সারারাত জেগে সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছিল অদ্রির। সকাল থেকেই ভাবছে মানসীর কথা। কে ছিল উনি? সবাই যখন ওনার কথা জানত তাহলে এরকম কেন হলো? চাচ্চু যখন ওনাকে বিয়েই করেছিল তাহলে বিয়েটা ভাঙল কী করে? আর কেনই বা ভাঙল? দুজন তো দুজনের জন্য পাগল ছিল, তাহলে? কী এমন ঘটতে পারে যার জন্য আজ দুজনে আলাদা? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। কোনো হিসেব মিলছে না। ছোটবেলাটা যার কোলে কোলে কাটিয়েছে তার কোনো অস্তিত্বই জানে না অদ্রি। কী অদ্ভুত এই দুনিয়া।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল অদ্রি। অর্পি ঘরে ঢুকে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে ক্রসবেল্ট খুলতে খুলতে বলল,
“আপ্পি কোনো ক্লু বের করতে পারলি?”
অদ্রি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“কিসের?”
“মানসীর।”
“না।”
“জানিস আপ্পি, ক্লাসে একদম মনোযোগ দিতে পারিনি। শুধু ভেবেছি বাকিটা কী করে জানব!”
“কোনো উপায় নেই।”
“তা বললে তো হবে না। উপায় একটা বের করতেই হবে এট এনি কষ্ট।”
অদ্রি কিছু বলল না। অর্পিই আবার বলল,
“বাবা তো অনেক ফ্রেন্ডলি। চল বাবাকে জিজ্ঞেস করি?”
“পাগল হয়েছিস? বাবা যখন জিজ্ঞেস করবে এসব ব্যাপার আমরা জেনেছি কোত্থেকে, কী বলবি? চাচ্চুর ডায়েরি পড়েছি?”
অর্পি দাঁতে জিভ কেটে বলল,
“তাইত! কিন্তু আমরা জানব কী করে?”
“ভাবতে হবে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জানার কোনো উপায় নেই কিন্তু নাথিং ইজ ইম্পসিবল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। এন্ড আই বিলিভ ইট।”
অর্পি অদ্রির গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল,
“দ্যাটস লাইক মাই বিগ সিস।”
সন্ধ্যাবেলা অদ্রিকে দাদুর ঘরের সামনে দেখে অৰ্পি বলল, “দাদুকে নিয়ে কি কোনো প্ল্যান করছিস?”
অদ্রি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“হুম।”
“কী প্ল্যান?”
“এদিকে আয়, বলছি।”
এই বলে অদ্রি অর্পিকে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“শোন, যেহেতু দাদুর একটা বোন ছিল। সেহেতু দাদুর অবশ্যই বোনের ব্যাপারে একটা দুর্বলতাও আছে। এটাকেই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।”
“হুম, কিন্তু অতটা দুর্বলতা নাও থাকতে পারে। গ্যাঞ্জাম কিছু একটা হয়েছিল সে ব্যাপারে তো আমরা সিওর। ছোটবেলা থেকে কখনো দেখেছিস ওদেরকে? মানলাম ওরা কানাডা থাকে তাই আসে না। কিন্তু ফোন টোনও তো আসে না।”
“দুর্বলতা হয়তো চাপা পড়ে আছে।”
“মানে?”
“তুই যখন আমার সাথে রাগ করিস, তখন কি আমার সাথে কথা বলিস?”
“না।”
“কষ্ট কিন্তু ঠিকই হয়। রাত্র বেলা কাঁদিসও।”
“হুম, তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমার সব থেকে আপন। তাই তোর সাথে ঝগড়া হলে খুব কষ্ট হয়।”
“তেমনি সব বোনেদেরই ছোটবেলা এভাবেই কাটে। কিন্তু বিয়েশাদি হলে দূরত্ব বাড়ে, সংসার আর ক্যারিয়ারের ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। তারপরেও অনুভূতিগুলো রয়েই যায়। আর আমাদেরকে সেটাই খুঁচিয়ে বের করতে হবে।”
“বাহ! তাহলে তুই দাদুর ঘরের সামনে থেকে চলে আসলি কেন?”
“আরে বাবা এখন হঠাৎ করে কিছু বললে তো সন্দেহ করবে। সুযোগ বুঝে খোঁচা মারতে হবে। এই ধর দাদুর সামনে এনি হাউ আমরা দুবোন আমাদের দুজনের প্রতি ভালোবাসা দেখাবো। তারপর দাদু নিশ্চয়ই কিছু বলবে। তোর মনে নেই আমাদের ঝগড়া দেখলেই দাদু বলে ঝগড়া করো না বোন হলো সবচেয়ে কাছের মানুষ। বা বেশি খাতির দেখলেও বলে এরকমভাবে চিরকাল থেকো। এরকম কিছু বললেই আমরা দাদুকে তার বোনের কথা জিজ্ঞেস করব।”
“ওকে কিন্তু কবে? কীভাবে? আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারছি না রে আপ্পি!”
“একটু ধৈর্য তো আমাদের ধরতেই হবে রে বোন।”
রাত্রে যখন সবাই খেয়ে উঠে গেল অর্পি তখননো খাচ্ছে, অর্পির খেতে অনেক সময় লাগে। আজ অদ্রির প্ল্যানমতো আরো বেশি দেরি করে খাচ্ছে। কারণ একটু পরেই দাদু সারা রাতের জন্য পানি নিতে আসবে। আর তখন অদ্রি অর্পির অভিনয় শুরু হয়ে যাবে। অর্পি বলল,
“কিরে আপ্পি? আজ কি দাদু পানি নিতে আসবে না? ভাত নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব? নাকি আগেই নিয়ে গেছে?”
“আরে দাঁড়া না। আরেকটু দেখি।”
কিছুক্ষণের মধ্যে দাদু আসছে টের পেয়ে অদ্রি অর্পিকে খাইয়ে দিতে শুরু করল। দাদু ওদেরকে দেখতে পেয়ে বলল,
“কী ব্যাপার? আমার দাদু মনিরা এখনো খাচ্ছে?”
অদ্রি বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
“আর বলোনা দাদু, এই মেয়েটার খেতে যে এত সময় লাগে। আবার বলছে আমি না খাইয়ে দিলে খাবে না।”
দাদু বলল,
“তো দাও না দাদু। বড় হয়ে গেলে কে কোথায় চলে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? তখন তো এসবই স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
হঠাৎ অৰ্পি বলে উঠল,
“আচ্ছা দাদু, তোমার না একটা বোন ছিল?”
অদ্রি মনে মনে রেগে গেল। অর্পিটা কিচ্ছু বোঝে না। এভাবে নয়, অন্যভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। উফ মেয়েটা সাহস দেখিয়ে সব ডোবাবে।
দাদু কেমন আনমনা হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ছিল ছোটবোন একটা। খুব আদরের বোন ছিল।”
অদ্রি জিজ্ঞেস করল,
“সে এখন কোথায়?”
“এখন কানাডাতে থাকে। ওর মেয়ে বিয়ের পর কানাডা চলে যায়। তারপর ওর স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়ে ওকেও কানাডাতে নিয়ে যায়। আর তো ছেলেপুলে নেই কার কাছেই বা থাকবে।”
অৰ্পি বলল,
“ওহ ওনার সাথে তোমার যোগাযোগ নেই? কই ফোন করতে দেখিনি তো কখনো।”
“নারে, ওর সাথে আর আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ওর তো অনেক রাগ আমার ওপর।”
একথা বলেই উদাস হয়ে গেল দাদু। এই উদাসীনতাকেই কাজে লাগাতে হবে। অদ্রি বলল,
“কিসের রাগ দাদু?”
“সে তোরা বুঝবি না। বড়দের অনেক সমস্যা। বড় হোসনে বোন, বড় হোসনে।”
একথা বলতে বলতে দাদু কেঁদে ফেলল। অদ্রি অর্পি কী করবে বুঝতে পারল না। দাদু এক বোতল পানি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। অদ্রি বলল,
“বিষয়টা খুব সেনসিটিভ। তা না হলে দাদু এভাবে কেঁদে ফেলত না। দাদুকে আর কক্ষনো এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না।”
অর্পি অদ্রির হাতটা ধরে বলল,
“আপ্পি আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি প্রেম করে আমরা তবে মেনে নেব ওকে? কারণ আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না। যতই ঝগড়া করি আমি তোকে খুব ভালোবাসিরে আপ্পি।”
অদ্রি অর্পির মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলল,
“পাগল!”
অর্পি একটু থেমে বলল,
“আচ্ছা আপি তাহলে তো দাদুকে আর জিজ্ঞেস করা যাবে না। আমরা বাকিটা জানব কী করে?”
অদ্রি হাত ধুতে ধুতে বলল,
“এখানে কথা বলাটা ঠিক হবে না। ঘরে চল বলছি।”
ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে অদ্রি বলল,
“আমাদের বাকি কাহিনীটা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ
বাকিটা ওই ডায়েরি পড়েই জানতে হবে।”
“সেটা কী করে সম্ভব? ডায়েরি তো ফাঁকা।”
“এখন ফাঁকা। কিন্তু কদিন পর তো ফাঁকা নাও থাকতে পারে।”
“তুই কী বলতে চাচ্ছিস বুঝতে পারছি না।”
“আমার বিশ্বাস চাচ্চু আবারও লিখবে। পুরো কাহিনীটাই লিখবে। বেশি সময় তো পায় না, তাই হয়তো অল্প অল্প করে লেখে। কিন্তু লিখবে।”
“তুই কী করে এত সিওর হচ্ছিস?”
“তুই খেয়াল করেছিস প্রত্যেকটা লেখার পর সিগনেচার আর তারিখ দেয়া আছে। তারিখগুলো কিন্তু কিছুদিন আগের। শেষ লেখাটা ২ এপ্রিল, ২০১৬ মানে গতকালকের। তার মানে কাল চাচ্চু এটাই লিখছিল। এখন আমাদের শুধু নজর রাখতে হবে কবে চাচ্চু লাইব্রেরিতে অনেকটা সময় কাটায়। তাহলেই বুঝব চাচ্চু লিখেছে।”
“আপ্পি তুই খেয়াল করেছিস চাচ্চু প্রতিটা লেখা লিখেছে কোনো না কোনো স্মৃতি মনে করে।”
“হুম। এটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। আর চাচ্চু এই কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে না বলেই ডায়েরিতে লিখছে, তাতে মন হালকা হচ্ছে। আর একবার যখন লিখতে শুরু করেছে শেষ নিশ্চয়ই করবে। তাছাড়া মন হালকা হবে না।”
“আর যদি চাচ্চু না লেখে তাহলে কি সব অজানাই রয়ে যাবে?”
“আরে দেখি না কী হয়। এত অস্থির হলে কী করে হবে?”
“কী করব? আমি যে বড্ড অস্থির রে আপ্পি।
·
·
·
চলবে..........................................................................