লোকটার চিরচেনা হলুদ ফর্সা মুখমণ্ডল, সেই আলতো গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়, সিল্কি চুল যা অনন্যার চোখে চিরজীবনের জন্য গেঁথে গিয়েছিল সে মানুষটি কিছুক্ষণ আগেও অনন্যার সামনে ছিল। কিন্তু মনের আশা যেন চোখের সামনে কাঁচের মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখলো অনন্যা। সবচেয়ে বড় ঘোর অমিল কী ছিল লোকটার মধ্যে জানেন ? লোকটার চক্ষু! কৌশিক স্যারের প্রতিটি বিষয় এখনো চোখে ভাসে অনন্যার। সব মিলের মধ্যে এই বিষয়টাই তাকে আলাদা করেছে। লোকটার চোখের মণি গাঢ় বাদামী। কৌশিক স্যারের চোখের মণি আকাশি রঙের ছিল। যে আকাশি মণিতে চোখ রাখলে মনে হতো চোখ দুটো সমগ্র আকাশ বহন করতে সক্ষম। এখনকার সেই একই চেহারার ব্যক্তির গাঢ় বাদামী দু চোখে তাকিয়ে তা আর মনে হয় না অনন্যার ।
অনন্যা অসহায়ের মত রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। লোকটাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। সেই আগেকার অনুভূতি, সেই ভালো লাগা, বুক ধুকপুক করে উঠা, ভালো লাগায় মনটা ভরে যাওয়া কিন্তু মূহুর্তের মধ্যেই সব অনুভূতি এক নিমিষে নষ্ট হয়ে গেলো। অনন্যাকে দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলো সে। অনন্যা নিজেকে সামলাতে গিয়ে বাস স্টপেজের সিটে বসে পড়েছিলো। লোকটার কণ্ঠে কর্কশ শব্দ।
রাগী কণ্ঠে তেজ দেখিয়ে বললো,
"লজ্জা শরম থাকলে অপরিচিত একজনকে জড়িয়ে ধরার সাহস করতেন না। স্টুপিড! মা বাবা হয়তো ম্যানার্স শেখায় নি। শিখিয়েছে হ্যান্ডসাম এবং রিচ ছেলে দেখলেই তার গলায় ঝুলে পড়া। রাইট? আজকাল বাংলাদেশে মেয়েরা এতো ছ্যাঁচড়া হয়ে যাচ্ছে কি বলবো! ডিসগাস্টিং। "
অনন্যা কৌশিক স্যারের মতো দেখতে লোকটির দিকে থম মেরে তাকিয়ে রইল। কৌশিক স্যারের চেহারায় না ছিল মায়া আর না ছিল ভালোবাসা। শুধুই আছে রুক্ষতা যা তছনছ করে ভেঙে দিলো অনন্যার মনটিকে। লোকটা অনন্যার মুখ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সোজা হাঁটতে থাকলো। রাস্তা পার হয়ে বিপরীত দিকে চলে গেলো সে। মানুষটি যতোই দূরে যাচ্ছে অনন্যার ভিতরের হৃৎপিণ্ড ততোই মুচড়ে - খামচে ধরছে তাকে। তাই আর বসে থাকতে পারলো না অনন্যা। রিকশা, গাড়ি, সিএনজি, বাস সব উপেক্ষা করে ছুটে গেলো বিপরীত পাশে। খুব জোরেই ডেকে উঠলো স্যার শব্দ উচ্চারণ করে। কিন্তু থামলেন না উনি।
অনন্যা কান্নায় ভেঙে পড়লো। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে শেষবারের মতো কৌশিক স্যারের নাম নিলো। লোকটা থমকে দাঁড়াল। কৌশিক স্যার শব্দ দুটো লোকটার অভ্যন্তরের কোনো গোপন কক্ষে ধাক্কা দিয়ে খুলে দিয়েছে বিস্মৃত কোনো দরজা। সে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে তাকাল। তার চোখে কোনো চিন্তা ছিল না, ঠোঁটেও কোনো কাঁপন নেই। একেবারে নিষ্প্রভ সেই চাহনি মনে হয় কাঁচের তৈরি কেউ। পিছন ফিরে আশেপাশে চোখ ফেরালো সে। অতঃপর ফুটপাতে সড়কের মাঝে একটি মেয়েকে হেঁচকি তুলে কান্না করতে দেখতে পেলো। অনন্যার কাঁধ কাঁপছে। নিঃশ্বাস টেনে টেনে কাঁদছে সে। লোকটা তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল অনন্যার দিকে। রাস্তার সিগন্যাল বদলে গেল কিন্তু তাদের দুজনের মাঝখানে এক অদৃশ্য সিগন্যাল যে এখনো লাল হয়ে রইলো। কেউ দেখলো না সেটা!
অনন্যার চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়গড়িয়ে পড়ছে।মন তো বলছে এই লোকটাই তার কৌশিক স্যার কিন্তু স্যারের ব্যবহার আর অনন্যা কে না চিনতে পারা আর স্যারের চোখের মণি এই সবকিছু ওর ভাবনা পরিবর্তন করে দিচ্ছে বারংবার।
অনন্যার সামনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো সে। ভ্রু কুঞ্চিত করলো খানিকটা। অনন্যা চোখ তুলে তাকাতেই আবারো কেঁদে উঠলো। উনার চেহারার ভাবভঙ্গিও কৌশিক স্যারের সাথে মিলে যায়। তাহলে ইনিই কৌশিক স্যার কেন নয়?
লোকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। নিচুতে ঝুঁকে অনন্যার চোখে চোখ রেখে বললো,
"বেশ চালাক মেয়ে তো আপনি! নাম কি করে জানলেন আমার?"
অনন্যা কান্না থামালো। আবারো ভ্যাবলার মত তাকিয়ে উচ্চারণ করলো,
"হু?"
"কানে কি কথা যায় না? আমার নাম কি করে জানলেন? উত্তর দিন।"
"কৌশিক আপনার নাম?"
"ইয়েস! ইশতেহার কৌশিক!"
অনন্যা দুই কদম এগিয়ে এসে কৌশিকের গালে এক হাত রেখে বললো,
"আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি আপনার ... আমি আপনার ওয়াইফ! আমাদের বিয়ে হয়েছে।"
কৌশিক বিরক্ত হয়ে নিজের গাল থেকে অনন্যার হাত সরিয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলো। বিরক্ত গলায় বললো,
"এই একদম টাচ করবেন না। কথায় কথায় শরীরে হাত দেওয়া একদম পছন্দ নয় আমার।"
অনন্যা নিজের হাতের দিকে তাকালো। এক হাতে রিং এর প্যাকেট ছিল তার। মনে পড়লো এটা তো উনার ই। নিজের বুকে হাত রেখে নিচু স্বরে বললো,
"আমাকে আপনি ভুলে গেলেন? কীভাবে পারলেন এটা?"
"শুনুন! আপনি হয়তো আমার পাগল প্রেমিকা। বাট সত্যি বলি আপনাকে একদমই পছন্দ হয়নি আমার। তাই নিজের রাস্তা মাপুন। আপনার মুখ থেকে নিজের নাম শুনে ভাবলাম কোনো রিলেটিভের মেয়ে হবেন। তাই এগিয়ে এলাম এখন দেখছি এসেও ভুল করেছি। আমাকে নিজের স্বামী বানিয়ে দিলেন? এ তো ঘোর অপরাধ! যাই হোক, আর কখনো দেখা হচ্ছে না আমাদের ।"
কথাগুলো বলেই কৌশিক চলে গেল। অনন্যা স্থির দাঁড়িয়ে রইল শিকড়ে আটকে থাকা কোনো গাছের মতো। এরপর তো আর বলার কিছু থাকে না। শুধু প্রিয় মানুষের দূরে চলে যাওয়ার দৃশ্যটাই থেকে যায় চোখের সামনে।
তখন থেকে মাথাটা ঘুরছে অনন্যার। সে এলোমেলোভাবে হাঁটছে ফুটপাতে। প্রায় ত্রিশ মিনিট কেটে গেছে। আশপাশে তাকিয়ে ঠাওর করতে পারলো না কোথায় এসেছে সে। হঠাৎ করেই পেটের ভেতরটা ব্যাথায় মোচড় দিলো তীব্রভাবে। কোনো সংকেত ছাড়াই অনন্যা ফুটপাতের পাশে নিচু হয়ে বসে বমি করে দিলো। জীবনের সমস্ত না বলা কথা, চাপা কান্না আর জমে থাকা যন্ত্রনা সবটা ছিটকে বেরিয়ে এল ।
চারপাশের কোলাহলের মধ্যে সে প্রচন্ড একাকী হয়ে রইল। কয়েক জন ওর অবস্থা দেখে নাক ছিটকে চলে গেলো। আবার কয়েকজন এসে ওকে শান্ত করতে লাগলো। পানি এগিয়ে দিলো। একজন বৃদ্ধ মহিলা পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। অনন্যা পানি খেয়ে অতঃপর শান্ত হলো। কিন্তু মাথা প্রচন্ড ব্যথায় সে টিকতে পারছিলো না। কয়েক জন মিলে অনন্যা কে রিকশায় বসিয়ে তবে ছাড়লো।
অনন্যার শরীর ভালো লাগছিল না। মানুষদেরকে কৃতজ্ঞ যে জানাবে, একটা ধন্যবাদ যে দিবে এই অবস্থাতেই ও ছিল না। কোনো রকমে বাসায় এসে পৌঁছেছে সে। রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই আবার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল সে। বাথরুমে দৌড় দেওয়ার সুযোগও পেল না। সব বেরিয়ে এলো ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
পেছনে দাঁড়িয়ে পল্লবী এই দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন। চোখে রাগ আর অস্থিরতা, কিন্তু কিছু বলার আগেই অনন্যা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
"মা, আমার ভালো লাগছে না… মাথা ঘুরছে শুধু।"
শব্দগুলো কেমন অসহায় শোনালো পল্লবীর কাছে। তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। মনে হলো কোথাও একটা ভেঙে গিয়েছে মেয়ে মানুষটা।
পল্লবী শীতল মাথায় মেয়েকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। যত্ন করে তাকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলেন। কষ্টে ভাঙা অনন্যার শরীরটা ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তিনি দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে। এক গ্লাস শরবত বানিয়ে ডেকে তুললেন পূর্বকে।
“পূর্ব, এইটা নিয়ে অনন্যার কাছে যা। একটু খাওয়ানোর চেষ্টা কর।”
ঘুমচোখে পূর্ব উঠে এল রান্নাঘরে। শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে গেল বোনের রুমে। ততক্ষণে অনন্যা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। পূর্ব আস্তে করে গ্লাসটা ঠোঁটে তুলে ধরলো। অনন্যা সামান্য কিছু খেয়েই আবার কুঁকড়ে উঠলো। পেট মোচড় দিয়ে উঠছে আবারও। ও বুঝে উঠতে পারছে না কেন শরীরটা এমন আচরণ করছে। পূর্ব হতচকিত। ঘুম কেটে বাস্তবের ভার বুঝে নিচ্ছে এক লহমায়। অনন্যার আচরণে ওর ঘুম উধাও সম্পূর্ণ। ওদিকে পল্লবী পরিপাটি করে রুম পরিষ্কারে ব্যস্ত। আচমকা অনন্যার কষ্টে ভরা কণ্ঠ শুনে ছুটে এলেন আবার।
শেষমেশ অনন্যার বাবার পরামর্শে সিদ্ধান্ত হলো বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে আনবে এবার।
অনন্যার স্বামী কৌশিকের খবর নেই। এদিকে মেয়েটার এই অবস্থা। মনে মনে মা বাপ দুজনেরই সন্দেহ হচ্ছে মেয়েটা আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায়নি তো? আজকের অবস্থা দেখে তাই মনে হচ্ছে। যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে সমাজে মুখ দেখাবে কি করে? সবাই তো বলবে স্বামী তার মনের আঁশ মিটিয়ে গর্তে ঢুকে গেছে। কিন্তু চিহ্ন! তা তো ঠিকই রেখে গেলো মেয়েটার মধ্যে। এসব কে সহ্য করবে?
প্রাইভেট ডাক্তার আসতে আসতে রাত আটটা বাজালো। অনন্যার অবস্থা করুণ। মাথা ব্যথায় থাকতে পারছে না। ঘুমের ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। বিছানার পাশের টেবিলে পড়ে আছে রিংয়ের প্যাকেটটা। তাই দেখে সকালের কথা বারবার মনে পড়ে যায় অনন্যার। কৌশিক স্যারকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে,
"ফিরে আসুন একবার। আর যেতে দিবো না আপনাকে।"
কিন্তু হায়! কি করে বলবে লোকটাকে? লোকটার আতা পাতা কিছুই তো জানে না অনন্যা আর জানলেই বা কি কৌশিক স্যার তাকে চেনে না। আর দ্বিতীয়ত যদি মানুষটি সত্যিই তার সেই পুরোনো ব্যক্তি না হয় , পুরোনো কৌশিক স্যার না হয়ে থাকে তাহলে এই অপরিচিত মানুষটিকে কাছে পেলেও মন ভরবে না অনন্যার। সেই পুরোনো প্রিন্সকে না পেলে অনন্যার জীবনের আঁশ যে মিটবে না। অনন্যা তো ভালোবেসেছিলো রহস্যময় মানবটিকে যার জীবন শুরু হয়েছিল বহু বহু অগণিত বছর আগে। যার জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না, যে সত্যিকারের মানুষ ছিল কিনা তা নিয়েই সন্দিহান ছিল। তাহলে সেই রহস্যময় পুরুষটি চলে গেলে সত্যিই কি আর ফিরে আসবে?
ডাক্তার অনন্যার চেকাপ করছে। বেশ অনেকক্ষণ পর বললো,
"রোগীর শরীর দুর্বল। হয়তো নিজের অবহেলা করছে অনেক দিন ধরে। স্ট্রেস বেশি নিচ্ছে। রাতে ঘুম ও কম হচ্ছে। এই কারণেই আজ এরকমটা অনুভব হচ্ছে। আচ্ছা আগেও কি হয়েছিল এমন?"
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে চিন্তা করতে করতে বললো,
"আসলে কয়েক দিন ধরে খাওয়ায় অরুচি এসেছে। কিছু খেতে ভালো না। সকালে উঠে পেট মোচড় দেয় আর বমি হিসেবে আগের খাবার আর কফ ই বের হয়।"
পল্লবী কটমট করে তাকিয়ে বললো,
"এগুলো আগে কেনো বলিস নি?"
অনন্যা মিনমিনিয়ে বললো,
"নিজের দিকে নিজের ই তো খেয়াল ছিল না আমার।"
ডাক্তার সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধীরে সুস্থে বললো,
"হুম, রোগীর শরীরে একটা নতুন প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে। তুমি মা হতে চলেছ।"
কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে সময় থেমে গেলো অনন্যার জন্য। ওর চোখ বড় হয়ে উঠলো। ঠোঁট কেঁপে উঠলো অনিচ্ছায়। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। জোর গলায় বললো,
"এটা হতে পারে না। কোনো ভাবেই এটা পসিবল না।"
কৌশিক স্যার তো স্পষ্ট বলেছিল, সে কখনো বেবি দিতে পারবে না। তাহলে এখন? তাহলে এই প্রাণ কোথা থেকে এল?
পল্লবী বললেন,
"যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। অস্বীকার করার কী আছে? তোর জামাই চলে গেছে তোর দোষে। বিয়ে হয়েছে তোদের এখন অস্বীকার করে লাভ কী?"
"আমি এটা বলতে চাইছি না। মানে আমাদের মধ্যে ওরকম কিছুই হয়নি যে....!"
ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে বললো,
"তাহলে কি আমি ভুল বলছি? যদি আপনাদের সন্দেহ থাকে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করান। সব নিমিষেই বের হয়ে যাবে।"
পল্লবী মেয়েকে থামিয়ে উত্তর দিলো,
"না আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, ডাক্তার। আমাদের মেয়েটা অবুঝ তো তাই।"
"কিন্তু মা! এটা সম্ভব না। আমাদের মাঝে...!"
অনন্যা আর কিছু বলতে পারলো না পল্লবী ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো মেয়েকে। অনন্যা থতমত খেয়ে গেল।
মাথা নিচু করে রইলো সে। মাথার ভেতর ধাঁধার মতো শব্দ গুঞ্জন তুলছিল। শরীর ভারী হয়ে এলো। আর কিছু না ভেবে শুধু মায়ের দিকে তাকালো অনন্যা। পল্লবীর চোখে তখন আগুন ঝরছে। রাগে-ঘৃণায়-অবিশ্বাসে ঠাসা সে দৃষ্টি। কোনো কথা না বলেও মেয়েকে তীব্রভাবে দোষারোপ করে ফেললো যেন।
অনন্যা নিচু হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। কাঁপা গলায় বললো,
"দুঃখিত।"
অনন্যার মা ডাক্তারকে নিয়ে বাইরে আসলেন। ডাক্তারের বয়স সাতাশের কাছাকাছি। নতুন নতুন হসপিটালে যোগ দিয়েছে, নাম প্রাঞ্জল! অনন্যার মা চা বিস্কুট খেতে দিলেন। প্রাঞ্জল অনন্যা কে কি কি ওষুধ দিতে হবে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিল। অনন্যার মা হাসতে হাসতে গল্প করতে লাগলেন ডাক্তারের সাথে। বুঝিয়ে বললেন মেয়ের কথায় কিছু না মনে করতে। প্রাঞ্জল বললো সেও কিছু মনে করেনি। শুধু আগ বাড়িয়ে জানতে চাইলো,
"আপনার মেয়ের হাসবেন্ড কোথায় জানতে পারি কী? আসলে বাচ্চার কথা ভেবে আমি চিন্তিত কিছু মনে করবেন না দয়া করে।"
অনন্যার মা হাত নাড়িয়ে বললো,
"আরে না না কি যে বলো, বাবা। কী মনে করবো আর? মেয়ের হচ্ছে ওর ভার্সিটির স্যারের সাথে বিয়ে হয়েছিল। ছেলেটাকে ভালোই মনে হয়েছিল আমার। বিদেশি ছেলে বুঝেছো? অনন্যার বাবার অনেক সাহায্য ও করেছিল। ওই ছেলেটার জন্য ই আমরা এখন ভালো আছি, ওর বাবার চাকরি আছে। কিন্তু কিছু দিন আগে অনন্যাদের ভার্সিটিতে দানবের হামলা হয়। খবর তো দেখেছোই নিশ্চয়ই? আমার মেয়েও ছিল সেখানে। সেদিন থেকেই ছেলেটাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মেয়েও স্বামীর চিন্তায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। এখন বাচ্চারা বড় হয়েছে। সবকিছু তো আর বলে না। ছেলেটা এখন কোথায় গেছে বলতে পারছি না।নাকি আমাদের মেয়েটাই বড় কোনো ভুল করেছে তাও বলতে পারছি না। জিজ্ঞেস করলেও বলে না। এই বাচ্চার কী হবে এই নিয়ে চিন্তা করিনি এখনো আমরা!"
প্রাঞ্জল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
"আমার ও অনন্যা কে চেনা চেনাই লাগছিল। শুধু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছিলাম না। "
অনন্যার মা হাসার চেষ্টা করলো। এর পরে আর কথা তুললেন না। ওইদিনের পর অনেকেই রাস্তায় অনন্যার সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করতো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে কি হয়েছিল না হয়েছিল। কিন্তু মেয়ে তো এমনিতেই স্বামীকে হারিয়ে কষ্টে ছিল এদের কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল একদম। বাসায় এসে আরো কান্নাকাটি করতো। নোহারা আর পল্লবী মিলেই সামলিয়ে ছিল মেয়েটাকে।
প্রাঞ্জল চা শেষ করে উঠে দাড়িয়ে বললো,
"আমি মাঝে মাঝে আসবো অনন্যা কে চেকাপ করতে। "
"হ্যাঁ?"
অনন্যার মা অবাক হয়ে গেলেন।
"চিন্তা করবেন না কোনো ফি লাগবে না। শুধু মনে করবেন নিজের পেশিয়েন্টের চিন্তায়ই এসেছি।"
অনন্যার মা মাথা নাড়লেন। ডাক্তার কে বিদায় দিলেন।
********
"ইশুইই! এই ইশু! কোথায় তুই?"
মেহজাবিন বেগম চিন্তিত হয়ে ডাইনিং রুমে আসলেন। হাতে বড় বড় প্লেট। ধীরে সুস্থে টেবিলে রাখলেন তিনি। মাথা ঘুরিয়ে সিঁড়ির উপরে থাকা ছেলের রুমের দিকে তাকালেন তিনি।
কৌশিক নিজের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলো। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
"মা! কি সব নামে ডাকছো? আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি?"
পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো ছোট ভাই নুহাশ। ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো,
"হ্যাঁ, ভাই আমার ছোট ই রয়ে গেছে। শুধু আমার বয়সটা বাড়ছে।"
কৌশিক নুহাশের মাথায় বারি দিয়ে বললো,
"তোকেও তো ডাকে! নুহু! ও নুহু!"
কৌশিক কথাটা বলেই সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে যেতে লাগলো। নুহাশ জোর গলায় বললো,
"মা! তুমি না তোমার ইশুকেই খাওয়াও। আমি নিচে আসছি না।"
মেহজাবিন বেগম ডালের বাটি নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসতে আসতে বললেন,
"আমি সবাইকেই ডেকেছি শুধু কৌশিককে না। তুই ও নিচে আয়। নাহলে কানের নিচে দশটা থাপ্পড় পড়বে।"
কৌশিক মৃদু হাসলো। চেয়ার টেনে চুপটি করে বসলো। নুহাশ রেলিংয়ে হাত রেখেই বললো,
"না, মা! তুমি শুধু ইশু! এই ইশু বলেছো। মিস্টার ইশতেহার কৌশিককে ডেকেছো। নুহাশ ইফতেখারকে নয়। ওকে!"
মেহজাবিন রাগী গলায় বললেন,
"আমার বড় ছেলে এক বছর পর সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছে। ওকে আমি আদর করবো না তো কাকে করবো? নিচে আয় বলছি আরেকবার যদি ডাকতে হয় তোর খাবার আমি ফ্রিজে রেখে দিবো।"
কৌশিক মায়ের কথা শুনে মুখের হাসি মুছে ফেললো। চক্ষু দ্বয় ঘোলা হয়ে গেলো তার। একবছর ধরে সে ঘুমে ছিল ভাবতেই ঝিম ধরে যায়। পুরোনো সকল কথা মনে করার চেষ্টা করতেই মাথায় চাপ পড়ে। কেমন ঘুরতে থাকে সবকিছু। মাথায় হাত চেপে ধরে সে। অল্প আর্তনাদ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।
·
·
·
চলবে.................................................................................