তিয়াশের হাস্যরসাত্মক কণ্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই রায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকাল। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাবধানে জ্বলজ্বল করতে থাকা আঁখি দ্বয় স্বাভাবিক হয়ে এলো। সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিলো। দরজার দিকে এগিয়ে গেল ছেলেটা। চারপাশের ঘূর্ণায়মান দৃষ্টি স্থির হলো তিয়াশের মুখমণ্ডলে। চোখজোড়া বুজে বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে নিলো। যেটাতে তাজা র ক্তে র ভ্যাবসা গন্ধ ব্যতীত কিছুই পৌঁছাল না শরীরের ভেতরে। অথচ এটাতেই একবুক শান্তি পেল রায়ান। মস্তিষ্ক এখন শান্ত। অধরের এক কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল,
"আমি আমার ব্যাক্তিগত জিনিস নিয়ে সিরিয়াস স্যার। সেখানে কারোর হস্তক্ষেপ আমার পছন্দ নয়। জানোয়ারগুলোকে প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছি। আগামীকাল টিভির নিউজ চ্যানেলগুলোর হেডলাইন কেবল ওদের ঘিরেই হবে। যেমন ধরুন পশুর মতো খুবলে খেয়েছে কেউ ওদের দেহগুলো। হাহ্!"
তিয়াশ হেসে রায়ানের কাঁধ চাপড়াল। দু'জন কোনো কথা ছাড়াই সামনে হাঁটা ধরল। সেভাবেই বলল তিয়াশ, "ভালোবাসার বিপরীতে ফিরতি ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য সবার হয় না ছেলে। সময় থাকতে নিজের মনের কথা ব্যক্ত কোরো। জীবন সবাইকে সব সুযোগ দেয় না।"
কথাটাতে অদ্ভুত এক সুর ছিল। না চাইতেও রায়ানের পা দুটো থেমে গেল। পাশ ফিরে চাইল ও। অন্যমনস্ক এক তিয়াশকে আবিষ্কার করল। মনটা ভীষণ ভার হলো। সবটা যেহেতু নখদর্পণে সেখানে মানুষটার মনের অবস্থাটাও ঠিক উপলব্ধি করতে পারল রায়ান। ম্লান কণ্ঠে আশ্বাস দিলো,
"স্যার কষ্ট পাবেন না। রিদাহ ম্যাম আপনাকে ঠিক বুঝবে। একদিন আপনার ভালোবাসা গ্রহণ করবে।"
"মানুষ থাকতে মূল্য দেয় না রায়ান। আর আমি বরাবরই অবহেলিত এক জীব। যে থাকা না থাকাতে কারোর কিছু যায় আসে না।"
"এই কথা আর কখনো ভুলেও বলবেন না স্যার। রৌহিশ স্যার জানলে জানে মেরে দিবে আপনাকে। স্যারের মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আপনি আছেন।"
গাছ গাছালির ফাঁক ফোকড় দিয়ে দৃশ্যমান দূরাকাশের নক্ষত্রের মেলায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই শব্দ করে হেসে ফেলল তিয়াশ। চোখদুটো চিক চিক করে উঠল। কাঁদতে চাইছে কি ছেলেটা? শান্ত, নিষ্প্রাণ স্বরে ছোট্ট করে বলল,
"ওর মায়া কাটিয়েই আমি ইহজগৎ ছেড়ে যেতে পারছি না। নাহলে আমার মুক্তি অনেক আগেই হয়ে যেত।"
রায়ানের বুকব্যথা অনুভব হলো। বুকের বা-পাশটাই হাত রাখল। ইস! ভালোবাসা শব্দটা যতটা প্রশান্তিদায়ক ঠিক ততটাই যাতনাময়। কাউকে আমৃত্যু সুখের স্বাদ দেয় তো কাউকে আমৃত্যু জীবন্ত লা শ বানিয়ে দেয়। জবাব দিলো,
"ম্যাম তো একপাক্ষিক ভালোবাসার কষ্ট খুব করে বোঝে স্যার তাহলে সেই একই কষ্ট আপনাকে কেন দিচ্ছে?"
"সেটার উত্তর তোমার ম্যাম ভালো দিতে পারবে। আমি জানলে তো এতদিনে তার মনে একাংশে নিজের জন্য ছোট্ট করে একটুখানি জায়গা করে নিতে পারতাম।"
এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রায়ানের আর কিছুই বলার থাকে না। কিই বা বলবে? জীবনে প্রথম বারের মতো একটা চমকপ্রদ কাজ করে বসল রায়ান। নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরল তিয়াশকে। কেবল নীরবে নিভৃতে ভরসার কাঁধ হলো স্যারের। এই পর্যায়ে উচ্চ শব্দে হেসে উঠল তিয়াশ। মন থেকে মরে যাওয়া মানুষগুলো নাকি একটু বেশিই হাসে। এমনকি তারা অপরকে হাসায় বেশি। বিনোদন দিতে পারদর্শী হয় তারা। তিয়াশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। রায়ানের পিঠে হাত রেখে বোঝাল ও ঠিক আছে। নিজেকে সামলানোর মতো ক্ষমতা ওর আছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? জীবনের কোনো এক পর্যায়ে, কারো না কারো কাছে আমরা ঠিক অসহায় হয়ে থাকি। এই অসহায়ত্ব অপ্রকাশিত কিন্তু জলধির ন্যায় গভীর। যা বুকে কাঁটার মতো বিঁধে সবসময়। মৃত্যু ব্যতীত মুক্তি মেলে না। সবাইকে ভালো রাখলেও দিনশেষে নিজেদের আর ভালো থাকাটা হয় না। আহ্ জীবন! ছোট্ট এক জীবনে কত ছলাকলা।
—————
রজনীর শেষ প্রহর। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ তুলে জানিয়ে চলেছে এখন রাত দুইটা বাজে। অ্যালার্মের শব্দে ঘুমন্ত তন্ময়ীর কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হলো। চোখ মুখ কুঁচকে আসলো। তবুও তন্দ্রা চ্যুত হলো না। আরও কয়েকবার অ্যালার্ম বাজতেই একপ্রকার তিতিবিরক্ত হয়ে উঠে বসল মেয়েটা। কপালে হাত রেখে কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল। ঘুম পুরো হয়নি। অকস্মাৎ একটা শেয়ালের কান জ্বালা করা হুক্কা হুয়া ডাকে মস্তিষ্ক সচল হলো ওর। তৎক্ষণাৎ বন্ধ চোখদুটো খুলে তাকাল। ডাকটা এতটাই বিকট যেন মনে হচ্ছে বাড়িটার মধ্যে থেকে ভেসে আসছে। ও একটু মনোযোগী হতেই শেয়ালের ডাক থেমে গেল। আবারও সব আগের মতোই নিস্তব্ধ। তন্ময়ীর একটু খটকা লাগল। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। যেদিক থেকে ডাকটা স্পষ্টভাবে আসছিল সেইদিকের জানালার দিকে এগিয়ে গেল। আলগোছে জানালার পর্দা সরাল। কিছুক্ষণ শাণিত দৃষ্টিতে আশেপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করল। কিন্তু ঝোপঝাড়, জঙ্গল, গাছপালা ব্যতীত কিছুই নজরে এলো না। মস্তিষ্কে এটা নিয়ে প্রশ্ন জাগলেও ও দমিয়ে রাখল। যেই কারণে এখন অ্যালার্ম দেওয়া সেটাই করতে উদ্যত হলো। জানালার পর্দাটা ঠিকঠাকভাবে রেখে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে নিলেই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় নিচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত হাতে পর্দা সরাতেই চোখজোড়া কপালে উঠে গেল। নিচে একটা গাছের আড়ালে সাদা কাপড় পরিহিত একজন দাঁড়িয়ে আছে। একটা মানবশরীর দৃশ্যমান কিন্তু সবটা ঝাঁপসা অস্পষ্ট। সে যেন কিছু বলতে চায় ওকে। ছেলে নাকি মেয়ে ও ঠিক বুঝতে পারল না। তন্ময়ীর প্রতিটা শিরা উপশিরা হিম হয়ে আসলো। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল সেথায়। পরক্ষণেই বাবার নামটা স্মরণ করতেই অদ্ভুতভাবে সব ভয় যেন এক চুটকিতে হাওয়া হয়ে গেল। ও সেই মানবছায়ার উদ্দেশ্যে চিল্লাল,
"কে আপনি? আপনি যাবেন না ওখান থেকে। আমি আসছি নিচে। কথা বলুন আমার সাথে।"
মুখের কথা শেষ করেই দৌড়ে নিচে গেল তন্ময়ী। অদৃশ্য এক টানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাড়ির পিছন সাইডের পরিত্যক্ত জায়গাটাতে উপস্থিত হলো। যেখানে শত বছরেও কারোর পদধুলো পড়েনি। এটা ওর নিকট অজানা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ওখানে কেউ ছিল না। তন্ময়ী যেন এক মুহূর্তের জন্য কথা বলতেও ভুলে গেল। হচ্ছে টা কী ওর সাথে? সবকিছু যেন মাথার একহাত উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভাবনার মাঝেই হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে অনেকগুলো মানুষের আর্তনাদ ভেসে এলো। যেন শতশত মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করছে। কী করুণ ভয়ানক সেই আর্তনাদ! রুহ অবধি কাপিয়ে তোলার ক্ষমতা আছে সেই হাহাকারের। এবার সত্যিই ও ভয় পেল। হুশে ফিরল যেন। ও কখন, কীভাবে এখানে এলো? আর দাঁড়ানোর সাহস পেলো না। যেইভাবে এসেছিল সেভাবেই এক দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। ও যেতেই হাওয়ায় ভেসে অনেকগুলো মানব ছায়া স্পষ্ট হলো জায়গাটাতে। তন্ময়ীর অজান্তেই কেটে যাওয়া পায়ের একাংশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের দাগ স্পষ্ট মাটিতে। একজন এগিয়ে এসে প্রাণভরে শ্বাস নিলো। গ্রহণ করল র ক্তে র উদ্ভট গন্ধ। পরক্ষণেই বৃহৎ জিহ্বা দ্বারা লেহন করল সেই র ক্ত। বিড়বিড় করে আওড়াল,
"ভেরি সুইট জাস্ট লাইক হার।"
উপস্থিত সকলের মুখে হিং স্র তা, প্রতিশোধের রেশ ছড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই হিংস্র হাসির শব্দে কম্পিত হলো আশপাশের সবকিছু। বিটপীর উঁচু শাখায় বসবাসরত বিহঙ্গ গুলো প্রাণ বাঁচাতে ছুটে চলল দিক বেদিক ভুলে। তবে ভবিতব্য কী? কী হতে চলেছে সামনে?
—————
তন্ময়ীর পা'টা বেশখানি কেটেছে। পায়ের তালুর মাংশ চিরে গেছে। সাথে সবসময়'ই ফার্স্ট এইড বক্স রাখে ও। এটা ওর পুরোনো অভ্যাস। যার দরুন খুব একটা ঝামেলায় ফাঁসতে হয়নি। একা একাই ব্যান্ডেজ করে একটা পেইন কিলার খেয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়েছে। মেয়েটা প্রায় এক ঘণ্টা মতো একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ভয়, অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছিল মস্তিষ্ক জুড়ে। শীর্ণ কায়া অসাড় হয়ে আসছিল বারবার। একটুও শক্তি পাচ্ছিল না। সবটা যখন স্বাভাবিক হলো তখন রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে।
সময় এখন ভোর চারটা বিশ। সেই অর্ধ পরিচিত জঙ্গলে এসেছে তন্ময়ী। আজ আর বাইক নিয়ে আসেনি। ওই যন্ত্রণায় পিষ্ট পা নিয়েই হেঁটে এসেছে। মনের যন্ত্রণা, মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে দাপিয়ে বেড়ানো মানসিক অশান্তি, অস্থিরতার কাছে এইসব বড়োই তুচ্ছ। বাড়িটার থেকে দশ মিনিটের রাস্তা হাঁটলেই সেই ঘন অরণ্যের দেখা মিলে। হাতে ছোট্ট একটা লাইট। জঙ্গলের ভেতরের একটা রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে। চারপাশের সবটা সর্বশান্ত। একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে আসতেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকটাও হারিয়ে গেছে। কেমন থমথমে পরিবেশ। ওর হাঁটার খসখসে শব্দ ব্যতীত আর কোনো শব্দের আনাগোনা নেই। একটু গা ছমছম করছে তন্ময়ীর এই যা। কিন্তু ওর মনে ভয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। ভয় শব্দটা আজকাল সেভাবে ওকে কাবু করতে পারে না। তন্ময়ী এতদিনে এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ওর সামনে বড়ো কোনো সত্য আসতে চলেছে। যেটা ওর সম্পূর্ণ অজানা। হতে পারে সেই বিষয়ে ও পুরোপুরি অজ্ঞাত। আচ্ছা সেই সত্য কী খুব কঠিন? মেনে নিতে পারবে তো ও? ইস! সেই রাতে যদি বাইরে খাবার কিনতে না আসত, ওই জানোয়ার গুলো তাড়া না করত। তাহলে এতো কিছু হতো না। ও সুন্দর একটা জীবন লিড করতে পারত। সুন্দর জীবনটা হঠাৎ করেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল! বুকচিরে ক্লান্ত এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মেয়েটার।
তন্ময়ী আজ দক্ষিণ দিকে হাঁটছে। ও এই অরণ্য নিয়ে পুরো দু'টো দিন গুগল ঘেটেছে। অতঃপর কিছু তথ্য নিজের ঝুলিতে জমা রাখতে পেরেছে। আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটা শেষে কয়েক কদম সামনে এগোতেই বয়ে চলা পানির কলকল ধ্বনি কর্ণগোচর হলো ওর। নিবিড়, নিস্তব্ধ রাতের পরিবেশে শব্দটা ভীষণ মোহনীয় শোনাচ্ছে।কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকল। নেত্র বুজে সেই শব্দ অনুভব করল। মস্তিষ্ক ঈষৎ হালকা হলো বোধহয়। আরও ত্রিশ মিনিট হেঁটে সামনে অগ্রসর হলে চোখের পর্দায় ভাসমান হয় ছোট্ট এক লেক যার উপর দিয়ে গড়ে তোলা কাঠের একটা সেতু। লেকের পানি গুলো একটু অন্যরকম। লালচে ধরণের। সচরাচর এমন পানি দেখা যায় না।তন্ময়ীর ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। এখন কী করবে? ওপারে যাওয়া কি উচিত হবে? একটা অদ্ভুত দোটানায় পড়ে গেল মেয়েটা। কিছুক্ষণ পেরোল। অতঃপর ওপারে যাওয়ার জন্য মনস্থির করল। যেই ভাবা সেই কাজ। আল্লাহর নাম নিয়ে সেতুর উপর পা দিলো। অমনিই অদৃশ্য কোনো এক শক্তির ঝাঁকুনি খেলে গেল শরীর জুড়ে। নিজেকে সামলাতে সেতুর একপাশের বাঁধাই করা কাঠ আঁকড়ে ধরল। কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে সামলিয়ে পুনরায় সামনে অগ্রসর হলো। তন্ময়ী বুঝতে পারছে ও অনেকটা দূরে চলে এসেছে। হয়তো রহস্যের খুব কাছাকাছি। যত সামনে এগোচ্ছে ততোই সেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো অদৃশ্য শক্তির ঝাঁকুনি বাড়ছে। কোনোভাবে কি কোনো অশরীরীর কাজ এটা? ও কোনোরকমে কষ্টের সাথে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেতুটা পার হলো। এখনো শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু তন্ময়ী থেমে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। এতদূর যখন এসেছে তখন সবটা জেনেই ফিরবে। মৃত্যু আসলে সাদরে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তবুও রহস্য উদঘাটনের পথে অবিচল রইবে।
এক পর্যায়ে হাঁটার মাঝেই ও অনুভব করল সামনে যত এগোচ্ছে পায়ের নিচে বড়ো বড়ো ঘাসপাতা সরে যেয়ে সুন্দর পরিচর্যা করা ঘাস পায়ে বাঁধছে। যেখানে ঘাসগুলো সুন্দর একটা মাপে কেটে রাখা। লাইট টা নিচের দিকে তাক করে ধরল। ঘাসগুলো দেখেই মনে হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে এগুলো কেটে একটা সুন্দর আকৃতিতে রাখা হয়। কিন্তু গহীন জঙ্গলের মাঝে এটা কীভাবে সম্ভব? কে করে এইসব? তাহলে ঘটনা কি অন্যকিছু? নাকি ওর ভাবনায় সঠিক? অকস্মাৎ হাতে জ্বলতে থাকা লাইট টা নিভে গেল। আকাশ ফুঁড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। বইতে শুরু করল ঝড়ো হাওয়া। কালো একটা ছায়া চাপ ধরাল প্রকৃতিতে। কেমন যেন এক নিমেষে সবটা ঘটে গেল। হঠাৎ নিজ হস্তে একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করল তন্ময়ী। পরপরই একটা ছাতার আবিষ্কার করল ডান হাতে। তন্ময়ী ঈষৎ ভড়কাল, থমকাল, চমকাল। পরক্ষণেই রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাতের ছাতাটা ছুঁড়ে মারল মাটিতে। সেকেণ্ডের ব্যাবধানে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা সিক্ত করে দিলো অন্ধকারের বুকে জ্বলতে থাকা সুশ্রী আনন সহ সম্পূর্ণ নারীদেহ। তন্ময়ী সেভাবেই উঁচু কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকল,
"কে এখানে? সামনে আসুন। কথা বলুন।"
"ওয়েলকাম টু মাই ডার্ক ওয়ার্ল্ড মিস ইসমাত মাহমুদা তন্ময়ী।"
সেই হাড়হিম করা অতি পরিচিত পুরুষালী কণ্ঠস্বর। তন্ময়ীর প্রতিটা শিরা উপশিরায় কাঁপ ধরাল। ওর কাছে সম্বোধনটা কেমন যেন পূর্ব পরিচিত মনে হলো। তবে মনে করতে পারল না। নাকি মস্তিষ্কের দখলদারিত্ব খোয়াল মেয়েটা? কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে পুনরায় বলল,
"এমনটা কেন করছেন আমার সাথে? কী চান আপনি?"
"তোমাকে।"
"মশকরা করছেন? আমাকে আপনার খেলনার পুতুল মনে হয়? শুনুন আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমি নই।" তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মেয়েটা। আঁখি জোড়া সাক্ষাৎ এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।
"ইয়েস, বেইবি ইউ আর দ্য মোস্ট বিউটিফুল উইমেন আই হ্যাভ ইভার সিন। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা তোমার সৌন্দর্য সহস্র গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ফেসেছি, নিজেকে হারিয়েছি তোমার মাঝে। ইউ আর হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট ডার্লিং। রিয়েলি তুমি অন্যদের থেকে আলাদা।"
এই পর্যায়ে তন্ময়ীর পুরো শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠল। এমন ফালতু, স্বস্তা প্রশংসাতে মন মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো। ইমপ্রেস হওয়া তো দূরের কথা। দ্বিগুণ শব্দে চিল্লাল,
"শয়টান আমার সামনে আই তুই।...." ওকে মুখের কথা শেষ করতে না দিয়ে হাওয়ায় ভেসে এলো আরও একটা বজ্রনিরেট শান্ত তীক্ষ্ম বাক্য,
"ইভিল হ্যাজ আ নিউ নেইম অ্যাণ্ড ইটস মাইন। আ'ম বর্ন টু বি ব্যাড।"
"আই'ল কিল ইউ বাস্টার্ড।"
"উঁহু, নো, স্ল্যাং বেইবি। তোমার হাতে মৃত্যু কবুল জান।"
এবার কণ্ঠস্বরটা কিঞ্চিত কৌতুক মিশ্রিত শোনাল। সাথে কী সব আজেবাজে সম্বোধন। এতেই যেন তন্ময়ীর রাগের পারদ ক্রমশ বাড়ল, "আমি আপনাকে ঘৃণা করি।"
"নিজ চোখে না দেখেই এত ঘৃণা?"
"আপনি নিকৃষ্ট একজন মানুষ। আপনাকে কখনো দেখতে চাই না আমি।"
"আর যদি মানুষ না হই?"
তন্ময়ী কিছু সময়ের জন্য চুপ হয়ে গেল। কথাটা বোঝার চেষ্টা করল। কী বুঝল কে জানে?
"আপনি মানুষের কাতারেও পড়েন না। শুনছেন আপনি? আমি আপনাকে ভয় পাই না।"
"মাই ব্ল্যাক টিউলিপ, বি অ্যাফ্রেইড অব দ্য ডার্কনেস উইদিন মি।"
'ব্ল্যাক টিউলিপ' সম্বোধনে আটকাল তন্ময়ী। অদ্ভুত এক অনুভূতি রক্তের ন্যায় শরীরের সর্বখানে প্রবাহিত হলো। রাগ বাড়ার কথা ছিল কিন্তু এমনটা হলো না। উল্টো কেমন যেন দমল মেয়েটা। বুকের ভেতরে নতুন এক অনুভূতি উঁকি দিলো। একটু অন্যরকম মনে হলো চারপাশের পরিবেশ। সেই কালো ছায়াটা সরে যেয়ে যেন মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ ছড়াল সবটা জুড়ে। এমনটা মনে হওয়ার কারণ ঠিক বুঝল না। আর কিছু ভাবতে পারল না তন্ময়ী। ধরিত্রী অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই কারোর প্রশস্ত বুকে ঠাঁই মিলল। আবারও নিজের গন্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসেও পৌঁছাতে পারল না। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সবটা একটুর জন্য অজানাই রয়ে গেল। আকাশসম অশান্তি থেকে মুক্তি মিলল না মেয়েটার। কপালে শীতল একজোড়া ওষ্ঠ আধিপত্য বিস্তার করল। শোনা গেল একটা পুরুষালী বজ্রগম্ভীর আওয়াজ,
"মাই লাভ, মাই ব্ল্যাক টিউলিপ ইউ আর অনলি মাইন।"
·
·
·
চলবে..........................................................................