মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - অন্তিম পর্ব ৮১ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"আমার শক্তি কি আর ফিরে আসবে না?"
নিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আপন মনে প্রশ্নটা করে ফেলল। কণ্ঠে চিন্তা এবং মুখমন্ডলে তার একরাশ অস্থিরতা ছড়িয়ে রয়েছে।

রুমের এক কোণে থাকা সোফায় বসে ছিল ভেনোরা। অনেক দিন ধরে ঠিকমতো চোখের পাতা এক হয়নি। হৃদয়ের ভিতরে জমে থাকা যন্ত্রণার পাহাড়টা আজ আরও ভারি হয়ে উঠেছে। কৌশিকের অস্তিত্ব জীবন থেকে মুছে যাওয়ার পর থেকে ভেনোরা নিজেকে দেখতেই পারছে না। মনে হচ্ছে সব ওর ভুলের কারণেই হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে বিধাতা কাজটা ওর মাধ্যমেই করাতে চেয়েছিলো এটা কে জানতো। কে জানতো কৌশিকের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে শুধু ওর ই হাত থাকবে। দিন যায়, রাত যায় কিন্তু ভেতরের শুন্যতা কোথাও থামে না। উল্টো আরো বেড়ে চলেছে। ব্যথাগুলো সমগ্র শরীরে খামচে ধরেছে। অসহায়ের মতো পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

নিকের সেই প্রশ্নে হঠাৎই সম্বিত ফিরে পেল আরিসা। গলার স্বর কেঁপে উঠল তার। মাথায় হাত দিয়ে চাপ দিল।

ভেনোরা ধীরে বলল, 
"কিয়ান তোমার শক্তি গ্রহণ করেছিল এজন্য সেটা উধাও হয়ে গেছে।"

"কিন্তু যেভাবে মানুষের প্রাণ ফিরে এলো আমার শক্তি ফিরে আসলো না কেন?"

নিকের কথা শুনে ভেনোরার মনেও ঠিক একই প্রশ্ন জেগে উঠলো। কৌশিক চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে মানুষের প্রাণ ফিরে এসেছে কিন্তু নিকের শক্তি ফিরলো না বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। ভেনোরাও ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। কি করে খুঁজবে মন ও যে বসছে না। 

কালো টিশার্ট পরা নিক ধীর পায়ে এসে ভেনোরার পাশে বসলো। ভেনোরার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আচ্ছা কৌশিকের তো বয়স থেমে গিয়েছিল, তাই না? তাহলে কি কোনোভাবে ওর ফিরে আসা সম্ভব? আমি কিছুতেই মানতে পারছি না ও নেই। সেই রাগী ছেলেটা যার কথায় বাতাস থমকে যেত আজ সবাই তাকে দানব বলছে, নানান গালি দিচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে ও ছিল ঠিক বড় ভাইয়ের মতো। শেষের দিকে কৌশিক যা করেছে তা ঠিক নয় কিন্তু আমরা এটাও জানি কৌশিক নিজের মধ্যে ছিল না। তখন ঠিক ভুল চিন্তা করার সময় ছিল না। তখন শুধু হৃদয় কথা বলে আর তার কথাই শুনতে হয়। নাহলে মস্তিষ্ক সেই স্থান দখল করে ফেলে। "

চুপ করে গেল নিক। ভেনোরা আচমকাই দাঁড়িয়ে উঠলো। নিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"তুমি নিজের অজান্তেই একটা বড় কথা বলে ফেলেছো।"

"হু?"
নিকের কপালে ভাঁজ পড়লো। ভেনোরার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে কোনো এক আশার আলো খুঁজে পেয়েছে মেয়েটা। 
ভেনোরা উত্তেজিত গলায় বললো,
"আমি আসছি‌।" 
বলেই ভেনোরা দ্রুত পেছন ফিরে হাঁটা ধরলো।

"কোথায় যাচ্ছো?"
নিক উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো।

ভেনোরা ফিরে তাকিয়ে হালকা হাসলো। সেই পুরোনো হাসি মুখমন্ডলে ফিরে এলো যেন।

"ঠিক আছে তুমিও আসো।" 
বলে সে আবারো পেছন ফিরলো। দ্রুত হাঁটতে লাগলো। মনের সেই সন্দেহ দূর করতে আর এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না।

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নিক তখনও বুঝতে পারছে না ঠিক কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু ভেনোরার চোখের ঝলক তাকে নিঃশব্দে ডেকে নিচ্ছে।

কৌশিকের আয়ু থেমে গিয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় বাঁধা পড়ে ছিল ওর জীবনযাত্রা। সময়ের চাকা কৌশিকের জন্য ঘুরতো না। শৈশব, কৈশোর সে দেখে এসেছিল কিন্তু বার্ধক্য তার জীবনের অভিধানে ছিল না।
তার এই অস্তিত্বকে সুরক্ষিত রেখেছিল নীল পাথর। বছরের পর বছর সেই পাথরের খাঁচায় সে থেকেছে নিরাপত্তায়। কিন্তু সেই নিরাপত্তার মূল্য ও ছিল চরম নিয়মানুবর্তিতা। নিয়ম ভাঙা মানেই সবকিছু হারিয়ে ফেলা। শরীরের অধঃপতন স্বীকার করা।চরম ব্যথা সহ করা, সেগুলোকে শাস্তি হিসেবে নেওয়া। আর তা সহ্য করতে না চাইলে অবশ্যই শক্তি অন্যজনের শরীরে স্থানান্তরিত করা। যা চাইলেই করতে পারতো কৌশিক। কিন্তু এরপরের সময় কীভাবে চলবে তা জানতো না কৌশিক। তার শরীর কি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতো নাকি অমৃত শক্তির উধাও হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়ে যেত? এসবের কিছুই জানতো না কৌশিক। কখনো চেষ্টাও করেনি জানার। তাই কৌশিকের মৃত্যু তো কোথাও লেখা ছিল না।

আরিসা কায়েরীথকে মেরে ফেলেছে এই কথা ভুল। আরিসা শেষ করেছে কায়েরীথের দেহ অর্থাৎ তার শরীরকে। সেই দেহে অবস্থিত নীল পাথরটিকে শেষ করার সাথে সাথে কৌশিকের দেহ থেকে অমৃত শক্তি চিরজীবনের জন্য উধাও হয়ে যায়। কিন্তু কৌশিকের আয়ু সেটা তো তখনও শেষ হয়নি।

ভেনোরা হাঁটতে হাঁটতে একটা রুমে প্রবেশ করলো। নিক ভেতরে প্রবেশ করতে অস্বস্তি বোধ করছিল। এই রুমে কৌশিকের ই আনাগোনা বেশি। কৌশিকের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যে ছিল এই রুমে। ছেলেটা থাকলে নিশ্চয়ই বকাঝকা করতো। রেগে গিয়ে তার জাদুবিদ্যা নিকের উপর প্রয়োগ করতেও দ্বিধা বোধ করতো না। ভেনোরাও অনুমতি ছাড়া কখনও প্রবেশ করেনি কিন্তু আজ তো কৌশিক নেই। তার অনুমতি নেওয়ার ও কোনো প্রয়োজন নেই। তাই সময় নিয়ে নিক ও গেলো ভেনোরার পিছু পিছু। রুমে ঢুকতেই ভেনোরার দৃষ্টি আটকে গেলো চারপাশের জিনিসপত্রে। পরিপাটি এবং সুন্দর করে সাজানো সবকিছু। সাজিয়েছে নিঃসন্দেহে কৌশিক নিজেই। ভেনোরা কৌশিকের নিঃশব্দ স্পর্শ টের পেলো চারপাশে।

চুপচাপ এগিয়ে গেলো একটা কাঠের শেলফের দিকে। শেলফটিকে একটু ধাক্কা দিতেই চোখে পড়লো কৌশিকের তলোয়ার। সেই লম্বা তলোয়ার যা দিয়ে কৌশিক সবসময় লড়াই করতো তাই রাখা আছে এখানে। ভেনোরা ধীরে ধীরে তলোয়ারটি হাতে নিলো। সময়ের ব্যবধানে তার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। চোখের সবুজ মণিতে কিছু দৃশ্য ঝলসে উঠলো। ঝাপসা আলোয় দেখা গেলো কোনো আত্মা ঘুরঘুর করতে করতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে এক মৃতদেহের ভেতর। দেহটা নিঃসন্দেহে প্রাণহীন মৃত্যু হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। অপারেশন রুমের মাঝে পড়ে ছিলো দেহটি। ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছিলো। মৃত ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ঠিক তখনই এমন এক ঘটনা ঘটলো। হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা সেই লোকটার চেহারা অস্পষ্ট। ভেনোরা চোখ কুঁচকেও তাকে দেখতে পেলো না। কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে গেলো সবকিছু। আর কিছু বোঝার আগেই ভেনোরার ভিশনটা মিলিয়ে গেলো।

ভেনোরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতে থাকা কৌশিকের তলোয়ারের দিকে চোখ চলে গেল। মস্তিষ্কে প্রশ্নরা দানা বাঁধলো 
"এর অর্থ সত্যিই কিয়ান ফিরে এসেছে?"

********

সেমিস্টার ফাইনাল আজ শেষ হলো। সেই দানবের কাহিনীর পর বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ দিন বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থী এবং প্রফেসররা সবাই প্রচণ্ড আতঙ্কে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলে ধীরে ধীরে ক্লাসগুলো আবারও চালু করা হলো। অনন্যা কোনো রকমে এই সেমিস্টারটি শেষ করেছে। নোহারা তাকে সাহায্য করেছে তাই কোনোভাবে সে এগিয়ে এসেছে। নাহলে পরীক্ষায় বসার মানসিকতা ছিল না তার। পড়াশোনা প্রথম দিকে ভালোই চলছিল বিশেষত কৌশিক স্যারের সাথে। কৌশিক স্যারের সাহায্য, পরামর্শ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্যারের ভালোবাসা, স্যারের কেয়ার তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সেভাবেই তো অনন্যার পড়াশোনা এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে তা কখনোই ভাবেনি অনন্যা। লোকটার রহস্যময় মনোভাব সত্যিই অনন্যা কে ভাবনায় ফেলে দিতো কিন্তু সত্যি যে এভাবে একদিন একা করে চলে যাবে তা যেন কল্পনায় ও ভাবতে পারেনি। ভাবতে পারেনি সেই বিদেশি সুন্দর মুখশ্রী, নীল মণিওয়ালা সুন্দর যুবককে আর চোখে দেখা হবে না। এই দু চোখের পাতায় আর কখনো সেই লোকটার ছায়া পড়বে না। 

এক্সিডেন্টের পর কৌশিক স্যারের চলে যাওয়া অনন্যাকে প্রচণ্ড শকে ফেলে দেয়। চার-পাঁচ দিন একেবারে কারও সাথে কথা বলেনি সে। কেবল চুপচাপ বসে থাকতো। কেউ কিছু জানতে চাইলে উত্তরও দিতো না, শুধুই এক অজানা ভাবনা ঘুরে বেড়াতো তার মনের মধ্যে। ভাবতে ভাবতে আচমকাই প্রচন্ড চিৎকার করে কান্না করতো অনন্যা। রাতেও ঘুমাতে পারতো না। যেই লোকটা ঘুমের সঙ্গী ছিল, নিত্যদিনের ভালো লাগা ছিল, যাকে ছাড়া অনন্যার দিন অসম্পূর্ণ ছিল সে তো চলে গেছে কি করে ঘুমাবে অনন্যা?

সবকিছু ধীরে ধীরে স্বপ্ন হয়ে যাচ্ছিলো অনন্যার কাছে। হঠাৎ বিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে ভালো লাগা, ভালোবাসা ! এই রহস্যময় পুরুষটা নাকি ভালোবাসা বোঝে না, কাউকে ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব নয় তাও অনন্যা কে সে তার শরীর, মন সব দিয়ে দিয়েছিল। এসব কী করে ভুলবে অনন্যা! মাত্র কয়েক মাসের পরিচয় তাও কত আপন, কত কাছের। রহস্যময় মানবের রহস্য খুঁজতে খুঁজতে সে যে নিজেই ফাঁদে পা ফেলে দেবে, এতো এতো ভালোবেসে যাবে সেটা কী জানতো অনন্যা! এসব ভাবতে ভাবতেই প্রচন্ড কেঁদে ফেলে মেয়েটা। নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে যায়। কিন্তু কষ্ট? তা তো কমে না। সময় চলে যায়। দিনের পর দিন যায় সে মানুষটা যখন ফেরে না, তার যখন খোঁজ পাওয়া যায় না শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে। 

সবাই অনন্যার এই পরিবর্তনে হতাশ হয়ে পড়েছিল। অনন্যার মা বাবা মেয়ের এই অবস্থা দেখতে পারছিলেন না। তাই একদিন পূর্ব কে পাঠিয়েছিলেন কৌশিক স্যারের বাড়িতে। সে গিয়েছিল কিন্তু বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায় দেখে আবারও ফিরে আসে। অনন্যার পরিবার ওর জামাইয়ের চলে যাওয়াতে আরো চিন্তায় পড়ে যায়। একদিকে তো মেয়ের খুব করুণ অবস্থা অপরদিকে জামাইয়ের কোনো পাত্তা নেই। সব নিয়ে খুব ঝামেলায় ছিলেন তারা। মেয়ের অবস্থা দেখে এদিকে ওর বাবাও দেশে আসতে চাইছেন। যদিও কাজের চাপে এখন তেমন একটা সুযোগ হচ্ছে না। কিন্তু খুব শিগগিরই তিনি আসবেন এই কথাই বারবার বলে চলেন ভিডিও কলে।

নোহারার সাথে বাসায় ফিরছিলো অনন্যা। নোহারা প্রতিদিনের মতো বকবক করেই যাচ্ছে। অনন্যা শুধু চুপ করে পাশে হেঁটে যাচ্ছে। ওর হাবভাব দেখে মনে হয় শরীরে কোনো প্রাণ নেই। শুধু চলার জন্য জীবন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পারলে সব ছেড়ে দিয়ে হারিয়ে যেতো , শেষ করে দিতো নিজের জীবনটা। কিন্তু সেটা করাও সহজ নয়। সে তো নিজের কাছে নিজেই পাপী হয়ে যাবে। এজন্যই মৃত মানুষের মতো জীবন কাটানো। নোহারার অন্য স্থান দিয়ে যেতে হবে। সে যাওয়ার সময় অনন্যাকে বারবার বুঝিয়ে বললো বাসার পথেই যেতে উল্টাপাল্টা পথে হাঁটতে না। কারণ এই কয়দিনে এরকম কয়েক বার হয়ে গেছে অনন্যা চিন্তা করতে করতে অন্য পথে যাওয়া শুরু করেছে। রাস্তা হারিয়ে চুপটি করে শুধু দাঁড়িয়েই থেকেছে। বাসায় যাওয়ার কোনো চিন্তা করেনি। একদিন তো কৌশিক স্যারের বাড়ির সামনে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই দিকটায় এখন প্রায় কেউ যায় না। সেই জঙ্গলে কৌশিক স্যারের পোষা বাঘ রিডো ঘুরঘুর করে। অনেকে এই বাঘকে ধরতে এসেছিল। নিজের কব্জায় নিতে এসেছিল কিন্তু কেউ পারেনি। বাঘটা নিজের মনমর্জি মতো এখানেই থাকছে। তাকে থামানোও যাচ্ছে না , ধরাও যাচ্ছে না। সকলের কাছে রিডো হিংস্রতা দেখালেও অনন্যার কাছে খুবই নরম। মাঝেমধ্যে যখন অনন্যা আসে রিডো খুব খুশি হয়। ছুটে চলে যায় অনন্যার কাছে। অল্প স্বল্প গর্জন করে বুঝিয়ে দেয় সে ভালো আছে। কিন্তু অনন্যাও যে বোঝে রিডো নিজের মালিকের মতো বোকা। সে ভালো আছে বললেও অনন্যা বুঝতে পারে রিডো কৌশিককে ছাড়া একদম ভালো নেই। হয়তো এক ফোঁটাও না। কৌশিকের জন্য ই এই জঙ্গলে তার আনাগোনা চলে। রিডো বিশ্বাস করে তার মালিক একদিন ফিরে আসবেই। কিন্তু কে জানে ফিরবে কিনা লোকটা!

নোহারা বুঝিয়ে সুঝিয়ে চলে যায়। অনন্যা মাথা নাড়িয়ে হাঁটতে থাকে কিন্তু হোটেলের দিকে নয় নিজের মামার বাসার দিকে হাঁটতে থাকে সে। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে যায় সেই জুয়েলারির শপটি। নামটাও চোখে পড়ে। কৌশিক স্যার এখান থেকেই অনন্যার জন্য রিং কিনেছিল যেটা এখনো ওর হাতে বিদ্যমান। অনন্যা নিজের হাতের দিকে তাকায়। অনেকক্ষণ যাবত তাকিয়ে মুচকি হেসে ফেলে সে। অনন্যার মনে আছে শেষ যখন তারা ঘুরতে গিয়েছিল তখন কৌশিক স্যার বলেছিল তাকে খুঁজে পাওয়ার উপায়। 
কৌশিক স্যার বলেছিল,
"আমাকে মনে করবে, এসে পড়বো। তাও যদি না আসি, তিনটে গোলাপ দিয়েছিলাম না? নিয়মিত পরিচর্যা করবে। বুঝবো তুমি মিস করছো। তারপর যদি ইচ্ছে হয় আসবো, নাহয়...!"

শেষের বাক্যটা মনে পড়তেই অনন্যার চোখ বেয়ে আবারো অশ্রু ঝরতে লাগলো। সে তো করছে পরিচর্যা! গোলাপ ফুলগুলো আবারো লাল রঙে পরিণত হয়েছে। কি সুন্দর আলোকিত হয়। কি সুন্দর ঘ্রাণ দেয়। ওর রুমটা গোলাপের মিষ্টি সুঘ্রাণে ভরপুর থাকে। অনন্যা যতবার গোলাপ গুলোর দিকে তাকায় ততোবার সে লোকটাকে মনে করে। প্রতি ক্ষণে, প্রতি মূহুর্তে রহস্যময় লোকটার কথা, তার প্রিন্সের কথা কানে বাজে। অনন্যা কে পাগল করে ফেলে। সে কি বুঝে না অনন্যা শেষ হয়ে যাচ্ছে? 

অনন্যা একটু জোরেই কেঁদে ফেললো। জুয়েলারি শপের ভেতরের লোকজন বোধহয় তাকে খারাপ ভাবছে। সে তাড়াতাড়ি সরে যেতে নিয়েছিল। কিন্তু জুয়েলারি শপের দরজা খুলে একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো। অনন্যার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো। অনন্যা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ওর কান্না থেমে গেছে।‌ বয়স্ক লোকটা এগিয়ে এসে অনন্যার হাতে টিস্যু গুঁজে বললো,
"পানি পান করলে ভেতরে আসুন, ম্যাডাম! একটু জিরিয়ে যান।"

অনন্যা চোখ মুছে বললো,
"না না আমি কিছু কিনবো না।"

"কেনার কথা বলিনি। পানির জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। মন চাইলে চা ও দিতে পারি।"

অনন্যা ইতস্তত বোধ করলো। কিন্তু এমনিতেও তার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। কারণ বাড়িতে কৌশিক স্যার থাকবে না। মিসেস হার্ট, প্রিন্সেস এই ডাকনামে ডাকার মানুষটাকে বাসায় গেলে পাওয়া যাবে না। এই কষ্টে অনন্যার মরে যেতে ইচ্ছে করবে।‌এর চেয়ে কিছু সময় এখানে কাটালে ক্ষতিই বা কি? যেখানে তার প্রিয় মানুষটির উপস্থিতি এখানে একবার হলেও ছিল সেখানে অনন্যা অবশ্যই যেতে চায়।

অনন্যা মাথা নাড়লো। বয়স্ক লোকটা ভেতরে প্রবেশ করলো। অনন্যাও তার পিছু পিছু ভেতরে প্রবেশ করলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শপটা। ঠিক আগের মতো রয়েছে। আগের দোকানদারটাকেও দেখা যাচ্ছে এক কোণে। অনন্যাকে বসতে বলে চায়ের অর্ডার দিলো বয়স্ক লোকটি। অনন্যা বসলো না। সে নিজের রিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কৌশিক স্যারকে রিং দেওয়ার ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো না। কিন্তু আজ টাকা আছে তার কাছে। অনন্যার মামা বাবার পাঠানো কিছু টাকা ফেরত দিয়েছে অনন্যা কে। কিন্তু সেদিন ছিল না। সময় ও বড় অদ্ভুত জিনিস। যখন যেটা জরুরি সেটা মিলে না কিন্তু যখন জীবন থেকে মানুষ হারিয়ে যায় তখন সেই জিনিসটা অনায়াসে পাওয়ার জন্য ঘুরা ঘুরি করে। মিলেও যায় জিনিসটা। কিন্তু যে মানুষ হারিয়ে যায় তাকে আর পাওয়া যায় না।

অনন্যা চিন্তা করছিল। তখন চা আসলো তার কাছে। পুরোনো দোকানদারটি এগিয়ে আসলো। অনন্যা কে খুঁটিয়ে দেখতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কিছু নিবে কিনা। বয়স্ক লোকটা উত্তর দিলো,
"না উনি কিছু কিনবে না। তা আপনি কাঁদছিলেন কেনো?"
পরের প্রশ্ন অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে করলো বয়স্ক লোকটি।

অনন্যা বয়স্ক লোকটির দিকে একটু চমকেই তাকালো। লোকটা হেসে বললো,
"আপনাকে দেখে আমার মেয়ের কথা মনে পড়লো। ও এভাবেই কান্না করে। হা হা হা!"

অনন্যা হাসলো না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এক চুমুক দিলো। গরম চা তার জিহ্বা পুড়িয়ে দিলো। অনন্যা তাও তোয়াক্কা করলো না। মাথা নিচু করে বললো,
"আমি অভাগী যে নিজের হাসবেন্ডকে একটা রিং পর্যন্ত দিতে পারিনি তার আগেই উনাকে বিদায় দিতে হয়েছে। "

বয়স্ক লোকটা মৃদু হাসলো। নরম গলায় বললো,
"অভাগী বলবেন না। আপনার হাসবেন্ড আপনার প্রচেষ্টা দেখেই হয়তো খুশি হয়ে গেছেন। তাই দিতে পারেননি ওইটা কোনো বড় বিষয় না। বড় বিষয় হচ্ছে উনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার জন্য।"

অনন্যা চোখ তুললো। গলার স্বর কঠিন হলো তার,
"অনেক গুরুত্বপূর্ণ উনি। অনেক অনেক অনেক! এতোটাই যে উনি যদি শত ভুল ও করে থাকে আমি উনাকে মাফ করে দিবো। বারবার আমার চোখের সামনে চাইবো। উনাকে প্রতিদিন একবার হলেও ছুঁতে চাইবো।উনি আমার জীবন বাঁচাতে নিজেকে এমনকি এই দুনিয়াকে ত্যাজ্য করেছেন। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে কীভাবে থাকে সে? কীভাবে না ভালোবেসে পারা যায় এই লোকটাকে? "

বলতে বলতে অনন্যা আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো। কিন্তু এতো মানুষের মাঝে নিজের কান্না আসাতে পর মূহুর্তে লজ্জাও পেলো অনন্যা। হঠাৎ মনে হলো সে শুধুই ভুল করছে। কৌশিক নিজের জীবন দিয়ে তাকে বাঁচতে শিখিয়ে গেছে। শুধু শুধু সে পুরোটা সময়টা মন খারাপ করে কৌশিককে কষ্ট দিচ্ছে।
অনন্যা দ্রুত চা শেষ করে নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,
"এরকম রিং আপনাদের কাছ থেকেই নেওয়া হয়েছে। আমি আমার হাসবেন্ডের জন্য এটা নিতে চাই সম্ভব হবে কী?"

বয়স্ক লোকটা রিংটা দেখতে লাগলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হ্যাঁ কিন্তু সাইজ?"

"সাইজ আমি বর্ননা করতে পারবো‌। উনার ওই আঙুলের সাইজ আমি এখনো অনুভব করতে পারি।"

বাকিটুকু অনন্যা মনে মনেই বললো,
"আপনার হাতের ছোঁয়া আমার কাছে মধুর মতো, প্রিন্স। আপনাকে খুব মিস করছি। আপনি বলেছিলেন না আমি আপনার ফেভারিট লেডি? সত্যিই প্রমাণ করে দিলেন আপনি। আমার এই জীবন ধন্য শুধু আপনার ভালোবাসার জন্য।"

অনন্যাকে তারা বসালো। অনন্যা মনের সবটুকু মনোযোগ দিয়ে কৌশিকের আঙুলের সাইজ বর্ণনা করলো। দোকানদার জানালো তাকে কয়েকদিন সময় লাগবে। অনন্যা বললো সে অপেক্ষা করবে।

বেশ কিছুদিন পর,

সেমিস্টার ব্রেক চলছে। অনন্যা হাঁটতে বেরিয়েছে।নিজেকে একটু সামলানোর জন্য, একটু নিঃশ্বাস নেবার জন্য বেরিয়েছে সে। কতদিন ধরে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাভাবিক থাকতে, কিন্তু কিছু যন্ত্রণার ওজন এমনই হয় মুখে বললেই তা হালকা হয় না। মাঝে মাঝে এতটাই কষ্ট হয়, বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে ওঠে, মনে হয় আর ধরে রাখা যাবে না।

রিং রেডি হয়ে গেছে। কাল ফোন দিয়েছিলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ভাবনায় সে জুয়েলারি শপের দিকে পা বাড়ালো। নোহারা ব্যস্ত। আর অনন্যাও এখন আর ওকে টানতে চায় না। মেয়েটা তার জন্য অনেক কিছু সহ্য করেছে, অনেক রাতের ঘুম হারাম করেছে এইবার একটু নিরিবিলি থাকুক না।

শপে পৌঁছালে বয়স্ক দোকানদারটা ওকে বসালো। আবারো চা অফার করলো। অনন্যা জানালো অন্য দিন খাবে। এখানে এসেই তার মনটা একটু হলেও হালকা হয়েছে তাই প্রায় আসবে সে। বয়স্ক লোকটা তাই রিংটা এগিয়ে দিল। অনন্যা রিংটা দেখে খুব খুশি হলো‌। হাতে নিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো শুধু। মুখ তুলে একটু হেসে উঠল। প্রশান্তি ময় হাসি ছিল সেটা। টাকা আগেই দিয়ে রাখা। তাই প্যাকেট হাতে নিয়েই বেরিয়ে এল। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে সে এসে পড়ল সড়কে। পার্কে পৌঁছতে হলে আরো খানিকটা পথ পেরোতে হবে। কিন্তু রাস্তায় তখন প্রচণ্ড জ্যাম, গাড়ি আর রিকশার গুঞ্জন কানে বাজছে।

অনন্যা হাত দেখিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করছিল। আচমকা একটি মোটরসাইকেল এত জোরে ছুটে গেল ওর গা ঘেঁষে যে সে ভারসাম্য হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল রাস্তার মাঝখানে। চারপাশ দিয়ে গাড়ি আর রিকশা চলে যাচ্ছে, কেউ থামছে না। কেউ দেখেও দেখছে না।
মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় সেদিনের সেই ভয়াবহ এক্সিডেন্টের স্মৃতি আচমকাই ঝলসে উঠল চোখের পর্দায়। শরীর যেন আবার সেই ব্যথার ছোঁয়া অনুভব করল। প্রেসার হঠাৎ বেড়ে গেল। মাথা চক্কর দিতে শুরু করল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। অনন্যার হাতে ভর দিয়ে উঠার মতো শক্তিও নেই।

হঠাৎ মনে হলো আর কতটা বাঁচা বাকি আছে তার? বেঁচে থেকে লাভ কী? এই রাস্তায় ই তার প্রাণটা নিয়ে যাক না। অনন্যা ঢুলে পড়ে যেতে নিয়েছিল। কিন্তু কেউ একজন তার বাহু টেনে উঠে দাঁড় করালো। অনন্যার হাত ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে বসালো। দ্রুত পানির বোতল কিনে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো। অনন্যা কে পানি খাওয়ালো অতঃপর অনন্যা সুস্থ হলো। এতোক্ষণ অনন্যা তাকায়নি মানুষটির দিকে কিন্তু মুখ তুলে যখন চোখের সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখলো। মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসলো তার। 

অনন্যার মুখ চেপে ধরলো লোকটি। গম্ভীর মুখে বললো,
"শশশশ! চুপ! 
এভাবে রাস্তাঘাটে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন লোকে ভাববে আমি আপনার সাথে খারাপ কিছু করছি। "

অনন্যা সাথে সাথেই চিৎকার থামালো। পারলে সে অজ্ঞান ই হয়ে যেত। কিন্তু না অজ্ঞান হওয়া চলবে না। যদি আবারো হারিয়ে যায় এই মানুষটি তাহলে কী করে বাঁচবে অনন্যা? তাই যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখলো অনন্যা। চোখের সামনে লোকটিকে দেখে অনন্যার বিস্ময় আর থামলো না। কারণ যেই ব্যক্তির জন্য ওর জীবনটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই ব্যক্তি অনন্যার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে‌। অনন্যা শ্বাস নিতে পারছে না, বুক ধড়ফড় করছে। ইশশ! ভাগ্যিস সে নিজেকে শেষ করে ফেলেনি। ভাগ্যিস সে আজ বাসা থেকে বেরিয়ে ছিল। ভাগ্যিস সে এই সড়কে পা রেখেছিল ‌। ভাগ্যিস মোটরসাইকেলটা খুব জোরে ছুটে গিয়েছিলো।

অনন্যা দ্বিতীয় বার কিছু চিন্তা করলো না। লোকটা হাত সরাতেই অনন্যা উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
"ধন্যবাদ আবারো আসার জন্য! ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য, মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স!"
·
·
·
সমাপ্ত................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp