নিজেকে দেখে বিপন্নবোধ করে ও। কেমন গা শিরশিরে শীতল একটা ভয়। অকথিত উচ্ছ্বাস বুকের অতলে ঢেউ তোলে, আবার দেখা যায় গলার কাছে কুণ্ঠা ভাব। আধো অন্ধকারে বন বাংলোর ঘরটা স্তিমিত সূর্যের মতো হলদে আভা ছড়িয়েছে। হারিকেনের পলতে নামিয়ে রেখেছে ও। পোশাক বদলানোর সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই লজ্জাতুর মনের একটা অংশ নিজেকে প্রাণপণ গোপন করে। ফরসা আলোতেও নিজেকে প্রকাশ পেতে দেয় না ও। খোলাখুলি আব্রুহীন ঝলক নিজের কাছেও জড়তা এবং সংকোচের মতো। পলতে নামানো ক্ষীণ আলোকে ধাপে ধাপে গায়ের সিক্ত বসন পরিবর্তন করে শুকনো পোশাকে মুড়িয়ে নেয় ও। দক্ষহাতে ভাঁজ করে নেয় কুচি, আঙুলের খাপ থেকে গুঁজে নেয় জায়গামতো, বাঁ কাঁধের কাছে আঁচল টেনে শাড়িটা সুন্দর করেই পড়ল। যেভাবে রেবেকা নেওয়াজ ওকে হাতে ধরে ধরে প্রতিটি জিনিস শিখিয়েছেন। কখনো স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাড়ি পরার জন্য, কখনো পহেলা বৈশাখে একাকী কলেজ যাবার জন্য। অথচ, আনন্দের জায়গায় আঘাত পেত প্রতি মুহুর্তে। এমন তো নয় ও মিশতে পারে না, কথা বলতে জানে না, সম্পর্ক করতেও ইচ্ছুক না; সব পারা সত্ত্বেও মানুষের বাঁকা হাসি, ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি , ওকে আঙুল দিয়ে দেখানো, এগুলো তো ওর চোখ এড়াতো না। বোকা সেজে আর কতদিন এসব অগ্রাহ্য করা যেত? আর কতদিন অবুঝ থাকার অভিনয়ে বোকা থাকা সম্ভব? ওরা তো মিশতো না, মন থেকে সম্পর্ক করতো না, ওর অগোচরে ওর পরিবার নিয়ে হাজারটা কথা চলতো, কর্দয ভাবে হাসাহাসি হতো, এমন সব ভয়ংকর কথা বাতাসে রটিয়ে যেত, যা পরদিন ক্লাসে উপস্থিত হলে ওকে মর্মাহত করে দিত। পাথরের মতো স্তব্ধ করতো ওর সহজ মুখটা। দোষ শুধু এটুকুই, অশ্রুভেজা চোখ কাউকে দেখায়নি। কেউ জানেনি ওর স্বভাবটা হুটহাট ভেঙে পড়া ছিল না। এটা যে হতো নীরবে, সংগোপনে, কঠিনভাবে তা কেউ জানতো না। যখন বাড়ি ফিরে স্বাভাবিক মুখে রুমে ঢুকতো, ঘুমের বাহানায় দরজা আঁটকে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিত, তখন ওই আর্তনাদ ফাঁকা বাড়ির কোথাও পৌঁছুতো না। কানে কম শোনা জোহরা খালেকেরও না, কর্মস্থলে ব্যস্ত ভাবীর কাছেও না। ব্যাপারগুলো মনে পড়তেই ডানহাতে খুব সাবধানে অবাধ্য পানিটা মুছে নিল ও। হারিকেনের পলতেটা বাড়াতেই ঘর উজ্জ্বল করা আলোকে নিজেকে দেখল শাওলিন। বাসন্তি রঙা চমৎকার সুন্দর শাড়ি, লাল-খয়েরি বর্ণ অপরূপ সুন্দর পাড়, পাড়টা মোটা থাকায় অন্যরকম একটা সৌন্দর্য ফুটে আছে। ব্লাউজটা গাঢ় খয়েরি রঙের, দুটো হাত ঠিক কবজি পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। ভেজা চুলগুলো সমস্ত পিঠজুড়ে কোমরের কাছটায় থামা, মাথার ডানদিকে সিঁথি তুলে চুলগুলো সেভাবেই রাখা। নিজেকে ওর স্বাভাবিক, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি বলে মনে হল। অথচ, ও কী জানতো, ওর সবচেয়ে সাদামাটা রূপটাই বিপজ্জনক সুন্দর? ওর নির্মল স্বচ্ছতাই বুকের সর্বনেশে স্পন্দন বাড়িয়ে তোলা? আজ যদি রেবেকা এখানে থাকতেন, তবে নির্নিমেষ চোখে থমকে যেতেন তিনি। তিনিও বুঝতে পারতেন, এই সর্বনাশিনী জগতের সমস্ত কৃত্রিমতাকে বুড়ো আঙুল যেন দেখিয়ে দিচ্ছে। পড়নের ভেজা কাপড়গুলো ঘরের এককোণে আলনায় মেলে দেয় ও। বিছানা থেকে টোটব্যাগটা নিতেই মোবাইলে আচমকা শ্রেষ্ঠার কল পেল। কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন সুরে শ্রেষ্ঠা বলল,
- আছিস কোথায়? আমরা কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি? সেলিম বলল তুই নাকি ওদের গাড়িতে আসিসনি! আবার সেলিমও দেখছি ভ্যালি পৌঁছুত পারল না। কী হচ্ছেটা কী বল তো?
শাওলিন শান্তস্বরে বলল,
- কিছুই হচ্ছে না। তোমার বন্ধু সেলিমের গাড়িতে আসার কথা ছিল। তবে উনি দেখলাম জিদান ভাইকে আনার জন্য গাড়ি ব্যাক করালেন। পথে এসকোর্ট মিস হয়েছে। বতর্মানে ফরেস্ট লোকটার চেনাশোনা একটা রিজার্ভ বাংলোতে আছি। আবহাওয়া খারাপের জন্য বাইরে বেরুনো সম্ভব হচ্ছে না। নয়ত এই মুহুর্তে তুমি আমাকে সেই বাংলোয় খুঁজে পেতে।
শাওলিন ইচ্ছে করে এক্সিডেন্টের কথাটা গোপন করল। যদিও ওই এক্সিডেন্টে ওর কিছুই হয়নি, ও সম্পূর্ণ সুস্থ, সম্পূর্ণ ঝড় ওই মানুষটার উপর দিয়ে গিয়েছে, তবু ভয়ানক ব্যাপারটা নিয়ে বাইরে উচ্চারণ করল না। আরো বেশি ভয় পাবে ওরা। শ্রেষ্ঠা ওপাশ থেকে আবারও বলে উঠল। এবার কিছুটা যেন চাপা গলায়, সতর্ককণ্ঠে, উদগ্রীব সুরে,
- জানা, একটা কথা বলব। আশেপাশে কেউ থাকলে সরে আয়। পাহাড়ের চূড়োয় নেটওয়ার্ক পাওয়া মুশকিল, তবু আমি নাযীফের নাম্বার থেকে কলটা ইমার্জেন্সী দিয়েছি। জলদি কর।
এরপর আবারও থামল ও। ততক্ষণে শাওলিন এপ্রান্ত থেকে জানাল, ওর আশেপাশে কেউ নেই। যা বলার, ও যেন নির্ভীক চিত্তে বলতে পারে। কথাটা শোনা পর শ্রেষ্ঠা স্বল্প বিরতি নিয়ে একনাগাড়ে বলে উঠল,
- একটা ভয়ংকর আভাস পাচ্ছি। আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত, বৈসাবি মেলা থেকে কিছু একটা আমাদের ফলো করেছে। আমি যদিও বেশি একটা খেয়াল করিনি। আমার কাছে শক্ত কোনো প্রমাণও নেই। কিন্তু কিছু একটা ঠিক নেই জানা, কিছু একটা স্বাভাবিক এখানে নেই। তুই যেখানেই আছিস, সাবধানে থাকবি। একা একা কোথাও বের হবি না। বাংলোর যে ঘরটা নিবি, সেখানে নিশ্চিত করবি এক্সিট রুট বলতে কিছু আছে কিনা। কি বিপদে আমরা পড়েছি সেটা কিছুই অনুমেয় না, কিন্তু বিপদটা যে ঘাড়ের উপর ঝুলছে এটুকু নিশ্চিত। ওই খুন দুটো হবার পর পরিস্থিতি আরো সংকটপূর্ণ। আধঘণ্টা আগে এক ভাইয়ের সাথে কথা হল। উনি বললেন পার্বত্যাঞ্চলের খুন নিয়ে কোনো কভারেজই নেই। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে একটা নিউজ পর্যন্ত না। এতোটা ঠাণ্ডাভাব কী করে বজায় থাকে জানা? এটা কী অদ্ভুত বিষয় না? ধরে নিলাম, আমাদের মিডিয়া ঢাকামুখী। অন্যান্য জেলা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে দুটো অজ্ঞাত লোক খুন হল, তাদের জবাই করে হত্যা করা হল, কিন্তু দ্যাখ, এটা নিয়ে টু শব্দটা কোথাও উচ্চারণ হল না। এর চেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার আর কোথাও দেখেছিস? মনে হচ্ছে না ঘটনাগুলো কেউ ধামাচাপা দিচ্ছে?
শাওলিন কথাগুলো শোনার পর অনেক কিছু ভাবল। ওর কাছেও এটা মনে হয়েছে ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃত চাপা দেয়া হচ্ছে। কোনো এক দৈবশক্তিতে এখানকার কোনো তথ্য বাইরে প্রচার হতে পারছে না। ঠাণ্ডা মাথায় পয়েন্টগুলো ভেবে শাওলিন কিছুটা উদ্বেগের সুরে বলল,
- তোমার কী মনে হচ্ছে এখানে কিছু একটা অ্যাবনরমাল?
- প্যারানরমাল বললেও ভুল হবে না। তুই ভেবে দ্যাখ, এখানে আসার পর থেকে ভৌতিক ভাবে হামলাটা হল। যেন আমরা কারো বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি, কারো আরামের লোকমায় ভাগ বসিয়েছি। এটা তো আমাদের মতো স্টুডেন্টের জন্য সম্ভব না। আমরা এখানে কী করতে এসেছি? স্রেফ ঘুরতে! এখানে আমাদের স্বার্থ জড়াবে কীসে? হামলাটা যারা করছে, তারা পাহাড়ি সন্ত্রাসী বলেই করছে? নাকি কেউ ওদের বাজেভাবে উস্কে দিয়েছে? যার দরুন ওরা এখন মারমুখি হয়ে আমাদের উপর দফায় দফায় হামলা চালাতে তৎপর? এর কোনো সদ্যুত্তর নেই জানা। আমার বিচক্ষণতা বলে, এখানে কেউ অদৃশ্য কলকাঠি নাড়াচ্ছে। কেউ আছে রে এখানে।
- অদৃশ্য কলকাঠি? কী বলতে চাইছ?
কথাটা বলেই ভ্রুঁ কুঁচকায় শাওলিন। ওর নিজের এখন ভালো লাগছে না। ওরা কী অজান্তে কোথাও ভুলচুক করে বসল? শ্রেষ্ঠা ওর প্রশ্নে চিন্তার সুঁতো জড়িয়ে বলল,
- একটা ব্যাপার তুই খেয়াল করেছিস? ভদ্রলোক মানুষটা আমাদের জায়গা পরিবর্তন করাচ্ছে। একেকবার একেকদিকে ট্রান্সফার করছে। কিন্তু মোটিভ, ইন্সিডেন্স কিছুই তিনি খোলাশা করেননি। উনি চুপচাপ, ঠাণ্ডা। বাইরে থেকে তোকে, আমাকে, আমাদের সবাইকে উনার বাড়িতে শেলটার দিয়েছেন। অন্যদিকে দুজন ডানহাত-বাঁহাত সহকর্মীকে সবকিছু তদন্ত করার জন্য জায়গামতো পাঠিয়েও দিয়েছেন। আমি এই তথ্যটা গতরাতে পানি খেতে উঠে শুনতে পেয়েছি। আনুমানিক রাত সাড়ে তিনটার দিকে ওই ভদ্রলোক মানুষটা নিচতলার একটা ঘরে ছিলেন। ঘরটা মনেহয় প্রাইভেট অফিস-রুম। কাউকে বোধহয় ঢুকতেও দেন না। আমি যখন পানির বোতল ভরতে ডাইনিং টেবিলে এসেছিলাম, তখন সমস্ত বাংলো অন্ধকারে ঘুটঘুট করছে। কিন্তু নিচতলার ওই সাইডে একটামাত্রা ঘরে আলো জ্বলছিল। আমারও তখন কৌতুহল, মাঝরাতে কে ওই সময় লাইট ধরিয়ে আছে? আমি বোতল হাতেই ওদিকের পথে হাঁটা দেই। কিন্তু তার আগে একটা ব্যাপার বলে রাখি, উনি রাতে ঘুমান না। কখন ঘুমান ওটা আমিও জানি না। যে কদিন উনার বাংলোতে আমরা আছি, তুই তো জানিস আমরা নিচতলায় থাকি। আমাদের হৈচৈ হাসাহাসির জন্য নিচতলায় আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। আমি তখন লক্ষ করেছি উনি সবসময় রাতের অন্ধকারে কাজ করেন। ওই অফিস রুমটার কথা বললাম না? সেখানে উনি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে চুপচাপ কাজ করতেন। এটা আমাকে নাযীফ বলেছে। ও নিজেও একরাতে লক্ষ করেছে। তো, গতরাতে যখন অদম্য কৌতুহল থেকে ওদিকে গেলাম, তখন দেখলাম উনি ফোনে কাউকে বলছে, কিন্তু কী বলছে একটা বর্ণও বুঝতে পারলাম না। ওটা যে চাঁটগাইয়া ভাষা না এটা শিয়োর জানা। আমি অন্তত সোহার খাতিরে চাঁটগাইয়া ভাষার হণ্ডে হাইয়্যুন এসব কিছুটা বুঝি। কিন্তু উনি তো ইংরেজিও বলেছিলেন না। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটা ভাষা ছিল!
এবার শাওলিনের আশ্চর্য হবার পালা। ওর সঙ্গে যতবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, বাংলাটাই শুদ্ধ করে বলতে শুনেছে ও। সঙ্গে ইংরেজি টানটা দু একবার এসে গেলেও অন্য ভাষায় কথা বলেননি। তাহলে শ্রেষ্ঠা যে বলল অজ্ঞাত একটা ভাষা, এটা আবার কী জিনিস? প্রশ্নাতুর চোখদুটো দরজার দিকে বিদ্ধ করল। বাইরে থেকে বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। কিছু একটা কী হয়েছে? শাওলিন কী যেন আন্দাজ করে শ্রেষ্ঠাকে বলল,
- তোমাকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি শ্রেষ্ঠা। বাকি কথা নাহয় সামনাসামনি শুনব?
এরপর কলটা কেটে দিল। দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই ডানদিক থেকে শব্দটা পেল শাওলিন। ডানদিকে একটা ঘর, সেখান থেকে হারিকেনের নরম আলো তেরছা ভাবে মেঝের বুকে পড়েছে। মনে মনে ভাবছিল, একবার কী দেখে আসবে? ও ঘরে কী সমস্যা জেনে আসবে? ব্যাপারটা কী হল জানা বড্ড দরকার। কিছু একটা ওর কাছে ঠিক ঠিক লাগছিল না। এমন সময় ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এল কেয়ারটেকার। তিনি ওর ঘরের সামনে দিয়ে যেতে নিলে শাওলিন উদগ্রীব কণ্ঠে উঠল,
- চাচা? পাশের ঘরে কিছু হয়েছে? কেমন যেন একটা শব্দ শুনলাম?
চাচা সম্বোধন করা প্রবীণ লোকটা তাকাল। মুখে একটা পাণ্ডুবর্ণ ছাপ ফেলে বলল,
- আবারো রক্ত পরের। গরম পানি চাইয়্যিল, গরম পানি দি আইলাম। বাপর হাছে ঔষুধ নেই, যা আছিল এগিন দিয়েরে ন হমের। আইঁ ডাক্তর ডাইকত্তু চাইলাম। কিন্তু মানা গইজ্জি।
এটুকু বলেই গফুর কেয়ারটেকার চলে গেল। লোকটার চাঁটগাইয়া ভাষা বুঝতে কষ্ট হল কিছুটা। তবে বুঝে নেওয়ার মতো ঘটনাটা আঁচ করতে পেরেছে ও। উলটো ঘুরে নিজের ঘরে ঢুকে টোটব্যাগটা খুলে ফেলল শাওলিন। দ্রুত হাতাপিতা করে কটা জিনিস নিয়ে পাশের ঘরে ছুটে গেল। দরজায় দুবার ঠকঠক করে কিছু বলতে নিচ্ছিল, তার আগেই ঘুরে না তাকানো মানুষটা প্রত্যুত্তর করে বসল,
- ঔষুধি পাতার ঝামেলায় যাবেন না চাচা। ওসব এখন ছাড়ুন। মেহমানের জন্য চা-পানির ব্যবস্থা করুন। আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। ঘণ্টা দুয়েক সময় দিন। বের হব।
শাওলিন কথা শুনে বুঝল, মানুষটা চোখ বন্ধ করে আছে। একবারও আয়নায় চোখ তুলে দেখেনি। নয়ত বুঝতে পারত, দরজায় গফুর চাচা না, বরং শাওলিন। দুহাতের মুঠোয় স্যাভলন, তুলো, মলমের টিউব, ঔষুধের পাতা নিয়ে ঘরে ঢুকল ও, কণ্ঠে জেদি একটা ঝংকার তুলে বলল,
- মেহমানের জন্য একটু বেশিই ভাবছেন আপনি। আমিই একমাত্র সুস্থ আছি, ঠিক আছি। আপনি নন। শোধ-বোধের হিসেব মেলাতে দিন। দেখি আমার পক্ষে কতটুকু সম্ভব। বিগত দুদিন আপনি শুশ্রূষা করেছেন, যেখানে এখন আপনার শরীরে. .
কথাটা বলতে গিয়ে চোখ পড়ল মেঝেতে। ভেজা, রক্ত মাখা, হালকা ধূলো জড়ানো সবুজ শার্টটা বাতাসের জন্যে নিচে পড়ে গেছে। ঘরের একমাত্র খোলা জানালাটা দিয়ে শোঁ শোঁ বাতাস ঢুকে এক পশমা বৃষ্টির ছাঁট প্রবেশ করাচ্ছে। শাওলিন হাতের জিনিসগুলো এক জায়গায় রেখে জানালাটা বন্ধ করতে তড়িঘড়ি ছুটে গেল। এদিকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসা শোয়েব আস্তে আস্তে মাথা তুলল। এতোক্ষণ সে চোখ বুজে মাথা নত করে ছিল। গফুরের দেয়া গরম পানিতে রুমাল ভিজিয়ে ডান কাঁধে চাপ দিচ্ছে। রডের আঘাতে মাংসটা ফুলে উঠেছে, ভ্রুঁটা কেটে টনটন করছে অনেক। ঘরের ডানকোণে চোখ ফেলল শোয়েব, ঠিক তখনই দেখল এক অবরুদ্ধ বিমোহন। হারিকেনের আলোয় তার ঘরজুড়ে যেন উনিশ বসন্তের ঝড়। তার হৃদয় নিংড়ে তোলা সেই রমণীরত্নাকে অপলকে শুধু দেখল। কী হয়েছিল তার বুকের মাঝে; কী হয়েছিল তার দূর্গশিবিরে, কী ঘটেছিল তার রুক্ষ মনে, কিছুই সে তা জানে না। শুধু এটুকু জানে, আজকের এই নীরব ক্ষণ থেমে যাক! এমনভাবে থেমে যাক, যেন আম্মির বলা কথাগুলো সত্যি হয়ে ফুটুক।
শাওলিন জানালার কপাট বদ্ধ করে ফিরে এসেছিল। টিউব থেকে একফোঁটা মলম তর্জনীতে নিয়ে শোয়েবের কাছে ঝুঁকে এল। কাঁটা ভ্রুঁটার দিকে নজর বুলাতেই এমন ভঙ্গি করল, যেন ব্যথাটা ও-ই টের পাচ্ছে। 'ইশ, ভ্রুঁয়ের উপর কাঁটাটা কখনো মিটবে? গর্ত হয়ে কাটলে আর কী মিশে?' শাওলিন কথাগুলো মনে মনে ভাবলেও বাইরে সেগুলো প্রকাশ করল না। চুপচাপ তর্জনীটা ক্ষতর উপর বুলিয়ে দিচ্ছে ও। আঙুলটা যতবার কাঁটাটার উপর ঘুরাচ্ছিল, ততবারই ওর চোখ যাচ্ছিল নীল তারাদুটোতে। মুখ ফুটে অস্ফুটে প্রশ্ন করতে মন চাচ্ছিল,
- যন্ত্রণা হচ্ছে? ভ্রুঁয়ের জায়গাটা কম গভীর হয়নি। ঘা শুকোতে, ব্যথা কমতে লম্বা সময় লাগবে। তার উপর এই দাগ মনেহয় না কোনোদিন মিটবে।
শাওলিন কিছুই বলল না। চুপচাপ নিজের কাজে মনোযোগী রইল। ওর গভীর সুন্দর চোখদুটোতে চেয়ে শোয়েবের জবাবটা দিতে ইচ্ছে করছিল। বলতে মন চাইছিল,
- ব্যথা হচ্ছে না আমার। এসব আমার জন্য ব্যথার সংজ্ঞা না। ভ্রুঁয়ের ব্যথার চেয়ে তিনগুণ ব্যথা আমি সয়ে এসেছি। এগুলো আমার দেহে দাগ কেটে দিলেও কোনো সমস্যা না।
দুপ্রান্তের দুটো বিচিত্র মানুষ কথাগুলো বলল ঠিকই, অথচ কেউ কারো কাছে ব্যক্ত করল না। পনের মিনিট নীরবে নির্ভীক রূপে কাজ সমাপন করল শাওলিন। কিন্তু বাড়তি আর একটা কথাও তুলল না। পুরোটা সময় শোধ-বোধের এক হাস্যকর সেবাযত্নে স্বভাবসিদ্ধ গুমোট রইল শোয়েব। আড় ভেঙে সেও কোনো বাক্যালাপ উঠাল না। শাওলিন যখন পা বাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন পেছন থেকে গলা খাকারি দিল শোয়েব। অর্থটা ছিল, থামো! শাওলিন ওই অদৃশ্য ইশারা কীভাবে ধরতে পারল, ও নিজেও জানল না। শুধু মাথা পিছু ঘুরিয়ে শোয়েবের শান্তমূর্তির দিকে চাইল। শোয়েব সারা দেহে মলম মাখা অবস্থায় কিছুটা ধীরাজ কণ্ঠে বলল,
- যদি প্রবলেম না হয়, কফি পান করবে?
একটু অবাক হয় শাওলিন। বন কর্মকর্তার সহজাত ব্যবহার দেখে বিস্মিতও হয়। এতোদিন আসল বাংলোয় পাশাপাশি ছিল, দোতলায় দুজনই থাকতো, তবু তো একবেলার জন্য এরকম ব্যাপারটা ঘটেনি? তবে এখন কেন? শোয়েব ওর নিরুত্তর চেহারা পড়তে পেরে সামান্য কথা ভেঙে বলল,
- আমি তোমার গল্পগুলো শুনব। কেন জানি না, তোমার গল্পগুলোতে আগ্রহ টের পাচ্ছি। শোনার এক তীব্র বাসনায় আমি মশগুল। নিশ্চয়ই কফির সঙ্গে ঝুমবৃষ্টির দিনে গল্পগুলো জমবে। এমন দিনে সব বলা যায়। তো, আমাকে শোনাবে শাওলিন আলম? বনের লোক আমি। পশু-পাখির আচরণ যেভাবে বুঝতে পারি, মানুষের নীরবতা বোঝাটাও আমার পছন্দ। আশাকরি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। দশ মিনিট পর ব্যালকেনিতে দেখা করব।
কথাগুলো এমন ভঙ্গিতে বলল, যা শাওলিনের কাছে অনুরোধ মনে হল না। বরং মনে হল ওগুলো ঠাণ্ডা গলায় চাপা হুঙ্কার। হয় পালন করো, নয় পালনের জন্য মনকেই বুঝাও। শাওলিন কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। হঠাৎ শাওলিনের মনে হল, উনি যে ওর গল্প শুনতে চাচ্ছেন, এর সঙ্গে কী হামলাগুলোর যোগসূত্র আছে? কোনোভাবে কী কিছু জড়িত? সন্দেহজনক!
—————
কলেজে দুটো ক্লাস সমাপন করে বাড়ি ফিরছেন রেবেকা। সিলেটের মৌলভীবাজার শহরে বসবাস করেন তিনি। উনার পৈতৃক নিবাস শ্রীমঙ্গলের কাছে। চা বাগানে একসময় বেড়ে উঠেছেন তিনি। আকাশের দিকে মুখ তুলে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলেন রেবেকা। আকাশ মেঘ করেছে। কিন্তু বৃষ্টি কী আজ হবে? দেশের একপ্রান্তে বৃষ্টি হলে অন্যপ্রান্তে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর থাকে। একদিকে তুফান, বন্যা, সাইক্লোন ধেয়ে এলে অন্যপ্রান্তে ক্ষতিহীন অবস্থা থাকে। বুক ভর্তি করে হতোদ্যম শ্বাস ছাড়লেন রেবেকা। চোখে কালো রঙের মোটা ফ্রেমযুক্ত চশমা। চশমার কাঁচ আয়তাকার। নাকের উপর চশমার দাগ বসে গেছে। তবু দূরের জিনিসকে কাছে দেখার জন্যে চশমাহীন থাকেন না। বাড়ির চৌকাঠে পৌঁছে চাবি দিয়ে তালামুক্ত করলেন। এখানে তিনি একাই বলতে গেলে থাকেন। আশেপাশে সরকারি কোয়াটার হিসেবে অন্যান্য শিক্ষকরা পরিবার-সহ বসবাস করে। কিন্তু রেবেকার জীবনে এক ননদ ব্যতীত আর কেউই নেই। মেয়েটা যে চট্টগ্রাম ঘুরতে সেই যে বেরুল, আজ প্রায় পঞ্চমদিন। অথচ, যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ওখানে থাকবে তিন থেকে চারদিন। এবার বাড়ি এলে আচ্ছা করে ধমক লাগাতে হবে। যদিও ধমকের 'ধ' পর্যন্ত তিনি বলার আগেই মেয়েটার উপর থেকে রাগ নেমে যায়। ঘুরতে গিয়েছে, থাক। জীবনে আর কত-ই বা ঘুরেছে? কে-ই বা নিয়ে গেছে? ছোট্ট গণ্ডির ভেতর বড় হতে হতে আজ উনিশে পা পড়ল। অথচ, ওকে নিয়ে যে কী বিরাট দুশ্চিন্তা! বয়স যেন বাড়ছে না, বরং বয়সকে টেক্কা দিয়ে চারপাশের মানুষকেই যেন ওর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। কাঁধ থেকে হ্যাণ্ডব্যাগটা নামিয়ে সোফায় বসলেন তিনি। এমন সময় মনে হল ফোনটা ভাইব্রেশনে ভুম ভুম করছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই দেখলেন একটা ম্যাসেজ। অদেখা করে ফোনটা রাখতে যাচ্ছিলেন তিনি, হঠাৎ স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়ল উনার। একটা আননোন নাম্বার থেকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ লেখা। সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে এরকম কিছু ফুটে আছে —
Assalamu Alaikum.
This is Shoyeb Farshad,
D.F.O., Chittagong Hill Tracts.
I would like to meet you in person to discuss an important matter respectfully. I would be grateful if you could kindly allow a meeting at your convenience.
·
·
·
চলবে........................................................................