যথাসময়ে মহাসমারোহে বিবাহ সম্পন্ন হলো লগ্ন-ইফতির। লগ্ন খানিক দুশ্চিন্তায় ছিল, বিদায়ের সময় যদি কাঁদতে না পারে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? দুশ্চিন্তারও যথেষ্ট কারণ আছে। কান্নার কোনো সম্ভাবনা তো দেখা যাচ্ছেই না, উলটো আনন্দ হচ্ছে। কথায় কথায় সে কেবল হাসছে। ভীড়ের ভেতর থেকে মুরব্বি ধরণের এক ভদ্রমহিলা তো বলেই ফেললেন, ‘ওমা বিয়ের কনের এত হাসি কীসের? বলছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। তলে তলে দেখো গিয়ে প্রেমের বিয়ে।’
কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটল অন্যরকম। বিদায়ের সময় কোত্থেকে এত মন খারাপ ভর করল লগ্নর ওপর। বাবা-মায়ের দিকে তাকাতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
বিদায় পর্ব শেষে যখন গাড়ি ছাড়ল লগ্ন তখনো কাঁদছে। ইফতি এক পর্যায়ে বলল, ‘তুমি চাইলে আমরা কালও যেতে পারি।’
লগ্ন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ইফতি বলল, ‘না মানে যেভাবে কাঁদছো, খারাপ লাগছে। তাই ভাবলাম একটা অপশন দিই।’
এ কথায় লগ্ন হেসে দিলো। এরপর ধীরে ধীরে খারাপ লাগা কিছুটা কমে গেল। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঠাকুরগাঁও যেতে যেতেই মন খারাপ অনুভূতিটা ভালোলাগায় রূপান্তরিত হলো। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। একটু ভয়, একটু উৎকণ্ঠা আর অনেকখানি ভালোলাগা, সব মিলিয়ে বারবার শিহরিত হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। সেই রাতেও ইফতিদের বাড়িতে নতুন বউ দেখার ঢল নামল। ভারী কাপড়চোপড় পরে থাকতে লগ্নর একটু কষ্ট হচ্ছিল। তবুও কাপড় বদলালো না সে, নতুন বউয়ের তো নতুন বউয়ের মতোই থাকা চাই।
রাত বাড়লে ভিড় কিছুটা কমে এলো। ঘর একেবারে খালি হয়ে গেলে ইফতি এসে বলল, ‘আমার বউ আমিই ভাগে পাচ্ছি না। কী আজব সোসাইটি!’
লগ্ন মুখ টিপে হাসল। ঠিক তখনই আবার ইফতির বাবার গলা পাওয়া গেল। তিনি ইফতিকে ডাকছেন।
ইফতি বিরক্তমুখে ঘর থেকে বের হবে তখন লগ্ন বলল, ‘শোনো।’
ইফতি দাঁড়াল। পেছন ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই লগ্ন বলল, তোমার কি নতুন বউয়ের সাজপোশাক নিয়ে কোনো ফ্যান্টাসি আছে?’
ইফতি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মানে?’
‘না মানে… থাকলে অপেক্ষা করব। না থাকলে গোসল করে বাসার জামা পরব।’
এবার লগ্নর কথার অর্থ বুঝতে পারল ইফতি। অবাক হয়ে কাছে এসে বসল। তারপর বলল, ‘তুমি ভাই দুষ্টু আছ। দেখলে বোঝা যায় না।’
লগ্ন চোখ নামিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘যাও তো, বাবা ডাকছেন।’
‘হুম। আচ্ছা আমার ওরকম কোনো ফ্যান্টাসি নেই। তোমার স্বাচ্ছন্দ্যই সবচেয়ে বড় কথা। নিশ্চিন্তে গোসলে যেতে পারো।’
ইফতি দরজার কাছে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘরে একটা টিকর্ণার আছে তার। সেখানকার ইলেকট্রিক কেটলিটা দেখিয়ে বলল, ‘কেটলিতে পানি গরম করে নিয়ো। এই শীতের রাতে ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে নির্ঘাত ঠান্ডা লাগবে।’
লগ্ন অনেক সময় নিয়ে কুসুম গরম পানিতে আরাম করে গোসল করল। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। গোসল করে বেরিয়ে দেখে ইফতি এরমধ্যেই জামাকাপড় পালটে ফেলেছে। ঘরে পরার সাধারণ ট্রাউজার আর টিশার্টে তাকে আরো বেশি সুন্দর আর নিজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। সোফায় আধশোয়া দেখে লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘ক্লান্ত লাগছে?’
‘তেমন না। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
ইফতি উঠে বসল। লগ্ন চুল শুকাতে শুকাতে বলল, ‘আমার কেবল আফসোস হচ্ছে।’
‘কেন?’
‘এইযে কদিন পরই তুমি চলে যাচ্ছ।’
ইফতি হেসে বলল, ‘এসব ভাবলে খারাপ লাগবেই। তাই এসব ভেবে বর্তমানটা নষ্ট কোরো না। যে কদিন আছি একদম মন খারাপ করা যাবে না।’
লগ্ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চুল শুকানো হয়ে গেলে চুলগুলো আঁচড়ে নিচ্ছিল।
তখনই ঘরের দরজায় টোকা দিলেন শাশুড়ি। ইফতি দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘লগ্নর হলো?’
ইফতি কিছু বলার আগেই লগ্ন বলল, ‘জি মা, হয়ে গেছে।’
শাশুড়ি বললেন, ‘খেতে এসো মা। রাত বারোটা বেজে গেছে। এত মানুষজন এলো, এদের বিদেয় করে সব রেডি করতে করতে দেরি হয়ে গেল।’
লগ্ন হেসে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই মা।’
—————
খাওয়াদাওয়া শেষ করে টুকটাক গল্পগুজব করতে করতেই রাত একটা বেজে গেল। তারপর সবাই যার যার ঘরে গেলে লগ্ন ইফতি তাদের ঘরে এলো। লগ্ন এবাড়িতে এসেই বিছানাটা ফুল দিয়ে সাজানো দেখেছে। কিন্তু তখন স্বাভাবিক লাগলেও এখন লজ্জা লাগছে। কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। ইফতিই সব সহজ করে দিলো।
বলল, ‘বিছানাটার করেছে কী!’
তারপর সে একটা শলার ঝাড়ু বের করে বিছানার ওপর থেকে ফুলের পাপড়িগুলো ঝেড়ে ফেলল।
বিছানা ঝেড়ে কাছে এসে লগ্নর হাত ধরে বলল, ‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটা বিয়েতে মেয়েদের কত ধকল যায় এটুকু বুঝি। সেই হিসেবে ছেলেদের তো কোনো কষ্টই নেই। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো। বাসররাত নিয়েও আমার তেমন কোনো ফ্যান্টাসি নেই। ভালোবাসতে জানলে সব রাতই বাসররাত। বউ তো আমারই, অত তাড়া নেই।’
এ কথা শুনে এই মুহূর্তে লগ্নর খুব ইচ্ছে করছে ইফতিকে জড়িয়ে ধরতে। স্ত্রীরা আগে জড়িয়ে ধরলে কি স্বামীরা কিছু মনে করে? এসব মনে করাকরির যুগ কি আছে আর? নাকি এসব বিষয়ে এখনো পুরুষেরাই এগিয়ে থাকতে পছন্দ করে?
লগ্নকে চুপ করে থাকতে দেখে ইফতি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছ এত বলো তো?’
লগ্ন হেসে বলল, ‘কিছু না।’
তারপর বিছানায় গেল। তার সত্যিই খুব ঘুম পাচ্ছে। ইফতিও শুয়ে পড়ল। একসময় লগ্ন পাশ থেকে বলল, ‘জানো ইফতি, তোমাকে না আমার খুব আপন আপন লাগে?’
ঘুমে গলা জড়িয়ে যাচ্ছে লগ্নর। ইফতির মায়া হলো। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কতটা আপন লাগে?’
লগ্ন ইফতির বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এতটা।’
ইফতিও লগ্নকে জড়িয়ে ধরল। ওই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা। ইফতি তাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল। তবে সহজে ঘুম এলো না তার।
লগ্নর যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে বেলা বারোটা। নতুন বউ এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে, লোকে কী ভাববে! লজ্জায় মাথা কাটা যাবে আজ তার। তড়িঘড়ি করে উঠে বেরিয়ে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। সব ঘর ফাঁকা বিয়েবাড়ি ভর্তি এত মানুষজন ছিল অথচ এখন পুরো বাড়ি ফাঁকা! অদ্ভুত লাগল তার। তার সঙ্গে দাদি আর দুজন চাচাতো ভাই এসেছে। তাদের যে ঘরে ঘুমোতে দেওয়া হয়েছে সেখানে গিয়ে দেখে তারা সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে।
এবার ঘরে গিয়ে ফোন খুঁজে ইফতিকে ফোন করতে গিয়ে দেখে লাবণ্য ও বাবা অনেকবার ফোন করেছে। কী আশ্চর্য! কী ঘুম ঘুমিয়েছে যে এতগুলো কল সে টের পেল না? ভাবল, বাবাকে নাহয় একটু পর কলব্যাক করবে। তার আগে ইফতিকে কল করা দরকার। কল করে দেখে ইফতির ফোন বন্ধ। হলোটা কী? মাথা কাজ করছে না! তখনই চোখ পড়ল তার ফোনের নিচে একটা কাগজ চাপা দেওয়া ছিল। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
Sorry,
-Iftekhar
·
·
·
চলবে..........................................................................