নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ২৪ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


          রঙ বেরঙের কাগজের টুকরো সুতোয় বেঁধে সাজানো হয়েছে উঠোন। বাঁশ আর মাচাল দিয়ে উঠোনের এক কোণে বরের বসার জন্য ছোট আকারের মঞ্চ তৈরি করে সজ্জিত করা হয়েছে; ঝিলিমিলি কাগজ, কাঁচের চুড়ি, রং তুলি আর রঙিন ফিতার সাহায্যে। শাপলাদের বড় উঠোনে রান্না বান্না ও বরযাত্রীদের খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ছোট আকারের দুটো কলা গাছ কেটে রঙিন কাগজে মুড়ে আরো হরেক রকমের বস্তুর সাহায্যে সাজানো হয়েছে বিয়ের গেইট। সেখানে চেয়ার পেতে বসে আছে শাপলা শফি সহ সুরেলার কতিপয় মামাতো চাচাতো ভাই-বোন। রোজার দিন হওয়ায় সব কটার মুখ শুকিয়ে থাকলেও সুর আপার বিয়ে নামক আনন্দে তা ভাটা পড়েছে। তাদের অধির আগ্রহ দক্ষিণ দিকের মেঠোপথে। বরের ফুলে সজ্জিত বড় গাড়ি এদিক দিয়েই আসবে যে। তাদের অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে আসে। চিরচেনা সেই জিপ গাড়ি। তবে গাড়ির হাল বেহাল। গতরাতের দূর্ঘটনার ছাপ স্পষ্ট। মুহূর্তেই 'বর আইছে বর আইছে' ধ্বনিতে পুরো বাড়ি গেয়ে ওঠে। তবে বরকে দেখে সবাই মূক! না বরযাত্রী না বরের লেবাশ! বাকপটু শাপলা ঝটকা সহ্য করতে পারে না। তাঁর সমস্ত আশায় পঁচা ডিম ছুঁড়ে মেরেছে আর সে ছেড়ে দিবে? কোমড়ে হাত রেখে এগিয়ে আসে। আহাজারিতে ফেটে পড়ে তৎক্ষণাৎ!

"না হওয়া দুলাভাই, আমি খেলমু না! এমতে ফহিন্নীর মতো বিয়া করতে আইছেন লইজ্জা করে না? ছেঃ ছেঃ ছেঃ! আপনের লগে সুর আপার বিয়া দিতাম না। ভাঙা টিন নিয়া ফুটেন! বিয়া করতে আইছে হাউশ কি!"

বলে বড়সড় ভেংচি কাটলো। রাগে কিশোরীর মুখ রক্তিম! নওরিজ গায়ের ঘিয়ে রাঙা শালটা ভাঁজ করে বা কাঁধে চাপায়। রোদচশমাটা খুলে বুক পকেটে ঝুলিয়ে এগিয়ে আসে। কিশোরী শাপলার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে উদ্যত হবে কোত্থেকে সিনান সালেহে এসে খেঁকিয়ে ওঠে শাপলার উপর। মাথায় ঠাস করে চড় লাগিয়ে বলে,

"মায়ের ঘরের ছেঁড়ি!এতো চোপা ফুটাস ক্যান? যা ফুট? কিল একটাও পিঠের বাইরে পড়বো না। যাহ্?"

ধমকে শাপলা ভয় পেলেও নাকের পানি চোখের পানি এক করে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। সিনানের বাহু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলে,

"যামু না কি করবা? বর টুপি নাই, বর মালা নাই, বরের পাঞ্জাবী নাই, চোখে সুরমা লাগায় নাই, হাতে ঝিলিমিলি ফুল নাই, লজ্জা ডাহনের জন্যি মুহে রুমাল নাই সে কুনহানের বর? বরযাত্রী নাই, কুলদারা নাই, নির্লজ্জের মতো ভাঙা টমটম নিয়া একাই ড্যাং ড্যাঁং কইরা বিয়া করবার আইছে, বলি মানষের হাউশ কি? আবার বউয়ের ডালাও আনে নাই! সুর আপারে দিমু ভাবছেন? কচু পোড়া দিমু আপনেরে?"

নওরিজের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আবারও ভেংচি কাটলো শাপলা। নওরিজ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এই মেয়ের মুখে দেখছি বাঁধ বিচার নেই। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

"পোড়া কচু তুমি ভর্তা বানিয়ে খেয়ো। বউ নিতে.."

"আপনে কথা কইয়েন না তো! আপনের কথা গন্ধ গন্ধ লাগতেছে। চেয়ারম্যানের পোলা বিয়া করবার আইবো! ভাবছিলাম হাতি ঘোড়া গান বাজনা বাজাইয়া পুরা এলাকায় হৈচৈ ফালাইবো! ফুলের পাপড়ি ছিটামু! দুলাভাইয়ের বন্ধুগোরে লগে ঝগড়া কইরা কচকচা নোট আদায় করমু। আপনে সবে জল ঢাইলা দিলেন। আপনে ঘোরত যান কইয়াদিলাম!"

অনর্গল বলে যায় বাঁচাল শাপলা। তাঁর গলায় রাগ উপচেপড়া। নওরিজ অপমান বোধ করবে নাকি হাসবে? না উঁচু গলায় ধমকে চুপ করাবে মেয়েটাকে? বিয়ে করতে এসে ধমক দেওয়া কেমন দেখাবে? বিরতিহীন নওরিজের তুলোধুনো করে যায় শাপলা। সিনান ধমকালেও সে ধমকে যেন জানপ্রাণ নেই। মনে হচ্ছে সেও চাইছে একটু কথা শুনুক বরমশাই। নওরিজ সিনানের দিকে তাকায়। ভরাট গলায় বলে,

"পাগলী টাকে সরা তো! কানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আর বিয়ের যত নিয়ম কানুন আছে জলদি সেরে নে। আমি সুরকে নিয়ে ফিরবো জলদি করে। ওদিকে রূপের জ্ঞান ফেরেনি এখন পর্যন্ত!"

সিনান পাল্টা প্রশ্ন করে না। না রূপসা নামক রমনীর হালচাল শুধালো। নওরিজের সুক্ষ্ম চাহনি খেলে যায় সিনান সালেহের উপর। রূপের মন কাননের ফুল এমনি এমনি ফুটলো নাকি সেখানে চতুর ভ্রমরের হাতছানি রয়েছে? তবে সিনানের হাবভাব দেখে ঠাহর করা মুশকিল। ওদিকে শাপলা ফোঁস ফোঁস করছে। তাকে পাগলী বললো? সে ঝগরুটে গলায় বলে,

"আমারে পাগলী কন? আপনের চোদ্দ গুষ্টি পাগল! আপনে হইলেন বউ পাগলা! আর.."

মাঝপথে থেমে যায় শাপলা। সিন ভাইয়ের এই চাহনির সাথে পরিচিত সে। বিড়বিড় করে শফির পাশে গিয়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়ায়। শফি বোনের হয়ে সিনানের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে,

"ভুল কি কইছে শাপলা? খালি জামাই হইলেই বিয়া হয় না। ময় মুরুব্বি কোলদারা লাগে। আমি পিচ্চি মানুষ হইয়াও জানি রিজ ভাই কেন জানবো না?"

সাথে সাথেই কিল পড়ে পিঠে। শফি মুখ বাঁকায়। এই তার-ছেঁড়ার মার না খেলে তাঁর দিন ফুরায় না। খিটখিটে সিনান শফি শাপলা দু'টোকেই ধমকে ধামকে নওরিজকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। নওরিজ আশেপাশে চোখ বুলায়। খুবই সাধারণ সাজসজ্জা কিন্তু দেখতে ভালোই লাগছে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে বরের গৃহ প্রবেশটা বেশ ধুমধামের সাথেই হতো। নওরিজ খেয়াল করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মুখটা কালো হয়ে আছে। কারণ বুঝতে বাকি থাকে না। বিয়ের মহলে বাচ্চাদের আনন্দ এভাবে ভাটা পড়তে দেওয়া যায় না। সে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে বলে,

"পিচ্চিরা গেইট ধরবে না, নাকি? আমার হয়ে ডিল করার জন্য যেহেতু কেউ নেই সেহেতু ডিসকাউন্ট দিতেই হবে। দেখো হাত টানাটানি চলছে। কম করে চাইবে।"

কিশোর ছেলে মেয়েদের মুখে দপ করে হাসি জ্বলে উঠলো। সবাই হৈচৈ মাতিয়ে ফেলে। দুই শত টাকা না দিলে বউয়ের কাছে যেতে দিবে না। সিনান হাসে খানিকটা। শাপলা গাল ফুলিয়ে আড়ে আড়ে চায় বর মশাইয়ের দিকে। বরমশাই গোমড়া মুখে বাচ্চাদের সাথে টাকা নিয়ে তর্ক করে যাচ্ছে। সে গুটি গুটি পায়ে ভিড়ের মাঝে ডুব দেয়। সবার সাথে গলা মিলিয়ে টাকার দাবি করে। নওরিজ মাহবুব খান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,

"আচ্ছা পিচ্চিরা কুল ডাউন! নতুন বর হিসেবে একটু ডিসকাউন্ট আমার প্রাপ্য ছিলো। তোমরা যেহেতু দিচ্ছো না তাহলে দিয়েই দিবো। তবে তাঁর আগে বলো তো দুই শত কে ইংরেজিতে কি বলা হয়?"

উপস্থিত কিশোর কিশোরীদের মাঝে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। শাপলা বোকা বোকা ভঙ্গিতে সিনানের দিকে তাকালো। সিনান নাক চুলকানোর বাহানায় মুখ লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

"মায়ের ঘরের গাধি! স্কুলে ঘাস কাটতে যাস? টু হান্ড্রেড হবে।"

শাপলা মিষ্টি করে হেসে নওরিজের দিকে ফিরে জবাব দিলো। সিনানও মুচকি হাসে বোকাসোকা শাপলার চঞ্চলা স্বভাবে। 

—————

ধরাম করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এক রমনী। চৌকিতে ধপাস করে শুয়ে পড়ে হাসিতে ফেটে পড়ে। গড়াগড়ি খাবার উপক্রম। সুরেলা দেখেও দেখে না তাঁর হাসি। মেঝেতে বিছানো শীতল পাটির উপর নিজ ছোট্ট রঙ চটা টিনের বাক্স আজ উন্মুক্ত। নিজ শৈশব থেকে কিশোরী অবদি সব স্মৃতি সেই বাক্সে বন্দী থাকে। আজ সে স্মৃতির মুহূর্ত ছুঁয়ে দেখে সুরেলা। মাটির পুতুল, হাতি ঘোড়া, হাঁড়ি-পাতিল, ছোট সাইজের কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা, লাল সবুজ রঙের চুলের ফিতা, পুরনো বর্ণমালার বই, বাঁশি, পুরনো খয়ে যাওয়া দুল চুড়ি মালা, খেলনা ক্যামেরা, মোবাইল! আরো টুকটাক অনেক কিছুই। অধিকাংশই সিন ভাইয়ের কিনে দেওয়া। কিছু কিছু সে লুকিয়ে লুকিয়ে জোলা বাড়ি সুতো কেটে দুই তিন পয়সা টাকা কামিয়ে সখিদের সাথে লুকিয়ে মেলা থেকে কিনে এনেছিলো। পরে ভাইয়ের কেলানি খেয়ে ব্যবহার করা দূর , লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। বাক্সতে আছে কয়েকটা ছবি। তাঁর আর সিন ভাইয়ের । ঈদের দিন স্টুডিওতে গিয়ে উঠেছিলো। খুব ছোট বেলার। ভাইয়ের কোলে বসে দন্তহীন চোয়ালে হি হি করে হেসেছিলো। কপালে তাঁর ইয়া বড় নজর কাড়া টিপ। সুরেলা ছবি গুলোয় আঙুল বুলিয়ে মলিন হাসে। অমূল্য রত্ন গুলো সুরেলা গুছিয়ে আবারও বাক্সবন্দী করে তালা ঝুলিয়ে চৌকির নীচে রেখে দেয়। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে তাঁর প্রাণপ্রিয়সই রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। সে মুচকি হেসে বলে,

"আচ্ছা বল! হাসছিলি কেন?"

মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে, "তোর বয়স্ক ভা/তা/র আইছে! শাপলা মেয়েটা তো সাবান পানি ছাড়াই ধুইয়া দিলো। একটুও রহম করলো না।"

"কি হইছে?"

সুরেলা স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়ে। মারিয়া বাঁকা চোখে চায়। মুখ বাঁকিয়ে বললো,

"খুব দরদ দেখছি বয়স্ক ভা/তা/রের জন্যে! আমার বলার মুড নষ্ট হইয়া গেছে সই। আর কইতাম না।"

সুরেলা দ্বিতীয়বার শুধায় না দেখে মারিয়া হতাশ হয়। বান্ধবীর চোখে মুখে উদাসী ছাপটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি তাঁর। সে কিছু বলবে এর আগেই খিল আটকানোর শব্দ হয়। মারিয়া সুরেলা দু'জনে চকিত চাহনিতে দৃষ্টি ফেলে দরজার দিকে। আগত ব্যাক্তিকে দেখে দু'জনের চোখ চরকগাছ।

 চোখে কালো রোদচশমা ঠিকঠাক করে ভাব নিয়ে এগিয়ে আসে আইয়ালী বেওয়া। মাথার ঘোমটা খুলে আঁচল কোমড়ে বাঁধে। পান খাওয়া টকটকে মুখ নাড়িয়ে বলে,

"বুবু তোর ভা/তা/রের দিলডা বহুত বড়। বাচ্চাগোর লগে দুইশো টাকার লাগি খচখচ কইরা হাজার টাকা ধরাই দিলো। সুযোগ বুইঝা আমিও দুই হাত মেইলা দাঁড়াইছি ওমা আমার চোখে চশমা পড়াইয়া পাঁচশো টাকা আঁচলে গুইজ্জা দিলো।"

মারিয়া হেসে নওরিজ মাহবুব খানের তারিফ শুরু করে দেয়।সুরেলা বাঁকা চোখে চায়। বৃদ্ধা হেসে নাতনির থুতনি ধরে বলে,

"বুবু জান ডর লাগে?"

"ডর ক্যান লাগবো বুবু?"

"বাহ্ রে! কবুল কইয়া তার নামে কুরবান হইবি বলে কথা!"

"আমি কি বকরি নাকি যে কুরবান হবো? আমি সুরেলা সালেহ্। আমাকে পেতে হলে তাকে কুরবান হতে হবে!"

আইয়ালী বেওয়া চশমাটা সুরেলাকে পড়িয়ে দেয়। দুই হাতে তালি বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন,

"এই না হইলো কথার মতো কথা। বুবু, পুরুষ মানুষরে যদি নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইবার না পারো লা; তুমি নারী জাতের কলঙ্ক! সবসময় আঙ্গুলের ডগায় ঘুরাইবি; এক আনা ভাউ দিবি না কইলাম!"

সুরেলা ভাবান্তর দেখায় না। আপনমনে অগোছালো বিছানা গোছাতে থাকে। মারিয়া টুরি'তে গুঁড় মুড়ি নিয়ে খাচ্ছে মুড়মুড় শব্দ করে। তাঁর সমস্ত ধ্যান বৃদ্ধার পারমর্শে। যদি তাঁর বিবাহিত জীবনে একটু সুফল আনে। বৃদ্ধা সুরেলাকে টেনে পাটিতে বসায়। নিজেও রয়েসয়ে বসে বলে,

"যেই কামে আইছি সেইডা আগে সাড়ি। ওই সই? হুনলাম তোরও অর্ধেক বিয়া হইছে আয় তোরেও কই!"

মারিয়া যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিলো। লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে বসে। সুরেলার চোখে মুখে সন্দেহের আভাস। বৃদ্ধা ফিসফিসিয়ে বলে,

"বিয়া যেহেতু হইতেছেই রাইতের আন্ধারে বাসরডাও হইবো। তাই বাসর রাতে বিলাই মারার শলা পরামর্শ দিই কি কস লা বুবু?"

নেত্রযুগ্ম কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বুকের ভেতর যেন অজানা ঝড় শুরু হয় সুরেলার। লাজে কান ভারী হয়ে আসে; কপোল যুগল রক্তিম আভায় ছেয়ে যায়। ওদিকে মারিয়া মুখ ভর্তি মুড়ি গুঁড় চিবোতে চিবোতে শুধায়,

"বুবুজান বাসর রাতে বিলাই ক্যান মারতে হইবো? নিরীহ প্রাণীটারে মারলে তো আল্লাহ গোস্বা হইবো!"

ফর্সা মসৃন গালে ঠাস করে চড় পড়ে। মারিয়া ফুলো গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চায়। আইয়ালী বেওয়া ব্যাঙ্গ স্বরে বলেন,

"উহ্ কথা হুইন্যা মনে হয় ফিডার খায়, কিচ্ছু বুঝে না! সুহাগ রাতে কোন বিলাই মারে জানোস না?"

মারিয়ার মুখটা চুপসে যায়। সে তো জানে টুকটাক। তবে একটু আকটু অবুঝ মন গভীরভাবে শুনতে চেয়েছিলো। বৃদ্ধা সুরেলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

" বিলাইডা তুই মারবি বুঝলি? বিলাই যতোই মাছের খোঁজ করুক মিউ মিউ করে ভুলানোর চেষ্টা করুক বুবু তুই আজ রাতে একদম গলবি না। আজ রাত কেন আগামী সাতদিন পাত্তাই দিবি না। মনে রাহিস, সহজে পাইলে মানষের কদর ফুইরা যায়। বুঝাইবার পারছি?"

সুরেলা লাজে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তবুও নানীর কথায় ছোট্ট অরে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। বৃদ্ধার শলা পরামর্শ থেমে নেই। লাজে সুরেলা পারে না সেখানেই জ্ঞান হারায়। কি সব লজ্জালু কথাবার্তা! ওদিকে মারিয়া বেশ মজা পায়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বৃদ্ধা কে আরো উস্কে দেয়। অবুঝ প্রশ্ন করে যায়। বৃদ্ধা চাপা স্বরে ধমকালেও হাসিমুখে জবাব দিয়ে যায়। বদ্ধ ঘরে তিনজন যুক্তি বুদ্ধিতে আঁটকে রয় বেশ সময়।

—————

"আরে শালাবাবু তুমি তো খান‌ বংশের মান ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিলে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ পুরো গ্রামে রটে গেছে খান বাড়ির বড় ছেলে খালি হাতে বিয়ে করতে এসেছে তাও একা একাই। সবাই ছিঃ ছিঃ করছে আর মুখ ঢেকে হাসছে।"

"বড় দুলাভাই? এতো বড় ধোঁকা তো আমার প্রাক্তন প্রেমিকাও দেয় নি! বলেছিলেন সুরদের বাড়িতে বসে আছেন আধাঘণ্টা হলো। তবেই না আমি এলাম!"

"আস্তাগফিরুল্লাহ শালাবাবু শশুর বাড়িতে বসে কি সব বলছো। কারো কানে পৌছেলে ঝাটা পেটা করে খেদাবে!"

নওরিজের পিঠ চাপড়ে বলে ইকরাম উল্লাহ। নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে চাইলে ভদ্রলোক হাত সরিয়ে নেয়। নিজ পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে নওরিজের মুখে ঠেসে ধরে বলে,

"জামাই মানুষ তুমি। পড়নে তপন না থাকলেও মুখে রুমাল অতীব জরুরী বুঝলা শালাবাবু?"

নওরিজ যেন গরম তেলে পানির ছিটা। ছ্যাঁত করে রুমাল ফেলে দেয়। অন্যের ব্যবহার করা রুমাল তাঁর মুখে ভাবতেই গা গুলায়। ইকরাম উল্লাহ বিরক্ত মুখে বলে,

"নতুন রুমাল ছিলো তোমার জন্যেই এনেছিলাম রিজ। এই নাও শেরওয়ানি কোথাও গিয়ে চেঞ্জ করে নাও!"

হাতের প্যাকেট ছুঁড়ে মারে একপ্রকার। নওরিজ থমথমে মুখে ধরে নেয়। বা‌ম বাহুর দিকে তাকিয়ে বলে,

"শেরওয়ানি পড়ার মতো অবস্থায় নেই বড় দুলাভাই। সাতটা সেলাই পড়েছে এখানে; পিঠে তিনটে। মাগরিবের আজান হয়েছে সবাই ইফতার সেরেছে। আপনি ওদের তাড়া দিন তো? আমি রাতেই ঢাকা ফিরবো।"

ইকরাম উল্লাহ অবাক হয়। ঢাকা যাবে মানে? সে জিজ্ঞাসা করবে ইকরা ইয়ামিনের আগমনে বলা হয় না। বাচ্চা দু'টোর হাতে দু'টো লাগেজ। তাদের পেছনে হালকা সাজে শাড়ি পড়িহিত নওরিন।সাথে সালোয়ার কামিজে আরিফা লাজুক ভঙ্গিতে ওড়নায় মুখ লুকিয়ে রেখেছে। আরো কিছু আত্বীয় স্বজন, সবার পেছনে বাবু হারুণ জামাল তমাল সহ আরো কিছু দলীয় লোকজন সহ গ্রামের ময় মুরুব্বিও আছে। নওরিজ তাদের সাথে টুকটাক কুশলাদি বিনিময় করে আবারও ইকরাম উল্লাহকে খোঁচা দেয় সবটা জলদি করার জন্য। নওরিন পিঠাপিঠি বড় ভাইয়ের বাহু ধরে একটু নিরিবিলিতে নিয়ে যায়। 

"মানুষের জান নিয়ে টানাটানি আর উনি বিয়ে করতে এসেছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। ডাক্তার পুরোপুরি বেড রেস্টে থাকতে বলেছিলো না তোকে? ড্যাং ড্যাঁং করে বিয়ে করতে এসেছেন মজনু মিয়া। বিয়ে কয়েকদিন পিছিয়ে গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হতো শুনি?"

বলতে বলতে হালকা শব্দ করে ফুঁপিয়ে ওঠে নওরিন। ভাইয়ের কপালে আবারও হাত রাখে। জ্বর শরীর নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। নওরিজ মাহবুব স্বীয় চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে বলে,

"অনেক কিছুই হতো রিন! মেয়েটাকে কথা শুনিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতো কতিপয় নর্দমার কিট।"

"মেয়েটাই তো সব আমরা তো আর কেউ না!

নওরিজ বোনের মাথায় গাট্টা মারে। নওরিন মায়ের পাঠানো প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনে সাথে করেই এনেছে। একটা একটা করে ঔষধ বের করে ভাইকে খাওয়ায়। নওরিজ মুচকি হাসলো।

"হায় আল্লাহ! আচ্ছা দে ওষুধ। আর চিন্তা করতে হবে না আমি ঠিক আছি। ভাইয়ের বিয়ে এনজয় কর।"

নওরিন হাসে না। এমন পরিস্থিতিতে হাসিটা আসে না‌ তাঁর। ওদিকে পিচ্চিটার জ্ঞান ফিরলেও কারো সাথেই কথা বলে নি এখনও।

বাদ মাগরিবের পর পরই বরযাত্রীকে খাওয়ানোর জন্য বসানো হয়। সিনান নিজ হাতে তদারকি করছে সব। বরকে যে টেবিলে বসানো হয়েছে সেই টেবিলে বর সাহেবের শ্যালিকারা ঘিরে রেখেছে। বরকে বেরেধেরে খাওয়াচ্ছে আর দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ায় মহল বানিয়ে রেখেছে। বিশাল বড় প্লেটে সজ্জিত বাঙালী খাবার। নওরিজ নেড়েচেড়ে দেখে। কচুর মতি দিয়ে নকল ডিম বানিয়ে ভেজেছে। শাকের সাথে দুবলা ঘাস মিশিয়েছে। মাছের ভেতর লঙ্কা গুঁড়ো উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। মুরগির রোস্টের পেটের ভেতর দু'টো ডিম ঢুকিয়ে রেখেছে। বড় দুলাভাই ডাল খেয়ে মুখটা যা বানালো নিশ্চয়ই লবণ নয়তো চিনি মিশ্রিত করেছে! টুকটাক খুঁজতে গেলে আরো ভেজাল খুঁজে বের করা যাবে। নওরিজের ওতো সময় নেই হাতে। গ্রাম বাংলার 'বরের থালা'র' সাথে এর আগেও পরিচিতি লাভ করেছে। সে ইকরাম উল্লাহর হাতে হাজার তিনেক টাকা ধরিয়ে ঝামেলা বিদায় করার তাড়া দেয়। সেই মুহূর্তে উপস্থিত হয় আইয়ালী বেওয়া। নওরিজের কাঁধে হাত রেখে মধু মিশ্রিত কন্ঠে শুধায়,

"নাতজামাই হুনলাম খাইবার পারতাইছো না? নিশ্চয়ই হাত দুঃখু হয়া গেছে! কুনো চিন্তা নাই। তোমার বুবুজান আছে না? আদর সোহাগ কইরা খাওয়াই দিমু!"

নওরিজ খুকখুক করে কেশে ওঠে। বুঝ হওয়ার পর থেকে মনে নেই কারো হাতে খাবার খেয়েছে কি না। তাঁর ঘরনীর মতানুসারে খুঁতখুঁতে লাট সাহেব কি না! সে অতি ভদ্রের সাথে নাকচ করে। পাশ থেকে ইকরাম উল্লাহ হেসে বলে,

"বুবু আমার জান? আমাদের দিকেও একটু তাকান?"

"না বাবা চাইতাম না। তোমার পাশেরডা কেমন কইরা চাইয়া আছে। আমার জানের ডর আছে!"

বৃদ্ধা আঁচলে ঘোমটা টেনে ব্যাঙ্গ স্বরে বলে ওঠে। ইকরাম উল্লাহ নওরিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো শুধু।

—————

মহাব্যস্ত সিনান সালেহের মেজাজ চটে আছে। যাকে পাচ্ছে তাঁর উপরেই খ্যাক খ্যাক করছে। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী শফি। কোথায় ভেবেছিল সুর আপার বিয়েতে ভালোমন্দ কবজি ডুবিয়ে খাবে! সে কব্জি ডুবিয়েই খাচ্ছে তবে সেটা সিনান সালেহ ওরফে তার ছেঁড়ার ঝাড়ি। রাগে দুঃখে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে তাঁর। ওদিকে তাঁর রূপসা আপার নাকি শরীর ভালো না সেই দুঃখে তাঁর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। 

"নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর! পানির জন্য হাঁক ছাড়ে কানে ঢুকে না? জলদি যা পানি নিয়ে?"

ঝাড়িতে শফি জগ হাতে কলপাড়ে ছুটে যায়। পানি পৌঁছে দিয়ে এসে সিনানের হাতে হাতে গামলায় ভাত তরকারি বাড়তে সাহায্য করে যায়। সিন ভাই একটু সন্দেহের সাথে তাকালেও সুযোগ বুঝে শফি বলেই ফেলল,

"সিন ভাই? তুমি কি জানো? কাল রিজ ভাইয়ের লগে রূপসা আপাও আছিলো। আপার মাথায় নাকি কোপ লাগছে। হাসপাতালে আছে। ওহনো হুঁশ ফেরে নাই। কষ্টে আমার বুকটা লাফাইতেছে। মন চাইতেছে সব ফালাই ছুইট্যা যাই। কিন্তু আমি তো ঢাকা শহর চিনি না! কুন হাসপাতালে আছে তাও জানি না!"

"তোর পরাণের রিজ ভাইরে জিগা সব বলবো নি!"

সিনানের ভাবলেশহীন জবাবে শফি কাঁচুমাচু মুখ বানিয়ে বলে,

"জিগাইতাম। তয় ওহন ডর লাগতেছে। কাল তিন লোকেরে কোপাই মাইরা হালাইছে। দুইজনে মড়মড় হইয়া হাসপাতালে। তারে দেখলেই তো আমার হাত পা কাঁপতেছে‌। আমার তো সুর আপার জন্যে ডর লাগতাইছে। তোমার লাগতাইতেছে না?"

"নাহ্। হের কপাল হেতি খাইবো। আমার কি? আমি তো ভাই একটু নিজেরে নিয়া ভাবমু। তিন চারটা বউ আনমু তাগোর সেবাযত্নে একটু ধলা হমু এই যা!"

সিনান হাসিমুখে প্রত্যুত্তর করে মাংসের বাটি নিয়ে যায় মেহমান আপ্যায়ন করতে। শফি চিন্তিত বদনে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সিনানের হাতের মাংসের বাটি পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। সম্মুখে দাঁত কেলিয়ে দন্ডায়মান রমনীকে দেখে সিনান খ্যাক করে ওঠে,

"শা/লী হা/রা/ম/জা/দি তোর চোখ তুইল্যা মরিচ লাগামু। তারপর ভাঙা থাল ধরাইয়া রাস্তায় বসাই দিমু। দূর হ চোক্ষের সামনে থাইক্যা!"

শাপলা ধমক শুনে লাফিয়ে উঠলো। কি গলা বাপরে! মাইকটাও ফেল মারবো! সে আমতা আমতা সুরে বলে,

"ওই আসলে ভুল হইছে মাইফ কইরা দেও সিন ভাই। হয়েছে কি? রিজ ভাই প্লেট সাজানোর তিন হাজার দিছে। আমার তো মাথা চক্কর দিয়া উঠলো! তিন হাজার..."

"চুপ! দেখি কত দিছে? তিন হাজার টাকা কয়ডা নোটে হয় জানোস?গুইন্যা দেখছোস?"

 সিন ভাইয়ের প্রশ্নে শাপলা মাথা নাড়লো। জানে না। জীবনে এতো টাকা একসাথে কখনো দেখেই নাই। সিন মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করে। খানিকটা নিচু গলায় বলে,

"আচ্ছা আমার কাছে দে আমি পড়ে গুইনা তোদের সবাইরে সমান সমান ভাগ কইরা দিমু নে। তোরা পিচ্চি মানুষ টাকা হারাই ফেলবি! দে?"

শাপলা আগের একহাজার সহ মোট চার হাজার টাকা সিনানের হাতে দেয়। সিনান মাংসের বাটি শাপলার হাতে ধরিয়ে টাকাটা গুনে পকেটে রাখে। শাপলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। শাপলাও প্রত্যুত্তরে চোখ পিটপিট করে হাসে।

"আমি তো তোমার কাছেই গচ্ছিত রাখবার আইছিলাম। তুমি আমারে হুদাই গাল দিলা!"

মন খারাপের সুরে বলে। সিনান বাটিটা নিজ হাতে নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলে,

"তো কি তোরে সোহাগ করমু? যা ভাগ ছেড়ি? আগলা পিরিত যত্তসব!"

শাপলার চোয়াল ঝুলে পড়ে। একটু আগেই না মিষ্টি স্বরে কথা বলছিলো? সে মুখ ভেঙ্গিয়ে চলে যাবে সিনান পিছু ডাকে। শাপলা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে চাইলে সিনান শাসনের সুরে বলে,

"রিজ ভাইয়ের বন্ধুগোর লগে এতো হাসাহাসি কিসের? ছোট না তুই। আদব লেহাজ রেখে চলাচল করবি কেউ যেন আঙুল তুলতে না পারে। যা? আর যেন না দেখি!"

সদ্য কিশোরীতে পা দেওয়া শাপলার মন বাগিচার কোকিল কুহু কুহু সুরে গেয়ে ওঠে। গাল ভারী হয়ে আসে লাজে। বাঁচাল শাপলা মুখের বুলি হারিয়ে বসে। কোনমতে মাথা কাত করে সম্মতি পেশ করে। সিনান বাঁকা চোখে তাকিয়ে চলে যায়।

—————

মওলানা সাহেব সহ মুরুব্বি গুরুজন বসে বধুয়ার সামনের শীতল পাটিতে। উদ্দেশ্য নতুন বউয়ের সম্মুখে দোয়া দরুদ পাঠ করার পর নিকাহনামায় বউয়ের অনুমতি নিজ কানে শুনবে। কাজি সাহেব বধুয়া সহ সকলকে তিনবার করে সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস আর দরুদ শরীফ পাঠ করতে বলে। দোয়া দরুদ পাঠ শেষ কাজি সাহেব বলেন,

" জনাবা সুরেলা সালেহ, 
নোমান মাহবুবের একমাত্র পুত্র জনাব নওরিজ মাহবুব খানের .....

থেমে যায় মওলানা সাহেব। দরজা দিয়ে প্রবেশ করে খোদ নওরিজ মাহবুব। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে তার দিকে। বর এখানে কি করছে? পুরো রুম জুড়ে চাঁপা গুঞ্জন ভেসে বেড়ায়। বউ ঝি'রা ঠোঁট চেপে হাসে। নওরিজ এগিয়ে এসে মওলানা সাহেবের পাশে বসে থমথমে গলায় বলে,

"আমিও নিজ কানে শুনি তাঁর কবুল বলা।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp