এক হাজার টাকা - পর্ব ২৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


সেদিন রাতে আদনানের যে পরিমাণ মন খারাপ ছিল তা আর পরে রইলো না। সে খুব হাসিখুশি মনেই আমার সাথে ঘুরে বেড়াতে লাগলো৷ আমরা প্রতিদিন দেখা করি। সারা ঢাকা চষে বেড়াই। আমাদের বাসার কাছেই বেড়িবাঁধ। একদিন সেখানে গেলাম নৌকা চড়তে। পানিতে পা ডু বিয়ে বসেছে আদনান। আমি বসেছি নৌকার গুলুইতে। সে আমাকে ফিসফিসিয়ে ডাকলো,
"তিন্নি..."

একজন ফিসফিসিয়ে কথা বললে সাথের জনও আপনাআপনি ফিসফিসিয়ে কথা বলে। এটা বোধহয় কোনো অঘোষিত নিয়ম। আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম,
"বলো।"

"আমার হোটেলে যাবে?"

আমি চমকে তাকালাম ওর দিকে। ওর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। আমি বললাম,
"হোটেলে যাব কেন?"

ও হেসে বলল,
"আমার তো আর এখানে বাড়িঘর নেই। যেহেতু হোটেলে থাকি সেহেতু হোটেলের কথা বলেছি।"

আমি ঢোক গিলে বললাম,
"কিন্তু এটা কেমন দেখায় না?"

"কেমন দেখায়? আমরা তো বিবাহিত। আমরা একে অপরের সাথে কিছু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে পারি না?"

ও পাশে এসে বসে আমার হাত ধরলো। জানিনা ও কীভাবে আমার হাতটা ধরলো, আমার রাজি হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে! আমার মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে না গেলে আমার এই মানবজীবন বৃথা। ও আবার জিজ্ঞেস করল,
"যাবে না?"

"যাব।"

ও হেসে ফেলল। আমি জানতে চাইলাম,
"হাসছো কেন?"

ও আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল,
"ভেবে বলছো তো? পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না যে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছি?"

"না দোষ দেব না। ভেবেই বলছি। যাব।"

কথায় কথায় আমরা হিসেব করে বের করলাম ও যে বছর এসএসসি দিয়েছে আমি সে বছর ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমি বললাম,
"আচ্ছা আমরা কি স্কুলে কখনো কেউ কাউকে দেখেছি?"

আদনান হেসে বলল,
"কি জানি! হয়তো দেখেছি... হয়তো দেখিনি।"

"আমার ভাবতেই অবাক লাগে আমরা এক স্কুলে পড়েছি। প্রতিদিন হয়তো একজন আরেকজনকে দেখেছি। ইশ কেন তখন পরিচয় হলো না? কেন তখন প্রেম হলো না? কতবছর একসাথে থাকতে পারতাম।"

আদনান হেসে দিল। আমি অভিমানের সুরে বললাম,
"হাসছো কেন?"

"তখনকার আদনানের কথা ভাবছি। প্রেম কী তাই জানতো না সে তখন।"

"তখনকার আদনান কেমন ছিল?"

"খুব জেদি ছিল।"

"এখনকার আদনান জেদি নয়?"

"না।"

"সত্যি?"

"সত্যি।"

আমি ভ্রু কুঁ চকে বললাম,
"কিন্তু যারা জেদি তারা তো আজীবন জেদিই থাকে।"

"বোঝাতে পারিনি বোধহয়। মানে তখনকার আদনানের কিছু ব্যাপারে জেদ কাজ করতো। তারমধ্যে কিছু করে দেখানোর জেদ কাজ করতো। এখনকার আদনান তো একজন সুখী মানুষ। জীবনে যা যা করতে চেয়েছিল তার সবকিছুই করেছে।"

"এবার বুঝেছি। আচ্ছা সেই আদনান কী কী জেদ করতো?"

আদনানের মুখে মৃদু হাসি। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলো,
"সেই আদনানের অনেক জেদ ছিল।"

"যেমন?"

"এই যেমন সে বোনের বাসায় থাকবে না। দুলাভাইয়ের টাকায় স্কুলের বেতন দেবে না। দুলাভাইয়ের টাকায় খাবে না। কতবার যে বাসা থেকে পালিয়ে গেছে সেই ছোট ছেলেটা! তারপর একসময় পেটের ক্ষুধায় ফিরে আসতে হয়েছে। সেই দুলাভাইয়ের টাকাতেই বসে বসে খেতে হয়েছে। সেই ছোট জেদি ছেলেটার জন্য এটা একটা বড় হার ছিল। পৃথিবীতে এই প্রথম কেউ জানলো আদনান বারবার কেন পালাতো। মাঝেমাঝে খুব অবাক লাগে, তোমাকে আমি অনেক কথাই কেমন অনায়াসে বলে ফেলি তিন্নি যা আর কাউকেই বলতে পারি না। সে কারণেই বোধহয় তোমাকে সারাজীবনের জন্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।"

আমার চোখে জল এসে গেল। আমি যদি এখন কাঁদি আদনানের বাকি কথা শোনা হবে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলাম,
"আদনান তুমি অনেকবার বলেছো আপার বাসায় থাকতে চাইতে না। কারণটা বলোনি। আজ বলবে প্লিজ? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। সবই যখন বলছো এটাও বলো।"

"সব বলছি না। অনেক কথাই বলি তবে তা আমার ভেতরকার ১০% ও না। তবে আমি ইদানীং চেষ্টা করি তোমাকে অনেক কিছু বলার। যাতে তুমি আমাকে বুঝতে পারো। যেটা জানতে চাচ্ছো সেটা বলার মত কোনো কথা না হয়তো। তবু তোমার যখন জানতে ইচ্ছে করছে বলি, না হয় আবার ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে।"

আমি নিশ্চুপ হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আদনান একটু সময় নিয়ে বলল,
"আমি ওখানে থাকতাম বলে আপা দুলাভাইয়ের মধ্যে অনেক সমস্যা হতো। দুলাভাই চাইতো না আমি থাকি কারণ আমি থাকলে ওদের প্রাইভেসি নষ্ট হতো। কিন্তু আপা আমাকে নিজের কাছে রাখবেই। প্রচুর ঝগড়া হতো ওদের। মাঝেমাঝেই ঝগড়ার এক পর্যায়ে দুলাভাই আপাকে মারতো। একদিন মারামারির এক পর্যায়ে আপা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কেবল দেখলাম রক্তে ভেসে যাচ্ছে আমার আপা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে জানতে পারলাম আপার পেটে বাচ্চা ছিল। মিসকারেজ হয়ে গেছে। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। আর কেউ না, কেবল আমার এই বোনটা আমার জন্য কত স্যাকরিফাইস করেছে যা বলতে গেলে দিন ফুরিয়ে যাবে। অথচ আমার আরও ৭ জন ভাইবোন ছিল। কেউ ফিরেও তাকায়নি৷ কোনো ঈদে একটা কাপড় দেয়নি। একবেলা খাওয়ানি। স্কুলের বেতন দেয়নি। একটা বই কিনে দেয়নি। সব করেছে এই পাগল বোনটা।"

আপার কথা শুনতে শুনতে কখন যে আমি কাঁদতে শুরু করেছি আমি নিজেও জানি না। আপাকে যতটা ভালো লেগেছিল তারচেয়ে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেললাম এসব জেনে। আদনান আমাকে কাঁদতে দেখে আমার গালে হাত রেখে বলল,
"আরে মেয়ে তুমি কেন কাঁদছো?"

আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,
"যে বোনটা তোমার জন্য এত করলো তুমি তার থেকে এতদূরে কীভাবে থাকো আদনান! ৮ বছরে তুমি এই বোনের কাছে একবারও আসোনি! আমার ভাবতেই অবাক লাগছে!"

"আপাকে ভালো রাখতেই আপার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। আপা ওর স্বামীকে কখনোই ছাড়তে পারবে না। তাই শুধু শুধু আমাকে নিয়ে অশান্তি না হোক। ওরা সুখে থাকুক এটাই চেয়েছি।"

"কলেজে উঠে তো আর তুমি ওদের কাছে থাকতে না তাহলে সমস্যা কোথায়?"

"আপার বাচ্চাটা নষ্ট হওয়ার পর থেকে এই ঘটনার জন্য দুলাভাই আমাকেই দায়ী করতো। আপা আমার সাথে দেখা করুক তাও চাইতো না। অথচ আমার পাগল বোন তো প্রতি সপ্তাহেই ছুটে আসতো আমার সাথে দেখা করতে। আমি মানা করলে আপা উলটো কষ্ট পেত। আপা দেখা করতে এসেছিল জানতে পারলেও সে আপাকে মারতো। ভাবতো আপা বুঝি আমাকে তার পকেট মেরে টাকা দেয়! আমি ভাবতাম, আমি দূরে গেলে আপার এই সমস্যা মিটবে। মিটেছেও।"

আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছি আদনানের দিকে। একটা মানুষকে বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। এতদিন কল্পনাও করিনি আদনানের আপার থেকে দূরে থাকার এমন কোনো কারণ থাকতে পারে। আদনান আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
"পাগলের মত কাঁদছে দেখো মেয়েটা! কান্না বন্ধ করো তো।"

দুলাভাইয়ের উপর আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল। তাই আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম,
"আদনান তোমার রাগ নেই?"

"প্রত্যেক মানুষের রাগ আছে। শুধু রাগের প্রকাশভঙ্গি আলাদা। অবশ্যই আমারও সবার মত রাগ আছে। তবে অন্য সব অনুভূতির মতই প্রকাশ করতে পারি না।"

"যদি কোনো নির্দিষ্ট মানুষের উপর খুহ রাগ হয় তাহলে কী করো?"

আপনারা বুঝতে পারছেন কিছু? কমলের কথা মনে পড়েছে। তাই আদনান আমার উপর রেগে গেলে কী করতে পারে সেটা ধারণা করার চেষ্টা করছি। আদনান বলল,
"আমার রাগ হলে সাধারণত মাথায় পানি ঢালি কিংবা গোসল করে ফেলি। এতে রাগ কমে যায়। আর কোনো নির্দিষ্ট মানুষের উপর রাগ হলে রাগ না কমা পর্যন্ত তার থেকে দূরে থাকি। এই যেমন দুলাভাইয়ের উপর এত রাগ হয়ে ছিল যে আজ অবধি তার সামনে আর যাইনি।"

"কিন্তু যদি রাগের কারণটা নিয়ে ওই মানুষটার সাথে কথা বলা জরুরি হয়ে থাকে?"

"তাহলে রাগ কমে যাওয়ার পর কথা বলি। তোমার সাথে রাগ হলে কী করব সেটা নিয়ে ভয়ে আছো?"

আমি লজ্জা পেয়ে হাসলাম। তারপর বললাম,
"রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক না। আমি সবসময় ভুলভাল কাজ করি।"

"সেটা কি আমাকে বলে বোঝাতে হবে? সব মানুষ কি পারফেক্ট হয় তিন্নি? তুমি এমন জেনেই তো তোমাকে ভালোবেসেছি। সামলাতে না পারলে তো ভালোবাসতাম না।"

আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠলো ওর এই কথাগুলোয়। এই তবে ভালোবাসা! উবারের গাড়িটা যখন আমার বাসার দিকে যাচ্ছিল আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
"আমার বাসার দিকে যাচ্ছি যে? আমরা তোমার হোটেলে যাচ্ছি না?"

ও হেসে বলল,
"না।"

"কেন?"

আমি অবাক হলাম! ও বলল,
"ওরকম কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই তিন্নি। শুধু দেখছিলাম আমার ক্ষমতা কতটুকু। তোমাকে রাজী করাতে পারি কি না। আমি কখনোই এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে তোমার সান্নিধ্য চাই না। আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, আপাতত এটাই আমার অনেক বড় প্রাপ্তি।"

সত্যি বলতে আমি নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছিলাম। এখন এ কথা শুনে মন খারাপ হচ্ছে। নিশ্চয়ই আদনানেরও বিয়ের রাতে এমনই মন খারাপ হয়েছিল!
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp