অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ১০ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          তন্ময়ী বাইকের উপরেই বসে আছে। কেবল ঘাড়টা একটু কাত করে পিছন দিকে কিঞ্চিত বাঁকানো। ওর মধ্যে ভয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। দৃশ্যমান চোখদুটো নির্লিপ্ত। পিছনে দু'জন ছেলে বাইকের উপরেই বসে আছে। দৃষ্টি নিবিষ্ট তন্ময়ীর দিকেই। এতো রাতে একটা মেয়েকে এরকম সুনসান রাস্তায় দেখে কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে তিয়াশের। রায়ান মুখটা একটু এগিয়ে তিয়াশের কান বরাবর নিলো,

"এই সেই মেয়ে স্যার।"

"আর ইউ শিওর?"

"ইয়েস।"

তিয়াশ আর কিছু বলল না। এতক্ষণেও দৃষ্টি চ্যুত হয়নি ও। কোনো ভণিতা ছাড়াই তন্ময়ীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

"রৌহিশ আপনার পূর্ব পরিচিত?"

এমন প্রশ্নে তন্ময়ীর শীতল আঁখি জোড়া ছোট ছোট হয়ে এলো। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল। সেভাবেই চেয়ে রইল, মুখে কিছু বলল না। রায়ান মুখ খুলল। গলার আওয়াজ ছোট, "এই মেয়ে খুব ত্যাড়া স্যার।"

"আমার কাছে ত্যাড়ামো করে পার পাবে নাকি?"

ঘাড় ঘুরিয়ে রায়ানের দিকে তাকাল তিয়াশ। ছেলেটা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল না, পার পাবে না। মুখটা গম্ভীর অথচ নেত্র যুগলে একটু উজ্জ্বলতা ছড়াল। চোখে হাসল বোধহয় তিয়াশ।
নিশুতি রাতের পরিবেশের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো কুকুরের ডাক। পরপরই সেই ডাক ছাপিয়ে শোনা গেল নারী কণ্ঠ,

"জি, পূর্ব পরিচিত।"

এমন উত্তরের জন্য অপরপক্ষ একদমই প্রস্তুত ছিলো না। মুখমণ্ডলে অবিশ্বাস্যতার রেশ ছড়িয়েছে ইতোমধ্যে। হেলমেটের ভেতরে থাকা রায়ানের চোয়াল ঝুলে গেছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ও যেন নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখজোড়া অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। তিয়াশের কপালের ভাঁজ বেড়েছে। 

"কত দিন?"

"জিজ্ঞাসা করুন কত বছর।"

তন্ময়ীর কথায় এই পর্যায়ে অবাকের শীর্ষে পৌঁছাল দু'জন। রায়ান জিজ্ঞাসা করল, "কত বছর?"

"এক শতাব্দী।"

তিয়াশ রায়ানের দিকে ফিরল, "অন্যের মস্তিষ্ক, মন পড়ার ক্ষমতা আছে?"

উত্তরস্বরুপ ডানে মাথা নাড়াল রায়ান। তিয়াশের রাগের পারদ ক্রমশ বাড়ল। দাঁতে দাঁত পিষল,
"তাহলে পড়ছ না কেন গর্দভ? এভাবে গাধার মতো বসে না থেকে কাজের কাজ করো।"

নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো রায়ান। রৌহিশ স্যার বোধহয় এই জন্যই ওকে মাথা মোটা বলে। একটু আধটু লজ্জাও পেল। সময় ব্যয় না করে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য বুঁজে নিলো আঁখি যুগল। তন্ময়ী তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সবটাই দেখছে। মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে। কাউকে ঘোল খাওয়াতে ওর ভালোই লাগে।

রায়ান বন্ধ আঁখি জোড়া মেলে তাকাল। অধরে মুচকি হাসি লেপ্টানো। ফিসফিসিয়ে উঠল,

"মেয়ে মিচকা শয়তান স্যার। মজা করছে আমাদের সাথে।" তিয়াশের মুখের কাঠিন্যতা ধীরে ধীরে সরে যেয়ে হাঁসির রেশ ছড়াল সবটা জুড়ে। ওষ্ঠপুটে উঁকি দিচ্ছে বাঁকা হাসি। কিছু একটা ভাবতেই মুখের হাসি প্রসারিত হলো, 

"তাহলে তো আপনি মানুষ নন। কোনো ভয়ংকর প্রাণী হবেন তাই না?"

"জি, মনুষত্যে পচন ধরা মানুষ নামক অমানুষদের কাঁচা মুণ্ডু চিবিয়ে খেতে খুব ভালোবাসি আমি।"

"এতগুলো বছরে কতজনের মুণ্ডু খেয়েছেন?"

"৯৯৮ টা। আপনাদের দুটো দিয়ে ১০০০ এর হাতেখড়ি করব।"

"নাইচ জোক। উই এনজয় ইট।"

কথাটার অর্থ গভীর ছিলো। কিন্তু ততটা গভীরভাবে ভাবার মতো ইচ্ছা পোষণ করল না তিয়াশ, রায়ান। শব্দ করে হেসে ফেলল তিয়াশ। ওর সঙ্গ দিলো রায়ান। এইসব মজার কথা শুনতে ওদের বেশ ভালো লাগছে। তন্ময়ীর মুখটা অধিকতর কঠিন হয়ে উঠল। এখানে তো হাসার মতো কিছুই বলেনি ও। তাহলে হাসছে কেন? গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল,

"এমনটা মনে হওয়ার কারণ?"

"কারণ আপনি পুরোটাই ধোঁয়াশায় মোড়ানো। আপনার নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই।"

উত্তরটা প্রশ্নের সাথে ঠিক মিলল না। এমন কথায় কিয়ৎসময়ের জন্য তন্ময়ী চমকাল, থমকাল। কিছু একটা মানসপটে ভেসে উঠল। তবে অস্পষ্ট, ঝাঁপসা সবটা। মস্তিষ্কে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হলো। প্রতিটা নিউরনে যেন রক্তের পরিবর্তে বিষ প্রবাহিত হচ্ছে। সহ্যাতীত সেই যন্ত্রণা।

তিয়াশ, রায়ান বাইক স্টার্ট দিয়েছে ততক্ষণে। আস্তে ধীরে সামনে এগোতে শুরু করল। তন্ময়ী বরাবর আসতেই একটু থামল,

"আপনি পাপের বেড়াজালে আটকে গেছেন। আপনার চারপাশে যা দেখছেন সব মিথ্যা এমনকি আপনি নিজেও। সবকিছুই কেবল এক টুকরো ভ্রম।"

মুখনিঃসৃত কথা শেষ করেই তন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝড়ের গতিতে দু'টো বাইকের অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। বিষাক্ত নীরবতায় মোড়ানো পরিবেশে একা পড়ে রইল তন্ময়ী। হাতে থাকা ছোট্ট নাইফটা ঠিকঠাক ভাবে প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো। এটার আর কোনো কাজ নেই।বাইকের হ্যান্ডেলের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসেই রইল। এইসব কী হচ্ছে ওর সাথে? এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড ওর সাথেই বা কেন ঘটছে? এই সবের পিছনে কে আছে? আর এইসব কী বলে গেল মানুষ দুটো? হেলমেট পরে থাকায় মুখটাও তো দেখতে পারেনি। এর উত্তর কার কাছে পাবে? বাবা কী পারবে এর উত্তর দিতে? হঠাৎ করেই জীবনে এইসব কী ঘটছে? নিজেকে একটা মানসিক রোগীর থেকে কোনো অংশে কম মনে হলো না তন্ময়ীর। খামছে ধরল বাইক। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল। কম্পিত হলো চারপাশের পরিবেশ। অদ্ভুদভাবে সেটা কোথাও একটা বাধা পেয়ে চারপাশ থেকে প্রতিফলিত হয়ে ওর কাছেই ফিরে আসলো। আকাশের বড়ো চাঁদটা ঢাকা পড়ে গেল কালো কাদম্বিনীর আড়ালে। আশেপাশের সবকিছুই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। ভেসে এলো আরও একটা হাড়হিম করা শীতল আওয়াজ,

"দে হেট টু সি ইউ স্মাইল বাট আই লাভ ইট। অলওয়েজ স্মাইল বেইবি।" 

কথাটার অস্তিত্ব বেনামি হাওয়ায় মিশে যাওয়ার পূর্বেই তন্ময়ী দ্রুত মাথা উঠিয়ে চারপাশে লক্ষ্য করল। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও কোথাও কেউ নেই। আশেপাশে কারোর উপস্থিতি নেই। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় চিল্লাল,

"কে আপনি? সামনে আসুন। আমাকে এভাবে মানসিক রোগী বানিয়ে রেখেছেন কেন?"

"আ'ম দ্য কেইঅস ইউ ক্রেভ। আ'ম দ্য ভিলেন ইন ইউর স্টোরি অ্যাণ্ড আই লাভ ইট।"

তন্ময়ী কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এবার কণ্ঠস্বর দ্বিগুণ উঁচিয়ে বলল,

"লিসেন নো ভিলেনস অ্যালাউড ইন মাই স্টোরি। আই জাস্ট হেট দেম।"

এইবার আর কোনো জবাব এলো না। গগনে শশীর উপর ভাসমান থাকা কালো নীরধর সরে যেয়ে মৃদু আলোয় ধরিত্রী আলোকিত করে তুলল। তন্ময়ী ভীষণ অসুস্থতা উপলব্ধি করল। আর দাঁড়াল না। কম্পিত হাতে বাইক স্টার্ট দিয়ে তা উল্টো ঘুরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলো। নিজের মন গহীনের যন্ত্রণা কমাতে এসে কয়েক গুণ বাড়ল তা। সাথে নিজেকে আরও একবার অসুস্থ মস্তিষ্কের অনুভব হলো মেয়েটার। কিন্তু আসলেই কি তাই? উঁহু, আমাদের চোখের দেখার বাইরেও অনেক কিছু রয়ে যায়।

—————

বাসায় ফিরে আলগোছে ড্রয়িং রুমের দরজার লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তন্ময়ী। সামনেই সোফায় বসে আছেন শেখ সাদমান। তন্ময়ীর আগমনে মেঝে থেকে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল। তন্ময়ী নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হলো। আজ অসুস্থতার জন্য জানালা দিয়ে ঘরের প্রবেশ করতে মন সায় দেয়নি। কিন্তু এখন তো মহাবিপদে পড়ল। বাবাকে কী বলবে? এই মানুষটাকে যে কখনো মিথ্যা বলতে পারে না তন্ময়ী। জীবনে বলে থাকলেও তার সংখ্যা খুব নগন্য। এতো ভাবনা চিন্তা কেবল করলই মেয়েটা কিন্তু ওকে কিছু বলতে হলো না। শেখ সাদমান মৃদু হেসে বললেন,

"ফ্রেশ হয়ে নিন আম্মা। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। রাত হয়েছে আমি রুমে যাচ্ছি। আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন। আগামীকাল সকালে কথা হবে। আপনার পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। কিছুদিন ভার্সিটি অফ দিন। বাবা সবসময় আপনার পাশে আছে। আপনার গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দিবে না বাবা। চিইইইল আম্মা।"

কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন শেখ সাদমান। তন্ময়ীর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো সবটা। তবে কি বাবা কিছু জানে এই বিষয়ে? এই প্রথম বাবার ব্যবহার, কথাগুলো একটু অদ্ভুত, রহস্যজনক ঠেকল তন্ময়ীর নিকট। পুনরায় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠতেই দরজা ধরে দাঁড়াল। নেতিয়ে আসা শরীর নিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ল বাবার উদ্দেশ্য,

"বাবা আমি কে?"

চলন্ত পদ যুগল থেমে গেল শেখ সাদমানের। পিছু ঘুরলেন। সমসময়ের মতো ওষ্ঠপুটে হাসি দৃশ্যমান। সেভাবেই উত্তর দিলেন,

"আপনি আমার রাজকন্যা। প্রিন্সেস অব শেখ সাদমান। আপনার এই একটাই পরিচয় আম্মা। আপনি ইসমাত মাহমুদা তন্ময়ী ব্যতীত আর কেউ নন।"

তন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। মূলত সেই শক্তিটুকু পেল না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন ওর সব শক্তি ক্রমশ শুষে নিচ্ছে। কোনোরকমে দরজা লক করে শ্লথ গতিতে হেটে নিজের ঘরে চলে গেল। শেখ সাদমান তখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের কোণে জল জমেছে। সন্তর্পণে তা মুছে নিলেন। 

—————

আরও একটা নব দিবসের সূচনা। বৃষ্টিমুখর দিন। ভোররাত থেকেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধরনীর বুকে। ঠাণ্ডা ঝিরিঝিরি মারুত বয়ে চলেছে প্রকৃতিতে। চারপাশ থেকে ভেজা মাটির ঘ্রাণ ভেসে আসছে। ভীষণ সুন্দর শীতল আবাহাওয়া। নিজের রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রিদাহ। হাতে এক কাপ গরমাগরম কফি। এক সিপ দিয়েছে মাত্র। উপভোগ্য একটা পরিবেশে এতোটাই মজেছে যে অন্যদিকে তার আর কোনো খেয়াল নেই। অকস্মাৎ গাছের একটা ডাল থেকে কেউ লাফিয়ে ব্যালকনিতে নামল। পাশে কারোর উপস্থিতি উপলব্ধি করতেই রিদাহ দৃষ্টি চ্যুত হলো। অমনিই সুন্দর একটা পরিবেশ উপভোগে বাঁধা পড়ল। ভীষণ বিরক্ত হলো মেয়েটা। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই পরিচিত একটা মুখ চক্ষুগোচর হলো। বৃষ্টির পানিতে মানুষটার শক্ত পোক্ত শরীরে জড়ানো শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। মোটকথা সম্পূর্ণ মানুষটাই কাকভেজা হয়ে গেছে একদম। নিষ্পাপ একজোড়া চোখ, নিষ্পাপ একটা মুখ দেখতেই হৃৎস্পন্দন বাড়ল মেয়েটার। কুঁচকে যাওয়া চোখ মুখ একটু স্বাভাবিক হতে চাইল। তৎক্ষণাৎ সামনে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। কিছু সময় নীরবে পেরোল। অপরপক্ষ থেকে ভেসে এলো শান্ত গলার আওয়াজ,

"কেমন আছেন ম্যাম?"

"যেমন দেখছেন।" তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো মেয়েটা। হাসল তিয়াশ, "আজ ভার্সিটি যাবেন?"

"ইচ্ছে আছে।"

"মন ভালো?"

"দেখে কী মনে হচ্ছে?"

তিয়াশ কিছু সেকেণ্ড নিগূঢ় মনোযোগ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। হয়তো ওর কথামতো মন বুঝতে একটুখানি চেষ্টা করছে। মুখে বলল, "মেইবি ভালো আছেন।"

"তাহলে তাই।"

আর কিছু বলল না তিয়াশ। চোখদুটো সামনের দিকে স্থির হলো। একমনে বৃষ্টি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রিদাহ একবার আড়চোখে ওর দিকে তাকাল। ভীষণ মায়া হলো মেয়েটার কিন্তু ও নিজেও অপারগ। কিছু করার নেই। 'ভালোবাসা' শব্দটা ওর কাছে মৃ ত। আনমনে কফির মগে সিপ দিতে নিলেই শুনতে পেলো তিয়াশের কণ্ঠস্বর,

"ঠাণ্ডা আবহাওয়া, শীতল বাতাস, উপভোগ্য পরিবেশ। চলুন হাঁটতে বের হই। এক কাপ চায়ে গল্পের আসর জমবে ভালো। প্রেম, ভালোবাসা হলে হবে আর না হলে বন্ধুত্ব।"

রিদাহ এর বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠল। কিছু তো একটা ছিলো কথাটাতে। কম্পিত হলো বুকটা। কিন্তু কেন? এর উত্তর চারপাশ হাতড়িয়েও পেলো না। চোখজোড়া বুজে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। চোখের পর্দায় নিজের ভালোবাসার মানুষটার মুখটা ভেসে উঠল। কী-এক অদ্ভুত দোটানা! যন্ত্রণায় পিষ্ট হলো অন্তর। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলতে পারল না। তিয়াশ ব্যথিত নয়নে ওর দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইল। রিদাহ এর নিরবতা যেন ওর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো। আর দাঁড়াল না তিয়াশ। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই লাফিয়ে গাছের ডালে উঠল পরপরই চোখের পলকে হারিয়ে গেল ছেলেটা। রিদাহ এতক্ষণে চোখ মেলে চাইল। ম্লান হেসে বিড়বিড় করল,

"আহ্! এই জীবন হচ্ছে অলিখিত বোঝাপড়া। সবটা মীমাংসিত হয়েও অমীমাংসিত।"

চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। অশ্রুসিক্ত নয়নেই বাম পাশটায় তাকাল যেখানে কয়েক সেকেণ্ড আগে তিয়াশ দাঁড়িয়ে ছিলো। জায়গাটাও ভিজে গেছে। হাতে থাকা মগটা সজোরে ছুঁড়ে মারল দেওয়ালে। সেটা শব্দ তুলে ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ব্যালকনির ফ্লোরের সবখানে। রাগে ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। চুল খামচে ধরে ওখানেই বসে পড়ল। দীর্ঘ একটা সময় ওখানে বসে ওভাবেই কাটিয়ে দিলো।

—————

সকাল নয়টা বেজে পাঁচ মিনিট। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এখন। সুবিশাল অম্বর বিশ্রামে আছে। তবে কালো মেঘের ঘনঘটা সরেনি। বইছে এলোমেলো হাওয়া। বাবার কথামতো আজ ভার্সিটি যায়নি তন্ময়ী। সবকিছু থেকে কিছুদিন আপাতত দূরে থাকতে চাইছে। এতে যদি একটু স্বস্তি মেলে। বাসায় ও মন বসছে না তাই হসপিটালে উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। মিরার কাছে যাবে। দুই বান্ধবী মিলে আড্ডা দিলে হয়তো ভালো লাগবে। ক্লারাকে সকাল থেকে বার কয়েক কল দিয়েছে কিন্তু মেয়েটাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে কী হয়েছে কে জানে? দুশ্চিন্তাও হচ্ছে ভীষণ। কাছের মানুষগুলো ভালো না থাকলে যে তন্ময়ী নিজেও ভালো থাকে না।

বাইক পার্কিং এরিয়ায় নিজের বাইকটা রেখে হসপিটালের দিকে হাঁটা ধরল। সিঁড়ি বেয়ে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে পৌঁছে মিরার কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল তন্ময়ী। ভেতর থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। পরিচিত মনে হলো ওর কাছে। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে নিলেই পা জোড়া থেমে গেল। রৌহিশ স্যার এখানে? আজব! কীভাবে কী? এও বুঝি সম্ভব? পরক্ষণেই ভাবল একজন স্টুডেন্টকে স্যার দেখতে আসতেই পারে। আর মিরার বিষয়টা সম্ভবত ক্লাসের কমবেশি সবাই জানে। সেখানে স্যারের দেখতে আসার বিষয়টা আহামরি কিছু না। 

তন্ময়ীর ভাবনার মাঝেই সানগ্লাসের আড়ালে থাকা দুটো চোখ ওর দিকে ঘুরল। স্যারের মুখটা চক্ষুগোচর হতেই তন্ময়ী ভদ্রতা স্বরুপ একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু রৌহিশ ওকে যেন দেখেও দেখল না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আগের মতো টুকটাক কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অপরপক্ষ থেকে পাওয়া ব্যবহারটা তন্ময়ীর ঠিক হজম হলো না। গতরাতেও না সুন্দর করে পরিচিত মানুষের মতো কথা বলল। আর দিনের আলো ফুটতেই পাল্টি খেয়ে গেল? এই হচ্ছে পুরুষ জাতি‌। তাচ্ছিল্য হাসল ও।

মিরার শত শব্দ উচ্চারণের বিপরীতে রৌহিশের থেকে কেবল একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে মেয়েটা। এতেই যেন ওর খুশি আকাশচুম্বী। তন্ময়ীর কাছে এই দৃশ্যটা বেশ ভালো লাগল। এভাবেই সবসময় হাসিখুশি থাকুক মেয়েটা। ওদের খুশিতেই ওর খুশি। আচ্ছা স্যারের সাথে মিরার ভাগ্য জুড়ে গেলে খুব কি ক্ষতি হবে? মেয়েটা তাহলে মনের ক্ষত ভুলে আজীবন ভালো থাকতে পারত। যার সামান্য আগমনে একটা মেয়ে এতটা খুশি হতে পারে তাকে সারাজীবনের জন্য পেয়ে গেলে সে নিশ্চয় নিজস্ব কল্পনার জগতে বাস করবে। যেখানে কষ্টরা কখনো হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকতে পারবে না।

পর মুহূর্তেই নিজের ভাবনায় নিজেও ঈষৎ অবাক হলো। এইসব কী ভাবছে ও? তবে এমনটা হলে খুব একটা মন্দ হয় না। ওর এমন উদ্ভট চিন্তা ভাবনায় একজোড়া চোখ নিঃশব্দে হাসল। মনে মনে আওড়াল,

"উঁহু, এটা কখনোই সম্ভব নয়। এমনটা হলে আমার ব্ল্যাক টিউলিপের কপাল পুড়বে।"
·
·
·
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp