দেখতে দেখতে দুটি সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু চাচ্চু আর লাইব্রেরিতে ঢোকেনি। অনেক রাতে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ এক বৃহস্পতিবার রাতে অদ্রি-অর্পি খেয়াল করল চাচ্চু সারারাত লাইব্রেরিতে কাটাচ্ছে। শুক্রবার রাত্রেও চাচ্চুকে লাইব্রেরিতে দেখা গেল। শনিবার ওরা জানতে পারল চাচ্চু অসুস্থ, কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে। ছুটির ম্যাক্সিমাম সময়টা চাচ্চু লাইব্রেরিতেই কাটাল। চাচ্চু বাসায় থাকাতে লাইব্রেরিতে যাওয়ার সাহস ওদের কারো নেই। এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে শনিবার চাচ্চু হসপিটালে গেল।
সেদিন অর্পি স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই অপেক্ষা করতে লাগল কখন সবার লাঞ্চ শেষ হবে আর ওরা লাইব্রেরিতে যাবে। দুপুরবেলা লাঞ্চের পর যখন সবাই ঘুমাতে গেল তখন অদ্রি অর্পি লাইব্রেরিতে ঢুকল। ড্রয়ার তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলল, কিন্তু কোথাও চাবি পাওয়া গেল না।
অৰ্পি বলল,
“আপ্পি, আমার কান্না পাচ্ছে। এতদিন অপেক্ষা করলাম আর এখন কিনা পড়তে পারব না!”
অদ্রি বলল,
“আরে দাঁড়া না। চাবিটা ভালোভাবে খুঁজতে হবে, হয়তো অন্য কোথাও রেখেছে।”
“যদি চাবিটা চাচ্চু সাথে করে নিয়ে যায়?”
“উঁহু। তা করবে না। চাচ্চু ভালো করেই জানে এ ঘরে কেউ আসে না। আর চাচ্চুর মধ্যে লুকোচুরিরও কিছু নেই। থাকলে চাবি প্রথম থেকে ড্রয়ারে ফেলে রাখত না। হয়তো ড্রয়ারের মতোই খুব সিম্পল কোনো জায়গায় রেখেছে, হাতের কাছেই। আমাদের জাস্ট খুঁজতে হবে।”
“আচ্ছা আপ্পি এই আলমারিটা তো টেবিলের কত কাছে, এর ড্রয়ারে রাখেনি তো?”
ওরা আলমারির ড্রয়ারে খুঁজে দেখল কিন্তু পেল না। অদ্রি বলল,
“আচ্ছা আমরা একটু আমাদের মতো করে চিন্তা করি তো, আমরা হলে চাবিটা কোথায় রাখতাম।”
অৰ্পি বলল,
“আমি তো অবশ্যই আমার ব্যাগে রাখতাম।”
“হুম, মেয়েরা সবকিছুই ব্যাগে রেখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কিন্তু ছেলেরা না।”
ওরা আস্তে আস্তে সারা ঘরের সমস্ত ড্রয়ার, বক্স সবকিছু খুঁজে ফেলল। কোথাও নেই চাবিটা। শেষমেষ পেন হোল্ডার থেকে পেনগুলো উঠাতেই চাবির ছড়াটা চোখে পড়ল অর্পির। আর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল।
ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটা হাতে নিয়েই অর্পি বলল,
“আপ্পি আমার বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে দেখ।”
“কেন?”
“যদি দেখি ডায়েরির লেখা ঐ পর্যন্তই!”
“আরে না পাগল, তাহলে চাবির জায়গা চেঞ্জ হতো না। আর চাচ্চুও এতদিন ধরে দিনরাত লাইব্রেরিতে পড়ে থাকত না। আর যদি লেখা নাও থাকে, অন্যভাবে জানার চেষ্টা করব। জানতে তো আমাদের হবেই।”
এই বলে ডায়েরিটা অর্পির হাত থেকে নিয়ে খুলল অদ্রি। একটা পাতায় মাত্র কয়েকটা লাইন। খুব ছোট্ট চিঠির মতো। সেখানে লেখা,
মানসী,
কদিন যাবৎ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তোর হাতের একটু স্পর্শ খুব দরকার। একবার শুধু একটাবার।
নীরব ইশতিয়াক
২১ এপ্রিল, ২০১৬
পৃষ্ঠা উল্টাল অৰ্পি। সেখানে অনেকটা লেখা পাওয়া গেল…
ইন্টার্নশিপের পর পরই আমাদের মেডিকেল কলেজেই আমার চাকরি হয়। খবরটা প্রথম মাকে দিয়েছিলাম। তারপর মানসীকে খুঁজতে লাগলাম
খবরটা দেয়ার জন্য। কিন্তু সারা বাড়িতেও খুঁজে পেলাম না। শেষে মাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ও ছাদে গেছে। ওর নাকি মন খারাপ। আমিও ছাদে গেলাম। মানসী আমাদের ছাদের ছোট্ট কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সূর্যটা ডুবে যাচ্ছিল, কন্যাসুন্দর আলো এসে পড়েছিল মানসীর মুখে। কী মায়া!
আমি মানসীর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমার সোনা বউটার নাকি মন খারাপ?”
মানসী আমার দিকে ফিরে বলল,
“কখন এলে?”
“এইমাত্র।”
“দুপুরে কোথায় খেয়েছ?”
“ওসব পরে হবে। আগে বল তোর মন খারাপ কেন?”
“খারাপ খবর আছে, শুনলে তোমারও মন খারাপ হবে।”
“হুম, আর আমার কাছে একটা ভালো খবর আছে, খারাপ খবরের দুঃখটা না হয় ভালো খবর দিয়ে ঢেকে দেব। বল কী হয়েছে?”
“বাবা-মা ঢাকায় আসছে।”
“ওহ এটা কোনো খারাপ খবর নাকি? আসছে আসুক। ঢাকা তো আর আমাদের একার না।”
“ফাজলামো রাখো। বাবা-মা পার্মানেন্টলি চলে আসছে। বাবা ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে। আর আমার বাবা-মা যদি ঢাকায় থাকে তাহলে তো আমাকেও তাদের সাথেই থাকতে হবে তাই না? আমি তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারি না। কখনো কি থেকেছি তোমাকে ছাড়া!”
“কবে আসছে?”
“সামনের মাসের এক তারিখ।”
আমি মানসীর মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বললাম,
“আমি সেদিন আমাদের মেডিকেল কলেজের হসপিটালে জয়েন করছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, মাত্র কটা দিন আমাদের কষ্ট করতে হবে। আমি চেষ্টা করব দুএক মাসের মধ্যেই সব গুছিয়ে নিয়ে বিয়েটা করে ফেলতে। তুই টেনশন করিস না।”
“এই সুখবরটাই কি দিতে চেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। তুই খুশি হোসনি?”
“খুব খুশি হয়েছি গো খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু তুমি এখনই চাকরি নিলে যে? কিন্তু হায়ার স্টাডিজের জন্য বাইরে যাবে না?”
“আরেব্বাস। এখনই নাকি? ওসব বুড়ো বয়সে হবে।”
“কী বলছ এসব?”
আমি এবার একটু সিরিয়াস হলাম। ওকে ছেড়ে পাশের কার্নিশে বসলাম। ওর হাতটা ধরে বললাম,
“শোন, তুই তো জানিস আমি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় কতটা সিরিয়াস ছিলাম। সেজন্যই সৌরভের বিয়ের সময় বিয়ে করতে চাইনি। তখনো পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। আমার এইম, আমার অ্যাম্বিশন, আমার ড্রিম সবকিছু। অনেক বড় ডাক্তার হবো। অনেক পড়াশোনা করব। কিন্তু এখন আর সেসব ইচ্ছে নেই। এখন মনে হয় কী হবে এসব করে?”
মানসী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমার কথা শেষ হতেই বলল, “কী হয়েছে তোমার? সত্যি করে বলো।”
“দ্যাখ, তোর কাছে লুকানোর তো কিছু নেই। বিয়ের পর আমার সবকিছু তোর দিকে কেমন ডাইভার্ট হয়ে গেছে। পড়াশোনা করতে আর ভালো লাগে না। মনে হয় টাকা আয় করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেই ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক আমাদের। কখনো এরকম ফিলিংস হতো না। আর বিয়ে হয়েছে ১ বছরও হয়নি তবু চিন্তাভাবনা কতটা পাল্টে গেছে। বিয়ের আগে অনেক বাইন্ডিংস ছিল যা বিয়ের পর আস্তে আস্তে সরে গেল। আর তারপর থেকেই আমার তোর প্রতি দায়িত্ববোধ বেড়ে গেল। এখন তো শুধু একটাই চিন্তা কবে সবাইকে জানিয়ে আবার তোকে বিয়ে করতে পারব। কবে তুলতুল আসবে আমাদের মাঝে। সেজন্যই তো এত তাড়াতাড়ি চাকরি নিলাম। চাকরির কথা শুনে মা খুব একটা খুশি হয়নি। মা বলছিল হায়ার স্টাডিজের জন্য বাইরে যেতে। কিন্তু আমি মাকে বোঝাতে পেরেছি। আর আমার এই চাকরিটা তো খারাপ না। যেখান থেকে পড়াশোনা করে সেখানে চাকরি করার ভাগ্য কয়জনের হয় বলত?”
মানসী কোনো কথা বলছিল না। চুপ করে আমার কথা শুনছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কিরে চুপ করে আছিস কেন?”
“কোনো মানুষ কি তার বউকে এতটা ভালোবাসতে পারে?”
মানসীর গলা কাঁপছিল। চোখে পানি। আমি ওর হাত ধরে টেনে আমার পাশ থেকে সামনে নিয়ে এলাম। ওর দুটো হাত ধরে বললাম,
“চোখে পানি এনেছিস ভালো কথা। কিন্তু কাঁদিস না। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।”
মানসী এবার খুব শক্ত হয়ে বলল,
“নীরবদা শোনো, তুমি একটু আগে যে অলক্ষুনে কথাগুলো বলছিলে ওগুলো আমি আর কক্ষনো শুনতে চাই না। চাকরিটা তুমি করবে না। বাইরে চলে যাও পড়তে। ততদিনে আমার পড়াশোনাও শেষ হয়ে যাবে। তারপর নাহয় আমাদের বিয়ে হবে।”
আমি হেসে বললাম,
“কেন রে? হাতুরে ডাক্তার স্বামী দিয়ে চলবে না? এদেশে কত মানুষ শুধু এমবিবিএস দিয়ে ডাক্তারি করছে না?”
“তোমার কোয়ালিফিকেশন দেখে তো তোমাকে ভালোবাসিনি। তাই তুমি যেমনই হও আমার তাতেই চলবে। বরং অন্য আর কাউকে দিয়ে চলবে না। কিন্তু তুমি যা বললে তাতে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে তোমার এই অবস্থার জন্য একমাত্র আমি দায়ী। কিন্তু আমি তো এমন ভালোবাসা তোমার কাছে চাইনি। তোমার আমাকে এত ভালোবাসা লাগবে না। তুমি নিজেকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নাও। আমি কখনো চাইনি আমার ভালোবাসায় বা আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে তোমার কোনো অবনতি হোক। আমাকে ছুঁয়ে বলো তুমি আরো পড়াশোনা করবে। অনেক বড় ডাক্তার হবে।”
“তোর ডায়ালগটা কিন্তু বাংলা সিনেমাকেও হার মানায়।”
মানসী বিরক্ত হয়ে আমার হাত ছেড়ে দিতে চাইল। কিন্তু পারল না, আমি ওর হাত দুটো ছেড়ে কোমর ধরে ওকে কাছে টেনে আনলাম। বললাম,
“আচ্ছা তোর সব কথা রাখব। কিন্তু এখন না। তার চেয়ে তুই গ্রাজুয়েশনটা শেষ কর ততদিন আমি এই চাকরিটাই করি। তারপর তোকে নিয়েই বাইরে চলে যাব।”
“আমার যাওয়ার কথা আসছে কেন?”
“গত ১২/১৩ বছর একসাথে আছি। তুই যখন বাবা মায়ের কাছে গেছিস বড়জোর এক সপ্তাহ আলাদা থেকেছি। তারপর তো ঠিকই ফিরে এসেছিস। এখন আর তোকে ছেড়ে থাকতে পারব না।”
“ইশ ঢং কত! সারাদিন তো থাকো বাইরে! আমার কাছে তো আর থাকো না।”
“সারাদিন বাইরে থাকলেও রাতে এসে তোর মুখটা দেখতে তো পারি। সারারাত তোকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে তো পারি।”
মানসী আবার মন খারাপ করে বলল,
“১ তারিখ থেকে তো সেটাও পারবে না।”
“হ্যাঁ, তবে সেটা মাত্র কিছুদিনের জন্য। জাস্ট ১/২ মাস তার মধ্যে তোর বাবাকে পটিয়ে তোকে বিয়ে করে নিয়ে আসব দেখিস!”
“ও আর এটা বুঝি বাংলা সিনেমার ডায়ালগ হলো না?”
তারপর আমরা দুজনেই হেসে দিলাম। আমি বললাম,
“তোর বাপ বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেব টাইপ হলে আমি আর কী বলব বল!”
“কী বললে তুমি? আমার বাবা চৌধুরী সাহেব টাইপ?”
মানসী আমাকে মারতে এল। কিন্তু তার আগেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর বললাম,
“সত্যি তোকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে। এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে যে তোর নিঃশ্বাসের শব্দ, চুলের ঘ্রাণ, আর শরীরের স্পর্শ না পেলে ঘুম আসে না আমার। এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।”
মানসী আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার এই শক্ত মানুষটা এত নড়বড়ে হয়ে গেল কী করে?”
“জানি না। তবে…
“তবে কী?”
“আমার ভয় করে।”
মানসী আমাকে ছেড়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের ভয়?”
“তোকে হারানোর ভয়।”
“কেন? আমি তো তোমারই।”
“তোর বাবা যদি না মানে? তোর বাবা যদি অন্য কারো সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেয়! এই একটাই ভয় আমার। সেজন্যও এখন কোথাও যেতে চাচ্ছি না। পড়তে গেলে তো হুট করে চলে আসতেও পারব না।”
“কী যে বলো না! তোমার যত আজেবাজে চিন্তা। মাত্র তো ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এখনই বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চাইবে কেন?”
“জানি না। শুধু জানি আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না। মানসী আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমি বুঝি পারব তোমাকে ছাড়া থাকতে? কক্ষনো পারব না।”
আমি ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে আরো শক্ত করে ধরে রইলাম। যেন এক্ষুনি কেউ নিয়ে যাবে।
·
·
·
চলবে........................................................................