মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৮০ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          নিক ধীরে ধীরে উঠে বসলো। শরীরে ব্যথা এখনো রয়েছে। নোহারা মুখ তুললো। নিকের দিকে তাকালো। কোনো কিছু চিন্তা না করে ঠাস করে চড় মেরে বসলো। নিক তো হতবাক। নিজের চড় খাওয়া গালে হাতে রেখে সে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। চারপাশে অনেক অনেক রোগীরা অবস্থান করছে। এর মধ্যে কিছু মানুষের চোখে এই বিষয়টা চোখে পড়লো। নোহারা সেদিকে খেয়াল করলো না। নিকের শার্টের কলার টেনে জোর গলায় বললো,
"তোমাকে কে বলেছিল ওদের মাঝে যেতে? নিজের ক্ষতি করতে খুব ভালো লাগে তোমার?"

নিক কিছুক্ষণ চুপ ই রইলো। অতঃপর নোহারার গালে হাত মিশিয়ে বললো,
"ওদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।"

নোহারা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে ফেললো। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"যে তোমাকে শেষ করার আগে একবার পর্যন্ত ভাবলো না তার উপর আবার কীসের দায়িত্ব? আগে কৌশিক স্যারের উপর যতটা ভালো লাগা কাজ করতো এখন ততটাই ঘৃণা কাজ করছে আমার। ভালো হয়েছে চলে গেছে। আর না আসুক!"

নিক ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো। আচমকাই শরীর থেকে সব যন্ত্রপাতি সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। গলা কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
"কৌশিক চলে গেছে?"

তার আচরণে বিস্মিত হয়ে নোহারাও উঠে দাঁড়ালো।নিককে ধীরে ধীরে আবার বসতে বললো। কণ্ঠে চিন্তা রেখেই শান্ত স্বরে বললো,
"হ্যাঁ ওইটাই তো কৌশিক স্যার ছিল তাই না? কী ভয়ংকর! অনেকখানি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে, নিউজেও প্রচার হয়েছে। পৃথিবীতে প্রথমবার এমন ঘটনা! কিন্তু তুমি ছাদে আসার পর ক্যামেরায় সমস্যা জাতীয় কিছু হয়েছিল। আর কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কৌশিক স্যারের দেহ ও পাওয়া যায় নি। অনেকে বলছে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। অনন্যা কে তো পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।"

সে একটু থেমে বললো,
"আর তুমি কোথায় যাচ্ছো? এখনো দুপুর। শরীর ঠিক হয়নি, কিছুটা বিশ্রাম তো দরকার!"

নিক কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো হাসপাতালের দরজা ঠেলে। নোহারাও দেরি না করে তার পিছু নিলো। হাসপাতালের চত্বরে তখন কোলাহল!মানুষের ছুটোছুটি আর উদ্বিগ্ন স্বজনদের কান্না। অনেকেই তখনও জানে না তাদের প্রিয়জনেরা বেঁচে আছে। কিন্তু সুস্থ ছাত্রছাত্রীরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছে দেখে আশার আলো জ্বলছে মানুষদের মুখে। কয়েক দিন ধরে যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিল তারাও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।

নিক বাইরে এসে চারপাশে তাকালো। এক নজরে ট্যাক্সি খুঁজে বেড়াতে লাগলো। নোহারা দ্রুত এসে বললো,
"তুমি কি করছো? তোমার শরীর তো সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না তাই না? ভেতরে চলো, প্লিজ! তোমার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না।'

নিক আচমকাই থমকে দাঁড়ালো। সূর্যের আলোয় ভ্যাম্পায়ারদের শরীর আসলেই ঝলসে যায়। চোখ ঘুরিয়ে উপরে তাকালো সে। আসলেই খুব কড়া রোদ পড়েছে। মাথার উপর সূর্য। গরমে মানুষের শরীর থেকে ঘাম ছুটছে। কাল পর্যন্ত বৃষ্টি ছিল। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো নিকের শরীরে কোনো ব্যথা লাগছে না। সূর্যের তাপ তার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না যে সে এখানে থাকতে পারবে না। আলোয় ঝলসে যাবে সে এরকম কোনো অনুভব ই হচ্ছে না নিকের। হতভম্ব হয়ে সে হাত তুললো আকাশের দিকে। তার কাঁধ, তার হাতের তালু! সব আলোয় স্নান করছে অথচ কিছুই হচ্ছে না। সেই দানবীয় অভিশাপ মুছে গেছে, তার ভ্যাম্পায়ার সত্ত্বাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

নিক ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো। আরো গভীরে ডুবে গিয়ে সেই চিরচেনা শক্তির আবেশ খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু কেমন একটা শুনশান শূন্যতা, কোথাও কোনো সাড়া নেই। সে বুঝতে পারলো তার ভ্যাম্পায়ার সত্ত্বা আর নেই। শুধু মানুষরূপেই দাঁড়িয়ে আছে সে সূর্যের আলোয় স্নিগ্ধ এক চিত্র হয়ে।

নোহারাও চমকে উঠলো। নিকের পাশে এসে দাঁড়ালো। নিকের চোখ অনুসরণ করে সেও সূর্যের দিকে তাকালো। নিক ফিসফিসিয়ে বললো,
"লিটেল গার্ল! কৌশিক কি সত্যিই চলে গেছে?"

নোহারা কোনো উত্তর দিলো না।নিক আবারো বললো,
"ও তো আমাকে সাধারণ মানুষে পরিণত করে দিয়ে গেছে।"

নোহারা চোখের পাতা ফেললো কয়েক বার। চোখ ঘুরিয়ে নিকের দিকে তাকালো। তার কাঁধ পর্যন্ত ছোট চুল গুলো দুলে উঠলো। নিকের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে কাঁপা গলায় নোহারা বললো,
"আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।"

নিক নোহারার মাথা নিজের শরীরে চেপে ধরলো। সূর্যের আলোর দিকে নিজের আরেক হাত বাড়িয়ে বললো,
"আমার নিজের ই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটাই সত্যি। আর কখনো আমাকে অন্য কোনো মানুষের রক্ত পান করতে হবে না, নোহারা। আমি তোমাদের মতোই এখন সাধারণ।"

নোহারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনমিনিয়ে বললো,
"আমি শুধু তোমার সুস্থতা চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার সাথে সময় কাটাতে। তোমাকে যখন ওই অবস্থায় দেখলাম মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল আমার। কৌশিক স্যারকে কত খারাপ কথা বললাম। গালিগালাজ করলাম। কিন্তু এখন খুব খারাপ লাগছে। উনি কি কখনো ফিরবে না? না জানি অনন্যার কি হাল!"

*******

অনন্যা পুলিশ স্টেশনের অন্ধকার এক কক্ষে চুপচাপ বসে ছিলো। মাথাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল সে। ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে। মুখে একফোঁটাও শব্দ নেই। পুলিশের প্রশ্ন একটার পর একটা চলতেই আছে অনর্গল,
“আপনি কি তাকে চেনেন?”
“ওই লোকটা কে ছিল?”
"পরে কোথায় উধাও হয়ে গেলো?"
"আপনি তলোয়ার কোথা থেকে পেলেন?"
"শুনুন লোকটা যদি কোনো জলজ্যান্ত মানুষ হয় আর আপনি তাকে চিনে থাকেন এখনি বলে দিন। কারণ তিনি অনেক মানুষের জীবন নিয়েছেন। হ্যাঁ অনেকেই সুস্থ হয়ে ফিরেছে কিন্তু যারা চলে গেছে তাদের দায়ভার তো তাকে নিতেই হবে তাই না? তাই জানলে এক্ষুনি বলে দিন ভালোয় ভালোয়। "

অনন্যা চুপ করে বসেই রইলো। পৃথিবীর কোনো আওয়াজ তার কানে পৌছাচ্ছে না। শুধু চোখে ভেসে উঠছে কৌশিক স্যারের চলে যাওয়ার সময়টা। স্যারের দানবের শরীরে ঠোঁটের কোণে শেষ পর্যায়েও হাসি ছিল। তিনি খুশি ছিলেন। অনন্যা কে শেষ পর্যন্ত সুস্থ দেখতে পেয়ে তার মুখটা খুশিতে জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ করেই অনন্যার চোখ বেয়ে নেমে এলো টপটপ করে অশ্রু। শেষ পর্যন্ত ধরা গলায় কান্না আটকে রাখার চেষ্টাটুকু ব্যর্থ হয়ে গেল। একসময় সে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়লো। হাউমাউ করে চিৎকার করতে লাগলো সে। দু'চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। শরীরের প্রাণটা নিঃশেষ করে দিতে ইচ্ছে করলো।

তিনজন পুলিশ ছিল। পুলিশেরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো অনন্যার দিকে। ভড়কে গিয়ে একে অপরের দিকে তাকালো তারা। অবশেষে অনন্যার মা ও ভাই এসে পৌঁছালো পুলিশ স্টেশনে। পুলিশ অনন্যাকে দুজনের হাতে তুলে দিলো। আর উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
“মেয়েকে কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান। ওর ব্যবহার আমাদের কাছে বেঠিক মনে হচ্ছে।”

অনন্যা তখনো চুপচাপ। অশ্রু-ভেজা চোখে সামনে তাকিয়ে আছে। প্রাণ নেই সে চোখে। যার কারণে প্রাণ ছিল, সুখ ছিল সে চোখে সে তো নেই। পুলিশ লোকটা আবারো বললো,
"আর উনার যদি ওই দানবটা সম্বন্ধে কোনো কিছু মনে পড়ে অবশ্যই জানাতে বলবেন। ফোন করবেন অথবা এখানে নিয়ে আসবেন।"

অনন্যার মা পল্লবী শুধু মাথা নাড়লেন। পল্লবী অনন্যা কে ধরে নিয়ে যেতে লাগলেন। অনন্যাও অসহায় দৃষ্টি নিয়ে হাঁটতে লাগলো।

হোটেলে ফিরলেন তারা। অনন্যার মা মেয়েকে নিজের রুমে বসালেন। বললেন,
"আমি খাবার গরম করে নিয়ে আসছি। তুই চাইলে হাত মুখ ধুয়ে নে। অথবা থাক ধোঁয়া লাগবে না। আমি আসছি। চুপচাপ বসে থাক নড়িস না। কিছু খাওয়া দাওয়া হয়নি আজ।"

অনন্যা চুপচাপ ই বসে রইলা। পল্লবী রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গোছাতে লাগলেন। পূর্ব এসে বললো,
"মা! আপু এমন করছে কেনো?"

"আমি কিছু জানি না। হয়তো বড় শকে চলে গেছে।"
অনন্যার মা চটপট উত্তর দিলো।

"আমি বুঝতে পারছি না। এতো মানুষ থাকতে বিল্ডিংয়ের ছাদে ওকেই কেনো যেতে হলো। আর সেই তলোয়ার! এরকম মারামারি! আমার তো মনে হয় কোনো ভূতে ভর করেছিল ওর উপর।"

অনন্যার মা চেঁচিয়ে উঠলেন,
'চুপ থাক তো। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এসব আর চিন্তা করে লাভ নেই। ওর জামাইকে ফোন দে। ওই ছেলেটাই এখন ওকে ঠিক করতে পারবে। '

পূর্ব বিরক্ত হয়ে বসার রুমে এসে ফোনে কৌশিকের নাম্বার খুঁজতে লাগলো। নাম্বার পেয়ে কল দিতে দিতে চোখ ঘুরিয়ে মায়ের রুমের দিকে তাকালো।কিছুটা সন্দেহজনক মনে হলো পূর্বর কাছে। তাই এগিয়ে গেলো সে। এদিকে কৌশিকের নাম্বারে কল যাচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। পূর্ব ফোনটা নামিয়ে ধীরে ধীরে রুমের সামনে এগিয়ে গেলো। সামনের দৃশ্য দেখে মা মা বলে চিৎকার করতে লাগলো। পল্লবী দৌড়ে আসলো। অনন্যাকে রুমের দরজা পেরিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের উপর উঠতে দেখা গেলো। পল্লবী দৌড়ে গেলো। হাত কাঁপছে দুজনের। মেয়েটা কি পাগলামি করছে বুঝতে পারছে না কেউই। মায়ের বুক যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে আতঙ্কে। 

দুজনে মিলে টেনে হিচড়ে অনন্যাকে রুমে আনলো। পল্লবী অনন্যাকে আগেই থাপ্পড় মেরে বসলেন। অনন্যা আবারো কান্না শুরু করে দিলো। চিৎকার করে বুক ফাটিয়ে সে কান্না করলো। ওর বুকের হাহাকার কেউ বুঝতে পারছে না। এ ব্যথা একটা সংক্রামক রোগের মতো তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে কীভাবে পারলো নিজের ভালোবাসার মানুষকে হত্যা করতে? তার তো মরে যাওয়া উচিত! বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই অনন্যার। যে মানুষটি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে শুধু রক্ষাই করে গেলো তাকেই মেরে ফেললো সে। এই চরম আঘাত নিয়ে সে কীভাবে সারা জীবন কাটাবে! আর সে মানুষটা যাকে ছাড়া একদিন কল্পনা করা কঠিন হয়ে যেত তাকে বিহীন কীভাবে জীবন কাটাবে অনন্যা?এই সব ভাবতে গেলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মনে হয় যে সব স্বপ্ন। অনন্যা আর পারছে না সহ্য করতে। এদিকে ওর মা, ভাই বুঝতেও পারছে না কি হয়েছে মেয়েটার।

*******

ল্যুমিস নদীর তীরে রয়েছে বিস্তৃত বালুর চাদর। সেই বালুকাবৃত ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট কাঠের ঘর। এরা মূলত বাড়ি নয় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গড়ে ওঠা সাময়িক আশ্রয় বলাই যায় এদের।
এখানে মূলত বাস করে সেইসব যাত্রাজীবী মানুষরা যারা স্থিরতার বাঁধনে বাঁধা পড়ে না। ছয় মাস বা বড়জোর এক বছর তারপরই তারা পাড়ি জমায় অন্য কোনো নতুন গন্তব্যে। এই এলাকাটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক প্রকার অস্থায়ী জীবনচক্র যেখানে শেকড় ছড়ানোর সুযোগ নেই। স্থানীয়রা একে জিপসিদের বসতি বলেই চেনে।

ল্যুমিস নদী নিজেই তো বেপরোয়া সত্তা। কখনও শান্ত, কখনও হঠাৎ উত্তাল। মাঝে মাঝে ঘূর্ণিঝড় কিংবা আকস্মিক বন্যা এসে সবকিছু গিলে ফেলে। যেটুকু গড়ে ওঠে সেটুকুই আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই কেউ স্থায়ীভাবে এই নদীতীরের বুকে আশ্রয় গড়তে সাহস পায় না। এখানে মানুষ আসে, বাঁচে, আবার হারিয়ে যায় ।নদীর মতোই অস্থির আর অনির্ভরযোগ্য তাদের জীবনযাত্রা। 

নদীর পাড়ে পাথরের মতো একটি উঁচু জায়গায় রয়েছে কৌশিকের দেহ। একদম সাধারণ অবস্থায় ফিরে এসেছে সে। ফর্সা হলুদ চ্যাপ্টা শরীরের পেটে ভয়ানক ক্ষত চোখে লাগছে। পেটের ভিতরের অংশ উপচিয়ে বেরিয়ে এসেছে, রক্ত ঝরতে ঝরতে শুকিয়ে গেছে সেই অংশ। আর বুকের ডান দিকের অংশে আরিসার তলোয়ার গাঁথা যা নিয়েই কৌশিক উধাও হয়ে গিয়েছিল। আরিসার আত্মা কৌশিকের দেহের সামনেই দাঁড়িয়ে। কৌশিককে এই অবস্থায় দেখে তার মুখে হাসি লেগেই আছে। এতো বছর যাবত যা করতে চেয়েছিল তা আজ সম্পন্ন। কৌশিকের বুকের সেই অংশে আঘাত করার সাথে সাথেই নীল পাথরটি ভেঙে গেছে। আর অমরত্বের সমাপ্ত এখানেই হয়েছে। কৌশিকের দেহের মুক্তি মিলেছে। ল্যুমিস নদীও এই নীল পাথর অথবা অমরত্বের দায়ভার থেকে মুক্ত হয়েছে। 

আরিসা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দূর থেকে আরণ্যককে আসতে দেখা গেলো। আরণ্যককে আরিসাই এখানে নিয়ে এসেছিল। আরণ্যক তার কথা রেখেছে। আরণ্যক ই অনন্যাকে সঠিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছিল। কারণ অনন্যা রূপী আরিসা সঠিক পথ জানতো না। আরণ্যক যদি সঠিক সময়ে তাকে পৌঁছে না দিত সবটা এমন নাও হতে পারতো। আর আরিসাও হয়তো কায়েরীথের মতো দানবকে আজ শেষ করতে পারতো না। আরণ্যক আরিসার পিছনে দাঁড়িয়ে বললো,
"তোমার কথামতো কয়েক জন মানুষকে আসতে বলেছি। ওরা আসছে। এখন বলো কী করতে হবে আমায়?"

আরিসা আরণ্যকের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললো,
"তেমন কিছু না। শুধু এই দেহটাকে নিয়ে ল্যুমিস নদীর মাঝপথে যেতে হবে। ভাসিয়ে দিতে হবে নদীতে। কায়েরীথের দেহ নিজের পথ খুঁজে নেবে। শাস্তি ও আগেই ভোগ করেছে। "

আরণ্যক নিচু কণ্ঠে বললো,
"আর তুমি?"

আরিসা হেসে বললো,
"আমি? আমার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আমার এই ভূখণ্ড ছাড়তে হবে। আমার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। এই যেমন এখানে আপনি ছাড়া এখন আর কেউ দেখছে না আমায়। আপনিও আপনার কার্য সম্পন্ন করে ফিরে আসলে আমাকে আর দেখতে পাবেন না। আর ভুলে যাবেন পুরাতন জন্মের কথা। আর যা যা সাহায্য করেছেন আমায় তাও মনে রাখতে হবে না। আমি ভুলিয়ে দেবো সবটা। সাধারণ জীবনে ফিরে যাবেন। এতো দিন যেভাবে ছিলেন সেভাবেই থাকবেন । রাজকুমারী আরিসা নামে যে এই দুনিয়ায় কেউ ছিল তাও মনে রাখতে হবে না।"

আরণ্যক এগিয়ে আসলো। আরিসার হাত চেপে ধরে বললো,
"এরকম করবে না। এসব ভুলে গেলে আরো কষ্ট লাগবে আমার।"

"না, রাজকুমার সায়েরিন। যখন মানুষ কোনো কিছু সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে তখনই কষ্টটা সবচেয়ে কম হয়। আপনি এখন আর সেই পুরোনো সেই রাজকুমার নন। এখন আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চরিত্র যার নিজস্ব ইচ্ছা আছে, উদ্দেশ্য আছে, ভবিষ্যৎ আছে। তাই পুরাতন জীবন নিয়ে পড়ে থেকে কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। আর হ্যাঁ, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি আপনাকে অনেক অসম্মান করেছি। যদি সেসময়টাতে আপনাকে গুরুত্ব দিতাম তাহলে সবকিছুই অন্যরকম হতো । "

আরণ্যক আরিসার হাত আলতো করে ধরে রেখেই বললো,
"আমি তোমাকে কখনোই খারাপ চোখে দেখিনি, রাজকুমারী। তুমি হয়তো যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে তা আগেই ঠিক করা ছিল। হয়তো এটা হওয়ারই ছিল। তাই কষ্ট পাবে না। যাদের প্রাণ গিয়েছিল তারাও হয়তো এখন কোথাও না কোথাও সুন্দর জীবন কাটাচ্ছে। কেই বা বলতে পারে কি হবে আগামীতে! যাই হোক, তোমার পরবর্তী যাত্রা শুভ হোক, রাজকুমারী। "

রাজকুমারী আরিসা মাথা নাড়লো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার। লোকগুলো আসতেই আরণ্যক কৌশিকের দেহ শক্ত করে তুলে নিলো। প্রচণ্ড ভারী ছিল কৌশিকের শরীর যার ফলে কয়েকজনকে সাহায্য করতেই হলো। সকলে মিলে যতক্ষণ না পর্যন্ত ল্যুমিস নদীর মাঝপথে পৌঁছোলো ততক্ষণ রাজকুমারী আরিসা দাঁড়িয়ে পুরোটা সময় দেখছিলো। হাওয়ার মাঝে তার লম্বা চুলগুলো তরতর করে উড়ছিল। কায়েরীথের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর সময় শেষ মনে হলে আরিসা হাওয়ায় নিজের হাত ঘুরিয়ে আরণ্যকের জন্য কিছু জাদু কার্য সম্পন্ন করলো‌। অতঃপর মূহুর্তের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেলো তার আত্মা। 

আরণ্যক ফিরতে ফিরতে আরিসাকে খুঁজছিলো। কিন্তু পেলো না তাকে আর। নদীর তীরে পৌঁছাতেই আরিসার করে যাওয়া জাদু বিদ্যা আরণ্যকের শরীরে কাজ করতে লাগলো। আরণ্যক পুরাতন জীবনের কথা ভুলে গেলো। ভুলে গেলো রাজকুমারী আরিসার কথা। চারপাশে তাকিয়ে এই জায়গা চিনতে পারলো না। সে কোথায় এসেছে আর কীভাবেই বা এখানে এসে পৌঁছেছে জানতে পারলো না। নদীর তীর পেরিয়ে রাস্তায় উঠে আসলো আরণ্যক। অতঃপর গাড়ি খুঁজতে লাগলো। গাড়ি ডাকাডাকির আর প্রয়োজন হলো না। গাড়ি নিজেই আসলো । আরণ্যককে কোনো লোকেশন ও বলতে হলো না। গাড়ি নিজেই আপনমনে অজানা রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলো। আরণ্যক গাড়িতে বসে ঝিমিয়ে পড়লো। চারপাশে কি চলছে তার খেয়াল রাখতে পারলো না আর। রাজকুমারী আরিসা দূর থেকেই আরণ্যককে বিদায় দিলো। মুখে হাসি নিয়ে সে ল্যুমিস নদীর দিকে তাকালো। কায়েরীথকেও বিদায় দিলো আরিসা। অতঃপর মিলিয়ে গেলো সে।

অন্ধকার রাত। আকাশে বড় চাঁদ। এই অন্ধকার রাতেই ল্যুমিস নদীতে ঘটল এক আশ্চর্যজনক কাণ্ড। কৌশিকের দেহ ল্যুমিস নদীর তলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশে রাত নেমেছে। কৌশিকের দেহ তলে পৌঁছাতেই বিকট একটা আওয়াজ হলো। তীরে থাকা ঘরবাড়ির মানুষজন ঘুম থেকে জেগে উঠলো। বেরিয়ে এলো তারা বাড়িঘর থেকে। কি হয়েছে বোঝার জন্য নদীর তীরে ছুটে আসলো সকলে। কিন্তু কারোর চোখেই কিছু ধরা দিলো না। ধরা দিলো না একটি আত্মা ল্যুমিস নদীর তলে থাকা কৌশিকের ক্ষত বিক্ষত দেহ থেকে বেরিয়ে এসে আকাশে অবচেতন মনে ঘুরঘুর করছে। খুঁজে যাচ্ছে কাউকে। সময়ের সাথে সাথে সবার চোখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেলো সেই আত্মা। দূরে বহুদূরে হলো তার বিচরণ। সাপের মতো তরতর তার গতি। কিন্তু পরবর্তী স্থান কোথায় হবে তার?
·
·
·
চলবে...............................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp