!!১!!
“সুলতানিম, জাহাপনা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তার দ্বিখণ্ডিত মস্তক তলোয়ারে ঝুলিয়ে শত্রুপক্ষ নগরে প্রবেশ করছে। খবর এসেছে ওরা শিরাজ শহর সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। লুটপাট করে নিচ্ছে যা পারছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো নগরের প্রবেশদ্বার তাদের দখলে চলে যাবে। ওরা মানুষ নয় মালেকা। পশুর মতো জবাই করছে সবাই কে। আমাদের বাঁচান সুলতানিম। ওদের হাতে পড়লে আমাদের রক্ষা নেই। হয় দাসী হতে হবে নয়তো আমাদের পুড়িয়ে মারবে”
খাস দাসীর ত্রাসে টুইটুম্বুর কান্নামিশ্রিত স্বর শুনতেই বুক ধক করে উঠলো। খোরতাইনের সুলতানা মারিয়ামের। জ্বলছে সাম্রাজ্য। হাহাকার গুঞ্জছে একসময়ে হাসির কলধ্বনিতে পরিপূর্ণ নগরী এসফাইন। সুলতান বেগ আরসালান মোহাম্মদ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। তার পরাজয়ের সাথে সাথে খোরতাইন সম্রাজ্যের সমাপ্তির ঘন্টাও বেজেছে। যেকোনো মুহূর্তে এসফাইন চলে যাবে শত্রুর দখলে, এই কথার মর্মার্থ কেবল একটি তা হল সমগ্র রাজ্য এখন অন্যের দখলে। মারিয়ামের শুভ্র মুখখানা ভয়ে রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। নিজ ভবনের খিলানযুক্ত জানালা খুলে অবস্থা দেখার চেষ্টা করলো সে। এর মাঝেই আরেকজন দাসী ছুটে এসে বললো,
“মালেকা, সুলতানের দরবারের সব দেওয়ানরা পালানোর ফন্দি আটছে। কেউ কেউ শত্রুর সম্মুখে মাথানত করতেও রাজী। ওরা কাউকে ছাড়বে না। ওর প্রতিনিধিত্ব করছে সুলতান মালেক শাহর পুত্র, ক্রুর সে”
বলেই বাঁচার জন্য আহাজারি শুরু করলো সে। মারিয়ামের মস্তিষ্ক কাজ করছে না। অন্তরের ভেতর জমায়িত হয়েছে ভয়। এই ভয় মৃত্যুভয় নয়। তবুও কণ্ঠে জড়তার লেশ না রেখে বললো,
“থামো, অস্থির হওয়ো না। তাতার আমাদের বন্ধু। তারা নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচাবে। তোমরা তাতারে সংবাদ পাঠাও। ওরা সৈন্যবল পাঠায়। জলদি”
তাতারের শেহজাদী মারিয়াম। নিজেদের শেহজাদীকে নিশ্চয়ই এই দুঃসময়ে একা ফেলে দিবে না তাতারবাসী। উপরন্তু তখতে এখন তার ভ্রাতা ওসমান আব্দুল মুয়িদের রাজত্ব। সে তার ভগিনীকে কখনোই মরতে দিবে না। কিন্তু তাকে আশাহত করে দু প্রহরের মধ্যেই খাসদাস জানালো,
“মালেকা, আমরা কেউ বাঁচবো না। তাতার থেকে কোনো সাহায্য আসে নি আমাদের বাঁচান মালেকা। আমাদের বাঁচান”
মারিয়ামের ভেতরটা ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো। নিজের ভ্রাতার বিশ্বাসঘাতকতা তার সকল পরিকল্পনা এবং আশাকিরণকে দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ করে দিল যেন। তবুও অকম্পিত স্বরে বললো,
“শান্ত হও। বুজদিলের মতো আচারণ করো না। ভুলে যেও না তোমাদের সুলতান এই ভুমিকে বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছেন। তার মৃত্যুকে এতোটা তুচ্ছ করে ফেলছো কি করে? আর যুবরাজ কোথায়? কোথায় শেহজাদা নাসির?”
“শেহজাদা তার ভবনে”
“আমাদের শেহজাদাকে বাঁচাতে হবে। যে করেই হোক। মনে রেখো ঐ আমাদের এই সালতানাতের উত্তরাধিকারী”
বলেই মারিয়াম ছুটলেন শেহজাদার প্রাসাদের দিকে। চারপাশে মানুষের চিৎকার, কান্নার শব্দ। এ যেন জাহান্নামের কোনো দৃশ্য। প্রতিটি মানুষ বাঁচার জন্য আহাজারি করছে। তাদের মধ্যে অস্থিরতা। যে যেমন পারছে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে। এর মধ্যেই খবর এলো,
“মালেক শাহ সেনাপতি মীর বখসি আল বহর এসফাইনের নগরদ্বার দখল করে ফেলেছে”
শত্রুর সেনাপতি ক্রুরভাবে হত্যা করছে সকলকে। প্রাসাদ দখলে যারা বাধা দিচ্ছে তাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ধারালো তরবারির। লহুর বন্যা বইছে। রক্তের লাল রঙ এতোটা ক্রুর এবং ভয়ংকর তা বোধহয় আজ এসফাইন নগরী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। উল্লাস, উৎসাহে ভরপুর নগরী এখন মৃত্যুপুরী।
—————
ভালিদে সুলতান মারিয়াম শেহজাদা নাসিরের প্রাসাদে যখন পৌছালেন তখন দেখলেন এগারো বর্ষিয়া শেহজাদা প্রস্তুত হচ্ছে। বর্ম তার শরীরে। মাথায় বাঁধছে সারিক। মারিয়াম ছেলের দিকে ছুটে গিয়ে রোষ মিশ্রিত স্বরে শুধালো,
“কি করছো তুমি?”
“আম্মীজান, শত্রু এসফাইনে ঢুকে গেছে। এসফাইনবাসীকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। শেহজাদা হিসেবে এই প্রাসাদকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আব্বুজান শহীদ হয়েছেন। একমাত্র শেহজাদা হিসেবে তার সকল দায়িত্ব এখন আমার”
“হ্যা, তার একমাত্র শেহজাদা হিসেবে খোরতাইন সাম্রাজ্যের সুলতান এখন তুমি। তাই তোমার প্রথম কাজ বেঁচে থাকা। তোমাকে বাঁচতেই হবে। চল আমার সাথে”
“কিন্তু আম্মী”
“কোনো কথা নয় নাসির। কোনো কথা বলার সময় নেই। এখন আবেগ দেখানোর সময় নয়। আজ যদি তুমি আবেগে ভেসে শত্রুর হাতে প্রাণ দেও তাহলে খোরতাইন সাম্রাজ্য পৃথিবী থেকে মিটে যাবে। তোমাকে বাঁচতে হবে। খোরতাইন সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মীর এহমাদ শত্রুকে যতসময় আটকাচ্ছে তোমাকে তত সময়ে পালাতে হবে”
নাসির মায়ের এমন কথায় স্তম্ভিত হলো। তার মা তাকে পালাতে বলছে? নাসির সাথে সাথেই প্রতিবাদ করলো,
“আমি বুজদিল নই আম্মী। আমি কেনো আমার প্রজাদের ছেড়ে পালাবো? তাদের সুলতান আমি”
“না বাঁচলে তুমি কেবল একটা নিথর শরীর”
“আম্মী”
“চুপ কোনো কথা নেই”
বলেই নাসিরকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলেন প্রাসাদের একটি গোপন সুরঙ্গে। গোপন সুরঙ্গের শেষ মাথা নাসিরকে নিয়ে যাবে একেবারে জায়ান্দে নদীর তীরে পৌছে দিবে। মারিয়াম ছেলের মুখে হাত দিয়ে কান্নামিশ্রিত স্বরে বললো,
“পালিয়ে যাও নাসির। আমাদের চিন্তা কর না। সুলতানকে রক্ষা করা তার প্রজার দায়িত্ব। আমরা আমাদের দায়িত্বপালন করছি”
“আম্মী, তুমিও চল আমার সাথে”
মারিয়াম ম্লান হাসলো। ছেলের আকুতিতে তার চোখ টলমল করছে। এতোসময়ে শান্ত মস্তিষ্কের সুলতানার গাল ভিজে যাচ্ছে। চুমু খেলো পুত্রের কপালে। মৃদু স্বরে বললো,
“তোমার আম্মী যে সুলতানা নাসির। এই প্রাসাদ, এই এসফাইন নগরী যে তার। আমার প্রজারা মরছে। আমি, সুলতানার পালিয়ে যাওয়া শোভা পায় না”
নাসিরের মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো অব্যক্ত যন্ত্রণা। মারিয়াম পুত্রের যন্ত্রণা যেন ঠিক আঁচ করতে পারলেন। ছেলের হাত ধরে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও নাসির। আমি তোমার মা হতে পারলাম না। সারাজীবন কেবল সুলতানার দায়িত্বেই নিজেকে বেঁধে রাখলাম। তোমার শৈশবটাকেও যুবরাজের দায়িত্বে বেঁধে দিলাম। আমি চাইলেই হয়তো তোমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। আজও তোমাকে খোরতাইন সাম্রাজ্যের দায়িত্বে বেঁধে মুক্ত করছি। মনে রেখো, তোমাকে ফিরতে হবে। এই তখত তোমার নাসির। ওই মালিক শাহর বংশের শেষ রক্তকেও তোমাকে হত্যা করতে হবে। তাদের রক্তে স্নান করে তুমি এই তক্তে বসবে। মনে থাকবে তো? কথা দাও আমায়”
মারিয়াম আকুল স্বরে প্রতীজ্ঞা চাইলো। নাসির অপ্রতীভ স্বরে বললো,
“জ্বি আম্মী”
“এই তখত কেবল খোরতাইনের উত্তরাধিকারের। ততদিন তুমি মুক্ত নাসির। তুমি মুক্ত”
বলেই ধাক্কা দিলো নাসিরকে। নাসির টাল সামলাতে না পেরের সুরঙ্গের ভেতর পড়ে গেলো। সাথে সাথে খাসদাস সুরঙ্গের দরজা দিয়ে দিলো। মারিয়াম রুক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“সুরঙ্গের দরজা সিলগালা করে দাও। শত্রু যেন কিছুতেই এই সুরঙ্গের খোঁজ না পায়”
দাস সুলতানার কথা শুনতে তৎপর হলো। প্রাসাদের দ্বার শত্রু দখল করে দিয়েছে। তরবারির আঘাতে শির গড়িয়ে পড়ছে এসফাইনের মাটিতে। চিৎকার, হাহাকার, আর্তনাদে মুখর হলো এসফাইন। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সেই সাথে অস্ত হলো খোরতাইন সাম্রাজ্যের সূর্যটাও। বেগ আরসালান মোহাম্মদের বংশধর কি আদৌ জায়ান্দ নদীর পারে পৌছাতে পারলো? নাকি শত্রুর হাতে তাকেও প্রাণ দিতে হয়েছিলো কেউ জানে না! সেদিন সুলতান আরসালান মোহাম্মদের ছয় কন্যাসহ তিন সুলতানাকে পুড়িয়ে মারা হয়। এসফাইনের রাজপ্রাসাদে সবুজ পতাকা নামিয়ে উত্তোলন করা হয় কালো বাঘ খচিত পতাকা, যা প্রতীক মেহমুদ সাম্রাজ্যের।
!!২!!
নয় বছর পর,
মেহমুদ সাম্রাজ্যের রাজধানী তাবরেজ শহরে উৎসব আজ। মেহমুদ সাম্রাজ্যে কিছুদিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে সূবর্ণজয়ন্তীর উৎসব। মেহমুদ বংশের দ্বিতীয় সুলতান মালেক শাহ দীর্ঘ তেত্রিশ বছর যাবৎ সালতানাদ সামলাচ্ছে। উৎসবমুখর তাই তাবরেজ শহর। বাচ্চা-বুড়ো সকলের মধ্যে আনন্দ-উল্লাসের লহর বইছে। নগরীর প্রবেশদ্বারে ফুলেল বর্ষা হচ্ছে। সুলতানের শরীর ইদানিং খুব একটা ভালো নেই। তবুও উৎসবে কোনো কিছুর কমতি রাখা হয় নি। অন্যান্য রাজ্য থেকে রাজা-রাজদূত-ওয়াজিররা উপস্থিত হবে। বিভিন্ন শহর, রাজ্য থেকে সুলতানের উৎসবকে আরও মুখরিত করতে নানান সঙ্গীতজ্ঞ, গল্পকার, চিত্রশিল্পী, খাগির উপস্থিত হয়েছে। সুলতানকে খুশি করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
এই উৎসবের অবশ্য আরোও একটি কারণ রয়েছে। মালেক শাহ তার আগাম সুলতানকে নির্বাচন করবে। শেহজাদারা নগরীতে ফিরছে। দীর্ঘ তিন বছরের যুদ্ধের অবসান হয়েছে কিছুদিন পূর্বেই। চৌদ্দজন শেহজাদার মধ্যে জনপ্রিয় শেহজাদা উমার শাহ এর নগরী ফেরতে জনসাধারণ যেন নতুন এক আশার কিরণ দেখতে পাচ্ছে। শেহজাদাকে দেখার জন্য রাস্তায় নেমেছে লোকের ঢল। তারা তাদের শেহজাদার এক ঝলক দেখতে চায়। সুদর্শন পুরুষটির হাত ধরে যাত্রা হচ্ছে মেহমুদ সাম্রাজ্যের। তাদের বিশ্বাস, এই সুলতানের শাসনে তাদের জীর্ণ-জীবনে নতুন সূর্যের উদয় হবে, যার কিরণে থাকবে আনন্দ, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘোড়ার পদধ্বনিতে উত্তাল হলো নগরী। উমার শাহ এর সাথে সাত শেহজাদা প্রবেশ করলো। ফুলেল বর্ষায় তাদের স্বাগতম জানালো নগরীবাসি। উমার শাহ নগরীবাসির পানে চেয়ে হাত নাড়ালো। সুঠাম বলশালী সুপুরুষ উমার শাহ। টকটকে শুভ্র বর্ণ, শানিত মুখশ্রী অথচ নমনীয় হাসি, দীঘির মতো গভীর, কালো নয়নে যেন ঠিকরে উঠে মায়া। নগরবাসী তার বদন্যতায় পঞ্চমুখ। তারা নিশ্চিত আজ সুলতান তাদের প্রিয় শেহজাদাকেই যুবরাজ ঘোষণা করবেন। তবে সুলতানের প্রিয় মালেকা তাবিয়ার পুত্র আবু সাঈদ ও যুবরাজ হবার যুদ্ধে নিজের যোগ্যাতা প্রদর্শন করছে। দেওয়ান, উজির, পাশারা তার পক্ষে। মালেকা তাবিয়ার আধিপত্য অজানা নয় কারোর। শেষমেশ সুলতানের মর্জি-ই সব। তবে যেই সুলতান হোক না কেন একজনকে তারা মোটেই নিজের সুলতানরুপে চায় না, সে হল ক্রুর শেহজাদা ইরহান আলী শাহ।
—————
উৎসবমুখর প্রাসাদের সর্বদক্ষিণের মহলের বিশাল কামড়ায় তখন ঘাম চটচটে নগ্ন গায়ে একটা পাতলা সাদা থান জড়িয়ে আছে ইরহান আলী শাহ। পেটানো, সুঠাম কৃষ্ণ শরীরে সাদা থান বড্ড বেমানান। কিন্তু তার সাদা রঙ বড্ড বেশি পছন্দ। তার হাতে পিতলের গেলাস। গেলাসে প্রাচীন উপায়ে প্রস্তুতকৃত মদিরা। তার সারাসির ন্যায় আঁখি নির্বিকার। পালঙ্কতে নগ্ন নারী কাঁদছে, তার গায়ে একটা সুতোও নেই। তার শরীর থেকে চুয়ে চুয়ে পড়ছে রক্তকনা। তার চোখে মৃত্যুভয়। পাশে রক্তপিপাসু তলোয়ারটি পড়ে আছে। তার তীক্ষ্ণ স্বর কানে লাগছে ভীষণভাবে। স্বরে অদ্ভূত আহাজারি বাঁচার। কিন্তু ইরহান আলী শাহর কাছে এই কান্নার সুর আনন্দদায়ক। বিনোদনের আরেক নাম কান্নার সুর। তার খাস দাস এবং অনুসারী হুদ দাঁড়িয়ে আছে। সে কিঞ্চিত বিব্রত। বিব্রতবোধের কারণ নিজেও জানে না সে। এই প্রথম এমন দৃশ্য সে দেখছে না। এমন বিভৎস দৃশ্য আগেও দেখেছে। তবুও এমন বিভৎসতা তার অভ্যাস হয়ে পারে নি। ইতস্তত স্বরে শুধালো,
"প্রভু"
"কিছু বলতে চাও?"
"সুলতানা তাবিয়ার খাস সে! তার গায়েব হয়ে যাওয়া কি মেনে নিবেন সুলতানিম?"
"তাহলে একটা কাজ করো, ওর কা'টা মা'থা একটা অলংকৃত সোনার বাক্সে পুরে মালেকাকে পাঠিয়ে দাও। সাথে সতর্কবানী"
"প্রভু..."
“সতর্কবানীতে উল্লেখ করবে বিষের কৌটার কথা, যা আমি তার গোপন অঙ্গ থেকে পেয়েছি”
ইরহান আলী শাহর ঠোঁটে বিকৃত হাসি। পৈচাশিকতার অপর নাম ইরহান আলী শাহ। হুদকে স্তব্ধ দেখে হাসি বিস্তৃত হলো। মদিরা পেয়ালা হাত থেকে ফেলে তলোয়ার তুলে নিষ্ঠুরতার সাথে চালিয়ে দিলো। দিখন্ডিত হলো নারী। রক্তে ভেসে গেলো পালঙ্ক। চাঁদর রক্তে রঞ্জিত। ইরহান আলী শাহ শীতল স্বরে বললো,
"এখন মহলে খবর দেও। শেহজাদা ইরহান আলী শাহর চতুর্থ বেগম গুলনাহারকে ঘাতকরা মে'রে ফেলেছে। পতিভক্ত নারী স্বামীকে বাঁচাতে নিজেকে বলি দিয়েছে"
হুদ মাথা নত করে বলল,
“আমি এখনই খবর পৌছে দিচ্ছি”
—————
ইরহান আলী শাহর স্ত্রী গুলনাহারের মৃত্যুর সংবাদ রাজপ্রাসাদে ছড়িয়ে পড়লো। উৎসবের আনন্দে যেন কৃষ্ণ মেঘের ছায়া পড়লো। সুলতানের কাছে খবরটি পৌছাতেই তিনি জলদগম্ভীর স্বরে বললেন,
“ইরহান ঠিক আছে?”
“জি হুজুর”
গুলনাহারের কবর দেবার পর ইরহান আলী শাহ সুলতানের সাথে দেখা করতে তার নিজকক্ষে গেলো। সেখানে সুলতানা তাবিয়ার সাথে আবু সাঈদ, উমার আলী শাহ, শেহজাদী রুমেলিয়াও উপস্থিত ছিলো। সালাম দিয়ে বললো,
“সুলতানের জয় হোক, কেমন আছেন আব্বুজান?”
“ভালো, কিন্তু মনটা যে বেজায় খারাপ। আক্রমণ হলো কি করে?”
“বারান্দা থেকে প্রবেশ করেছিলো। গুলনাহার বুঝতে পারে নি, সে আমাকে বাঁচাতে সে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে”
“ঘাতক পালিয়ে গেছে?”
“জি, আব্বুজান। গুলনাহারের মৃত্যুতে আমি হতচকিয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে, যুদ্ধের পর প্রাসাদে ফিরে এমন কিছুর সম্মুখীন হব বুঝতে পারি নি”
এরমধ্যেই তাবিয়া প্রশ্ন করে উঠলো,
“কেউ দেখলো না?”
“আমি রক্ষীদের খবর দিতেই তারা পিছু নেয়। কিন্তু ঘাতকেরা পালিয়ে যায়”
সুলতান চিন্তিত মুখে বলে,
“আমার রাজ্যে এতো রক্ষীর মধ্যে কি করে?”
ইরহান স্মিত স্বরে বললো,
“আমার মনে হয় কোনো পরাজিত রাজ্যের চর ছিলো। মেহমুজ সাম্রাজ্যের সূবর্ণ জয়ন্তীকে মাটি করার উদ্দেশ্যেই এমন কিছু করা। আপনি চিন্তা করবেন না। উৎসবের কোনো কিছুতে কমতি থাকবে না”
তাবিয়া হিনহিনে স্বরে তখন বলে,
“আমার তো মনে হয় প্রাসাদেই ঘাতক ঘুরছে”
“আমারো সেটাই মনে হয় আম্মীজান। কেননা, উৎসবের পরে অনুসন্ধান চালানো হোক”
এর মধ্যেই উমার আলী শাহ গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমার মতে যা হবে তা উৎসবের পরই হওয়া ভালো। ততদিন গুলনাহারের মৃত্যুর সংবাদটা গোপন থাকুক। একে একে চারটি স্ত্রী গত হয়েছে ইরহানের। বিষয়টা জানাজানি হলে কুৎসা রটবে। উৎসবে মিত্র রাজ্যের মানুষেরা আসছে। আমার মনে হয় বিষয়টা গোপনীয়ই থাকুক”
সুলতান সম্মতি প্রদান করলেন। ফলে গুলনাহারের মৃত্যুর সংবাদ প্রাসাদ থেকে বের হলো না। তাবিয়া অবশ্য এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে চাইলো। তখন ইরহান বিদ্রুপ টেনে বললো,
“আমি বুঝতে পারছি আম্মী, গুলনাহারকে আপনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পালিত মেয়ে বলে কথা। কিন্তু ভাগ্যের খন্ডন যে আমাদের হাতে নেই”
তাবিয়ার মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। সে সতর্কবানীটা আজ সকালেই পেয়েছে। গুলনাহারকে কে মেরেছে সেটা তার জানতে বাকি নেই।
!!৩!!
তাবরেজ নগরীতে উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন রাজ্য, অঞ্চল থেকে উপস্থিত হয়েছে বনিকেরা। উৎসবে তারাও নিজেদের ট্যাক ভরতে চায়। নগরীর প্রবেশদ্বারে তাই কড়া প্রহরী। ইরহান আলী শাহর উপর ঘাতকের আক্রমণে নিরাপত্তা আরোও কঠোর করা হয়েছে। বনিক এবং নগরবাসীর সকলকেই ভালো করে পরীক্ষানিরিক্ষা করা হচ্ছে। সেই পরীক্ষায় নগর প্রহরী ভিনদেশী এক বনিককে আটকে দিলো। তার সাথে বিশাল একটি বাক্স। কাঠের বাক্স। প্রহরী কড়া স্বরে শুধালো,
“এই বাক্সে কি?”
বনিক স্বর নরম করে বললো,
“হুজুর এতে সুলতানের জন্য বিশেষ উপহার”
“খুল, খুলে দেখাও”
“সুলতানের উপহার আপনাকে কি করে দেখাই”
“খুলবে নাকি চাবুকের ঘায়ে তোমার পিঠের ছাল তুলবো?”
বনিক বিপাকে পড়লো। ঠিক তখনই বাক্সের ভেতর থেকে একটি মিষ্টি স্বর বললো,
“আমাকে দেখার অধিকার শুধু আমার মালিকের আছে। আর আমার মালিক সুলতান”
·
·
·
চলবে.........................................................................