শার্টের বোতামে থাকা সুরেলার হাত কাঁপে মৃদু মন্দ। ভয়, অস্বস্তি, লজ্জা সব যেন জাপ্টে ধরে। সময় নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একে একে শার্টের বোতাম খোলে সে। বলিষ্ঠ ফর্সা বুকটার দর্শন মিলতেই মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নানীর কথাগুলো যেন জোরে জোরে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের কাছটায় বাজে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গতর হতে শার্ট আলাদা করে যত্নসহকারে। নওরিজ মাহবুব টিস্যু তুলে নেয়। হাতের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলে,
" তোয়ালেটা ভিজিয়ে আনো সুরেলা।"
সুরেলা চলে যাবে নওরিজ গম্ভীর গলায় আবারও হুকুম তামিল করলো,
"সাথে ব্রাশটাও করে এসো। লিপস্টিকের প্রলেপ যেন গায়েব হয়ে যায়। গ্রিন কালারের ব্রাশ তোমার। ব্লু'টা আমার। পেস্টও সেখানেই রাখা আছে!"
সুরেলা কপাল কুঁচকালো। অবুঝ স্বরে শুধালো,
"ব্রাশ কেন করবো?"
নওরিজ বাহুতে টিস্যু ঘষতে ঘষতে স্বাভাবিক জবাব দিলো,
"চুমু খাবো আমি!"
সুরেলা ফ্যাল ফ্যাল করে চায়। কি ভয়ানক কথাবার্তা!খুঁতখুইত্যা লাট সাহেব! সুরেলা লজ্জায় নুইয়ে পড়বে নাকি হাসবে বুঝতে পারে না। নওরিজ মাহবুব আবারও তাড়া দেয়,
"ডার্লিং, কথার সাথে সাথে কাজ করবে। হাতে সময় নেই।"
সুরেলা ভয়, লজ্জা, অস্বস্তি সব গিলে নেয়। লাট সাহেব তাঁর সাথে খুঁতখুঁতুনি মার্কা আচরণ করবে আর সে মুখ বুজে সহ্য করবে? তার আবার ওতো ধৈর্য নেই।
"দাঁত মাজতে আমার সমস্যা নাই; সমস্যাটা হইলো বেরাশ!"
নওরিজের কপালে ভাঁজ পড়ে। ঘার বাঁকিয়ে সুধরে দেয়, "নট বেরাশ, ইটস ব্রাশ।"
"যাইহউক ইটিজ বিগ বিগ সমস্যা। আমারে কয়লা মাজন আইনা দিলে আমি ওহনি তর্জনী আঙ্গুলে কয়লার গুঁড়া লাগাই দাঁত মাইজা ঝকঝকা বানাই দিমু। তারপর না হয় চুম্মা খাইয়েন।"
আঁচলে মুখ লুকিয়ে শেষের কথাটা লাজুক ভঙ্গিতে বলে ওঠে। তবে তাঁর শকুনী নজর লোকটার মুখাবয়বের পানে আঁটকে। মুখটা যা বানাইছে মনে হইতেছে শাপলার মায়ের মুরগির গু নাকের ডগায় লাইগছে। খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব কুনকার! আসছে ব্রাশ করাইয়া চুম্মা খাইতে। আপনমনে বিড়বিড় করে সুরেলা। নওরিজ রক্ত মাখা টিস্যু ঝুড়িতে ফেলে। শান্ত গলায় হুকুম ফরমায়,
"বাপের বাড়ি কি করেছিস না করেছিস সব ভুলে যা। এখন আমার হাতের নাগালে থাকবি তো আমার কথা পাই টু পাই মেনে চলতে হবে। জানিসই তো আমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব সচেতন তাই.."
"ওটাকে এক ধরনের মানসিক রোগ কয় ডাক্তারগোরে ভাষায়। রওশন ভাই জানাইছিলো আমারে।"
নওরিজকে থামিয়ে দিয়ে সুরেলা বলে ওঠে। সুরেলার মুখে রওশন নাম শুনতেই নওরিজের চোয়াল শক্ত দেখায়। রাশভারী গলায় বলে,
"মাথা গরম করাবি না সুর। যা ব্রাশটা করে আয়।"
সুরেলা একটু মিইয়ে গেলেও নানীর ভাষ্যনুযায়ী নিজের ঠাঁঠ বজায় রাখতে হবেই। নইলে ভবিষ্যত অন্ধকার! সে মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে টুনে বলে,
" আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম দাদাজান কইছেন ওই বেরাশ দিয়া দাঁত ঘষলে দাঁতের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই আমি, ভাই, আমরা বেক্করে কয়লা গুঁড়া কইরা বোতলে রাখছি। আর মাঝেমধ্যে নিম গাছের ছাল দিয়া মেছওয়াক করি। আমার চৌদ্দ গুষ্টি জীবনে দাঁতে বেরাশ লাগায় নাই। আমি লাগাইলে হেগের মান সম্মানে টান পড়বো না?"
নওরিজ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে। সুরেলা গালে জিভ ঠেঁকিয়ে দৌড় লাগালো। ঢপ বেশি হয়ে গেলো বুঝি। সে তড়িঘড়ি গোসলখানায় চলে যায়। ধরাম করে দরজা আটকে গলা চড়িয়ে বলে,
"আরে রিজ ভাই রাগেন ক্যান? আপনেও কয়লা ব্যবহার করবার পারেন। দাঁত এমন ঝকঝকা ফকফকা হইবো, আয়নার মতো মুখ দেখা যাইবো।"
"দরজা খোল সুর? তোর মুখ আমি সেলাই করে দিবো।"
নওরিজের কথায় সুরেলা ঠোঁট টিপে হাসে। পুরো গোসল খানায় চোখ বুলায়। ট্যাপ ছেড়ে বালতি পুরো করতে দেয়। তোয়ালে এনে ভিজিয়ে রাখে সেই বালতিতে।
দরজা খটখটানোর আওয়াজে উষ্ণ শ্বাস ফেলে নওরিজ। আলমারি থেকে একটা শাল গায়ে চাপিয়ে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়। ইকরাম উল্লাহ লাগেজ হাতে ভেতরে প্রবেশ করে। হেসে বলে,
"বউ পেয়ে সব ভুলে গেলে রিজ?"
"গাড়ি রেডি করুন দুলাভাই। আমার আর পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে। শুধু চেঞ্জ করবো।"
নওরিজ বলে ওঠে গমগমে সুরে। ইকরাম উল্লাহ কিছু বলবে নওরিন ভেতরে প্রবেশ করে বলে,
"আম্মার সাথে কথা হয়েছে আমার। পিচ্চির জ্ঞান ফিরেছে, এখন কথাও বলছে। ডাক্তার বলেছে আর চিন্তার কিছু নেই।রাতের বেলায় নতুন বউ ঘরে ফেলে যাওয়ার দরকার নেই রিজ। সকালে রওনা দিস। আমরাও তখনি যাবো। বাচ্চাদের নিয়ে রাত করে যাওয়া ঠিক হবে না। ঢাকার রাস্তায় ডাকাত ছিনতাইকারী দের অভাব নেই। তাছাড়াও ড্রাইভার কাক্কাও তো নেই।"
"জামাল ড্রাইভ করবে। আর তোদের যেতে হবে না; আমি একাই যাচ্ছি। তুই শুধু আম্মা যেসব নিতে বলেছে প্যাক করে দে ঝট পট।"
"রিজ.."
" বড় ভাই আমি তোর। তাই জ্ঞান দিতে আসবি না। তোর জ্ঞান তোর কাছেই রাখ।"
নওরিনকে থামিয়ে নওরিজ রসকষহীন গলায় বলে ওঠে। ইকরাম উল্লাহ কিছু বলবে নওরিজ সুযোগ না দিয়েই গোসল খানায় চলে যায়। নিঃশব্দে দরজা আটকিয়ে শব্দহীন পায়ে সুরেলার পিঠ পেছনে দাঁড়ায়।
কারো বলিষ্ঠ বুকের উষ্ণ ছোঁয়া পিঠে ঠাহর করতে পেরেই সুরেলা কেঁপে কেঁপে ওঠে। হাত থেকে ব্রাশ ফসকে যায়। নওরিজ কাঁধে থুতনি রেখে আয়নায় স্বীয় প্রতিচ্ছবির পাশে নববধূয়ার কাজল কালো আঁখিতে আখি মেলায়। কোমড় বেষ্টনীতে বেঁধে আস্টে পৃষ্ঠে জাপটে ধরে ধীমান গলায় আওড়ালো,
"ডার্লিং, দেখতো ফ্লোরে কি যেন গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে।"
সুরেলা নওরিজের কথায় মেঝের দিকে তাকায়। কিছু বুঝতে না পেরে বেসিনে মুখের ফ্যানা ফেলে শুধায়, "কই? কেডা কান্দে?"
নওরিজ সুরেলাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। মেঝের দিকে ইশারা করে বলে,
"তোর চৌদ্দ গুষ্টির মান সম্মান!"
সুরেলা আবারও বোকা বোকা চোখে চায়। মস্তিষ্ক ঠাহর করতে পারে না কথার ভাবার্থ। নওরিজ শালটা সুরেলার কাঁধে ঝুলিয়ে ভেজা তোয়ালে চিপে গা গতর মুছতে মুছতে বলে,
"দাঁত ব্রাশ করলি বলে তোর চৌদ্দ গুষ্টির মানসম্মান ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে!"
সুরেলা মুখে পানি নিয়েছিলো কুলকুচি করবে বলে। নওরিজের কথায় ছিটকে বেরিয়ে আসে। ফ্যাল ফ্যাল করে চায়। খানিকটা তেড়েফুঁড়ে এসে ঝগরুটে ঘলায় বলে,
"দেখুন?"
"দেখা তবে। আমি আগ্রহ প্রকাশ করছি ডার্লিং।"
নওরিজ জায়গা মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠে। সুরেলার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয় মাদকতায় আচ্ছন্ন বাঁকা চাহনি। দুই কদম পিছিয়ে আঁচল ঠিক করে। শুকনো ঢোঁক গিলে বলে,
"লুইচ্চা লোক।"
নওরিজ অধর বাঁকিয়ে হেসে বলে,
"তোর ঘরের লোক। সাত বছরের আরাধনার পর দু'বার পরীক্ষার দিয়ে লুচ্চামি করার সার্টিফিকেট পেয়েছি ডার্লিং।"
থেমে নওরিজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। সুরেলার সারা অঙ্গে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট চোখা বানিয়ে চুমুর ভঙ্গিমা করে বলল,,
"সম্পূর্ণ তুমিটাই আমার। সময় হোক, কোনো এক পূর্ণিমায় না হয় লুচ্চামির অধ্যায় শুরু হবে।"
লাজে রাঙা সুরেলা হাঁসফাঁস করে। ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস জাগে। কি সব অশ্লীল কথাবার্তা! সে নজর লুকিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে মুখে পানির ছিঁটা দেয়। ডলে ডলে মুখে প্রসাধনীর প্রলেপ তুলে। নওরিজ হেসে ঘরে চলে যায়। হাত, পিঠের ব্যাথায় কেমন পাগল পাগল লাগছে। গা টাও কেমন ঘেমে উঠেছে বারবার। বুঝতে অসুবিধা হয় না শরীর বিশ্রাম চাইছে তবে সম্ভব নয়। সে গায়ের পোষাক পাল্টে নেয়। হাতে যে সময় নেই।
হুট করে ঘরে ঢুকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সরে সুরেলা। ভদ্রলোক প্যান্ট পড়ছে। সুরেলার ইচ্ছে করে গায়েব হয়ে যেতে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! লজ্জারাও যেনো লজ্জায় পড়ে গেল। কি সব হচ্ছে আজ! সে উল্টো ঘুরে আবারও গোসল খানায় ঢুকে যাবে নওরিজ গম্ভীর সুরে ডাকে,
"ডার্লিং? সময় নেই আমার। শার্টটা পড়তে হেল্প করো তো আমাকে। অসুবিধা হচ্ছে আমার!"
সুরেলা ক্ষণপল সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। শার্ট পড়িয়ে দেবে? লজ্জায় সে ফিট খাবে না তো? সুরেলা দোনামোনা মনে লজ্জা মাখা বদনে এগিয়ে যায় নওরিজের দিকে। চোখ রাখে না ওই রক্তিম সম্বোধনী চাহনিতে। সেথায় যে তাঁর সর্বনাশ নিশ্চিত। বিছানা হতে শার্ট তুলে দিতেই নওরিজ ডান হাত এগিয়ে পড়ে নেয়। সুরেলা নজর তুলতেই বলিষ্ঠ লোমহীন ফর্সা বুকটা নজর কাড়ে। আবারও ঝড় বইয়ে যায় বুকের ভেতরটায়। পিঠের দিকটায় নজর যেতেই মুখটা ছোট হয়ে আসে। ফর্সা পিঠে ব্যান্ডেজের প্রলেপ ভালো লাগে না। লোকটার কি অনেকটাই কেটে গেছে? নওরিন আপু যে বললো বারো তেরোটা সেলাই পড়েছে! সুরেলা ব্যান্ডেজের উপর আলতো আঙুল ছুঁয়ে দেয়। বাম বাহুর দিকে চাইতেই বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। রক্তে রক্তিম সাদা ব্যান্ডেজ। হাত কাঁপে তাঁর। কোনোমতে শার্টের হাতায় হাত গলিয়ে দিতে সাহায্য করে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। কি মনে করে এক হাত উঁচিয়ে ছুঁয়ে দেয় গলার ভাঁজে, ওই চওড়া কপালে। আঁতকে উঠে সুরেলা।
"জ্বরে তো গাঁ পুইড়া যাইতেছে!"
"তো নিভিয়ে দাও আগুন। একটু ঠান্ডা করো?"
ভরাট আকুতি ভরা গলায় সুরেলা শুকনো ঢোঁক গিলে। ওই শান্ত চোখের চাহনিতে পুড়ে নিঃশেষ না হয়ে যায়। নজর সরিয়ে শার্টের বোতামগুলো আটকাতে শুরু করে। নওরিজ মাহবুব খানিকটা ঝুঁকে আসে। উষ্ণ শ্বাসের খেলায় পেরেশানিতে সুরেলা। এ কেমন মরণ মরণ অনুভূতি? সে তো দম আঁটকেই মারা পড়বে। তাকে মারতে নওরিজ দূরত্ব ঘুচিয়ে আরেকটু কাছে আসে। জ্বরে উত্তাপে পোড়া শুষ্ক ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় ললাটে। এক বার, দু বার, বারবার। সুরেলা যেন প্রবল ঝড়ের তান্ডবে খেই হারা তরী। শার্টের একাংশ মুঠোয় ভরে লাজে মিইয়ে যায়। রুক্ষ ঠোঁটের তপ্ত ছোঁয়া গভীর হয়। মাথার ঘোমটা টানা ওড়না খুলে পড়ে যায় মেঝেতে। গলার ভাঁজে দুই হাত রেখে মুখখানি আঁজলায় ভরে খসখসে হাত দুখানি। মসৃণ গালে নাক ডাবিয়ে দিতেই সাবানের ঘ্রাণ পায়। ফোঁস ফোঁস শ্বাসের শব্দ করে গালে নাকের ডগা ঘঁষে শুঁকে বলে,
"ফেইস ওয়াশ ছিলো তো ঝুড়িতে। মুখে ফেইস ওয়াশ ব্যবহার করবি। সাবানে ত্বকের ক্ষতি হয়।"
সুরেলা চোখ খুলে চায়। নেহায়েৎ অনুভুতির উত্তাপে দগ্ধ তনুমন। নয়তো দু'টো কথা শুনিয়ে দিতে জড়তা করতো না খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেবকে। চুম্মা খাবি খা এতো শুকাশুকির কি আছে মিয়াসাব? বিড়ালের স্বভাব তো ভালা না। সত্যিই বিড়ালের স্বভাব ভালো না। সিক্ত স্পর্শে রগে রগে অনুররণ সৃষ্টি হয়। গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করে উঠলো সুরেলা। কিশোরী তনু মন এহেন স্পর্শে মূর্ছা যাবার পথে। নওরিজ বেজায় বিরক্ত হয়। নরম মসৃণ গালে দাঁত কপাটি বসিয়ে বিরক্ত ঝাড়ে।
"তোমার কাঁপাকাপির গুষ্টির ষষ্ঠী বানিয়ে দিতাম যদি না তাড়া থাকতো।"
থেমে মুখপানে দৃষ্টি রাখে নওরিজ। শ্যামল কম্পমান মুখটায় এক অন্যরকম দ্যুতি জ্বল জ্বল করছে। যেন টানছে তাঁকে। খিঁচে রাখা চোঁখের পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সুরেলা পাগল পাগল অনুভূতি লুকাতে বুকটায় কপাল ঠেকিয়ে মুখ লুকায়। নওরিজ ডান হাতে শক্ত জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে খানিকটা নরম সুরে বলে,
"আমি চলে যাবো সুরেলা ডার্লিং। তিন চারদিন সেখানেই থাকবো। মন খারাপ করবে না। কাল সকালে সিন এলে ওর সাথে যেও। তবে সন্ধ্যার আগেই নিজ ঘরে ফিরে এসো। বাপের বাড়ি খুঁটি পুঁতে থেকো না।এখন এটাই তোমার আসল ঠিকানা। বুঝাতে পেরেছি?"
"হুঁ।"
ছোট্ট করে জবাব দেয় সুরেলা। মনটা খারাপ হয়ে আসে তাঁর। নববধূ কে সোহাগ রাতে ফেলে বর সাহেব চলে যাবেন; মন খারাপ হবে না? পরিস্থিতি বুঝতে পারে তবুও অপরিপক্ক আবেগী মনটা খারাপ হয়। তবে প্রকাশ করে না। বুক থেকে মাথা তুলে অবশিষ্ট বোতাম আঁটকে দেয়। নওরিজের কথা মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাপড় জিনিসপত্র গুছিয়ে দেয়। এমনকি ব্রাশ, সাবান, তোয়ালেও প্যাক করে দেয়। এতো খুঁতখুঁতে লোকটা!
—————
টিনের চালে বৃষ্টির ছিটেফোঁটায় টুংটাং শব্দ হচ্ছে।অন্ধকার কামরায় কুঁপি জ্বলছে নিভু নিভু আলো ছড়িয়ে। আলো নিভু নিভু হলেও উত্তেজনা আকাশচুম্বী। সবার মুখেই চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মেঝেতে বসে কালু ব্যান্ডেজ করা কব্জি সহ কাটা হাত দেখিয়ে আহাজারিতে ফেটে পড়ছে। উপস্থিত সকলেই চিন্তিত মুখে বসে। শফিল নামক ত্রিশোর্ধ্ব লোক গম্ভীর মুখে বলে,
"মাথায় আঘাত বা আতংক ছড়িয়ে পড়ে এমন আক্রোমণ করতে বলা হয়েছিলো তোদের। তোরা কি করলি? আর ডাবলু কোত্থেকে টপকালো ভাই?"
কালু কাঁদতে কাঁদতে বলে, "ভাই জানি না। আপনেরা পঞ্চাশ দেওনের কথা কইছিলেন। আর রেজা ভাই কইছিলো খতম করবার পারলে দুই লাখ দিবো। এর আগে কত মারছি মানুষ! তাই রাজি হইয়া গেছিলাম। জন্মের শিক্ষা পাইছি ভাই। ওই লোক ভারী ভয়ংকর। মনে হইতেছিলো রক্তকালী মাথায় চড়ছিলো উনার!"
শফিলের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
"এই রেজা আবার কে?"
মেম্বর রুমাল ঘঁষে কপালে গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছতে মুছতে বলে,
"আমার ছাওয়াল সেলিম রেজা। কাইল মেলা রাত্তিরে হাঁপাইতে হাঁপাইতে আইছে। বমি টমি কইরা চোখ উলটাইয়া গা ছাইড়া দিছিলো। আমরা তো ভয়ে শ্যাষ; কি হইলো! হুশে ফিরতেই সব কইলো। চেয়ারম্যানের পোলায় সেবার মাইরা আধমরা বানাইছিলো ছলডারে। গায়ে ওহনো মারের দাগ শুকায় নাই। চ্যাংড়া মানুষ বুঝেনই তো; রক্ত গরম। না বুইজ্যা কামডা করছে।"
শফিল নামক লোকটা সহ ঘরে উপস্থিত সবাই হতবাক। ক'দিন আগেই না রিজের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো! সবার চাঁপা গুঞ্জনের মাঝে মন্টু মিয়া নীরব বসে। শফিলের ডাকে লোকটা কেশে গলা পরিষ্কার করে সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
"আমার কথাডি মনোযোগ দিয়া শুনো বেক্কলে। যতদূর বুঝলাম চেয়ারম্যানের ছলডায় ভেজাল আছে। হুট কইরা আমাগোরে পিছনে পড়লো কারণ তো আছেই। কাল রাতে যেই ঘটনা ঘটলো সেইডা ভুইলা যাও। এইডা নিয়া নিজের লগে অবদি কথা কইও না। খবরডা রমজানের কানে না যায়। হের মাইয়ার নাকি মরণ দশা। ডাবলুডা মরছে বইলা ওর হাউরি শেফালী বু ক্ষেপছে। উনি মনে হয় ছাইড়া দিবো রিজরে। মহিলার ক্ষ্যামতা বহুদূর অবদি। এইদিক দিয়ে ভাবতে গেলে আমাগোরে সন্দেহ করা হইবে না। ডাবলুর উপরেই যাইবো সব।সে যাই হউক সাবধানে থাকতে হইবো। মালামাল গুলা লুকাই রাখো দশ পনেরো দিন। অতি বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কাউরেই খুচরা মাল দিও না। নতুনদের তো আরো না। তয় ইস্কুলের পোলাপাইনের হাতে দিও অল্প করে।"
"তাইলে তো মিয়াভাই লস হইয়া পড়বো। দিন লাখ টাকার বেশি মাল বেচাকেনা হয়। ইনজেকশনের চাহিদা বাড়তেছে। ওহন ঢিল দিলে তো.."
"কিচ্ছু হইতো না শফিল। এই উছিলায় দাম'ডা বাড়াই দিমু নে। যে পদ্মার মাঝিরা মাল দিতে গাইগুই করে, দাম বেশি দিয়া আনতে হয়। লস আবার কি? সবেত থাইক্যা লাভ খুইজ্যা লইতে হয়।"
সবাই তাঁর কথায় সহমত পোষণ করে। উপস্থিত জনরার একজন কালুকে দেখিয়ে বলে,
"এই বাইঞ্চতের কি করমু মিয়া ভাই?"
মন্টু মিয়া দাঁড়িবিহীন চোয়ালে হাত বুলিয়ে হাসে।
"আমি কি কমু। যা ভালো বুঝো করো। কিছুমিছু ট্যাহা দিয়া দূরে পাঠাই দাও।"
মুখে একথা বললেও ভদ্রলোকের চোখের ভাষা ভিন্ন। শফিলসহ অভিজ্ঞদের সেই ভাষার মানে বুঝতে অসুবিধে হয় না একআনাও।
—————
কামরার সাদা দেয়ালে দৃষ্টি স্থির। মুখে অক্সিজেন মাস্ক আর হাতে ক্যানুলা লাগানো। সাদা চাদরে আব্রুত ছোট খাটো দেহখানি। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজে কান অবদি ঢেকে আছে। শুধু ছলছল চোখ দুটো নড়ছে এদিকে ওদিকে। নার্স মেয়েটা মুচকি হেসে বলে,
"পিচ্চি? একা একা বিরক্ত হচ্ছো? কাউকে ডাকবো? তবে একজন এলাউ করা হবে। তাও শুধু দশ মিনিটের জন্যে।"
রূপসা ইশারায় না বোঝায়। নার্স হেসে চলে যাবে রূপসার ইশারায় থেমে যায়। মেয়েটা কিছু বলতে চাইছে। নার্স বুঝতে পেরে বলে,
"পিচ্চি অক্সিজেন মাস্ক খোলা বারণ। তুমি যখন বলছো যাস্ট ওয়ান মিনিট ওকে?"
রূপসা চোখ পিটপিট করে সম্মতির জানালো। মাস্ক খুলতেই যেন রূপসা স্বস্তি পায়। দূর্বল ভঙ্গুর সুরে বলে,
"আমার মাথা হালকা লাগছে!ব্রেন আবার বেরিয়ে যায় নিতো?আমি তো বড় হয়ে ডাক্তার হবো। ব্রেন না থাকলে তো ডাক্তার হতে পারবো না। "
সময় নিয়ে আস্তেধীরে ভেঙে ভেঙে বলে রূপসা। তার বোকা বোকা কথাগুলো একসাথে জুড়ে কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে নার্স হেসে ফেলে।
"আরে বোকা ব্রেন বেরিয়ে কোথায় যাবে? তোমার ব্রেন তোমার মাথাতেই আছে। ডাক্তার বাবু নিজের মাথা থেকে একটু ব্রেন তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন ধরে নাও তুমি ডাক্তার। ডিগ্রী পেলে চিকিৎসা শুরু করে দিও।"
হেসে বলে সুন্দর দেখতে নার্স টি। রূপসাও একটু হাসলো। নার্স টাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। দেখতেও সুন্দর আর কি মিষ্টি করে কথা বলে! একে রওশন ভাইয়ের বউ বানালে কেমন হবে? সে অনেক অনেক কথা বলবে ওনার সাথে।
"আমার একটা ভাই আছে। খুউব ভালো আর হ্যান্ডসাম। তুমি কি তাঁর বউ হবে?"
রূপসার ভাঙা ভাঙা কথায় নার্সের চোখ ছানাবড়া। মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,
"বলে কি পিচ্চি মেয়ে? কাল আজরাইলের হাতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো এখন একটু হুঁশ ফিরতেই ঘটকালি করতে নেমেছে।"
"তোমার কথাগুলো অনেক মিষ্টি। কিছু খিটখিটে লোক আছে জানো? তারা তো কথা বললে মনে হয় জীবনেও মিষ্টি খায় নি।"
রূপসার কথায় নার্স ছোট ছোট চোখে চায়। মাস্কটা পুনরায় মুখে দিয়ে বললো,
"হয়েছে আর না। অনেক গপ্পো সপ্প হলো। রেস্ট নাও পিচ্চি! তোমার বাড়ির কাউকে ডাকবো?"
রূপসা বিরক্ত বোধ করে। নিজেই মাস্ক সরিয়ে বলে,
"না। সবাই শুধু কাঁদে। আমার সামনে কেউ কাঁদলে আমারও কান্না পায়! তুমিই থাকো না?"
বলতে বলতে ভেজা চোখের কোনা বেয়ে নোনাজল পড়ে। নার্স রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। মেয়েটা সত্যিই পিচ্চি। যেন আদুরে চলতি ফিরতি ইয়া বড় পুতুল। ওই যে সিনেমার সুন্দরী নায়িকার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করা কোনো পিচ্চি নায়িকা। আর বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা চঞ্চলা হরিণী।
"আচ্ছা আমিই থাকছি তুমি মাস্ক লাগাও দেখি?"
" না, এমনিই থাকি না। মাথা না, হালকা হালকা লাগছে! ডাক্তার ব্যান্ডেজ করেছে তাহলে ভারী হবে না বলো?"
নার্স মলিন হাসে। শুনেছে মেয়েটা পরিবারের আহ্লাদী একজন। সত্যিটা জানলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? তারই তো কেমন লাগছে। এতো বড় ঘন চুলগুলো এখন অর্থহীন হয়ে পড়ে আছে কোনো এক কোণে। দরজা খটখটানোর আওয়াজে নার্স রূপসার প্রশ্নবাণ থেকে ছুটকারা পায়। মাস্ক পরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যায়। ভেতরে প্রবেশ করে ছামিনা বেগম। রূপসার শুকনো মুখটা দেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে।
—————
সফেদ দেয়াল ঘেঁষে সচ্ছল আয়নায় এক অর্ধনগ্ন নববধুর প্রতিচ্ছবি ফুটে আছে। গা হতে শাড়ির অবশিষ্টাংশ খুলে সাদা বিছানায় রাখে। হাতের ভারী স্বর্ণের বালা, গলার সীতা হার, কোমড়ের বিছা ড্রেসিং টেবিলের উপর জ্বল জ্বল করছে। খোঁপার নেতিয়ে পড়া গোলাপ খুলে নাকে সুবাস টেনে রেখে দেয় অবহেলায়। নানী তো বিড়াল মারার অনেক কৌশল শিখিয়ে পড়িয়ে দিলো কিন্তু আফসোস সেগুলো কাজে লাগলো না। ফুল বিহীন বাসর ঘরে অবস্থান করছে সে। ওহ্ হ্যাঁ জামাই বিহীনও বটে। মলিন হেসে আয়নায় নিজেকে দেখে সুরেলা সালেহ। এই ঘরের এই আয়নাটা তাঁর সবচেয়ে বেশি পছন্দের। এই আয়নায় সে নিজেকে অনেক দেখেছ। আয়নাটায় তাঁকে কালো বা কুৎসিত লাগে না। বেশ লাগে দেখতে। আগে রিজ ভাইয়ের ঘরে এলে সবার আগে সে আয়নায় নিজেকে দেখতো। মাঝে মাঝেই ভাবতো আয়নাটা সে চুরি করে খুলে নিয়ে যাবে নয়তো রিজ ভাইয়ের কাছে চেয়ে নিবে। রিজ ভাই মানা করতো না, সে জানে। ভদ্রলোক একবার বিদেশি চকলেট খেতে দিয়েছিলো তাকে। সে লুকিয়ে একটা সিন ভাইয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। সিন ভাই মিষ্টি চকলেট খায় নি বরং তাঁকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিল অনেক রাত অবদি। সেই ভয়েই রিজ ভাইদের বাড়ি আসা বন্ধ হয় তাঁর। আয়নাটাও চাওয়া হয় নি। ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস আয়নাটার একচ্ছত্র অধিপতি এখন সে।
মাথার টিকলি টা খুলে সুরেলা হামি তুলে। ঘুম পাচ্ছে তাঁর। রাতও নিশ্চয়ই অনেক হয়েছে! সুরেলা বিছানায় রাখা সালোয়ার কামিজ হাতে নিবে ফিরে এসে আয়নায় আবারও নিজেকে দেখে মুচকি হাসলো। পরণে তাঁর ফুল হাতার ব্লাউজ আর পেটিকোট শুধু। ব্লাউজটা বেশ বড়সড় বিধায় অস্বস্তি হচ্ছে না। সুরেলা খোঁপাটা খুলে দিতেই শ্যাম্পু করা ঝলমলে ঘন কালো চুল কোমড় ছেড়েছুড়ে প্রায় হাঁটু ছুঁই ছুঁই করে। মাথা চুলকে আয়নার নিজ প্রতিচ্ছবি দেখে একটু রংঢং করে। মুখটা গম্ভীর বানিয়ে আঙুল তাক করে আয়নায় নিজেকে ছুঁয়ে বলে,
"ডার্লিং, লুকিং নাইস হুম!"
মুচকি হাসে সুরেলা। তবে দরজা খোলার আওয়াজে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। সিঁটকারীর নাগাল না পাওয়ায় দরজা আটকাতে পারে নি। নিজেকে আব্রুত করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে সুরেলা। তখনই কানে বাজে চেনা পরিচিত ভরাট গলার স্বর। শুকনো ঢোঁক গিলে সুরেলা লাল শাড়ি বুকে জড়িয়ে লাজুক নতমুখে দাঁড়ায়। হাত পা সহ সর্ব অঙ্গ যেন কাঁপছে ঠকঠক করে।
"প্রকৃতির নিয়মে যা যার, তাকে তার থেকে ঢেকে রাখা বৃথা ডার্লিং। ফুল ফুটলে মধু যে শুধু ভ্রমরের ই অধিকার।"
বলতে বলতে নওরিজ বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে আসে সুরেলার সম্মুখে। শাড়ি ছিনিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে। পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে আপাদমস্তক আবারও চোখ বুলিয়ে খানিকটা ঝুঁকে আসে নওরিজ। ধীমান স্বরে বলে ওঠে,,
" এতো পিচ্চি!
তবুও কী অসম্ভব আকর্ষণ তোর মাঝে !
যেন নিষিদ্ধ কিছু ছুঁয়ে ফেলার তীব্র অভিলাষ।
ভয় নেই ডার্লিং,
আমার ভালোবাসার ছায়ায়, শক্ত হাতের দখলে
ধীরে ধীরে পরিস্ফুটিত হবি।"
ধীমান স্বরে বলে নওরিজ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ডান হাত বের করে সুরেলার উন্মুক্ত উদরের একাংশে চিমটি কাটে সজোরে।
"আর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে ব্যাড লাক সুরেলা সালেহ।"
গম্ভীর সুরে বলে নওরিজ। সুরেলা চোখ মুখ খিঁচে রেখেছে। লজ্জায় তাকাতে পারছে না। ওদিকে লোকটা পেটে চিমটি কেটেছে তো ছাড়ছেই না। সে কি করবে ভেবে পায় না। যার দরুণ লাজে মরছে তারই বুকে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়।
—————
ভাড়ায় আনা চেয়ার টেবিল গচ্ছিত করে ভ্যানে তুলে হাঁফ ছাড়লো সিনান সালেহ। উঠোনে গাছের সাথে টাঙানো রশিতে ঝুলিয়ে রাখা গামছায় ঘর্মাক্ত মুখ মুছে পিছনে ফিরতেই শাপলার দেখা মিলে। তাঁর দিকে পানি ভর্তি গ্লাস বাড়িয়ে দিয়েছে। সে গ্লাসটা হাতে নেয়। পানি পান না করে শাপলার মাথায় ঢালে। খ্যাক করে বলে ওঠে,
" মেলায় হারায় যাওয়া ইবলিশের নানী! দূর হ চোক্ষের সামনে থাইক্যা। রোজাদাররে পানি দেস বেক্কেল ছেড়ি। খালি চোপা ফুটাইবার পারোস। ঘটে বুদ্ধি শুদ্ধি কিচ্ছুটি নাই।"
শাপলা ফোঁস ফোঁস করে চায়।
"সিন ভাই এইডা কি করলা তুমি? সাত সকালে ভিজাই দিলা। তুমি তো রাইতে সাহরি খাইলা না তাইলে রোজাদার কেমনে হইলা?"
"যাবি সামনের থাইক্যা? নাকি গাল লাল করোনের শখ জাগছে?"
সিনানের ধমকে শাপলা ঠোঁট চোখা করে শ্বাস ফেলে। সিন ভাইয়ের সাথে কথা বাড়ানো মানে সেধে ধমক খাওয়া। সে মুখ মুচড়ে ডান হাত পেতে বলে,
"যামু আগে আমার চার হাজার ট্যাহা দাও?"
"তোর আবার কিসের ট্যাহা?"
কুঞ্চিত কপালে শুধায় সিনান। শাপলা গোল গোল করে চায়। নেকি সুরে বলে,
"সিন ভাই? খাড়াই ভুইল্যা গেলা? দুলাভাই যে দিলো; সেই ট্যাহা কাল তোমার কাছে দিলাম মনে পড়ে নাই?"
সিনান নিম্ন ওষ্ঠাধর ফুলিয়ে কাঁধ উঁচিয়ে অস্বীকার করে। শাপলার চোখ ছলছল করে ওঠে। কি বাটপার এই সিন ভাই? তাঁর কত্তোগুলা টাকা। সব জলে গেলো। সে আর কিছুই না বলে ধচং বচং করতে করতে চলে যাবে সিনান পিছু ডাকে,
"সাপের খালা শাপলা? শুন ছেড়ি?"
শাপলা ভাবে শুনবে না। তবে উপেক্ষা করেও যেতে পারে না। গোমড়া শুকনো মুখে এগিয়ে যায়। সিনান শার্টের পকেট থেকে বিশ টাকার দুটো নোট শাপলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
" শেয়ালের কাছে মুরগি বাগি দিবি আর শেয়াল মুরগি খুব যত্ন সহকারে রোস্ট বানাইয়া তোরে খাওয়াইবো, বুজছোস নি?আমি শেয়াল একটু ভালা আছি তাই চার হাজারের দুইটা গোল্লা কাইটা এই চল্লিশ দিলাম; দোকান থাইক্যা বাদাম কিইনা খাইস সবাই মিইলা। কি হইলো নিবি না? না নিলে নাই!"
শাপলা খপ করে ছিনিয়ে নেয় টাকা। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ঢের ভালো। টাকাটা ওড়নার গিঁটে শক্ত করে বেঁধে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ায়। জিভ দেখিয়ে ভেঙ্গিয়ে গলা চড়িয়ে বলে,
"তার-ছেড়া সিন ভাই! তোমার কপালে বউ নাই। আইবুড়া থাকবা সারা জনম! দিলাম এই ফুউউউউ!"
সিনান মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে হাতের চার আঙ্গুল দেখিয়ে বলে,
" বউ আনমু চারডা বুজছোস? বড় বউ রান্না বান্না করবো, মেজ বউ ঘর দোর সাফ সাফাই করবো, সেজ বউ মা, বাপের আর বিউটিফুলের সেবা যত্ন করবো আর ছোটডা আমার খেয়াল রাখবো চব্বিশ ঘন্টা!"
"আহা বুইড়ার শখ কতো! মাইয়াগোরে বাপে তো তোরে দেইখ্যা সাপের পাঁচ পা দেখবো। যাইস বিয়া করতে? ঠেঙানি জুটবো মাইয়া না। যেই না তার চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা!"
আইয়ালী বেওয়া লাঠি হাতে এগিয়ে আসতে আসতে বলে ওঠে। সিনান ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে বলে,
"এই বুড়ি তুই ওহনো ফুটোস নাই? বিয়া তো শ্যাষ ওহন পোঁটলা বাইন্ধা রাস্তা মাপ। নাকি খুঁটি গারার পরিকল্পনা কইরা আইছোস?"
বৃদ্ধা রাগে না। পানের পিক ফেলে ফোকলা দাঁতে হেসে বলে, "ও আমার সিনান পিতলা ঘুঘু। ওমন কইরা কস ক্যান? আর কয়দিনই বা বাচুম ক? পোলারা বউ ছলপল নিয়া ঢাকায় খাইট্যা মরতেছে। বাইত্তে একলা ভাল্লাগে না। কয়ডা দিন থাকতে চাইছিলুম। না রাখলে ক সত্যিই চইলা যামু।"
"যা ওহনি যাবি। ওসব কুমিরের কান্দায় আমি সিন গলার মানুষ না। বুড়ি তুই তোর বিটির মতোই ফন্দিবাজ।"
সিনানের রসকষহীন গলায় বৃদ্ধা হে হে করে হাসলো। এগিয়ে গিয়ে সিনানের পেটে লাঠি দিয়ে আলতো গুঁতো মেরে বলে,
"আগে তোর বিয়া দিমু তারপর যামু তার আগে না। এক্কেরে বুড়ার কসম।"
সিনান ভ্রু কুঁচকে বলে, "বুড়ি, অসুখ জামাইরে রাইখ্যা রং ঢং মারাও? বুড়ারে কেডা দেখবো?"
বৃদ্ধা মলিন হাসে। হুট করেই চোখের কোটরে পানি জমেছে ক্ষীণকায়।
"তাঁর আরেক বউ আছে হেই দেখবো নি। আমি বাপু আর পারুম না হের গু মো/ত ধুইতে। এতো করি তাও নাম হয় না। বড়ডাই জানের জান কইলজ্যা।"
সিনান বাঁকা চোখে চায়। বৃদ্ধার ঝুঁলে পড়া গাল টিপে দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলে,
"ওলে লে লে বুড়ির কি কষ্ট! বুড়ার উপর রাগ কইরা দেওলিয়া হইছে বুড়ি। সতিনরে সহ্য করবার পারিস না তো আইছিলি কেন সতিনের ঘরে?"
"পেটের দায়ে আইছি ভাই। গরিব বাপে খাওন কাপড় দিতে পারতো না তাই বিয়া দিছে। খাওন দাওন কাপড় তো পাইছি সুখ পাইলাম না জীব্বনে। ভাই, যারে আনবি সুখ না দিলেও দুঃখ দিস না। আর হুন? বউ সোহাগের জিনিস। আহ্লাদী আইনা আহ্লাদ করবি। বুজছোস?"
বৃদ্ধা বলে ঠোঁট টিপে হাসে। সিনান পাত্তা দেয় না। গরুর চারিতে খরকুটো আর পানি মিশিয়ে দেয়। বাছুর গরুর প্রশস্ত ললাটে চুমু বসিয়ে বলে,
"বিউটিফুল বেশি বেশি খাইয়া মোটাতাজা হও। সামনের বছর আমারে একখান আইড়া বাছুর দিও আইচ্ছা?"
বাছুর হাম্বা হাম্বা বুলি আওড়িয়ে সিনানের পেটে মুখ ঘঁষে দিলো। যেন লাজে রাঙা বধূ মুখ লুকালো। ওদিকে কলাপাড়ে বালতি হাতে দন্ডায়মান শাপলা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে তাঁর পেটে খিল এঁটে যাওয়ার উপক্রম। তাদের বিউটি ওরফে হাম্বা ভাবী সিন ভাইরে বাচ্চা দিবো; তাও আইড়া বাছুর। গরু আর মানুষের বাচ্চা কেমন হইবো? ভাবতেই হেসে লুটোপুটি খায় শাপলা। সিনান ছোট ছোট চায়। বাড়ি ভর্তি মেহমানের সামনে গলা ফাটিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করছে বেয়াদব। সে চাপা স্বরে ধমকে বলে,
"বেকুব ছেড়ি। মাইয়া মানুষ হাসবো মিটিমিটি পাশের মানুষ অবদি জানবো না; তা না পিশাচিনীর রূপ নিছে। পুরা এলাকার মানুষ ডরাইতেছে। থামবি না টানাচর খাবি?"
শাপলার হাসি থামার নাম নেই। পানি ভর্তি বালতি নিয়ে যায় আর পুরো বাড়িতে ঢোল পিটায় সিন ভাই আর হাম্বা ভাবীর বাচ্চা আইবো সামনের বছর।
সিনানের ওসবে হেলদোল নেই। বৃদ্ধা এগিয়ে এসে সিনানের পাশে দাঁড়ায়। গরুর গা দুইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
"ওই শাপলা ছেড়িরে কেমন লাগে? চার হাত এক করোন যায়?"
সিনান ভ্রু উঁচিয়ে চায়। খানিক হেসে বুড়ির চেয়েও ফিসফিসিয়ে সুরে বলে,
"মন্দ নয় বুড়ি। তয় কাইল্যা বামনের ঘরে খোদ চাঁদের নজর লাগছে। বামনের আর কি দোষ!"
—————
"তোমার মতো কেয়ারলেস লোক প্রসাশনে আসে কিভাবে আমি ভেবে পাই না। এই তোমাকে প্রমোশন কে দিয়েছে?"
"আইজিপি সানাউল হক! এতেও কাহিনী আছে স্যার। প্রায়শই স্যার তার সুকন্যাকে ভার্সিটি থেকে আনা নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। মেয়েটার চোখে তো সর্ষে ফুল ফুটছিলো। নিজ থেকে কফি ডেইটের অফার করলো বলে মানা করতে পারলাম না। ব্যস স্যার কোত্থেকে প্রোমোশন লেটার হাতে ধরিয়ে বের করে দিলেন।"
"রিজ তুমি সব কিছু হালকা ভাবে কেন নিচ্ছো? প্লিজ বি সিরিয়াস! এর আগেও এক অপারেশনে রাগে বশবর্তী হয়ে দু'টো শুট করে মেরেছো। এখন তিনটেকে কুপিয়ে হত্যা করলে। ব্যাপারটা উপর থেকে খতিয়ে দেখা হবে। এদিক সেদিক পেলে সাসপেন্ড করতে পারে।"
নওরিজ চেয়ারের গা এলিয়ে দেয়। পাশে দন্ডায়মান র্যাবের কালো পোষাক ধারী সাদমান নওরিজের গা ছাড়া ভাব দেখে চোখ রাঙায়। নওরিজ বলে,
"স্যার আমি চাকরিচ্যুত হতে ভয় পাই না। আমার পরিবারের দিকে যে হাত বাড়াবে তাঁর হাতসহ মাথা আলাদা করে দিবো। আমি একা থাকলে ভিন্ন ব্যাপার ছিলো আমার পিচ্চি বোনটি সাথে ছিলো।"
কর্নেল তাহের মিয়াজী কাচের টেবিলে হাত রেখে বলে, "রিজ বুঝতে পারছি। আচ্ছা ছাড়ো এসব যে কাজে লেগেছো সেটা কতদূর? খুঁজে পেলে কিছু? আমি কাউকে পাঠাবো? এনাদার কোম্পানি?"
"নো নীড স্যার। আ'ম এনাফ।"
তাহের মিয়াজী মৃদু হাসেন।
"শুনলাম বিয়ে করেছো। নেমন্তন্ন পাই নি কিন্তু!"
"বাচ্চার আকিকায় আসবেন স্যার। ঘ'টা করে আয়োজন করবো ইনশাআল্লাহ।"
নওরিজ স্যালুট জানিয়ে প্রস্থান নেয় কামরা থেকে। কর্ণেলের কপালে ভাঁজ পড়ে। বিয়ে করলো চব্বিশ ঘন্টাও গড়ালো না; বাচ্চার আকিকার দাওয়াত দিয়ে গেলো! সে সাদমানের দিকে তাকায়। গম্ভীর মুখে বলে,
"কোম্পানি কমান্ডার আঙুরকে পাঠাও ওখানে। চক্রটা বেশ বড়সড় আর গ্রামের মানুষ বলে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। এরা আরো ডেঞ্জারাস।"
সাদমান সায় জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বেরিয়ে আসে কামড়া থেকে। সোজা অফিস থেকে বেরিয়ে আসে পাশে নওরিজকে খুঁজে বেড়ায়। দূরে রাস্তার ওপাশে এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। সে এগিয়ে যায় লম্বা লম্বা পা ফেলে।
"তোমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের সাথে সিগারেটটা মানাচ্ছে না রিজ। এক সিগারেটের শলাকায় কতগুলো জীবাণু আছে ধারনা আছে তোমার?"
সবেই একটান দিয়েছিলো নওরিজ সাদমান ভাইয়ের কথায় নাক মুখ কুঁচকে ধোঁয়া ছাড়ে। সিগারেট বাড়িয়ে বলে,
"আমি সিগারেট খাই না। তবে মাঝেমধ্যে দুই এক টান দিই খালি খালি লাগলে।"
সাদমান, নওরিজের হাত থেকে জলন্ত সিগারেটের শলাকা নিয়ে সুখ টান দিতে নিয়েও থেমে যায়। রমজান মাস চলছে কি না! জলন্ত শলাকা পায়ের তলায় পিষে বলে,
"বউয়ের জন্য খালি খালি লাগছে? সঙ্গেই আনতে!"
নওরিজের মানসপটে বধূ বেশে থাকা এক কিশোরীর কায়া ভাসে। মেয়েটা কি করছে এখন? নিশ্চয়ই তাঁর বিরহে উদাসী চোখে প্রহর গুনছে! সে দোকান থেকে পানির বোতল নিয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে। বোতলের গায়ে টিস্যু ঘঁষে উঁচু করে মুখে পানি নিয়ে কুলকুচি করে বলে,
"হাসপাতালে যাই। ডাক্তার কি ব্যান্ডেজ করলো একটু পরপরই রক্তে ভিজে জুবুজুবু হচ্ছে। আপনি যাবেন?"
"না রিজ। বাড়ি ফিরবো। রাতে রূপালীকে সঙ্গে করে যাবো ইনশাল্লাহ। আর ব্যান্ডেজের দোষ নয়। ইয়ু নীড প্রোপার রেস্ট রিজ। অনেকটা ব্লাড লস হয়েছে।"
নওরিজ ছোট্ট করে সম্মতি জানিয়ে চুইং গাম মুখে পুরে গাড়িতে উঠে বসে।
—————
"আম্মা আমি এখন পঁচা মেয়ে হয়ে গেছি। ওই লোকটা অনেক বাজে ভাবে ছুঁয়েছে এখানে?"
স্বীয় বুকের দিকে ইশারা করে বলে রূপসা হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে। ছামিনা বেগম কান্না ভুলে অবাক চোখে চায়। কি বলছে এসব রূপ?মেয়েটা ঘুমিয়ে ছিলো। হঠাৎ চোখ খুলে কেঁদে ওঠে। তারপর এসব প্রলাপ বকে যাচ্ছে।রেবেকা বানু, নওরিনও বিস্ময়ে হতবাক। নওরিন এগিয়ে এসে রূপসার শিয়রে বসে বলে,
"এই পিচ্চি কি সব বলছিস? কে ছুঁয়েছে? কাদিস না তোতা পাখি। মাথায় টান লাগবে। কি হয়েছে আপুকে বল?"
রূপসা ঠোঁট উল্টিয়ে ফোপায় মৃদু স্বরে। ভাঙাচোরা গলায় থেমে থেমে বলে,
"ওই ডাকাত গুলোর একজন।"
ছামিনা বেগম কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। চোখে মুখ আতংকে রক্তশূন্য। যেন এখনি হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। রেবেকা বানু কামরার দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসে। ফিসফিস শব্দে বলে,
"আস্তে কথা বলো। আর রূপ আম্মা কি করেছে ওই ডাকাত? খারাপ কিছু করে নি তো তোমার সাথে?"
"অনেক খারাপ কাজ করেছে। তাই তো রিজ ভাই ওকে জবাই করেছে।"
অবুঝ বোকা রূপসা ফ্যাচ ফ্যাচ স্বরে কেঁদে জানায়। তার অবুঝ কথার পৃষ্ঠে কতটা ভয়াবহতা চুপটি করে ওঁৎ পেতে আছে বুঝতে পারে না। রেবেকা বানুর চোখে মুখে ভয়। ছামিনা বেগম চোখে অন্ধকার দেখে। নওরিন রূপসার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজল মুছে দেয়। কোমল গলায় শুধায়,
"কি খারাপ কাজ করেছে ওই ডাকাত টা?"
রূপসার জবাব দেওয়া হয় না দরজা খটখটানোর আওয়াজে। ভেতরে প্রবেশ করে নওরিজ মাহবুব খান।
·
·
·
চলবে..........................................................................