শুরু হয়ে গেল রাধা-কৃষ্ণের বিরহ। খালু ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এল, আর মানসী চলে গেল ওদের বাসায়। ওদের বাসাটা আমাদের বাসার কাছেই ছিল কিন্তু একসাথে তো না। নতুন চাকরি, তাই দিনটা বেশ ব্যস্ততায় কেটে যেত, কিন্তু রাতগুলো কাটতে চাইত না। আজকালকার মতো মোবাইল ফোনের প্রচলন তখন ছিল না। টিএনটি ফোন অবশ্য ছিল। কিন্তু আমি ফোন করতে পারতাম না। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মানসী লুকিয়ে ফোন করত, সেই অপেক্ষায় আমাকে বসে থাকতে হতো। তারপর রাত জেগে ড্রইং রুমে বসে মশার কামড় খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলত। সারারাত কথা বলতাম। ফজরের আজান পড়লে খেয়াল হতো এবার ঘুমানো উচিত। সকালে উঠে আবার হসপিটালে যেতে হতো। সকাল হলেই আবার দুপুরের জন্য অপেক্ষা। কারণ দুপুরবেলা মানসীর ইউনিভার্সিটি শেষ হতো আর ও আমার সাথে দেখা করতে হসপিটালে আসত। মাঝে মাঝেই আমার জন্য এটা সেটা রান্না করে নিয়ে আসত। সারাদিনে ওই একবারই দেখা হতো আমাদের। যেদিন কোনো কারণে আসতে পারত না সেদিন খুব কষ্টে কাটত।
শুধু আমি না সবাই মিস করত মানসীকে। আমাদের বাসার সবার কাছের মানুষ হয়ে ছিল ও। যার যার সাথে তার তার মতো করে মিশত। ও খুব ভালো চা বানাত। বাবা ভুলে হঠাৎ হঠাৎ বলে উঠত, “আম্মু এক কাপ চা দে তো।” তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে যেত। মাও মিস করত তার রান্নার সঙ্গীকে। অনন্যা টিভি দেখা নিয়ে ঝগড়া করার মানুষ পেত না। মোনালিসাকেও নিজ হাতে খেতে শুরু করতে হলো ও চলে যাওয়ার পর।
অদ্রি কেবল কথা বলতে শুরু করেছে। দুএকটা শব্দ বলতে পারত, অনন্যাকে বলত মা আর মানসীকে বলত আম্মা। মানসী চলে যাওয়ার পর ছোট্ট সেই অদ্রিটাও খালি কাঁদত আর বলত “আম্মা দাবো” “আম্মা দাবো” মানে আম্মার কাছে যাব।
সবকিছু বদলে যায়। বদলে যায় সময়, বদলে যায় পৃথিবী। সত্যি সবকিছু বদলে গেছে। বাবা-মার চুল পেকেছে, বয়স হয়েছে। এলমেলো অনন্যাও কেমন সংসারী হয়ে গেছে। স্কুল যাওয়া মোনালিসাও পড়াশোনা শেষ করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। আবার ভালো চাকরিও করে। ছোট্ট অদ্রি কদিন পর কলেজে যাবে। ফ্যামিলিতে নতুন সদস্য হিসেবে এসেছে অৰ্পি ও দিহান।
বদলে গেছি আমিও। যেই নীরব একটা দিনও মানসীকে না দেখে থাকতে পারত না সে দিব্যি আছে বছরের পর বছর। যে নিরব মানসীর নিঃশ্বাসের শব্দ, শরীরের ঘ্রাণ না পেলে একটা রাত ঘুমাতে পারতো না সে তো ঠিকই এখন তার ছেলের মাকে জড়িয়ে রাতের পর রাত পার করে দেয়। এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব!
·
·
·
চলবে.........................................................................