আজকের দিনটা ছিল আমার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়ার একটা দিন। দিনটা সবচেয়ে সুখের না বেদনার, প্রাপ্তির না হারানোর তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। এই পৃথিবীটা এমনই এক অদ্ভুত খেলাঘর যেখানে সবচেয়ে সুখের কারণটাই সেকেন্ডের মধ্যে দুঃখের কারণে রূপ নিতে পারে।
মানসী কি আজকের দিনেও আমাকে মনে না করে থাকতে পারে? কীভাবে পারে? নাকি আমার মতোই কিছু করতে পারে না, অসহায়তা নিয়ে পুড়ে মরে?
মানসী একটু অন্যরকম ছিল। অল্প বয়সেই যেন অনেক বেশি ম্যাচিওর। বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে থাকার কারণেই নাকি কে জানে। ও অনেক কথাই চেপে রাখতো যা বোঝার সাধ্য কারোই ছিল না, আমারও না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সেই চেপে রাখা ব্যাপারগুলো কোনোভাবে বেরিয়ে আসলে নিজেকে অনেক বড় আহাম্মক মনে হতো। এরকমই একদিন হঠাৎ বলে বসল,
“নীরবদা, তুমি খুব নিষ্ঠুর, জানো?”
আমি ওর একটা হাত নিয়ে খেলতে খেলতে বললাম,
“কেন রে? আমি কি তোকে বিষ খাইয়েছি? নাকি তোর শাশুড়িকে সুইসাইড করার বুদ্ধি দিয়েছি?”
“উফ, কী সব হাবিজাবি যে বলতে পারো তুমি। কখনো কি একটু সিরিয়াস হতে পারো না?”
আমি খুব সিরিয়াস এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম,
“আচ্ছা যা, আর কোনো ফাজলামো না। তুই বল নীরব কী নিষ্ঠুরতা করেছে তোর সাথে। পিটিয়ে ব্যাটার হাড়গোড় ভেঙে দেব।”
“ধুর, আবার সেই অহেতুক কথা।”
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা আচ্ছা সরি, এই কান ধরলাম। এবার বল আমি কী করেছি?”
“কিচ্ছু করোনি? সৌরভদার বিয়ের সময় খালামণি আমাদেরও বিয়ে দিতে চাইল। তুমিই তো রাজি হলে না। তখন বিয়েটা হয়ে গেলে কত্ত ভালো হতো।”
ওর এই কথাটার অর্থ বোঝার কোনো চেষ্টাই সেদিন করিনি। রাগের চোটে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। কারণ মনে হলো মানসী যে এখন আবার এসব বলছে তাহলে কাকে কি বুঝিয়েছিলাম ওদের বিয়ের দিন রাতে। ওর কি আমার ওপর বিশ্বাস নেই নাকি! রাগের মাথায় বললাম,
“সেদিন বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল। আজ বিয়ে করতে রাজি আছি, করবি?”
রাগ হলে সাধারণত আমি চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতাম, একটু বেশিই উত্তেজিত হতাম। কিন্তু তখন শান্তভাবে জিজ্ঞেস করাতেই বোধহয় ও আমার রাগটা ধরতে পারল না। ও রাজি হয়ে গেল এবং আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ওর যখন আমার ওপর বিশ্বাসই নেই বিয়ে করেই ফেলি। এই একটা বিয়ে নিয়ে বারবার কথা শুনতে ভালো লাগে না। তার পরেরদিন আমার কয়েকজন বন্ধু আর সৌরভ, অনন্যাকে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেললাম। অল্প বয়সের ভুল যাকে বলে এই বিয়েটাও সেরকমই কিছু ছিল। এরকম ভুল করতে বোধহয় কোনো যুক্তি লাগে না। লাগে না কোনো কারণ। লেগেছিল শুধু একজনের প্রচণ্ড অন্ধ রাগ আরেকজনের প্রচণ্ড আবেগময় কিছু স্বপ্ন।
হ্যাঁ আজ থেকে ১৮ বছর আগে ঠিক এই দিনেই বিয়ে করেছিলাম আমরা। মানসীর বয়স তখন ১৮ আর আমার ২৫ পেরিয়েছিল। বিয়ের পর আমার আর মানসীর মধ্যে কেমন একটা দূরত্বের সৃষ্টি হলো। আমি এমনিতেও বাসায় কম থাকতাম। তখন আরো বেড়ে গেল আমার বাইরে থাকা। রাত করে বাসায় ফিরে ও ওর সাথে কথা বলতাম না আগের মতো। মানসীও বুঝতে পারল আমি শুধু রাগের মাথায়ই ওকে বিয়ে করেছি। তা না হলে দূরে দূরে কেন থাকব!
আসলে একসময় রাগটা কেটে গিয়েছিল কিন্তু তখন আবার কিছু ভয়, দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তা জেঁকে ধরল আমাকে। মাকে কী জবাব দেব তার ভয়, মাকে লুকিয়ে এই প্রথম কিছু করলাম। কিন্তু দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তা কেন কাজ করছিল তা আজও জানি না আমি।
এভাবেই কেটে গেল ৫ দিন। এরপর বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেল। মাও বাবার সঙ্গে গেল। বাসায় তখন আমরা তিন ভাইবোন, অনন্যা আর মানসী। প্রথম দিনই চাইলাম যেহেতু বাবা-মা বাড়িতে নেই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরব। কিন্তু নানান কাজে দেরি হয়েই গেল। অবশ্য বেরই হয়েছিলাম সন্ধ্যায়। সৌরভ যেহেতু বাসায় আছে তাই আমি নিশ্চিন্তে আমার কাজ শেষ করে রাত ১০টা নাগাদ বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ঢুকেই দেখলাম সৌরভ-অনন্যা টিভি দেখছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মানসীকে না দেখে নিজের ঘরে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই অনন্যা বলল,
“দাদা, তোমাকে ভাত দিয়ে দিই?”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“এত তাড়াতাড়ি?”
“হ্যাঁ, আসলে মা বাসায় নেই, বাসাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমাদের কারোই ভালো লাগছে না। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমাব।”
“মানসী কোথায়?”
“মানসীর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, ও শুয়ে পড়েছে।”
“আচ্ছা, প্রব্লেম নেই, তোরা শুতে যা তো। আমি নিয়ে খেতে পারব।”
“না দাদা, আমি এটা করতে পারব না। মানসী প্রচণ্ড মাথা ব্যথা নিয়েও তোমার জন্য বসে ছিল। ওর ওই অবস্থা দেখে আমি জোর করে ওকে ঘুমাতে পাঠিয়েছি। কাল যদি জানতে পারে আমি তোমাকে খেতে দিইনি, তুমি নিজে নিয়ে খেয়েছ তাহলে কেটে ফেলবে আমাকে।”
“আরে ধুর, ওর কথা বাদ দে। তোর অসুস্থ শরীরে এত কষ্ট করতে হবে না। আমি নিয়ে খাব।”
“উফ, কিসের অসুস্থ! তোমাদের ভাব দেখলে মনে হয় পৃথিবীতে আমি প্ৰথম মেয়ে যে মা হচ্ছে।
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা দে এখনি খেয়ে নিই। না হলে তো তুই ছাড়বি না।”
অনন্যা চলে গেল ভাত বাড়তে। সৌরভ বলল,
“বুঝলি দাদা, শাশুড়ির শোকে তার বউদের এতই দুরবস্থা যে আমাদের ১০টার আগে ডিনার করতে হচ্ছে!”
আমি হেসে বললাম,
“কী আর করা, কয়েকদিনই তো। আয় খেয়ে নিই।”
“আমাদের সবার খাওয়া হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ, তুই খা। গুড নাইট—”
একথা বলে সৌরভ চলে গেল নিজের ঘরে।
আমি খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। তারপর ১২টার দিকে শুতে গেলাম। ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলাম। আমার বিছানার ওপর মানসী বউ সেজে বসে আছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে বাসায় আসার পর থেকে যা ঘটেছে তার সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত ছিল। খুব সম্ভব ওরা খেয়াল করছিল আমি মানসীর ওপর রেগে ছিলাম, আর আমার রাগ ভাঙাতেই মানসীকে এভাবে আমার সামনে উপস্থাপন করল। বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিল। আর বিছানার পাশের সেন্টার টেবিলে ফুলদানিতে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা। তবে এসব কিছু নয়, আমি শুধু দেখছিলাম মানসীকে। ও খুব সেজেছিল সেদিন, এর আগে ওকে কখনো এত সাজতে দেখিনি। তাই হয়তো জানা হয়নি ওকে সাজলে এত ভালো লাগে। আমি ওর কাছে গিয়ে ঠিক ওর সামনেই দাঁড়ালাম।
আমাকে দেখে ও কী ভাবছিল কে জানে। তবে উঠে দাঁড়িয়ে ভয় ভয় কন্ঠে বলেছিল,
“আমি কিছু করিনি। এসব সৌরভদা আর অনন্যার প্ল্যান। আমি ওদের অনেক নিষেধ করেছিলাম।”
মানসীর এসব কথা শোনার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। আমি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছিলাম। যেন শৈলচূড়ার সূর্যোদয়ের সমস্ত আলো এসে ঠিকরে পড়েছিল ওর গায়ে। ওর একটা গালে হাত রেখে বললাম,
“তোকে অন্যরকম লাগছে। এত সেজেছিস!”
ও হয়তো এতেই বুঝে গিয়েছিল আমি আর রেগে নেই। তাই ওর ভয় কেটে গেল। আহ্লাদি কন্ঠে বলল,
“ভালো লাগছে না তো? আমি জানি আমাকে সাজলে ভালো লাগে না। সৌরভদাকে এত্তবার করে বললাম আমি এত সাজব না। শুনলোই না আমার কথা।”
আমি ওর মুখটা দুহাতে ধরে বললাম,
“তাই মনে হচ্ছে? তাহলে কি আমি এমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতাম তোর দিকে? তোরা মেয়েরা নাকি ছেলেদের দৃষ্টি দেখলেই বুঝতে পারিস কোন ছেলে কেন তাকাচ্ছে?”
ও কোনো কথা বলল না। আমিই আবার বললাম,
“পাগলি, তোকে আজ পরীর মতো লাগছে। তুই যে এত সুন্দর আগে তো কখনো খেয়াল করিনি।”
“এটা ফলস সৌন্দর্য, সেজেছি বলেই। আমি তো সত্যি সত্যিই এত সুন্দর নই।”
“কেউ যদি সুন্দর না হয়, সাজ তাকে সুন্দর করতে পারে না। সাজের কাজ হলো লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যর বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।”
ও লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। বলল,
“হয়েছে হয়েছে, আর মিথ্যে বলে আমাকে খুশি করতে হবে না।”
আমি ওকে ছেড়ে বিছানার একপাশে বসে বললাম,
“আমার কি দায় পড়েছে যে তোকে খুশি করতে যাব? তুই তো আমারই, আজীবন মেয়াদ। তার ওপর কদিন ধরে আবার রেজিস্ট্রিকৃত। তোকে পটানোরও আর দরকার নেই।”
ও কাছে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাই? তাহলে এখন থেকে কী করবে?”
“অন্য মেয়েদের পটাব, নিত্যনতুন।”
একথা শুনেই মানসী আমার চুল খামচে ধরল। বলল,
“একটা চুলও যদি রেখেছি আজকে তোমার!”
আমি ওকে থামালাম না। শুধু মাথাটা তুলে এক দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার সেই দৃষ্টিতেই এমন কিছু ছিল যে হঠাৎ ও আমার চুলগুলো ছেড়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, অদ্ভুত দৃষ্টিতে! এ যেন এক আত্মসমৰ্পণ।
আমার মনের ওই খুঁতখুঁতে দুশ্চিন্তা কোথায় উবে গেল কর্পূরের মতো! যেন আগুন পেয়ে গলে যাচ্ছে মোম। ওর শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম, কী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ! নেশা নেশা। সত্যি ওই ঘ্রাণটার নেশা হয়ে গিয়েছিল আমার। নেশা এখনো আছে কিন্তু নেশা করা হয় না আর।
নীরব ইশতিয়াক
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
ডায়েরি বন্ধ করে অৰ্পি বলল,
“এটা কীভাবে সম্ভব? চাচ্চু মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল! সবাই সবকিছু জানত আর এখন এরকম কারো কথা আমরা জানিও না।”
অদ্রি চিন্তিত মুখে বলল,
“আমার কী মনে হয় জানিস? চাচ্চু খুব বেশি ভালবাসত মেয়েটাকে। লেখাগুলো অন্তত তাই বলছে। ব্রেকাপের ব্যাপারটা বোধহয় মানতে পারেনি তাই সবাইকে বলে দিয়েছে ওর কোনো চিহ্ন না রাখতে। ওর ব্যাপারে কোনো আলোচনা না করতে।”
“সেটা হতে পারে কিন্তু তাই যদি হয় নিজেই কেন তার ব্যাপারে এত কথা লিখবে?”
“হয়তো সবাইকে বোঝাতে চায় সে ভালো আছে। তাছাড়া নিজের মন হালকা করারও একটা ব্যাপার আছে। হয়তো কাউকেই বলতে পারে না তাই নির্বাক ডায়েরিতে লিখছে।”
“হুম, তাও ঠিক। একটা জিনিস খেয়াল করেছিস, দাদুকে মেয়েটা খালামণি বলত।”
“হ্যাঁ, সেটা আমিও খেয়াল করেছি। কিন্তু দাদুর তো একটাই বোন। যে কানাডাতে থাকে তার মেয়ের কাছে।”
চোখমুখ উজ্জ্বল করে অর্পি জিজ্ঞেস করল,
“হ্যাঁ। আচ্ছা আপ্পি, ওই মেয়েটাই মানসী নয়তো? হতেই পারে। নিজের আপন বোনের মেয়ে বলেই এত আদর করত। চাচ্চু কোথায় যেন লিখেছে না মানসী কাঁদছে এটা টের পেলে দাদু চাচ্চুকে আস্ত রাখবে না, এ ধরনের কিছু।”
অদ্রির কপালে চিন্তার ছাপ। বলল,
“তুই একদম ঠিক বলেছিস। সে হতে পারে। আমরা কিন্তু কখনো তাকে দেখিনি, এমনকি দাদুর বোনকেও দেখিনি। কখনো আমাদের বাড়িতে আসেনি অথচ দাদুর আপন বোন। এমনটা তো হতেই পারে যে নিজেদের ছেলেমেয়েদের প্রেম-বিয়ে এসব নিয়ে দুই বোনের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। চাচ্চু কিন্তু এক জায়গায় লিখেছে যে ওদের বিয়েটা ছিল ছোট বয়সের ভুল।”
“হ্যাঁ আপ্পি, আর চাচ্চুর সাথে ব্রেকাপের পর সে কানাডাতে চলে গেছে।”
“হুম, কিন্তু সে আমাদের বাসায় কেন থাকত সেটাই মাথায় ঢুকছে না।”
“কোন কারণ হয়তো ছিল। বাদ দে সে কথা, অবশেষে তার পরিচয় তো পাওয়া গেল।”
বিজয়ের হাসি ফুটল অর্পির মুখে। অদ্রি ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল,
“রাত কত হয়েছে খেয়াল করেছিস? ১:৪০ বাজে। নিজেরা আলোচনা না করে পরের পাতাগুলো পড়ি। আরো অনেক কিছুই জানতে পারব।”
·
·
·
চলবে.........................................................................