পৃথিবীতে হাজারো মুখের ভিড়ে এমন মিল কী করে সম্ভব? অনন্যার প্রশ্ন থামে না। কেনো ঠিক কৌশিক স্যারের মতো দেখতে আরেকজন থাকবে? শুধু যে মিল চেহারায় এমন ও নয়, মিল রয়েছে কণ্ঠে, মিল রয়েছে নামে। মেনে নিতে পারছে না অনন্যা কিছুই। তার মনে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে। যদি সত্যিই উনি কৌশিক স্যার হতেন তাহলে কী এমনভাবে আচরণ করতেন? কী করে পারেন তিনি চেনা চোখগুলো উপেক্ষা করতে? কী করে পারেন নির্লিপ্ত থাকতে যাকে একদিন অপার স্নেহে দেখতেন? এতো এতো ভালোবাসা দিয়ে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন অনন্যাকে আজ সব ভুলে গেলেন কি করে!
এই কৌশিক স্যারের চোখে কোনো অনুভব নেই। তার কথায় নেই সেই চেনা উষ্ণতা। মনে হয় যে তিনি অন্য কেউ। শুধু মুখটা এক কিন্তু মনটা নয়। অনন্যার বুক চেপে আসে। চোখের অশ্রু বাধা মানে না। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে সে বসে আছে কমন রুমের কোণে। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে সে। হঠাৎ ফোনের আলো জ্বলে উঠলো। নোহারার নাম ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। অনন্যা এক চিলতে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সেই ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর ফোনটা সুইচড অফ করে রাখলো। এখন সে একা থাকতে চায়। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করছে।
কমন রুমের মধ্যে বড় একটি জানালা রয়েছে। জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত সড়ক, মানুষের হাঁটাহাঁটি আর রাস্তার জ্যাম। অনন্যা নিঃশব্দে সেখানেই তাকিয়ে আছে। আর চোখ থেকে পানি পড়ে যাচ্ছে অনবরত। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শোনা গেলো। অনন্যা মাথা ঘোরালো না। দ্রুত চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ একজন ধীরে ধীরে পা ফেলে ভেতরের দিকে আসছে। অনন্যা ঢোক গিললো। পেছনে তাকানোর আগেই কেউ ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো। অনন্যা আড়চোখে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু পেছনে থাকায় লোকটিকে চোখে পড়লো না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি টিস্যু সহ হাত নাড়ালো। অনন্যা দ্রুত টিস্যু নিয়ে চোখ মুছতে লাগলো।
অতঃপর শোনা গেলো চেনা কণ্ঠস্বর,
"ক্লাস না করে এখানে কান্নাকাটি করার অর্থ কী?"
অনন্যা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। কৌশিক স্যার দাঁড়িয়ে ছিল চোখের সামনে। কৌশিক ও ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
"আরে আপনি তো সেই একটু আগের মেয়েটাই?"
অনন্যা মাথা নাড়ালো। কৌশিক কিছুটা নিচুতে ঝুঁকে বললো,
"তো কান্না করছেন কি জন্য? এভাবে কান্না করলে বন্যা হয়ে যাবে শহরে!"
অনন্যা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। এই একি কথা কৌশিক ও একবার বলেছিলো তাকে। কতটা আগলে রাখতো লোকটা। অনন্যা কান্না করলে প্রথম খারাপ লাগা তারই হতো! বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতো অনন্যাকে। অথচ আবার একি কথা এই লোকটার মুখে শোনা গেলো যে কিনা সেই পুরোনো কৌশিক স্যার নয়। শুধু স্যারের মতো দেখতে একি চেহারার পুরুষ।
অনন্যা সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কৌশিক ও চমকে উঠলো। অনন্যার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিন্তিত হয়ে ভাবলো,
"কি সমস্যা এই মেয়ের? যখন তখন হুট করে এসে পড়ে আবার হুট করে পালিয়ে যায়।"
কৌশিক মেয়েটার চিন্তা বাদ দিয়ে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো। সে যদিও ফিজিক্স সম্পর্কিত ক্লাস নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সাথে কিছু এক্সট্রা সাবজেক্টের ক্লাসও তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে তার মনে কোনো দ্বিধা নেই সময় দিলে, মনোযোগ দিলে, হয়ে যাবে সবকিছুই। আজ অবশ্য পড়ানোর চাপ নেই। কেবল পরিচিতি, একেকটা মুখের মাঝে নতুন সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ দেখবে সে। দুপুরের দিকে নবীন বরণের অনুষ্ঠান। গানের সুরে, হাততালিতে, অচেনা মুখের হাসিতে ভরে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। এরপর খাবারের প্যাকেট বিলিয়ে দেওয়া। আনুষ্ঠানিকতায় মিশে থাকা একটু আন্তরিকতা আর একটু শ্রদ্ধা গ্রহণ করার গল্প।
কৌশিক নিজের ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ক্লাসরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই এক ভরপুর উষ্ণতা তাকে ঘিরে ধরলো। শোনা গেলো শিক্ষার্থীদের খুশীতে করা হৈচৈ। একেক জন একেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল কৌশিককে। কয়েক জন জিজ্ঞেস করলো,
"আপনি এতো দিন কোথায় ছিলেন, স্যার? আপনাকে খুব মিস করছিলাম।"
কৌশিক অসুস্থতার কথা বলে কাটিয়ে দিলো। কারণ সে তো নিজেই জানে না সে এতো দিন কোথায় ছিল । কিছু কিছু নতুন স্টুডেন্টদের কারণে কৌশিককে আবারো নিজের পুরোনো বায়োডাটা পরিচিতি আকারে বলতে হলো। কৌশিক এখানে আসার আগে পুরোনো বায়োডাটা বারবার পড়ে এসেছিল। পড়ার সময় ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল তার। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেওয়া তার সিভি একদম তার ইচ্ছের সাথে মিলে গিয়েছিল। সিভিতেও লেখা ছিল সে পুরোনো জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালোবাসে। ফিজিক্স তার প্রিয় সাবজেক্ট। এছাড়া আরো আরো তথ্য যা মিলে যাচ্ছিলো। কিন্তু কৌশিককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল একটা ব্যাপার! কে এই লোক যে তার নাম ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছিলো? এই বিষয়টাই কৌশিকের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর একটি ভয় যদি এই লোকটা ফিরে আসে তবে? মাঝে মাঝে কৌশিকের মনে হয় এই লোকটা সে নিজেই। কিন্তু যখন নিজের বাড়ির লোকের কথা শোনে, যখন সে জানতে পারে এক বছর ধরে সে হসপিটালে ভর্তি ছিল আর তখন এক বছর ধরে তার কোনো জ্ঞান ছিল না। মৃত প্রায় অবস্থায় সে হসপিটালে দিনের পর দিন কাটিয়ে ছিল তখন ই কৌশিকের কাছে সবকিছু মূহুর্তের মধ্যেই গুলিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না কোনটা সত্যি আর কোনটা ভুল।
ক্লাসরুমে কৌশিকও একে একে সবার নাম জিজ্ঞেস করলো। জিজ্ঞেস করলো কোথা থেকে তারা পড়াশোনা করে এসেছে। কলেজের নাম বলার মাধ্যমে আর গল্প করার মাধ্যমেই আজকের ক্লাসের সমাপ্তি ঘটলো। কৌশিকের বেশ ভালোই লাগলো শিক্ষার্থীদের সাথে।
কৌশিক শিডিউল দেখলো। পরের কোর্সের নাম ইন্টারনেট কমিনিকেশন সিস্টেম। বোঝা গেলো কম্পিউটার সায়েন্স স্টুডেন্টদের কোর্স। আপাতত ক্লাস শুরু হতে আরো বিশ মিনিট বাকি। তাই সে এই কোর্সের বিষয়বস্তু বুঝতে টিচার্স রুমের দিকে রওনা দিল।
অনন্যা প্রথম ক্লাসটা মিস দিয়েছে। যতক্ষণে সে ক্লাসে পৌঁছাতো ক্লাসের টাইম অর্ধেক শেষ। তাই দ্বিতীয় ক্লাসের জন্য লাইব্রেরীতে বসে ছিল। ফোন খুলে নোহারাকে টেক্সট ও করে দিলো পরের ক্লাসে আসবে সে। লাইব্রেরীতে এসেও পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। বিয়ের আগে প্রথমবারের মতো লোকটার সাথে কথাবার্তা, চোখে চোখ মিলিত হওয়া, অজান্তেই দুজনে এই লাইব্রেরীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া সবকিছুই কত কাকতালীয় আর সুন্দর ছিল তাই না? সময় পেলে অনন্যা কৌশিকের হেঁটে যাওয়া সকল রাস্তায় বারংবার হেঁটে যেতে চায়। পুরোনো স্মৃতিতে বারবার ডুব দিতে চায় সে। কিন্তু তাও মিথ্যে একজন মানুষের ভালোবাসা চায় না।
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলো ক্লাসের দিকে। আকাশে আজ ধূসর মেঘ জমা হয়েছে। বৃষ্টি পড়ে কিনা কে জানে। বৃষ্টি পড়লে কি অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে যাবে? এমনিতেও অনন্যার থাকার ইচ্ছে নেই। বাসায় গিয়ে শান্তিতে একটু শুয়ে থাকতে চায়। রান্নাবান্নার ঝামেলাও আছে। মা ও তো নেই যে রান্না করে রাখবে আগে থেকেই।
ক্লাসের দিকে যেতে যেতে দেখা হয়ে গেল আরণ্যকের সাথে। আরণ্যক এগিয়ে এসে প্রথমেই অনন্যাকে ডাক দিলো। অনন্যা ঘাড় ঘুরিয়ে আরণ্যককে দেখতে পেলো। অতঃপর আবারো সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। আরণ্যক হালকা গলায় বললো,
"আজ এতো মনমরা কেনো? তোর প্রিয় স্যার থুক্কু জামাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। খুশি না তুই?"
অনন্যার পা দুটো আটকে গেলো। সে আরণ্যকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"তুমি ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছো?"
আরণ্যক উপর নিচ মাথা নাড়লো। অনন্যা মুখ ফুলিয়ে ফেললো,
"কেনো আনতে গেলে? উনি সেই আগের মানুষটা নন। আমি এই সত্য নিয়ে কীভাবে থাকবো? প্রতিদিন উনাকে দেখে যেতে হবে আর কষ্ট পেতে হবে!"
আরণ্যক চিন্তিত হয়ে বললো,
"কৌশিক স্যার আগের মতো নয়? হ্যাঁ আমার ও মনে হচ্ছিল এরকমটা। মানে ওনাকে বেশ অন্যরকম লাগছিল। কিন্তু তাও আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো উনাকে দেখে খুশি হবি কিন্তু তুই ও দেখছি...!"
অনন্যা মাথা নিচু করে ফেললো। শ্যামল নাক দুটো লাল হয়ে গেছে ওর। নাক টেনে অনন্যা বলে উঠলো,
"আমি আসছি।"
অনন্যা ওয়াশ রুম থেকে এসে ক্লাসে ঢুকলো। নোহারার পাশের সিট গ্রহণ করে ব্যাগ রাখলো টেবিলে। নোহারা অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"দোস্ত!"
"হুম!"
অনন্যা ফোন বের করে সেখানে মনোযোগ দিলো। নোহারা উত্তরে বললো,
"আসতেছে।"
"কে?"
",তোর জামাইয়ের ক্লাস তো সেই হিসেবে তোর জামাই আসতেছে!"
অনন্যা থেমে গেলো। ফোন থেকে চোখ সরালো না সে।নোহারা অনন্যার বাহু ধরে বললো,
"স্যরি! আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম।"
অনন্যা মুখ তুলে হাসার চেষ্টা করে বললো,
"তুই ভুল বুঝিসনি। আমিই ওনাকে আমার হাসবেন্ড ভেবে ভুল করেছিলাম। কিন্তু উনি সে না।"
নোহারা চমকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইল। তখনই কৌশিক স্যার রুমে প্রবেশ করলো। সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালো। এই ক্লাসেও কোর্সের ইন্ট্রোডাকশন হলো। যদিও সবাই ই তাকে চেনে। তাই স্যার নিজের পরিচয় আর দিলো না। সরাসরি কোর্সে পড়ায় মনোযোগ দিলো। এই সেমিস্টারে কি কি পড়বে সবাইকে বুঝিয়ে বললো কৌশিক। অনন্যা স্যারের দিকে দুই একবার তাকিয়েছে শুধু। বাকি সময় সামনে খোলা খাতায় আঁকিবুঁকি করছে বসে বসে। নোহারা কয়েক বার ডাক দিয়ে বলেছে এমনটা না করতে কিন্তু অনন্যা কথা শোনেনি। কৌশিকের ও বিষয়টা অনেকক্ষণ ধরে নজরে এসেছে কয়েক জন তার কথায় মনোযোগ না দিয়ে অন্য কোথাও মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে নোহারা, অনন্যা সহ আরো দুটো ছেলেকে কৌশিক দাঁড় করালো।
অনন্যা, নোহারা দুজনেই দাঁড়ালো। বাকি দুই ছেলেও সময় নিয়ে দাঁড়িয়েছে। কৌশিক প্রথমেই এগিয়ে গেলো অনন্যা আর নোহারার দিকে। দাঁড়ালো অবশ্য অনন্যার সাইডে।
"নাম কী দুজনের?"
অনন্যা কিছুই বললো না। নোহারা পাশ থেকে উত্তর দিলো,
"আমি নোহারা। আর ও হচ্ছে আমার বান্ধবী অনন্যা।"
অনন্যার নামটা শুনে সেদিনের ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেলো কৌশিকের যে কিনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে ওকে সাহায্য করেছিল।
ছেলেটা বলেছিল, অনন্যা আপনার স্ত্রী।
এই মেয়েটাও আজ বলছিলো কিছু একটা। এমন ব্যবহার করছিলো যে কৌশিক ওর আপন কেউ। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে কৌশিকের হঠাৎ মাথায় স্ট্রাইক করলো কয়েক দিন আগের ঘটনা। মনে পড়লো বেশ কয়েক দিন আগেও এই মেয়েটার সাথে ওর দেখা হয়েছিল। সেদিনও কৌশিককে দেখে কাঁদছিলো এই মেয়ে।
সারা ক্লাস নিশ্চুপ হয়ে আছে। সকলে তাকিয়ে আছে কৌশিক এবং অনন্যা, নোহারার দিকে। কৌশিক পুরোনো কথা মনে করতে করতেই বলে উঠলো,
"সারাক্ষণ কি কান্নাকাটির মুডেই থাকেন আপনি?"
অনন্যা সোজা বললো,
"স্যরি, স্যার।"
"স্যরি বলছেন কীসের জন্য? কান্না করার জন্য নাকি কথা বলার জন্য?"
অনন্যা মুখ তুলে চাইল। কৌশিক আবারো বললো,
"আমি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ কোর্স। সামনে কি কি পড়বো আর কোন ফ্লোতে আগাবো সবকিছু বুঝিয়ে বলছি। আর আপনারা সেই কথাতে মনোযোগ না দিয়ে একজন খাতায় আঁকিবুঁকি করছেন।"
কৌশিক অনন্যার খাতা টেনে নিয়ে বললো শেষের কথা। তারপর থেমে আবারও বললো,
"আর একজন তাকে ডাকাডাকি করে আমার ক্লাসে ডিস্টার্বেন্স ক্রিয়েট করছেন। আর ওদিকে দুই ছেলে মিলে গল্প করছে আর ফোন চালাচ্ছে। আচ্ছা আপনারা না বলছিলেন আপনারা আমার আগের স্টুডেন্ট। আগের স্টুডেন্ট হয়েও এইসব বদমাইশি সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে?"
কৌশিক হাতে অনন্যার খাতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছেলে দুজনের কাছে এগিয়ে গেলো। ধমক দিয়ে ফোন দিতে বললো দুজনকে। দুজনে মাথা নিচু করে ফোন বের করে কৌশিকের হাতে দিয়ে দিলো। কৌশিক সামনে এসে ফোন দুটো আর খাতাটা টেবিলের উপর রেখে কঠোর গলায় বললো,
"প্রথম দিনেই আপনাদের প্রতি ইমপ্রেশন খারাপ হলো আমার। যাই হোক, বসুন। আর এইসব জিনিসপত্র ক্লাস শেষে ফেরত পাবেন।"
সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়লো। কৌশিক আবারো পড়ানোতে মনোযোগ দিলো। অনন্যা মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বেশিক্ষণ পারছে না যতবার এই লোকটার দিকে তাকায় কৌশিক স্যারকে মনে পড়ে যায়।
ক্লাস শেষে কৌশিক সকলের এটেনডেন্স নিলো। অনন্যার নাম নেওয়ার সময় কৌশিক কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল নামটার দিকে। মনে মনে বিরবির করে 'অনন্যা শিকদার ' নামটা কয়েক বার পড়লো সে। আচমকাই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। কিছু স্মৃতি চোখের সামনে হুট করেই ভেসে উঠলো। কৌশিক নিজের মাথা চেপে ধরলো।কানের পর্দায় কিছু শব্দ বারি খেলো,
"শিকদার! হাউ ডেয়ার ইউ?"
"প্রিন্সেস, ভালোবাসি তোমায়!"
"মিসেস হার্ট!"
কৌশিক জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। হৃদয়টা অচেনা অজানা ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো তার। বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে আচমকা। তাড়াতাড়ি সামনে পড়ে থাকা বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো। তারপর একটু কেশে অনন্যার নাম উচ্চারণ করলো। অনন্যাও এতোক্ষণ স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজের নামের সময়েই স্যারের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সে দুই হাত বেঞ্চে এগিয়ে ফেলেছিল। বুঝতে চেষ্টা করছিল কি হচ্ছে উনার। কৌশিক ওর নাম ডাকতেই অনন্যা উনার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রেজেন্ট স্যার উচ্চারণ করলো। কৌশিক বিভ্রান্ত চোখ দুটো নিয়ে তাকালো অনন্যার দিকে। অতঃপর পরের নামে মনোযোগ দিলো।
ক্লাস শেষে অনন্যা উঠে দাঁড়ালো। দুই জন ছেলেও তাদের ফোন নিয়ে আসার জন্য হুড়মুড়িয়ে গেলো স্যারের কাছে। কয়েক বার স্যরি বললে স্যার ফোনগুলো ফেরত দিলো। অনন্যাও শেষে এগিয়ে গেলো। কৌশিক অনন্যার খাতা ফেরত দিতে গিয়েও থেমে গেল। অনন্যার খাতায় উল্টাপাল্টা আঁকিবুঁকির মাঝে ফুটে উঠেছে দুটো ছোট ছোট চোখ। কৌশিকের হঠাৎ মনে হলো এই চোখ দুটো তার। একটি চোখের একপাশে একটা শব্দ 'Prince'! কৌশিক সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অতঃপর অনন্যার দিকে খাতাটা ফেরত দিয়ে বললো,
"সো মিস অনন্যা শিকদার! প্রিন্স আপনার বয়ফ্রেন্ড?"
অনন্যা খাতাটা নিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে গর্বের সাথে বললো,
"নো স্যার! আই এম ম্যারিড! এন্ড আমার হাসবেন্ডকে আমি প্রায় প্রিন্স বলে ডাকি।"
কৌশিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"ওহ, গুড!"
অনন্যা মিষ্টি হেসে নোহারাকে নিয়ে ক্লাসের বাইরে চলে গেলো। নোহারা ফিসফিসিয়ে বললো,
"স্যারের সত্যি কিছুই মনে নেই?"
"আই থিংক সো। অথবা হতে পারে ইনি ভিন্ন কেউ।জানি না দুইটার একটা হবে।"
নোহারা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হুম! আমি সন্ধ্যা ব্রোকে এই কথাটা বলবো। দেখি ও কি বলে!"
"নিক ভাইয়াকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস।"
"কখন?"
"কালকে ক্লাসের আগে আসতে বল।"
"ওকে! আজ অনুষ্ঠানে থাকবি?"
অনন্যা কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল। অতঃপর হাঁটা থামিয়ে মুখ খুলতেই নিচ্ছিল পাশ দিয়ে কৌশিক স্যারকে যেতে দেখে সে থেমে গেলো।
মনে মনে ভাবলো,
আজ নাম নেওয়ার সময় ওনার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। নাকি ওইটা আমার ভুল ধারণা? যদি উনি কৌশিক স্যার হয়ে থাকেন তাহলে আমার কাছে এসে একটু দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উনার মধ্যে এমন কিছুই নেই। শুধু নাম নেওয়ার সময় হয়তো ওনার কিছু মনে পড়ছিল।
অনন্যা বললো,
"অনুষ্ঠানে থাকবো।"
নোহারা হাত তালি দিয়ে বললো,
"আমার ও থাকার ইচ্ছে আছে। আমি ভাবছি পরের বার আমরা দুজনে নাচে নাম দেবো। কি বলিস? তুই তো নাচ ও পারিস তাই না?"
"আমার ইচ্ছে নেই। এতো মানুষের সামনে নাচতে ভালো লাগে না।"
অনন্যা হাঁটতে হাঁটতে বললো।
"নাচ যদি প্রদর্শনের জন্য না হয় তাহলে পেরে আর কি লাভ?"
অনন্যা হেসে ফেললো,
"লাভ আছে। কোনো কিছু শেখার মধ্যে নিজের মনের শান্তি ও লুকিয়ে থাকে, নোহা!"
দুজনে মাঠের দিকে রওনা দিল। বড় মাঠের সব সিট বুকড। কোনো সিট বাকি নেই যে দুজনে বসবে। নোহারা কপাল চাপড়ে বললো,
"দেখ! বাচ্চাগুলো কি ফাজিল! আমরা সিনিয়র হয়ে জায়গা পাচ্ছি না আর এরা ক্লাস শেষ হতে না হতেই ছুটে এসে সব দখল করে নিলো?"
"ওদের বোধ হয় আগে ছুটি দিয়েছিল তাই।"
অনন্যা, নোহারা দাঁড়িয়ে থেকেই অনুষ্ঠান দেখছিলো। কিছু সময় পর আরণ্যক ওদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করলো। নোহারা তো বেশ খুশি হয়ে গেলো। আরণ্যকের ভারী ভারী প্রশংসা করতে ভুললো না। শেষমেশ বলে উঠলো,
"ইশশ! আমার পেছনে যদি এমন একটা পাগল ছেলে পড়ে থাকতো। তাহলে আমি কখনোই ওকে রিজেক্ট করতাম না।"
আরণ্যক হেসে নোহারাকে বললো,
"ইটস ওকে আমার জন্য দয়া দেখাতে হবে না। আমার জীবনে কারো গুরুত্ব তখনি বেশি যখন আমি বুঝতে পারি মানুষটা ভেতর দিয়ে অনেকটা ভালো যা আমার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। আর হ্যাঁ, আমি যাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তাকে সারাজীবন ধরে সাহায্য করতেও আমার গায়ে লাগবে না।"
নোহারা হাত তালি দিয়ে বললো,
"গ্রেট। খুব ভালো বলেছ।"
আরণ্যক মিষ্টি হেসে অন্যদিকে চলে গেলো। এবার সে কোনো পারফর্ম করবে না। তাই সবাইকে এভাবেই সাহায্য করে যাচ্ছে। কার কি লাগবে দেখছে সে। নাচ, গান একে একে শেষ হতে থাকলো। হাততালিতে ভরে উঠলো মিলনায়তন। বিকেলের রোদের আলো মাঠে বিদায়ের রঙ ছড়িয়ে দিলো। নতুনদের আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হলো। তাদের হাসিতে, লাজুক মুখে এক রকম সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছিল। এরপর ছোটখাটো কিছু গেইমে মেতে উঠলো সবাই। হাসাহাসি, আনন্দে ভরে উঠলো ক্যাম্পাসের আবহাওয়া।
কৌশিক স্যারকেও মঞ্চের দিকটায় দেখা গেলো। অনন্যা তাকেই খুঁজছিলো। তার দিকেই সে এখন ধ্যান দিয়ে তাকিয়ে আছে। কৌশিক স্যার একপাশে থাকা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সবার হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে দিচ্ছিলেন। নোহারাও বললো,
"চল। আমরা খাবার নিয়ে বাসায় চলে যাই।"
অনন্যা মাথা হেলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কৌশিক স্যারের হাতেই সে খাবারের প্যাকেট নিলো। অনন্যা হাঁটতে হাঁটতে সামনে যাচ্ছিলো। আচমকা নোহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
"তুই বাসায় যা। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো।"
নোহারা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
"কেনো?'
অনন্যার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দেখা গেলো।
·
·
·
চলবে....................................................................................