অভিমানিনী - পর্ব ০৭ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


অৰ্পি বলল,

“আপ্পি, কাঁদছিস কেন?”

“ঠিক বুঝতে পারছি না কেন এত কান্না পাচ্ছে। যে মানুষটা আমাকে এত আদর করত, তার সম্পর্কে কিছুই জানি না সেজন্য নাকি অন্য কিছু!”

অর্পি বোনকে কাঁদতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। বলল,

“আপ্পি, রাত আড়াইটা বাজে, তুই এভাবে কাঁদলে তো পড়ে শেষ করতে পারব না।”

“আমি ঠিক আছি! পরের পৃষ্ঠায় যা।”

অৰ্পি পৃষ্ঠা উল্টালো…

দিহান বড় হচ্ছে। আমি বাবা হিসেবে সব দায়িত্বই পালন করছি, ওকে সময়ও দিচ্ছি কিন্তু ওর সাথে বাপ-ছেলের কোনো আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। দিহান আমাকে ভয় পায়, পারতপক্ষে ধারেকাছে আসে না। আমি দিহানকে প্রচণ্ড ভালোবাসি অথচ কেন যেন প্রকাশ করতে পারি না। ও যেদিন পৃথিবীতে এসেছিল সেদিন আমি ওকে কোলে নেয়ার পর দিতিয়া বলেছিল,

“বলো তো তোমার কোলে কে?”

আমি হেসে বলেছিলাম,

“কে আবার দিহান।”

“ওর আসল পরিচয় জানো?”

“মানে?”

দিতিয়া বলেছিল,

“ওর আসল পরিচয় হলো ও দিতিয়া, মানসী এবং নীরবের ছেলে। দিতিয়া, মানসী আর আমার সন্তান! কনসেপ্টটা কি দারুণ না? ওকে কোলে নিয়ে সেদিন আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। যা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।

“আমার সন্তান–এই কথাটা ভাবলে আমার দিহানের আগে তুলতুলের কথা মনে হয়। তুলতুল আমার প্রথম সন্তান সেজন্যই বোধহয়।”

এই পর্যন্ত পড়ে অর্পির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল,

“তুলতুলটা কে?”

“পড়লি তো, চাচ্চুর মেয়ে।”

“তাহলে সে এখন কোথায়?”

“উফ অৰ্পি, তুই যতটুকু পড়েছিস আমিও তো ততটুকুই পড়েছি। তাই না? চুপচাপ পড় তো।”

ওরা আবার পড়া শুরু করল…

তুলতুল আমার মেয়ে, আমার আর মানসীর মেয়ে। ওকে এই পৃথিবীতে আসার ভিসা আমরা দিতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ওর অস্তিত্ব তখনও ছিল। এখনো আছে।

মানসী খুব বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করত। আমাকে সবসময় বলতো, আমাদের একটা মেয়ে হবে। এমন হবে, তেমন হবে। ওকে নিয়ে আমরা এটা করব, ওটা করব। এভাবে সাজাব, ওভাবে সাজাব। একসময় ওর এসব প্ল্যানিং-এ নিজের অজান্তে আমিও যোগ দিলাম।

একদিন বিকেলবেলা বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিলাম। বইয়ে এতই মগ্ন ছিলাম মানসী যে কখন এসে আমার পাশে বসেছে খেয়ালই করিনি। হঠাৎ শুনতে পেলাম ও বলছে,

“বইটা কি আমার থেকেও সুন্দর?”

আমি হেসে বললাম,

“তা এই সুন্দরী এতক্ষণ কোথায় ছিল?”

“শোনো না, বইটা একটু রাখো তো। তোমার সাথে খুব ইম্পরট্যান্ট একটা কথা আছে।”

“বল, শুনছি।”

“থাক, তোমার শুনতে হবে না। তুমি বই পড়ো।”

“আরে কই যাচ্ছিস? এই রেখে দিলাম, এবার বল।”

একটু গালটা টিপে দিয়ে বললাম,

“খালি রাগ না?”

মানসী খুব সংকোচ করে যেটুকু বলল তা হলো,

“না মানে, একটা কথা আরকি! তোমার সাথে শেয়ার করা দরকার।”

“এত আমতা আমতা করছিস কেন? বল কি বলবি?”

মানসী লজ্জা পাচ্ছিল। আমার মাথায় কিছু আসল না, যে মেয়েটা সারারাত আমার বুকে লেপ্টে থাকতে ভালোবাসে, যার অজানা কিছুই নেই আমার, তার এমন কী কথা থাকতে পারে যা বলতে লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছে! আমি ওর একটা হাত আমার বুকে চেপে ধরে বললাম,

“আমাকে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? পাগলি! বল তো।”

“কই লজ্জা পাচ্ছি না তো।”

“লাল হয়ে গেছিস অলরেডি।”

“কালোরা লজ্জা পেলে লাল হয় না।”

“অহেতুক কথা বলিস না, যেটা বলতে এসেছিস সেটা বল।”

“নাহ মানে, থাক আরেকদিন বলব।”

এই বলেই ও উঠে যাচ্ছিল। আমি ওকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

“এখন আই কন্টাক্ট হবে না। তাই লজ্জার কোনো কারণ দেখছি না। এবার তো বল।”

“আমাকে একটু ভালো করে দেখো না। আই মিন চেকাপ করো।”

“কেন তোর আবার কী হলো? কোনো সমস্যা?”

“হ্যাঁ”

“কী সমস্যা?”

“অনেক সমস্যাই হচ্ছে। আমার কেমন যেন লাগছে গো। একটু ভালো করে দেখো না আমার পেটে বাচ্চা এল কিনা!”

হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হবার জোগাড়! কোনোরকমে বললাম, “তোর এমন কেন মনে হচ্ছে?”

মানসী খুব অভিমান করে বলেছিল,

“সবকিছুতেই তোমার ঠাট্টা। আমার ওরকম মনে হলো বলেই তো বললাম। যাও, কথাই বলব না।”

“আচ্ছা বাবা সরি, শোন শোন…তোর তো বাচ্চাকাচ্চা খুব পছন্দ তাই এসব মনে হয়। তার ওপর তোর বেস্ট ফ্রেন্ড এক বাচ্চার মা হয়ে গেছে, তোরও তাই…”

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মানসী বলল,

“আন্দাজে কথা বলছ কেন? খুব বড় ডাক্তার হয়ে গেছ?”

“আন্দাজে বলব কেন? তুই প্রেগন্যান্ট হলে তোকে দেখেই বুঝব আমি। তাছাড়া আমি বাপ হচ্ছি কিনা সেটা আমি জানব না?”

মানসী চুপ। আমি আবার বললাম,

“লক্ষণ যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অন্য কারণে। দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে।”

ও এবারো কিছু বলল না। চুপ করে আমার বাহুডোরে বসে রইল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,

“খুব মা হতে ইচ্ছে করে বুঝি?”

“তুমি বোঝো না কিছু।”

আমি হেসে বললাম,

“আমার ইন্টার্নশিপ তো প্রায় শেষ। এরপর একটা চাকরি হয়ে গেলেই সবাইকে জানিয়ে আবার বিয়ে করব। তারপর আর তোর মা হওয়া আটকায় কে!”

“ধেৎ, তুমি না…!”

“পাগলি এই কটা দিন অপেক্ষা করতে পারবি না?”

“তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব।”

“হুহ…এগুলো সব আবেগের কথা, তোর বাপ তোকে একটা ধমক দিলে তুই সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে ভুলে যাবি।”

“ছিঃ কক্ষনো না। আমি বাবাকে ভয় পাই ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভয় পাই তোমার থেকে দূরে থাকা। আমি বাবাকে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলব দেখো। আর খালামণি তো আছেই, তার কথা বাবা কিছুতেই ফেলতে পারবে না।”

আমি ওর গাল টিপে আদুরে গলায় বললাম,

“হুম তাও তো ঠিক।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মানসী হঠাৎ বলে উঠল,

“এই শোনো, আমাদের একটা মেয়ে হলে নাম রাখব তুলতুল

“তুলতুল? এটা আবার কেমন নাম?”

“এটা ডাক নাম। ভালো নাম তুমি কিছু একটা রেখো। কিন্তু ডাকনামটা তুলতুলই হবে।”

“আচ্ছা কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”

“কী?”

“ওর গালগুলো যদি তোর মতো তুলতুলে হয় তাহলেই ওর নাম তুলতুল রাখতে দেব।”

মানসী হেসে বলল,

“সব বাচ্চাদের গালই তুলতুলে হয়। শুধু গাল কেন, পুরো শরীরই নরম তুলতুলে হয়?”

“তোর মতো?”

একথা বলতেই ও আমাকে অসভ্য বলে মারতে লাগল।

আগে যেমন আমরা বলতাম আমাদের একটা বাচ্চা হলে ওকে নিয়ে এই করব সেই করব…সেদিন নাম রাখার পর থেকে আমরা তুলতুলের নাম ধরেই বলতাম। সত্যি তুলতুল জন্ম না নিয়েও খুব ইম্পরট্যান্টলি আমাদের মধ্যে ছিল।

নীরব ইশতিয়াক
২ এপ্রিল, ২০১৬

ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতেই অদ্রি অর্পির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পুরো ডায়েরিটাতে আর কোথাও কিচ্ছু লেখা নেই!
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp