মেহুল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল। মেহুলের চোখের জল দেখে যেন আকাশটাও কেঁদে উঠলো তৎক্ষণাৎ। হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। ভিজিয়ে দেয় পুরো শহর, ভিজিয়ে দেয় মেহুলের শুকনো শরীরটা। তার খোলা চুল ভিজে গেছে, সেখান থেকে টুপটাপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে ছাদের মেঝেতে। মেহুলের চোখের জল আর বৃষ্টির পানি মিলে মিশে একাকার। মনে হচ্ছে বৃষ্টি যেন তার চোখের নোনা জলকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। মেহুল হঠাৎই ধপ করে নিচ বসে পড়ে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে—শুধু একটাই শব্দ ঘুরে ফিরে বাজছে মনে “ভুল”। শব্দটা হয়তো ছোট, কিন্তু মেহুলের কাছে যেন হাজার মণ ভারী লাগছে। কীভাবে শেরাজ ভাই এত সহজে সব কিছু ভুল বলে দিল? কীভাবে? মেহুল শব্দ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে, আকাশের দিকে তাকায়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কিন্তু বাজ পড়ে না। মেহুল অপেক্ষায় রয় একটা বজ্রপাতের, যেন সেই বজ্রপাতের গর্জনের সঙ্গে সবার আগোচরে প্রাণভরে একটা চিৎকার করে মনের সব দুঃখ ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে। কিন্তু প্রকৃতি তার ইচ্ছার বিরোধিতা করল যেন। পড়লো না বজ্রপাত বরং ধীরে ধীরে বৃষ্টির গতি কমে আসতে শুরু করল।
—————
শেরাজ নিজের রুমে পায়চারী করছে। স্থির থাকতে পারছে না কিছুতেই। একবার সোফায় বসছে তো কখন আবার উঠে গিয়ে বসছে বেডে। মাঝে মাঝে খামচে ধরছে মাথার চুল, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরছে হাতের নখ।
তার শরীর কিছু একটা চাইছে—ভীষণ করে চাইছে। শেরাজ সেই চাওয়াটাকে বারবার থমিয়ে রাখছে, কিন্তু আর পারছে না। চাহিদাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসছে বারবার তার নিকটে। শেরাজের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখ-মুখ অদ্ভুত রকমের হয়ে উঠেছে। এখন যে কেউ দেখলে হয়তো ভয় পেয়ে যাবে।
শেষমেষ শেরাজ নিজেকে আর সামলাতে না পেরে, আলমারি খুলে ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে আনে। সেন্টার টেবিলের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে তড়িঘড়ি করে। প্যাকেট থেকে সাদা পাউডার জাতীয় কিছু একটা রাখে কাচের ওপর। চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে—নাক দিয়ে টানতে নিবে ঠিক তখনই থেমে যায়। মেহুল। মেহুল কি এখনও ছাদে? এই একটা মাত্র চিন্তা মস্তিষ্কে আঘাত আনতেই তার শরীরের সমস্ত চাহিদা মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। শেরাজ সটান উঠে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু না ভেবেই হুড়মুড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে চলে যায়। পড়ে রইল সেন্টার টেবিলের উপর রাখা সাদা পাউডারটা।
—————
শেরাজ ছাদে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু কোথাও মেহুল নেই। চারপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজে, কিন্তু মেয়েটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হঠাৎই খুব নিচু স্বরে কারো গুঙানোর শব্দ ভেসে আসে। শেরাজ পেছন ফিরে তাকায়। ছাদের একপাশে চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে লেপ্টে বসে আছে মেহুল—শীতে কাঁপছে মেয়েটা। মেহুলের এই অবস্থা দেখে শেরাজের বুকের ভেতরটা চিপা দিয়ে উঠে। শেরাজ আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড়ে গিয়ে মেহুলের পাশে বসে পড়ে। মুখে হাত রেখে ভয়ার্ত কণ্ঠে ডাকে।
"মেহুল!"
মেহুলের সাড়া নেই তার শরীর ঠান্ডায় জমে গেছে। শেরাজ আর দেরি না করে মেহুলকে কোলে তুলে নিতেই শব্দ করে নিচে কিছু একটা পড়ে যায়। মেহুলের চশমাটা নিচে পড়ে গেছে। শেরাজ চশমাটা তুলে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার করে ডাকে, "ইফা!"
ভাইয়ের চিৎকার শুনে ইফা দরজা খুলে বের হয়। ভাইয়ের কোলে অচেতন মেহুলকে দেখে মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে, "কি হয়েছে ভাইয়া?"
কোনো জবাব না দিয়ে শেরাজ মেহুলকে নিয়ে ঢুকে পড়ে মেহুলের ঘরে। চেয়ারে বসিয়ে দেয় মেয়েটাকে। পেছন পেছন ইফাও ঘরে ঢোকে। শেরাজ বোনের দিকে তাকিয়ে আদেশ দেয়, "ইফা, জলদি ওর গা থেকে ভেজা কাপড় খুলে শুকনো কাপড় পরা।"
ইফা একটু থেমে বলে, "কিন্তু এসব হলো কি করে ভাইয়া?"
শেরাজ রেগে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে, "যেটা বলছি সেটা কর, এতো প্রশ্ন না করে!"
ভাইয়ের এমন রূঢ় কণ্ঠে ইফা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। শেরাজ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার চিৎকার শুনে শাহানা বেগম আর আকলিমা ছুটে আসে নিচ থেকে। ছেলেকে মেহুলের ঘরের সামনে দেখে শাহানা বেগম জিজ্ঞেস করে, "রাজ, কি হয়েছে বাবা? এভাবে চিৎকার করছিস কেন? তোর দাদাভাই তো ঘুমাচ্ছে নাকি!"
কোনো কথা না বলে শেরাজ সোজা নিজের রুমে চলে যায়। ছেলের আচরণে অবাক হয়ে যায় শাহানা বেগম। হলো কি হঠাৎ ছেলের? মেহুলের বিয়ে হবে বলে কি রেগে আছে নাকি, কিন্তু ছেলেই তো নিজ থেকে বিয়ের সব দায়িত্ব নিলো তাহলে? আকলিমা বলে, "মনে হচ্ছে মেহুল আপার কিছু হইছে।"
বলে দ্রুত ঘরে ঢুকে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁত কামড়ে শাহানা বেগম বিড়বিড় করে বলে, "এর জন্য আমার ছেলেটা সবসময় বিপদে পড়ে। কবে বিদায় হবে এই আপদ এই বাড়ি থেকে?"
শাহানা বেগম এক নজর মেহুলকে দেখে চলে যান। আকলিমা আর ইফা মিলে মেহুলের ভেজা কাপড় পাল্টে দিয়ে মেহুলকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মেহুলের ভেজা চুল শুকিয়ে দিয়েছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে। আপাতত মেহুলের শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু মেয়েটা এখনো অচেতন। কোনো সাড়া নেই।
আকলিমা নিচু গলায় বলে, "ইফা আপা, মেহুল আপার এই অবস্থা হলো কী করে?"
ইফা ধীর গলায় জবাব দেয়, "জানি না… হয়তো বিয়ের খবরটা শুনে কষ্ট পেয়ে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে। ভাইয়া দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছে বোধ হয়।"
আকলিমা দুঃখী গলায় বলে, "ইস কষ্ট লাগছে মেহুল আপার জন্য। সবসময় খালি দুঃখ পেয়ে এসেছে মেহুল আপা।"
ইফা বিরক্ত হয়ে বলে, "উফ চুপ করো তো, এই সময় এসব না বললে চলে না তোমার!"
আকলিমা একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি আজ রাতে মেহুল আপার সাথেই থাকবা?"
"হুম, মেয়েটার যদি রাতে জ্বর আসে তখন কে দেখবে? তাই ওর সাথে থাকব রাতটা। দাদাভাই ঘুমিয়ে গেছে ভালো হয়েছে। মেহুলের এই অবস্থা দেখলে দাদাভাই টেনশন করত।"
হঠাৎ মেহুল ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে শুরু করে। ইফা এগিয়ে গিয়ে মেহুলের মাথার পাশে বসে, মেহুলের কপালে হাত রেখে নরম গলায় বলে, "মেহুল… কোথায় কষ্ট হচ্ছে বোন?"
মেহুল কিছু একটা অস্পষ্টভাবে বলে যাচ্ছে। ইফা মাথাটা নুইয়ে কানটা মেহুলর মুখের কাছে নিয়ে শোনে, "মা… বাবা… কোথায় তোমরা…? তোমাদের মেহু ভালো নেই… একটুও ভালো নেই…"
কথাটা শুনে ইফা সোজা হয়ে বসে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। কতটা কষ্ট পেলে একটা মানুষ ঘুমের মধ্যেও এই কথা গুলো বলে? কিন্তু সামান্য বিয়ের খবর শুনে এতটা কষ্ট পাবে এটা যেন ইফা মানতে পারছে না কিছু তো একটা ঘটেছে কিন্তু কি? ইফা আপন মনে বলে উঠে।
"ভাইয়া আর মেহুলের মাঝে কিছু কি চলছে? কিন্তু তা কি করে হয় ভাইয়া নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়েছে মেহুলের বিয়ের সমস্ত কিছুর। ভালোবেসে থাকলে কি ভালোবাসার মানুষটার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিজে থেকে কেউ আগ বাড়িয়ে নেয়? কি যে হচ্ছে এই বাড়িতে এক আল্লাহ ভালো জানেন।"
—————
সকাল হয়ে গেছে। মেহুলের শরীরে জ্বর আসে নি রাতে। তবে গা হালকা গরম হয়েছিল। কিন্তু তেমন গুরুতর কিছু হয় নি। শেরাজ যে মেহুলকে রাতে ঘরে দিয়ে নিজের গিয়ে ঢুকেছে তারপর আর একবারের জন্যও নিজের রুম থেকে বের হয় নি। ডাকা হলেও কোনো সাড়া দেয় নি। ঘড়িতে এখন বাজে সকাল সাড়ে নয়টা। মেহুল আধশোয়া হয়ে বসে আছে বিছানায়। তার পাশেই বসে আছেন আতাউর মির্জা। সকালে ঘুম থেকে উঠে এই খবর শোনার পরপরই তিনি চলে এসেছেন নাতনির ঘরে। ইফা মেহুলকে চামচে করে ভেজিটেবল স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। মেহুল কয়েক চামচ খাওয়ার পর মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলল, "আর খাবো না।"
ইফা চোখ গরম করে বলে, "উমম... চুপচাপ সবটা শেষ কর। সারা রাত সেবা করছি। এরপর যদি আবার অসুস্থ হোস তাহলে সেবা তো দূরের কথা, দেখতে পর্যন্ত আসব না।"
আতাউর মির্জা স্নেহ ভরা কণ্ঠে বলেন, "খেয়ে নাও নানাভাই, শরীরের বল পাবে।"
মেহুল নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "তুমি খেয়েছো নানাভাই?"
তিনি মাথা নেড়ে বলেন, "হ্যাঁ, খেয়েছি। তুমি খেয়ে শেষ করো। পরে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে আমার।"
মেহুল টের বুঝতে পারছে নানাভাই কি বলবে তাই আর কোনো প্রশ্ন করে না। মেহুলের খাওয়া শেষ এখন রুমে শুধু মেহুল আর আতাউর মির্জা আছেন। তিনি নীরব, চুপচাপ বসে আছেন।
মেহুল একটু হাসি মুখে বলে, "কি হলো নানাভাই? বলো, কী বলবে?"
আতাউর মির্জা নাতনির মুখের দিকে তাকান। মেহুল মুচকি হেসে বলে, "আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে, তাই না?"
আতাউর মির্জা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, "তুমি তো জানো, নানাভাইয়ের বয়স হয়েছে। যেকোনো সময় ডাক আসতে পারে ওপর থেকে। তাই আমি চাই আমার মৃত্যুর আগে অন্তত তোমায় একটা ভালো জায়গাতে বিয়ে দিয়ে শান্তিতে মরতে। তোমার বাবারও ইচ্ছে ছিল, আসিফের সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক।"
একটু থেমে কণ্ঠটা ভারী করে বললেন, "কিন্তু সেই ইচ্ছেটা পূরণ হওয়ার আগেই..."
নানাভাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহুল রূঢ় গলায় বলে ওঠে, "আমি আসিফ ভাইকে বিয়ে করতে রাজি আছি নানাভাই। তুমি যাকে বলবে আমি তাকেই বিয়ে করব। আমি এই বাড়ি থেকে চলে যেতে চাই... থাকতে চাই না আর এখানে।"
বলেই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে নানাভাইয়ের বুকে। আতাউর মির্জা এক মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে যান নাতনির এমন আচরণে। মেহুল কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, "বাবার ইচ্ছা পূরণ করব আমি, নানাভাই। খুব তাড়াতাড়ি করব। তুমি প্লিজ, যত তাড়াতাড়ি পারো, বিয়ের ব্যবস্থা করো।"
আতাউর মির্জা কোনো কথা বলেন না। শুধু নীরবে নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। আতাউর মির্জা নাতনিকে বিশ্রাম নিতে বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যান। মেহুল বিছানায় শুয়ে আছে। তার গলা ভার, বুকের ভেতরটা হাঁসফাঁস করছে। বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে, আবেগ চেপে রাখতে পারছে না। মনেই মনে ফিসফিস করে বলে।
"তোমার ইচ্ছা পূরণ করব আমি, শেরাজ ভাই। তোমার ‘ভুল’—আমি সংশোধন করব। তোমার চোখের সামনেই আমি অন্য কারোর হবো।"
চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল, ভিজিয়ে দেয় বালিশের কোণা। মেহুল চোখ বন্ধ করে আবার নিজেই নিজেকে বলে।
"মনের অজান্তেই তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি, শেরাজ ভাই।
তুমি ড্রা গ নাও, মানুষ খু ন করো—সব জেনেও ভালোবেসেছি তোমার মতো এক ভয়ংকর পুরুষকে আমি। ভেবেছিলাম, তুমিও বুঝি আমায় ভালোবাসো...কিন্তু আমি ভুল। তুমি আমায় ভালোবাসোনি শেরাজ ভাই একটুও ভালোবাসো নি।"
—————
শেরাজ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। শরীর উদাম, কোমর পর্যন্ত ঢাকা কম্বলে। কপালে ছড়িয়ে আছে এলোমেলো চুল, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ক্লান্তি আর অস্থিরতায়। ডান হাতের আঙুল দ্বারা সাদা রঙের ব্লুটুথটা কান থেকে খুলে বেডের ওপর রেখে বিড়বিড় করে বলে।
"এত সহজে তুই এই বাড়ি থেকে বের হতে পারবি না মেহুল। এক মাত্র তোর মৃত্যুই পারবে এই বাড়ি থেকে বের করতে। তুই এই বাড়িতেই থাকবি আর আমার কাছেই থাকবি সারাটা জীবন।"
শেরাজ মাথার পাশে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে তোলে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দ্বারা ফোনের লক খুলতেই ভেসে ওঠে মেহুলের ছবি। শেরাজ চেয়েছিলো মেহুল যেন বিয়েতে রাজি হোক। আর ঠিক সেটাই হলো। শেরাজ মেহুলে ছবিটার উপর বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলে।
"কোনো মাঙ্গের নাতি আইসা তোরে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারব না। তুই আমার হবি মেহুল শুধুই আমার আর কারোর না। তোর জন্ম শুধুই আমার জন্য।"
শেরাজ চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় ধীরে ধীরে। ফোনটা হাত থেকে পিছলে পড়ে পাশে। এখন শুধু অপেক্ষা—মেহুলের বিয়ের দিন।
—————
মেহুলের বিয়ের তোড়জোড় পুরা দমে চলছে। বিয়ের কার্ড থেকে শুরু করে বিয়ের সব কেনাকাটা প্রায় সব শেষ। কিন্তু এসবের মধ্যে মেহুল যত শেরাজকে দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। সেই দিনের হঠাৎ ঘটে যাওয়া মুহূর্তটা দুজনের চুম্বনের ঘটনাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না অথচ শেরাজ কী নিখুঁতভাবে, নিঃসংকোচে তার বিয়ের সব দায়িত্ব পালন করছে! একেই বলে হয়তো বেডা মানুষ। কত সহজে সবটা ভুলে গেলো। মাঝে মাঝে মেহুলের ইচ্ছা করে শেরাজের গালে ঠাটিয়ে চড় মেরে সবটা মনে করিয়ে দিতে। কিন্তু আদৌ কি এটা সম্ভব শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া।
মেহুল ভার্সিটি এসেছে। সবাইকে তার বিয়ের দাওয়াত দিতে। কলি, ইকরা আর লামিয়া প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় নি মেহুলের মুখে বিয়ের কথাটা শুনে। ভেবেছে মেহুল তাদের সাথে মজা করছে। কিন্তু মেহুল যখন ওদের হাতে বিয়ের কার্ডটা ধরিয়ে দিল তখন তিনজনেই অবাক হয়ে যায়। তিনজনেই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। বান্ধবী যে এত জলদি বিয়ের করবে তাদের সেটা কল্পনার বাইরে ছিলো।
মেহুল ভার্সিটিতে বেশিক্ষণ থাকে নি। আপনজনদের বিয়ের কার্ড দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভার্সিটি থেকে। মেহুল একটা সিএনজিতে উঠে বসে। কিছুদূর যেতেই একটা ছেলেও উঠে বসে সিএনজিতে। মুখে মাস্ক, চোখে অদ্ভুত ঠাণ্ডা চাহনি। মেহুল ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছেলেটার দিকে, ছেলেটাকে কোথায় যেন দেখেছে সে কিন্তু মনে করতে পারছে না ঠিক।
ছেলেটা হঠাৎ করে নিজেই বলে উঠে, "চিনতে পারছেন না নিশ্চয় আমায়? মাস্কটা খুললেই চিনে ফেলবেন এক সেকেন্ডে।"
বলেই মাস্কটা খুলে ফেলে সে। চেহারা দেখা মাত্রই মেহুল চিনে ফেলে। ওই দিনের সেই ছেলেটা যেই ছেলেটা তাকে পানি খেতে বলেছিলো কিন্তু সে খায় নি। আজও ছেলেটার হাতে একটা পানির বোতল।
ছেলেটা নিজ থেকেই হালকা হেসথ লল, "শুনলাম, আপনার নাকি বিয়ে?"
মেহুল সংক্ষেপে জবাব দিল, "হুম।"
ছেলেটা একটু নড়েচড়ে বসে বলল, "তাই নাকি? তাহলে আমায় বিয়ের দাওয়াত দিবেন না?"
মেহুল ভ্রু কুঁচকে তাকাল, "আপনি কে? আমি তো আপনাকে চিনি না তাহলে আপনাকে কেন দাওয়াত দিতে যাব?"
ছেলেটা হেসে বলল, "ও চিনেন না বলে বিয়ের দাওয়াত দিবেন না আমায়। তাহলে চলুন পরিচিত হই। আমি মুঈন আহমেদ। আপনার ভার্সিটিতেই অধ্যায়নরত আছি। পড়ালেখার পাশাপাশি আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। আর কি কি জানতে চান বলুন?"
মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলল, "কই, আপনাকে তো কখনো ভার্সিটিতে দেখি নি?"
মুঈনের গলায় রহস্যময় সুর, "আপনি মন দিয়ে দেখতে চান নি, তাই দেখতে পান নি। তবে এখন তো দেখতে পাচ্ছেন।"
মেহুল বাইরে দিকে তাকাতেই চমকে উঠে। এটা কোন রাস্তা? বাড়ির রাস্তা তো এটা নয়। মেহুল হতবিহ্বল হয়ে সিএনজি চালককে জিজ্ঞেস করল, "কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি আমায়? এটা তো আলম রোডের রাস্তা নয়!"
মুইন ঠাণ্ডা গলায় বলল, "আপনি উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হয়ে বসুন। ওনি আপনায় ঠিক জায়গাতে দিয়ে আসবেন?"
মেহুল চিৎকার করে উঠল, "না! গাড়ি থামান! এক্ষুনি গাড়ি থামান, না হলে আমি চিৎকার করব!"
মেহুল চিৎকার করতে নিবে ঠিক তখনই একজোড়া শক্ত হাত আচমকা তার মুখ চেপে ধরল একটা রুমাল দিয়ে। মেহুল বড় বড় চোখ করে তাকায়। নিঃশ্বাস আটকে আসে। শরীরটাও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে।
মুঈন মেহুলের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, "তুমি আমার হবে মেহুপাখি, একান্তই আমার হবে। না হবে তুমি ওই শেরাজ মির্জার, না হবে অন্য কারোর। তোমার ভাগ্যে আমি আছি শুধুই আমি।"
মেহুলের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। মুহূর্তে মাথাটা ঢলে পড়ে মুঈনের বুকে। মুঈন ঠোঁটে হাসি রেখে মেহুলের চোখ থেকে চশমা খুলে মেহুলের চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে চালককে আদেশ দেয়, "তাড়াতাড়ি চালা।"
কথাটা বলে সাথে সাথে সে মেহুলের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ফোনের পাওয়ার বন্ধ করে দেয়।
·
·
·
চলবে...................................................................................