লগ্নজিতা - পর্ব ০৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          বিয়ের তিন-চার দিন আগে থেকেই লগ্নদের বাড়ি লোকসমাগমে ভরে উঠল। দূরের আত্মীয়স্বজনেরা সব আসতে শুরু করেছে। এ যেন শুধু বিয়ে নয়, বিরাট এক উৎসব!

লাবণ্য এক অনলাইন পেজ থেকে অর্গানিক মেহেদি এনেছে। এই মেহেদির রং নাকি অসম্ভব গাঢ় এবং এক মাস স্থায়ী হবে। একারণেই রং হতেও দুদিন সময় লাগবে। তাই বিয়ের দুদিন আগেই মেহেদি উৎসবের আয়োজন করা হলো। রাজশাহী থেকে দুজন মেহেদি আর্টিস্ট এসেছে বাড়ির সব মেয়েদের হাতে মেহেদি লাগাতে। লগ্নর মেহেদি দেয়া প্রায় শেষ, তখনই ফোন এলো ইফতির। ইফতির নম্বর দেখেই সবাই খ্যাপাতে লাগল। লগ্ন একটু লজ্জা পেল, তবে সারাদিন সে যার ফোনের অপেক্ষায় থাকে তার ফোন না ধরে থাকবে কী করে? সেসবে তোয়াক্কা করল না, ফোন ধরল।

‘হ্যালো লগ্ন?’

‘বলো।’

‘একটু নিচে নামতে পারবে?’

চমকে উঠল লগ্ন। বলল, ‘তুমি কি দিনাজপুর এসেছ? বাসার সামনে?’

‘এলাম একটু।’

‘তাহলে উপরে আসছো না কেন?’

‘না না উপরে আসব না। তুমি নিচে এসো। তোমাদের বাসার পাশের নার্সারিটাতে আছি। আর…’

‘আর কী?’

ইফতি ইতস্তত করে বলল, প্লিজ কাউকে বোলো না যে আমি এসেছি।’

ইফতি লজ্জা পাচ্ছে তাই হাসি পেল লগ্নর। তবুও ভালো লাগল এই ভেবে যে, লজ্জা পেলেও দেখা করতে তো এসেছে!

বিয়ের কনের পক্ষে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া সম্ভব না। তাই লাবণ্যর সাহায্য নিল। লাবণ্য একটু হাসিতামাশা করলেও সুযোগ করে দিলো।

লগ্নদের বাসার সাথেই বিরাট এক নার্সারি। নানান গাছের সমাহার। লগ্নর বাবা সেখান থেকে গাছ সংগ্রহ করেই গড়েছে তার শখের বাগান। সেখানেই ঘুরঘুর করছিল ইফতি। লগ্নর চোখে চোখ পড়তেই হাসি বিনিময় হলো। লগ্ন কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার হঠাৎ দিনাজপুর আগমন?’

সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারল না ইফতি। সে মগ্ন হয়ে আছে লগ্নর সৌন্দর্যে। বহুরঙা একটা লেহেঙ্গা পরেছে, চুল খোলা, হাতভর্তি মেহেদি। এমন সাজে লগ্নকে এই প্রথম দেখছে ইফতি। চোখ ফেরানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।

ইফতি উত্তর না দেওয়ায় লগ্ন আবার প্রশ্ন করল, ‘কী হলো চুপ করে আছ যে?’

এবার ইফতি বলল, ‘এলে যে এক পরিকে দেখতে পাব এ কথা আগে জানলে আরো আগেই আসতাম। ছবি দিলে না কেন আমাকে?’

লগ্ন ভেংচি কেটে বলল, ‘হুহ! বুঝি বুঝি সবই নতুন বউ পটানোর ধান্দা।’ ইফতি হেসে বলল, ‘এখন আর পটানোর কী আছে? বিয়ে তো কনফার্ম। পটিয়েছি তো প্রথম দিন। যাতে বিয়েটা পাকাপাকি হয়ে যায়।’

‘ও তার মানে সেদিনের সব কথা ছিল পটানোর জন্য? মিথ্যে কথার জাল? লগ্নর গলায় নিপাট অভিমান। ইফতি হেসে বলল, ‘সব পটানিমূলক বাক্য মিথ্যে হওয়া জরুরি নয়। আর পটিয়েছি তো তোমাকে পাওয়ার জন্য এটা ভাবলে না?’

লগ্ন লাজুক হেসে বলল, ‘হয়েছে হয়েছে এবার বলো হঠাৎ এত রাতে দিনাজপুর কী ভেবে এলে?’

‘রাত কোথায় কেবল তো সন্ধ্যা। ঠাকুরগাঁও থেকে আসা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো, তাই চলে এলাম।’

লগ্ন এবার অভিমানী সুরে বলল, ‘ধুর তুমি অভ্যাস খারাপ করছ। নিজের এবং আমারও। কদিন পর তো চলে যাবে। তখন থাকব কেমন করে?’

ইফতি হেসে বলল, ‘মাত্র তো কয়েকটা মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’

‘যাবে না। এই কদিনে তুমি এত আপন হলে কেন? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, দূরের মানুষ দূরের হয়েই থাকতে। এখন কেমন লাভ ম্যারেজ লাভ ম্যারেজ মনে হচ্ছে।

‘লাভ হলে ক্ষতি কী?

‘লাভে কোনো লাভ নেই, সবটাই ক্ষতি।’

হো হো করে হেসে উঠলো ইফতি। তারপরেই চোখ পড়ল লগ্নর মেহেদি পরা হাতের দিকে। বলল, ‘কী ব্যাপার আমার জন্য মেহেদি পরলে আর আমাকেই দেখাচ্ছ না যে?’

লগ্ন মুচকি হেসে হাত দুটো মেলে ধরল। হাতভর্তি নকশার ঠিক মাজখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ইফতেখার’।

ইফতি দাঁতে জিভ কেটে বলল, ‘তুমি তো শেষ, প্রেমে একদম মজে গেছ।

প্রতিবাদ করল লগ্ন, ‘ইশ একদম না। এটা নিয়ম। বরের নাম লিখতে হয় তাই লিখেছি। কোনো প্রেমফ্রেম নেই এখানে।’

এবার ইফতি তার হাত মেলে ধরল। কোনো নকশা নেই, শুধু হাতের মাঝখানে মেহেদি দিয়ে লেখা ‘লগ্নজিতা’। দেখে হেসে দিল লগ্ন।

তারপর বলল, ‘এখন বোঝা যাচ্ছে আসলে কে মজেছে প্রেমে।’

ইফতি মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার স্বীকার করার সৎ সাহস আছে। প্রেমে মজেছি বলেই তো এতকিছু। এক পলক দেখার জন্য ঠাকুরগাঁও থেকে ছুটে আসা।’
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp