন চোখে স্পষ্ট দেখলো উমার। মলিন স্বরে শুধালো,
“আপনি খুব খুশি হবেন তাই না আম্মী?”
“হ্যা, খুব খুশি হব। আমার বিশ্বাস মেহমুদ বংশের উপযুক্ত শাসক হবে তুমি”
“কিন্তু”
“কি কিন্তু?”
নীলুফার কপালে ভাঁজ পড়লো। উমার থেমে গেলো। কথাটা শেষ করলো না। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হামিদা কেমন আছে আম্মী?”
“আসতে না আসতেই হামিদার জন্য মন পুড়ছে?”
“আমি খুব জলদি ওকে বিয়ে করতে চাই আম্মী”
“সেও তোমার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু উমার, তুমি সামনে সুলতান হবে। তোমার সুলতানা সেই হবে যে তোমাকে সালতানাত সামলাতে সাহায্য করবে। হামিদার বাবা খুব উচ্চ বংশীয় নয়। তাবায়াফের কন্যা সে। আমি জানি না সুলতান ব্যাপারটাকে কিভাবে নিবেন? আমি বলি কি তুমি বরং তাকে তোমার হারেমে রাখো। এটাই সবচেয়ে ভালো হবে”
উমার শুভ্র মুখখানা কঠিন হয়ে গেলো। শীতল স্বরে বললো,
“আমি কেবল একজনকেই আমার সুলতানা বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আম্মী”
“তোমার প্রতিশ্রুতি শুধু মেহমুদ সাম্রাজ্যের জন্যই বরাদ্দ। কোনো মানুষ তোমার প্রতিশ্রুতির অধিকারী নয়”
উমারের মুখশ্রীতে ব্যথা ফুটে উঠলো যেন। হামিদা তাবায়েফ শাহরীনের কন্যা। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী সে কেবল উপপত্নী হতে পারবে সুলতানের, স্ত্রী নয়।
—————
নীলুফার ঘর থেকে বের হতেই লাল গোলাপের বাগানে চোখ আটকে গেলো উমারের। নিলীন চোখজোড়া লাল গোলাপের ভেতর মানুষরুপী গোলাপ ফুলে আবদ্ধ হলো। মানুষরুপী ফুল হামিদা। হামিদার শুভ্র মুখখানি দেখতেই হৃদয়ের ভেতরে একটা ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভূত হলো যেন। স্নিগ্ধ হাসিতে ডুবতে ইচ্ছে হলো। নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক হামিদা যার স্নিগ্ধতায় হৃদয় হারিয়েছে উমার। হামিদা গোলাপের বাগানে তার বান্ধবীদের সাথে গল্প করছে। খিলখিল হাসি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে অমলিন আনন্দ। চঞ্চল চোখজোড়া দুষ্টুমির ছক কষছে হয়তো। এতো কোমল রমনীকে কি করে বলবে উমার,
“আমার প্রতিশ্রুতি ভুলে যাও”
কি করে তার নিষ্পাপ হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিবে? সুলতানের স্ত্রী কখনো দাসী হয় না। এটাই যে নিয়ম। অথচ হামিদাকে সে কথা দিয়েছে। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে উমারের। রাজবংশে জন্মানো তার কাছে অভিশাপ মনে হয়। একদিকে মাকে তার যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি অন্যদিকে নিজের এতোটা বছরের প্রিয়তমাকে আপন করে নেওয়ার ধৃষ্টতা! দীর্ঘশ্বাস ফেলে উমার। তার খাসদাস ইয়াকুব মৃদু স্বরে বলেন,
“শেহজাদা, চলুন”
!!৫!!
সালতানাতের সূবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে উৎসবমুখর দরবার। বিভিন্ন অধীন, মিত্র রাজ্য থেকে শাসকেরা রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছে সুলতান মালেক শাহকে অভিনন্দন জানাতে। মেহমুদ সাম্রাজ্যের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস যেন স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকে ইতিহাসের পাতায় তাই এই জলসার আয়োজন। দরবারে উজির, দেওয়ান সকলেই উপস্থিত। সুলতানও হাজির হলেন কিছুসময়ের মধ্যে। তার চৌদ্দজন শেহজাদা উপস্থিত হয়েছে। সেই সাথে নিজেদের মেধার প্রদর্শন করতে এসেছে নানান শিল্পী। সঙ্গীতজ্ঞ থেকে শুরু করে কবি, চিত্রশিল্পী। নিজেদের সুলতানকে উপহার দিতে এসেছে সাধারণ জনগণ। সাধারণত রাজদরবারে আসার অনুমতি দেওয়া হয় না জনগণকে। কিন্তু উৎসব উপলক্ষ্যে প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে সাধারণ জনগণও। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী তারা উপঢৌকন দিচ্ছে সুলতান মালেক শাহকে। সেই সাথে জয়ধ্বনি গাইছে। উপহারের এক পর্যায়ে বণিকের পালা এলো। লাল মখমলে ঢাকা বাক্স নিয়ে হাজির হলো সে। সুলতান মালেক শাহের সামনে হাত জোড় করে বিনয়ী স্বরে বললো,
"সুলতান আল মু-আয়্যাম, আপনার রাজ্যে এহেন কিছু নেই যার অভাব আপনাকে বিচলিত করতে পারে। তবে এই ক্ষুদ্র বণিক আপনাকে একটি ছোট্ট উপহার দিতে চায়"
সুলতানের রক্ষী হুকুম দিলো,
"উপহার পেশ করা হোক"
সাথে সাথেই লাল মখমলের কাপড়টি সরানো হলো। বাক্সটি পেরেক মারা ছিলো। সেই পেরেক ভেঙ্গে খোলা হলো বাক্সের ঢাকনা। ঢাকনা খুলতেই দরবারের মানুষের চোখ বিস্মিত হলো। এতো সুন্দর রমনীও পৃথিবীতে আছে। শুভ্র বর্ণের মুখখানি যেন পুতুলের আদলে তৈরি। চোখের মনিখানা সাগরের উত্তাল ঢেউ। আপেল বর্ণের পুরু ঠোঁট। নারীটি শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। পরণে চকচকে বর্ণের একটি কাফতান। বণিক দরাজ গলায় বললো,
"সুলতানের খেদমতে এই দাসীকে আমি পেশ করছি। তাবরেজ কেন সমগ্র সাম্রাজ্যেও পাওয়া যাবে না এমন সুন্দরী রমনী। আমার উপঢৌকন গ্রহণ করুন সুলতান"
সত্যি অত্যন্ত সুন্দর এই রমনী। পুরুষের হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়ে দেবার মতোই তার রুপ। মালেক শাহ শুধালো,
“এই রমনীর নাম কি?”
“যা আপনি দিবেন হুজুর। আমরা অবশ্য ওকে নাফিসা বলে ঢাকি। বড্ড মূল্যবান কি না”
“আমি খুশি হয়েছি। রাজকোষাগার থেকে ১০০ মোহর এই বণিককে দেওয়া হোক। এবং তার উপহারকে হারেমে নিয়ে যাওয়া হোক”
সুলতানের হুকুমে বণিক খুশিতে আটখানা,
“সুলতানের জয়হোক। মেহমুদ সাম্রাজ্যের জয়। সুলতান মালেক শাহর জয়”
নাফিসা নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে। তার সৌন্দর্য্যে বিভর দরবারের হাজার চোখের মধ্যে একজোড়া ধূসর, সারাসির মতো তীক্ষ্ণ আঁখি ছিলো যার দৃষ্টিতে খেলে যাচ্ছিলো দূর্বোধ্য আনন্দ। স্বগোতক্তি করলো আনমনে,
"অবশেষে আমাদের সাক্ষাৎ হলোই"
—————
নাফিসাকে দাসীরা হারেমে নিয়ে গেলো। সুলতানের হুকুম আজ রাত সে এই দাসীর সঙ্গে কাটাবেন। ফলে তাকে ভালো করে পরিষ্কার করে, পরিষ্কার সাদা কাপড় পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো সুলতানের কামরায়। সুলতান মালেক শাহ দাগহীন স্বচ্ছ জিনিস পছন্দ। ফলে একেবারে পরিষ্কার করা হলো নাফিসাকে। কোনো ত্রুটি রাখলেন না হারেম প্রধান উসমা। নাফিসার মনোস্থিতি বিচলিত। সে এখন এই প্রাসাদের তুচ্ছ দাসী। তার কাজ শুধু সুলতানের মনোরঞ্জন এবং যৌনসুখের খোরাক হওয়া। একটা ভুল, সাথে সাথে মৃত্যু। সে মরতে চায় না, কিন্তু কারোর মনোরঞ্জনের খোরাকও হতে চায় না। মনটা কেমন ঝিমিয়ে আসছে যেন। এতো সুন্দর পোশাক, এতো সুন্দর গহনা সবকিছুই যেন ফাঁসির ফান্দার মতো লাগছে। দাসীরা তাকে ঈর্ষা করছে। বলছে,
“বাহ, তোর তো ভাগ্য খুলে গেছে। প্রথম দিন ই সুলতানের সেবার সুযোগ পাচ্ছিস”
কিন্তু নাফিসা জানে এটা ভাগ্য নয় দূর্ভাগ্য। তার জীবনটা হয়তো এই দূর্ভাগ্যেই কেটে যাবে। শুধু মরতে চায় না সে। এভাবেই যদি বাঁচা যায় ক্ষতি কি। সুলতানের খাস কামরায় তাকে নিয়ে গেলো দাসীরা। প্রবেশ করেই সুলতানের হাতে চুমু খেলো সে। ঈষৎ কম্পিত স্বরে বললো,
“সুলতানের জয় হোক”
সুলতান তখন মদিরার নেশায় বুদ। নেশাতুর স্বরে বললো,
“জামা খোলো”
বুকটা ধক করে উঠলো নাফিসার। সুলতানের হুকুম অমান্য করলে প্রাণ যাবে তার। সে খুব ভালো করেই জানে। এতোকালের সম্ভ্রম আজ সুলতানের কাছে সপে দিতেই হবে। তাকে যে বাঁচতে হবে। শুধু নিচু স্বরে বলল,
“আমি একটু ঘুরে দাঁড়াই?”
“আমি তো তোমাকে দেখবোই, তাহলে লজ্জা কেন?”
নাফিসা ইতস্তত করলো। তার হাতপা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। জড় বস্তুর মতো মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সুলতান মদিরা পান করতে করতে বিরক্ত স্বরে বললেন,
“ঠিক আছে”
নাফিসা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। জামাটা খুলতে মশালের হলুদ আলোয় উন্মুক্ত পিঠটা নজরে আসলো সুলতান মালেক শাহ। সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ক্ষত বিক্ষত টাটকা চাবুকের দাগে শিওরে গেল সুলতান মালেক শাহ। মদিরার গ্লাস ফেলে রাগী স্বরে বললেন,
“এতো বড় সাহস, একটা ক্ষতবিক্ষত কুৎসিত শরীরের নারীকে আমার কামরায় পাঠানো হয়েছে। কোথায় কে আসিস, এই কুৎসিত জিনিসটাকে সরা আমার চোখের সামনে থেকে”
সাথে সাথেই কাপড় দিয়ে দেহ ঢেকে ফেললো নাফিসা। ভয়ে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেলো। তবে কি এবার তার মৃত্যু নিশ্চিত?
·
·
·
চলবে.........................................................................